মারুফ ইমনের ধারাবাহিক উপন্যাস যখন থামবে কোলাহল:
[লেখকের কথা: আমরা উপন্যাসের শুরুর কোলাহল পেরিয়ে এখন চরিত্রের ভীড়ের মাঝে আছি, সে কোলাহল থামার এখনো বাকি অনেক পথ। জীবনভর চলা মানুষের ভীড়ে আমরা আমাদেরকেই অনেক সময় ভুলে যাই। সম্পর্কগুলো তাদের জটিলতা পেরোতে চেষ্টা করে যায় অনবরত। কখনো পারে, কখনো বা ব্যর্থ হয়। তবু তাদের দিনকার এই চেষ্টা থেমে থাকেনা। উপন্যাসে জিনাত, রেজা খান, রিচি, অনিন্দিতা, সফুরা, আবেদা কিংবা গল্পকথক ‘আমি’ সবাই তাদের সেই সম্পর্ক আর জটিলতার সাগরে এই পর্ব থেকে ভাসতে থাকবো, যোগ হবে নতুন কেউ, আসবে উত্তাল স্রোত। সুবিধার্থে ‘আমি’ উত্তম পুরুষ এই কিস্তি থেকে তার নিজের নাম ‘সাদাত’ দিয়ে এগুবে। তাতে পাঠকের এই সংসার সাগরের ভেলাগুলো থেকে তাদের খুঁজে নিতে সহজ হবে বলে আশা রাখি। মতামত জানাতে ভুলবেন না, পড়তে থাকুন কিস্তি ধরে।]
আগের পর্বগুলো পড়তে ক্লিক করুন:
প্রথম কিস্তি | দ্বিতীয় কিস্তি | তৃতীয় কিস্তি | চতুর্থ কিস্তি | পঞ্চম কিস্তি | ষষ্ঠ কিস্তি | সপ্তম কিস্তি | অষ্টম কিস্তি | নবম কিস্তি | দশম কিস্তি
যখন থামবে কোলাহল
(দশম কিস্তি)
ছুটির দিন ভোরে ঘুম ভেঙে গেলে খুব বাজে ব্যাপার হয় সাদাতের জন্য। এমনিতে কাল রাতে ফিরতে দেরি হয়ে গিয়েছিলো। নৌকা পাওয়া যায় না বেশি রাত হলে। পরে সে অনেকটা ঘুরে ব্রিজ হয়ে এসেছে, বাজার করতে পারেনি। খুব সকালে ঘুম ভাঙার ব্যাপারটা প্রতি ছুটির দিনেই নিয়ম করে হয়। একবার সকালের কাঁচা ঘুম ভাঙলে আর ঘুম আসতে চায় না। ঘুম না ভাঙার প্রায় সব কারণই সাদাত বের করেছে। হয় চোখে আলো এসে লাগে, নয়তো কোথাও বিরক্তিকর শব্দ হতে থাকে, রান্নার ঝাঝ আসে আবার কেউ দেখা করতে আসতে পারে। তবে লাহিড়ী বাড়িতে তার কোনটিরই সম্ভাবনা ছিলনা, সে এখানে আছে তা কারো জানার কথা না। সেসব সম্ভাবনাকে ভুল প্রমাণ করেছে অনিন্দিতা। খটখটানি শুনে দরজা খুলে সাদাত কিছুক্ষণ হাবার মত তাকিয়ে রইলো। অনিন্দিতা আর তার সাথে শাড়ি ধরে একটা চার পাঁচ বছরের বাচ্চা ছেলে দাড়িয়ে আছে। সাদাত প্রায় মিনিট খানেক বুঝতে চেষ্টা করলো এই মেয়ের সকাল সকাল ডাকার কি কারন থাকতে পারে, ভেবে পেল না।
অনিন্দিতা হাত বাড়িয়ে একটা কাগজ ধরে বলল, ‘আপনার নামে একটা চিঠি এসেছে।’
বলেই সে কেমন মিটিমিটি হাসছে। মেয়েদের এই হাসির অর্থ, সে তার সামনে কোন বোকা লোককে দেখছে। মেয়েরা বোকা লোককে দেখলে তুচ্ছতার হাসি দেয়। সাদাত টের পেল কোন আপত্তিকর কিছু করে ফেলেছে সে। সাথে সাথেই তার খেয়াল হল তার গায়ে কিছু নেই, লুঙ্গি বাদে। চিঠি হাতে নেবার থেকে গায়ে কিছু দেয়া বেশি জরুরি কিনা সে বুঝতে পারছে না। সে হাতে চিঠিটা নিয়েই ভেতরে চলে গেল, গায়ে একটা টিশার্ট দিয়ে ফিরে এসে দেখে সেখানে অনিন্দিতা নেই। হয়তো মেয়েটাও লজ্জা পেয়েছে। সাদাত চিঠিটা হাতে নিয়ে বারান্দায় দাঁড়ালো। দেয়াল থেকে হলুদ রং খসে খসে পড়ছে। সেখান থেকে তার চুলেও খানিকটা পড়লো। পুরনো বাড়িগুলোতে এই এক সমস্যা। হয় চুন পড়ে নয়তো ছাদ ফুটো হয়ে পানি। সাদাতের এখন চিঠিটা খুলতে ইচ্ছে করছেনা, ভাবতে ইচ্ছে করছে। কেননা, চিঠিটা পাঠিয়েছে তার রীনা খালা। তার এখানকার ঠিকানা জানার কথা না, সে জানলে অবশ্যই তার দুলাভাই মানে সাদাতের বাবাকে জানাবে। কিন্তু সাদাত সেটা চায় না, তাই খালা অনেক জোর করলেও সে বলেনি। আরেকটা হতে পারে। নিয়াজ। নিয়াজ জানলে খালাকে সে বলতো, কিন্তু সে তো তাকেও বলেনি। তাহলে?
লাহিড়ীবাড়ির উঠানে শুকনো মরিচ রোদে দেয়া হয়েছে। একজন বয়স্কা মহিলা পা দিয়ে মরিচগুলো ছড়িয়ে দিচ্ছেন। তার মুখে পান। সাদাতের এখন নাস্তা করা উচিত। বাজার করা হয়নি, সকালের বাজারটা ধরতে হবে। গ্রামের মানুষগুলো আবার জুম্মার দিন খুব তাড়াহুড়ো করে। যেন সবাই নামায পড়তে প্রতিযোগিতায় নামবে কিছুক্ষণ পরেই। সে ঘরে ঢুকতে যাবে এমন সময় সেই ছেলেটাকে দেখলো, যে একটু আগে অনিন্দিতার সাথে এসেছিলো। তার এক হাতে একটা পিতলের থালা আর অন্য হাতে একটা পানির বোতল দেখা যাচ্ছে। ছেলেটা খুব লাজুক।
টিপ টিপ পায়ে এগিয়ে এসে বলল, ‘পিসি দিছে।’
সাদাত থালার দিকে তাকিয়ে রইল, কয়েক টুকরো গুড় আর সন্দেশের সাথে খই। সে বলল, ‘তোমার পিসিকে গিয়ে বল, আমি সকালে এসব খাইনা।’ ছেলেটা হ্যা সূচক মাথা নাড়লো, কিন্তু গেলনা। সাদাতের এবার কিছুটা বিরক্ত লাগছে। সে আবার বলল, ‘গিয়ে বল আর এগুলো নিয়ে যাও।’ ছেলেটি সব মাটিতে রেখে দৌড় দিল আর চিৎকার করে বলল, ‘খাইলে খাইন, না খাইলে নাই।’
ভোরের আলোর মাঝে একটা নিজেকে একা পাওয়ার বিষয় আছে। অনিন্দিতা খেয়াল করে দেখলো, মানুষ দুটো সময় শুধু তার জন্যই ভাবতে পারে। এক হল ভোরে আর আরেক হল রাতে ঘুমাবার আগে। সারাদিন সে শুধু ব্যস্ত থাকে দিনকার কাজে। তাই ভোর খুব ভাল লাগে তার। সে তার মায়ের কোন গুন পায়নি, শুধু ভোরে উঠে কৃষ্ণতুলসীর পূজা নিয়মিত করে। তারপর ঘরদোর গুছিয়ে একটু বই পড়া। এই সময়টা সে শুধু তার জন্যই খরচ করে। আজ একটা কাজ বেশি করেছে, দোতলার ভদ্রলোককে খই পাঠিয়েছে। মানুষকে খাবার দিলে তার ঠিক কি ধরনের প্রতিক্রিয়া হয় তাতে নাকি তার আচরন ধরা যায়। অনিন্দিতা চাচ্ছে সাদাতের আচরন জানতে।
খাটে একটা বই নিয়ে বসেছিল অনিন্দিতা। নাম ‘যাবজ্জীবন’। পড়ে খুব সুবিধার মনে হচ্ছে না, কাহিনী তেমন ধরা যাচ্ছেনা। তার মধ্যে কিছু বিশ্রী কথাবার্তা আছে, ঘুরে ফিরে বেশ্যাপাড়ায় চলে যায় শুধু নায়ক। তবু অনিন্দিতার কেমন যেন একটা ভালো লাগছে। নিষিদ্ধ বিষয়ে আলাদা ভালো লাগা আছে ব্যাপারটা তা না, লেখকের বর্ণনা খুব সাজানো, মনে হয় তার নিজেরই ওসব জায়গায় যাবার অভিজ্ঞতা আছে। তবে সে বেশিক্ষণ পড়তে পারলো না। তার বাবার ঘুম থেকে উঠার সময় হয়েছে। উঠার আগেই নিমের রস আর ছাইয়ের মাজন সামনে রেখে আসতে হয়। নইলে সে রাগারাগি করে। আজ সেটা ভুলে যাওয়ায় উঠেই চেচামেচি শুরু করেছে সে। বাড়িতে কাকা কাকি নেই, ছেলেকে রেখে তারা গেছে পশ্চিম পাড়া। কে যেন মারা গেছে কাকির দিকের আত্নীয় তাকে দেখতে। সাথেও কাকাও গেছে। কাকি থাকলে এই নিমরস সে ই এগিয়ে দেয়।
‘অনি, কই গেলি রে….অনিন্দিতা? কখন সকাল হল, কারও দেখা নাই। বাড়ির সব মরলো নাকি।’ ও ঘর থেকে অনিন্দিতার বাবা সুব্রত’র দারাজ গলাটা শোনা গেল।
অনিন্দিতার যেতে যতক্ষণ লাগলো তার মধ্যে সব বলে ধুয়ে ফেলছে সবাইকে। ঘরে গিয়েই দরজার সামনে ঠায় দাঁড়িয়ে রইল অনি। সুব্রত তার মেয়েকে ভয় পায়, এটা অনিও জানে। কেউ যদি জানে তাকে অন্য একজন সমীহ করে, ভয় পায় তবে সে আরো চেপে ধরে। এটা বাঙালির রক্তে লেগে আছে। অনি চেপে না ধরলেও তার তাকানোতে বুঝে নিতে হয় সে ভালরকম রেগে গেছে। সুব্রত তা বুঝতে পেরে চুপ হয়ে গেল। তার কথার ধরন নিমেষেই বদলে গেল।
‘বলছিলাম, বাড়ির লোক কই সব। এতবার ডাকছি। তুই কই ছিলি?’
নিমের রসটা বোতলেই ছিল, অনি সেটা গ্লাসে নিতে নিতে বলল, ‘বাড়ির সব লোককে তো তোমার দরকার নাই বুঠা। আর তুমি এতবারও ডাকো নাই, আমি কাছেই ছিলাম, শুনছি।’
সুব্রত এখন আর কোন উত্তর করা বুদ্ধিমানের কাজ মনে করছে না। সে নীরবে নিমের রসটা শেষ করতে পারলেই বাঁচে। অনিন্দিতা টেবিলে ছাইয়ের মাজনটা রেখে বেরিয়ে এল। সে জানে এর পরেই আবার নাস্তার জন্য চেচামেচি শুরু হবে। বাড়িতে সুব্রত বাদে আর কেউ এই মাজন ব্যবহার করে না। সে বাজারের মাজন দাঁতে লাগায় না বলে এটা বাড়িতেই করতে হয়।
সাদাত বুঝতে পারছে না এই নাস্তা দেয়ার কারন কি, সে খাবে নাকি নিচে গিয়ে দিয়ে আসবে তাও বুঝতে পারছে না। না খেলে বিষয়টা কেমন দেখায়। সৌজন্যতা রক্ষার মত ঝামেলা মানবসমাজে খুব কমই আছে। আপাতত তার সেটা করতে ইচ্ছে করছে না। সে তো আর ‘পেইং গেস্ট’ না। নিচের ঘরের সামনে সুব্রত বসে কলকচা করছেন। কলকচার সময় তিনি এত শব্দ করেন মনে হয়, এই সুমধুর শব্দ পুরো তল্লাটকে না জানালেই নয়। সাদাত থালা হাতে সেখানে দাঁড়াতেই সুব্রত এমনভাবে তার দিকে তাকালো যেন পথ ভুলে কোন পথিক বাড়িতে এসে আশ্রয় চাইছে তার কাছে।
‘আদাব, আংকেল থালাটা দিতে এসেছি।’ সাদাত এক নিমিষে বলে ফেলল।
সুব্রত গামছাটা কাধ থেকে নামিয়ে মুখ মুছে থালাটা নিয়েই অনিন্দিতাকে ডাকলেন, ‘অনি, অনি রে।’
সেকেন্ডের মধ্যে অনি হাজির, তার মুখে উৎকন্ঠা। সাদাত হাসিমুখে বলল, ‘না দিলেও পারতেন, আমি সকালের নাস্তাটা এমনিতে বাইরেই করি। তবে অনেকদিন পরে খই ভাল্লাগলো, থ্যাংক ইউ।’
‘আমাদের ঘরের তো, তাই দিলাম। মা থাকলে দই দিয়ে করতেন, আমি পারি না।’ বলে অনিন্দিতা মুচকি হাসলো। সুব্রত এই দুজনের মাঝে নিষ্ক্রিয় দর্শকের মত দাঁড়িয়ে আছে।
সাদাত বুঝতে পেরে বলল, ‘আমি একটু বাজারে যাবো।’
সুব্রত বলল, ‘আপনে এহানে তাইলে কয়দিন আছেন?’
‘তিন মাস। আমার প্রজেক্ট এর আগেও শেষ হতে পারে।’
‘আপনে সবই জানেন। আমি তো ভাড়া দিতে চাই নাই। আমার বাপ দাদা কেউ বাড়িতে কাউরে ভাড়া দেয় নাই, মেমান থাকতো। ভাড়া না। আমি অনির কথা শুইনা….’
কথা শেষ হবার আগেই অনি বলল, ‘বুঠা, এহন আবার এইসব কেন? নাস্তা খাইতে যাও।’
সুব্রত আরেকবার সাদাতের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ওই আর কি। থাকেন, কোন সমস্যা হলে কইয়েন।’
‘জ্বি ’ সাদাত বলে অনির দিকে একবার তাকালো।
বাজারে যাবার রাস্তাটা সকালবেলা একদম অন্যরকম লাগে। চেনা, পরিচিত আর মনে হয় পথটা সাদাতকে কিছু বলতে চায়। ক্ষেতের আইল পেরিয়ে একটা মাঠের মত জায়গা, সেটার পরে স্কুলঘরটা ঘেষে একটা কলাবাগান। তারপর বাজারটা। অথচ রাতের বেলা এ দিকে কেমন গা ছমছম করতে থাকে সাদাতের। তার হাতে একটা বাজারের ব্যাগ। চুল কাটা উচিত, অনেক বড় হয়ে গেছে। চেহারায় একটা জংলীভাব এসে গেছে তার। ফোম শেভ হলেও মন্দ হয় না। এখানকার সেলুনে ব্যবস্থা আছে কিনা তা আগে দেখতে হবে।
হাটতে হাটতে সাদাত প্রায় স্কুলঘরটার কাছে চলে এসেছে, দূর থেকে বাজারের কোলাহল আঁচ করা যাচ্ছে। কলাবাগানের পাশ দিয়ে পায়ে হাটার পথ, শুকনো থাকায় কোনাকুনিও যাওয়া যায়। সেদিকে পা বাড়াতেই সাদাত একটা অদ্ভুত শব্দ শুনতে পেল। অনেকটা মানুষের গোঙানির মত। অনেকদিন আগে ভাল্লুকের এমন শব্দ শুনেছিল সাদাত, চট্টগ্রামের ডুলাহাজরার প্রজেক্টে থাকার সময়। এখানে ভাল্লুক আসার কথা না। সাদাত আশপাশে তাকাতেই ‘ই ই একটা শব্দ। বাগানটার কোনার দিকে ঘন ঝোপ, অনেকগুলো কাটা কলাগাছ পড়ে আছে। সাদাত সেদিকে এগুতেই দেখলো একটা লোক কি যেন কাটছে, কোন গাছের গুড়ি টুড়ি হবে। কিন্তু গাছের গুড়ি মানুষ এভাবে কাটেনা, আর শব্দটাই বা আসছে কোথা থেকে। লোকটা একবারো পেছনে তাকাচ্ছে না, পুরো বিপরীত দিকে তাকিয়ে খুব শক্তি প্রয়োগ করছে এটা বোঝাই যায়। সাদাত একটু পা পিছলে পড়েই যাচ্ছিল, ‘এই…’ বলে শব্দ করতেই লোকটা বিদ্যুত বেগে তাকালো। সাদাত কোনমতে নিজেকে সামলে নিয়ে তার দিকে তাকিয়েই ভয় পেয়ে গেল। লোকটার মুখে রক্ত লেগে আছে। মনে হয় ফিনকি দিয়ে রক্ত এসে লেগেছে।
‘এইনে কি? যান।’ বলেই লোকটা ভয়ংকর দৃষ্টি দিয়ে তাকাল সাদাতের দিকে।
লোকটা একটা ময়লা ফতুয়া পড়া, যার পুরোটাই ঘামে ভেজা। সাদাত চলে যাবার জন্য পা বাড়াবে, এমন সময় তার চোখ গেল লোকটার নিচের দিকে। লোকটার নিচে আরেকটা লোক, তার লুঙ্গি দেখা যাচ্ছে, আর ছটফট করছে। সাদাতের রক্ত হিম হয়ে গেল।
(চলবে)
উপন্যাসের সবগুলো পর্ব একসাথে:
প্রথম কিস্তি | দ্বিতীয় কিস্তি | তৃতীয় কিস্তি | চতুর্থ কিস্তি | পঞ্চম কিস্তি | ষষ্ঠ কিস্তি | সপ্তম কিস্তি | অষ্টম কিস্তি | নবম কিস্তি | দশম কিস্তি