ধারাবাহিক উপন্যাস: যখন থামবে কোলাহল | প্রথম কিস্তি

মারুফ ইমনের উপন্যাস: যখন থামবে কোলাহল

অভিযাত্রী ডট কমে প্রতি বৃহস্পতিবার প্রকাশিত হচ্ছে তরুণ লেখক মারুফ ইমনের ধারাবাহিক উপন্যাস যখন থামবে কোলাহল। আগের পর্বগুলো পড়তে ক্লিক করুন:

মারুফ ইমনের উপন্যাস: যখন থামবে কোলাহল

প্রথম কিস্তিদ্বিতীয় কিস্তি | তৃতীয় কিস্তি চতুর্থ কিস্তি | পঞ্চম কিস্তি | ষষ্ঠ কিস্তি | সপ্তম কিস্তি | অষ্টম কিস্তি | নবম কিস্তি

 

লেখকের কথা:

‘যখন থামবে কোলাহল’ আমার লেখা দ্বিতীয় উপন্যাস হলেও কোন মাধ্যমে প্রকাশের দিক থেকে প্রথম। তাই এটি নিয়ে আমার একটা আলাদা উত্তেজনা আছে। ওয়েব পোর্টালগুলো প্রযুক্তির কল্যাণে জীবন যাত্রার অন্যান্য শাখার মতো সাহিত্যেও নতুন সুযোগ সৃষ্টি করেছে। পাঠকদের কাছে নিজেদের ভাবনা, গল্প পৌঁছাতে তাই বিভিন্ন প্রতিভাবান লেখক, সাহিত্যিক নানা মাধ্যমে কাজ করে যাচ্ছেন এবং দিন দিন সেই ক্ষেত্র আরো প্রসারিত হচ্ছে। তাই অনেকটা আমার ব্যক্তিগত ইচ্ছাতেই প্রথম উপন্যাস বই আকারে প্রকাশের আগেই সাহিত্যপ্রেমী পোর্টাল পাঠকদের কাছে এই লেখাটি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করতে চেয়েছি। এজন্য ‘অভিযাত্রী’র সম্পাদক সাইফুল্লাহ সাইফের কাছে আমি বিশেষ কৃতজ্ঞ। বস্ত্রপ্রকৌশলে পড়াশুনা করলেও লেখালেখি আর চলচ্চিত্রের প্রতি আমার টান অনেক আগে থেকেই, তাই দেরিতে হলেও কর্মজীবন ও বর্তমান সকল ভাবনার জায়গায় লেখাকেই প্রাধান্য দিচ্ছি। আর সাহিত্যের বিরাট জগতের নবীন সদস্য হিসেবে আমি লিখিয়ে আর পাঠকদের দারুন পরোক্ষ সম্পর্কে বিশ্বাস করি।

যখন থামবে কোলাহল আমার কয়েক বছর আগের ভেবে রাখা গল্প। এর সময়কাল ২০১৩ থেকে বর্তমান। চলমান সামাজিকতা, প্রেম আর দেশীয় রাজনীতির কিছু অস্থিরতাকে কেন্দ্র করে কয়েকটি সাধারন চরিত্রকে পুজিঁ করে গল্পটি গাঁথতে চেষ্টা করেছি। প্রতি বৃহস্পতিবার সেটি ধারাবাহিকভাবে আসতে থাকবে। পাঠকদের প্রতিক্রিয়া হয়তো বই আকারে উপন্যাসটি আলোর মুখ দেখাতে সাহায্য করতে পারে অদূর ভবিষ্যতে। আমি নবীন লিখিয়ে হিসেবে আপনাদের ভালো মন্দ শোনার অপেক্ষায় আছি। সবার চলমান জীবন ভালোবাসাময় হোক।

মারুফ ইমন

চিত্রনাট্যকার, দীপ্ত টিভি

ঢাকা।


যখন থামবে কোলাহল

(প্রথম কিস্তি)


ইজ্জতপুর রেলস্টেশন যাবো। জঙ্গলের ভেতর দিয়ে লালমাটি পথে আমি আর খালাতো ভাই নিয়াজ হেটে রাস্তায় এসে দাঁড়িয়েছি।

আন্তঃনগর ট্রেনগুলো ইজ্জতপুর থামেনা। দিনে হাতেগোনা যে কয়েকটি লোকাল আসে ঢাকা থেকে ময়মনসিংহ বা জামালপুর যায় তারাও অনেকটা অবহেলা করে দু-মিনিটের বেশি দাঁড়ায়না এখানে। স্টেশনের নাম যে এখানকার লোকদেরও বিব্রত করে তা আমিও টের পেলাম। এসেছিলাম রীনা খালার বাড়িতে, সেই অন্ধকার থাকতেই দুজন বেরিয়েছি, দু-একটা ভ্যান যা পেলাম তারাও স্টেশনে কোন এক অজানা কারনে আসতে চায়না। কাধে বই ভর্তি ভারি ব্যাগ, তাই হেঁটে আসার কথা মাথাতে আনিনি। এ যাত্রায় কপাল ভাল, আমার মত কয়েকজন ভ্যানযাত্রী পেয়ে গেছিলাম। আমার চেহারা দেখে হয়তো মায়াও লেগে গেছিল, তাই ভ্যানচালক না চাইলেও যাত্রীদের মধ্যে মুরুব্বি টাইপ একজন বলল, ‘নিয়ে নাও, আর তো কিছু পাবানা’ । চালক এমনভাবে আমার দিকে তাকালো যেন আমি তার বিঘাখানেক জমি লিখে নিয়েছি। আমি জবাবের অপেক্ষা না করে চড়ে বসলাম। নিয়াজ ফিরে গেল।

হাতঘড়ি আনতে ভুলে গেছি, তাই একদম ঠিক সময়টা বলতে পারছি না। সূর্য উঠেনি তা জানি তবে লালমাটি আর জঙ্গলের মাঝ দিয়ে কুয়াশা ভেদ করে কিভাবে এত দ্রুত ভ্যান চলছে তা আমার জানা নেই। পুরো দেশে নাকি এবার শীতের সব রেকর্ড ভেঙে যাবে- এমনটাই বলেছে আবহাওয়া অফিস। এমনিতে শীত, তার ওপর কুয়াশা, কয়েকহাত দূরেও ভাল করে কাউকে দেখা যাচ্ছেনা। ভ্যানে আমার পাশের যাত্রী তিনজন, একজন পুরুষ আর দুজন বোরকাপড়া নারী, তাদের মুখ দেখা সম্ভব ছিলনা। অনেকটা ফিসফিসিয়ে তারা এমনভাবে কথা বলছিল যেন সবাই একই পরিবারের। আমার ধারনা যে সত্যি ছিল তা বুঝতে পেরেছি স্টেশনে নেমে ভ্যানের ভাড়া দিতে গিয়ে। আমার ভাড়া তো নিলই না বরং কর্তামত একজন একাই সবারটা দিয়ে দিলেন। মুরুব্বির কাঁচাপাকা দাড়ি, মাথায় পাগড়ির মত কিছু একটা পেচানো আর হাতে একটা কাপড়ে বাধা স্টিলের জগ। ভ্যানভাড়া নেহাৎ কম হলেও, আমার জন্য তাদের এই ছাড়ের মূল্য কম নয়।

তারা তাদের মালসামানা নিয়ে স্টেশনের একপাশে এগুলো নিয়ে দাঁড়িয়ে, স্টেশন পুরো নিস্তব্ধ। গুনে তিন চারজন মানুষ একপাশে আর একটা কুকুরকে খুব আয়েশি ভঙ্গিতে হাটতে দেখলাম। আমি ছয়টার মেইলটা কখন আসবে তা জিজ্ঞেস করার মত কাউকে খুজঁছিলাম, পেলাম না। ছোট্ট স্টেশন, স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে কোন সংস্কার কাজ হয়েছে বলে মনে হচ্ছেনা। স্টেশন মাস্টারের রুম নামে কিছু নেই, হয়তো ছিল মুছে গেছে, ভেতর থেকে লাগানো।

একটা আবদ্ধ জায়গায় কয়েকজন কম্বলমুড়ি দিয়ে বিকট নাক ডেকে এমনভাবে ঘুমুচ্ছে দেখেই তাদের আর জাগাতে ইচ্ছে হলনা, কয়েকজনের আবার গায়ের কাপড় আপত্তিকর পর্যায়ে সরে গেছে, তাতে ঘুমের বড় একটা ব্যাঘাত ঘটেনি। দেয়ালে কয়েকজন স্থানীয় নেতার ‘সালাম নিন’ টাইপের পোস্টার আর আশপাশের কোন সিনেমাহলে ‘চলিতেছে’ এমন কয়েকটি ছবির পোস্টার । কয়েকবার ভুল করে সেসবে আমার চোখ পড়তেই খুব দ্রুত ফিরিয়ে নিয়েছি, কারন সেগুলোতে প্রায় নগ্ন নায়িকারা কামুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আর তাদের স্পর্শকাতর স্থান সাদা কাগজে ঢাকা। শুধু তাই নয় ছবির নামও একশ্রেণীর জন্য খুব আগ্রহ সৃষ্টি করতে পারে; যেমন- মহিলা হোস্টেল, নাইট ক্লাব।

ধারাবাহিক উপন্যাস যখন থামবে কোলাহল
যখন থামবে কোলাহল

যাই হোক, ব্যাগ থেকে একটা আপেল বের করে কামড় বসালাম। একটু দূরে একটা লোহার পাটাতনে বোরকাপড়া মহিলারা বসেছেন কিন্তু তাদের কর্তাকে আশপাশে দেখা যাচ্ছে না। আর তখন মনে হল বোরকাওয়ালী কেউ একজন অল্প দূরত্বে থেকে আমার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ব্যাগ থেকে হাতঘড়ি বের করলাম, ছয়টা বেজে গেছে প্রায়, শীতে জমে যাচ্ছি একেবারে, তালুতে ঘষতে শুরু করলাম। এমন সময় টিকিট কাউন্টার থেকে একজনকে বের হতে দেখলাম, চাদর গায়ে, পরনে লুঙ্গি আর হাতে একটি মাঝারি সাইজের বদনা। প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে তার প্রস্তুতি মন্দ নয়, সাথে সাবানের কেসও আছে। ভাবলাম একবার ডাক দিয়ে ট্রেনের খবর জানি, পরে তার এমন জরুরী মুহূর্তে না ডাকাই সমীচীন মনে করে একটা লোহার বেঞ্চিতে বসলাম।

একজন আমার কাধে হাত রাখলো, অনেক ঠাণ্ডা সে হাত। পেছন ফিরে দেখলাম সেই বয়স্ক মুরুব্বী। আমাকে দেখে মুচকি হাসলেন, আমিও হেসে বললাম, ‘কিছু বলবেন?’

ভদ্রলোক আবার মুচকি হেসে বললেন, ‘বাজি (বাবাজি) কি করেন? যাবেন কোথায়?’

আগে ভাল করে খেয়াল করিনি, এখন দেখি উনি আসলেই বয়স্ক, তার সাথে শীতে ঠোট ফেটে তাকে একদম দুঃস্থ লাগছে। বললাম, ‘আমি একটা বিদেশী সংস্থায় কাজ করি, বিভিন্ন জায়গায় যেতে হয় কাজের জন্য। এখন যাবো গফরগাঁও, আসলে আজকে নাকি বাস বন্ধ থাকবে, তাই ট্রেনে যেতে আসলাম’

– কিন্তু আজকে বাস বন্ধ তা তো জানিনা।

-জ্বী, আমিও এমনটাই শুনেছি।

-যাই হোক, ভালোই। আমরাও গফরগাঁ যাব, কিন্তু একটা ভুল হয়ে গেছে।

-কি ভুল?

-আসলে এখন ঢাকা থেকে কোন লোকাল নাই যে ওদিকে যাবে।

-বলেন কি? আপনি কিভাবে জানলেন, এই ট্রেন দিয়ে প্রায়ই যান?

-জ্বে না, তবে আমার মেয়ে যায়। সে গফরগাঁও আদর্শ মহিলা কলেজে পড়ে, ওইখানেই থাকে।

আমার রীতিমত মেজাজ চড়ে গেল। খালাতো ভাইয়ের উপর প্রচণ্ড রাগ হচ্ছে, আমাকে বলেছে সে ট্রেনের শিডিউলে একশো ভাগ নিশ্চিত। আরেকটি বিরক্তির কারন, মুরুব্বি তার মেয়ের বায়োডাটা বলেই যাচ্ছে।

 –  আমার মেয়ে ওইখানেই থাকে, সে ট্রেনেই আসা যাওয়া করে, আমি আর তার মা নিষেধ করি, তবু। অনেক সাহস, কি বলেন?

আমি তাকে থামিয়ে বললাম, ‘জ্বি অনেক। তাহলে মুরুব্বি, এখন যাবার বন্দোবস্ত কি চিন্তা করলেন?’

মুরুব্বি আবার হাসলেন।

 – আপনে যাইবেন শুইনা আর চিন্তা করিনা। একটা লোকাল ট্রেন উল্টা দিক থেইকা আসেতেছে, আপনে যদি তাতে শ্রীপুর যান, তাইলে বাসও পাবেন আবার ঢাকার থেইকা আসা ট্রেনও পাবেন।

এটুকু বলেও মুরুব্বি হাসলেন। এইলোকের বোধহয় হাসিরোগ আছে, প্রতি কথার শেষেই হাসি মজুদ।

 – তাই নাকি, দারুন বুদ্ধি তো।

আমি ভালোই অবাক হলাম।

 – এইটাও আমার মেয়ের বুদ্ধি, তার সাহস আর বুদ্ধি সমান ভাল।

 – হ্যা, তাইতো দেখি।

 – বাজি, আমার মেয়ে আর তার মাকে ট্রেনে উঠাই দিয়ে আমি চলে যেতাম। বাড়িতে অনেক কাজ, ক্ষেতের কামলারা সাতটা বাজতেই চলে আসে। তাই আমার এখনই চইলা যাইতে হবে। আপনি যদি একটু তাগো লগে থাকেন, আমার আজাইড় (চিন্তা কমে) হয়।

আমি না করতে পারলাম না। দুজন মহিলা যাবেন, তাদের উঠানামার ঝামেলা আছে জেনেও আমি বললাম, ‘ঠিক আছে, ভাববেন না। শ্রীপুর থেকে উঠতে পারলেই আর সমস্যা নেই।’

ভদ্রলোক আমার হাত ধরে টেনে তার পরিবার যেখানে বসা সেখানে নিয়ে গেলেন। আমার কিছুটা লজ্জা করতে লাগলো।

 – এইটা আমার পরিবার, সফুরা।

তিনি বোরকাপড়া একজনকে দেখিয়ে বললেন। মহিলা বোরকা না খুলে চোখের উপর থেকে কাপড় সরালেন। আমি সালাম দিলাম।

 – আর এইটা আমার মেয়ে জিনাত।

জিনাত তার মুখ থেকে কাপড় সরিয়ে একবার তাকিয়ে মাথা নিচু করে আছে, কাজল দেয়া চোখে মায়াভর্তি একটা মুখ। আমি চোখ সরাতে পারলাম না।


(চলবে)

উপন্যাসের সবগুলো পর্ব একসাথে:

প্রথম কিস্তিদ্বিতীয় কিস্তি | তৃতীয় কিস্তি চতুর্থ কিস্তি | পঞ্চম কিস্তি | ষষ্ঠ কিস্তি | সপ্তম কিস্তি | অষ্টম কিস্তি | নবম কিস্তি

Share this

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top