আমরা সকলেই সুস্থ সুন্দর জীবন যাপন করতে চাই। সবাই চাই যেন আমাদের শরীর সব সময় সুস্থ থাকে। শরীরে দুর্বলতা, অতিরিক্ত ক্লান্তি ভাব আমাদের কারোরই কাম্য নয়। শরীরের দুর্বলতা আমাদের দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন কাজে বাধা সৃষ্টি করে। আর যদি শরীর দুর্বল হলে কি করব না করব এ বিষয়ে ধারণা না থাকে তাহলে এটা আরো তীব্র হতে পারে।
শরীরে বিভিন্ন অংশে দুর্বলতার কারণে অনেকে শারীরিক এবং মানসিক অশান্তিতে ভোগেন। শরীর দুর্বল হলে শরীর ম্যাজ ম্যাজ করা, কাজে মন না বসা, শরীর অসার লাগা, শরীরের ক্লান্তি বোধ করা ইত্যাদি হতে পারে। কিন্তু ভয় নেই, শরীর দুর্বল হওয়ার আসল কারণ খুঁজে বের করতে পারলে এ থেকে মুক্তির অনেক সহজ উপায় আছে। তাহলে চলুন আজ আমরা জেনে নেই কিভাবে শরীরের দুর্বলতা দূর করব ও শরীর দুর্বল হলে করণীয় কি :
শরীর দুর্বল হওয়ার কারণ
আমাদের সর্বপ্রথম জানতে হবে কি কারনে শরীর দুর্বল হয়। শরীর দুর্বল হওয়ার পেছনে অনেক কারণ থাকতে পারে। আমাদের দেশের ভৌগোলিক অবস্থানের দরুণ আমাদের দেশের মানুষের শরীর যেসব কারণে দুর্বল হয়ে থাকে সেগুলো হচ্ছে:
সঠিক ভিটামিনের অভাব, রক্তস্বল্পতা, ক্রনিক কিডনি রোগ, ক্রনিক পাতলা পায়খানা, ডায়বেটিস, ক্রনিক লিভার রোগ, থাইরয়েড রোগ, ক্যান্সার, হার্ট ফেলিওর, ডায়াবেটিস ইত্যাদি।
শরীর দুর্বল হলে কি করা উচিত
শরীর দুর্বল বোধ করলে সর্বপ্রথম আপনাকে জানতে হবে কি কারনে শরীর দুর্বল হচ্ছে। আপনি নিজে যদি না বোঝেন তাহলে এক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের শরণাপন্ন হওয়া উচিত। ডাক্তার সম্পূর্ণ পরীক্ষা নিরীক্ষার পর আপনাকে সঠিক পরামর্শ দিতে পারবে। আর যদি আপনার শরীর দুর্বল হওয়ার কারণ বের করতে পারেন তাহলে সেই অনুযায়ী আপনার নিজেকেই পদক্ষেপ নিতে হবে। তাহলেই আপনি শরীরের দুর্বলতা থেকে মুক্তি পাবেন।
শরীর দুর্বল হলে কি খাওয়া উচিত:
আমাদের খাদ্যাভ্যাসের সাথে শারীরিক সুস্থতার রয়েছে নিবির সম্পর্ক। শরীরকে সব সময় সুস্থ সবল রাখতে হলে খাবারের বিকল্প আর কিছু নেই। সেজন্য আমাদের প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় স্বাস্থ্যকর খাবার রাখা প্রয়োজন। তাহলে চলুন দেখে নেই শরীর দুর্বল হলে কি খাওয়া উচিত:
শরীর দুর্বল হলে ভিটামিন সমৃদ্ধ খাবার, দুধ, ডিম, শাকসবজি, গরুর মাংস, কলা, মধু, ভিটামিন সি, চকলেট, গরু-ছাগলের কলিজা ও বিভিন্ন দেশীয় ফল খাওয়া উচিত।
শারীরিক দুর্বলতা দূর করার ভিটামিন
আজকাল অনেক মানুষকে দেখা যায় শরীরে একটু দুর্বলতা দেখা দিলেই ভিটামিনের উপর নির্ভরশীল হয়ে যায়। ডাক্তারের কাছে গিয়ে তারা ভিটামিন চায়। কিন্তু শরীরে ভিটামিনের যেমন দরকার আছে তেমন অতিরিক্ত ভিটামিন শরীরের ক্ষতিও করতে পারে। শরীর দুর্বল হলেই যে ভিটামিন খেতে হবে এর কোন মানে নেই। সাধারণত কোটার ভিটামিন দীর্ঘদিন খেলে শরীরের ক্ষতি হয়।
তাই সুস্থ সবল থাকার জন্য চাই সুষম খাদ্যাভাস। তাই নিয়মিত সুষম খাদ্যাভ্যাস গড়ে তোলা ভিটামিনের চেয়ে বেশি জরুরি। পুষ্টিকর খাবার, সুষম খাবার ইত্যাদি খাদ্য তালিকায় নিশ্চিত করতে পারলেই ভিটামিন বা এই জাতীয় ঔষধ খাওয়ার কোন প্রয়োজন পড়ে না।
জ্বরে শরীর দুর্বল হলে করণীয়
জ্বর হলে এমনিতেই শরীর দুর্বল হয়ে যায়। জ্বরের সময় প্রচুর তরল খাবার গ্রহণ করা উচিত। জ্বর হলে প্রতিদিন বেশি বেশি তরল জাতীয় খাবার খেতে হবে। বিশেষ করে ডাবের পানি, এটা শারীরিক দুর্বলতা কাটাতে খুব ভালো কাজ করে।
জ্বর হলে কলা, বাদাম, আঙ্গুর জাতীয় ফল খাওয়ার চেষ্টা করুন। এই জাতীয় ফল খুব তাড়াতাড়ি দুর্বলতা কাটাতে সাহায্য করে এবং প্রতিদিন সকালে সূর্যের আলোতে যাওয়ার চেষ্টা করুন। এতে আপনার শরীরে ভিটামিন ডি পৌঁছাবে, যা আপনার হাড়কে শক্তিশালী ও মজবুত করার পাশাপাশি শরীর দুর্বলতা কাটাতে সাহায্য করবে এবং পর্যাপ্ত ঘুমানোর চেষ্টা করুন। প্রতিদিন কমপক্ষে ৭ থেকে ৮ ঘন্টা ঘুমান। পর্যাপ্ত ঘুম হলে দেহে এবং মস্তিষ্কে কোষ নতুন করে শক্তি যোগায়।
শরীর দুর্বলতার লক্ষণ
শরীর দুর্বল হলে সাধারণত শরীর ম্যাজ ম্যাজ করে, ভালো লাগে না, কাজে মন বসে না, শরীর অসার লাগে, অনেক ক্লান্তি বোধ করে, বেশি বেশি ঘুম আসে, ঘুম থেকে উঠতে মন চায় না ইত্যাদি ।
গর্ভাবস্থায় শরীর দুর্বল হলে করনীয়
প্রায় সব নারী গর্ভাবস্থায় শরীরিক দুর্বলতায় ভোগে। গর্ভাবস্থায় যদি নারী ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া না করে তাহলে নিজে তো দুর্বল হয়ে যায় সেই সাথে সন্তানও দুর্বল হয়ে পড়ে। তাই গর্ভাবস্থায় দুর্বলতা কাটাতে সঠিক খাবার খাওয়া জরুরী। গর্ভাবস্থায় খেতে পারেন এমন কিছু খাবার হল:
গর্ভাবস্থায় বেশি বেশি আয়রন সমৃদ্ধ খাবার খান, যেমন- পেয়ারা, কচু শাক, কাচ কলা, মটর ডাল, কলিজা, মাংস শিম, বাঁধাকপি, মধু, খোলসহ মাছ; যেমন চিংড়ি ইত্যাদি।
সহবাসের পর শরীর দুর্বল হলে করণীয়
শরীর দুর্বল হলে এনার্জি সমৃদ্ধ খাবার শরীরে শক্তি ফিরিয়ে দেবে। তাই শরীরে দুর্বলতা অনুভব করলে এনার্জি সমৃদ্ধ খাবার খান। যেমন- খেজুর, বাদাম, মিষ্টি জাতীয় খাবার ইত্যাদি। এসব খাবার শারীরিক দুর্বলতা কাটিয়ে তুলতে পারে।
প্রতিদিন কমপক্ষে সাত থেকে আট ঘণ্টা ঘুমানোর চেষ্টা করুন। ঘুম কম হলে মাথা ঘুরানো ও শরীর দুর্বলতার পরিমাণ বেড়ে যায়। তাই পর্যাপ্ত ঘুম দূর করতে পারবে এই দুর্বলতা। ব্যায়াম, মেডিটেশন, ইয়োগা ইত্যাদি শারীরিক দুর্বলতা দূর করতে পারে। এছাড়াও শরীর ফিট রাখার পাশাপাশি আপনার মেটাবলিজম ভিত্তিতে সহায়তা করবে। তাই নিয়মিত ব্যায়াম করার চেষ্টা করুন।
শরীর দুর্বল দূর করার উপায়:
১) নিয়মিত খাবার খাওয়া: আমাদের শরীর ঠিকমত কাজ করার জন্য খাবারের সবচাইতে বেশি প্রয়োজন। ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া না করলে শরীরের শক্তি কমতে থাকে, যার ফলে শরীর অনেকটা দুর্বল ও নিস্তেজ হয়ে পড়ে। এছাড়াও খাবার দাবার ঠিকমতো না খাওয়ার কারণে মেজাজ অনেকটা নিম্ন স্তরের দিকে সর্পিল হয়। অপরদিকে সঠিক খাদ্যাভাসের ফলে জ্ঞানীয় কার্যকারীদের উন্নতি হয়। তাই নিয়মিত খাবার গ্রহণ করুন। নিয়মিত খাবার গ্রহণ না করাই শরীর দুর্বলের প্রধান কারণ।
২) পাওয়ার ন্যাপ নেওয়া: পাওয়ার ন্যাপ হল এক ধরনের ঘুম, যা দিনের বেলায় ঘটে। এটা সাধারণত দুপুর ১টা থেকে বিকাল ৪টার মধ্যে হয়ে থাকে, যা ১০ থেকে ৩০ মিনিট মধ্যে স্থায়ী হয়। আপনার যদি ঘুমের জরতা বেশি হয় সে ক্ষেত্রে বেশি সময় লাগতে পারে। এর প্রধান সুবিধা হচ্ছে আপনাকে সতেজ বোধ করতে সাহায্য করে। এর কারনে আপনি দিনের বাকি সময় আরো জাগ্রত বোধ করবেন। আপনি যখন পাওয়ার ল্যাব ন্যাপ করবেন এটি আপনাকে শক্তি যোগাবে এবং পরবর্তী চার থেকে পাঁচ ঘন্টার জন্য আপনাকে আরো সতেজ রাখবে।
৩) চকলেট খেতে পারেন: চকলেটে থাকা ক্যাফেইন নামক উপাদান খুব সহজে আপনার শরীর দুর্বলতা দূর করতে সাহায্য করতে পারে। তাই যদি কখনো আপনার কাজ করতে করতে ক্লান্তি বোধ হয় কিংবা শরীর দুর্বল মনে হয় তখন দুই পিস চকলেট খেয়ে নিতে পারেন। তাছাড়া চকলেটে আছে কোকো নামক উপাদান, যা জ্ঞানবৃদ্ধি ও দক্ষতা বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে।
৪) নিয়মিত কার্বোহাইড্রেট গ্রহণ: ভাবছেন শরীর দুর্বল হলে কি খাবেন। কার্বোহাইড্রেট সবচাইতে ভালো খাবার শরীরের দুর্বলতা ও ক্লান্তি দূর করার জন্য। কারণ কার্বোহাইড্রেট প্রচুর পরিমাণে গ্লুকোজ সরবরাহ করে, যা মস্তিষ্কের জন্য খাদ্য হিসেবে কাজ করে। জটিল কার্বোহাইড্রেট যুক্ত খাবার খেলে শরীর আরো বেশি শক্তি পায় ও ক্লান্তি ভাব দূর হয়ে যায়। অপরদিকে কম কার্বোহাইড্রেট ডায়েটকারীরা যারা কার্বোহাইড্রেট কম খায় তাদের মেজাজ সব সময় চড়াও থাকে ও বেশি ভুলে যাওয়ার সমস্যা হয়।
৫) কফি পান করুন: এক কাপ কফি তাৎক্ষণিকভাবে আপনার শরীরকে চাঙ্গা করে তুলতে পারে। হঠাৎ শরীর দুর্বল হলেই আপনি এক কাপ কফি খেয়ে নিতে পারেন। যেমন আপনি কোন কাজ করার ক্ষেত্রে অলস বা ক্লান্তি বোধ করলে তখন এক কাপ কফি আপনাকে উৎসাহিত করতে পারে।
৬)চিনি মুক্ত কোমল পানীয় বেছে নিন: চিনিযুক্ত এনার্জি ড্রিংক আমাদের ১ ঘন্টা পরেই বিপর্যস্ত করে ফেলতে পারে। ক্যাফিনমুক্ত চিনি যুক্ত পানি ক্রাশের কারণ হতে পারে। তাই সব সময় চেষ্টা করবেন শরীরের ক্লান্তি ভাব দূর করার জন্য চিনি মুক্ত পানি পান করা।
৭) প্রাণ খুলে হাসুন: হাসলে শক্তির মাত্রা বৃদ্ধি পায় ও স্ট্রেস-বাস্টার থেকেও রক্ষা পাওয়া যায়। তাই চেষ্টা করুন প্রতিদিন অত্যন্ত ৩০ মিনিট প্রান খুলে হাসার। যা আপনাকে সারাদিনের এনার্জি পেতে সাহায্য করবে।
৮) পানি পান করা: নিয়মিত পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করুন। হালকা ডিয়ারড্রেশন ঘুমের কারণ হতে পারে, তাই শরীরের ক্লান্তি ভাব দেখলেই দুই গ্লাস পানি পান করুন। এছাড়াও সারাদিনে কিছু সময় পর পর পানি পান করুন।
৯) লেবুর ঘ্রাণ নিন: লেবুকে উত্তেজক ঘ্রাণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। নিয়মিত লেবুর ঘ্রাণ শুনলে মেজাজ ফুরফুরা হয়ে ওঠে ও শরীরের ক্লান্তি দূর হয়।
১০) বাদাম খান: বাদামে আছে উচ্চ পরিমাণে ম্যাগনেসিয়াম ও ফোলেট, যা শক্তি এবং কোষ উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয়। শরীরের পুষ্টির অভাবের কারণে ক্লান্ত বোধ হতে পারে। তাই শরীরের ক্লান্তিক দূর করার জন্য নিয়মিত বাদাম খান।
১১) আপনার মস্তিষ্ককে শিথিল করুন: সুস্থ সবল থাকতে হলে আপনার মস্তিষ্ককে সব সময় শিথিল রাখার প্রয়োজন। এজন্য বন্ধুদের সাথে গেম খেলুন, আপনার সহকর্মীদের সাথে গল্প গুজব করুন, পরিবারের সাথে সময় কাটান, সময়সীমার আগে আপনার কাজ শেষ করার চেষ্টা করুন এবং মুখে সবসময় হাসি রাখুন।
সবশেষে, শরীর দুর্বল হলে করণীয় কি তা জেনে ঘরোয়া উপায় বা চিকিৎসকের শরনাপন্ন হয়ে শরীরে সতেজতা ফিরিয়ে আনতে হবে। কারণ, শরীরের দুর্বলতা ও ক্লান্তি কেউই চাইনা। উপরোক্ত বিষয়গুলো মেনে চললে আপনি খুব সহজেই আপনার শরীর সতেজ ও সবল রাখতে পারবেন এবং শরীরে দুর্বলতা ও ক্লান্তি কোনোভাবেই যদি দূর না হয় তাহলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করবেন।
Leave a Reply