অভিযাত্রী ডট কমে প্রতি বৃহস্পতিবার প্রকাশিত হচ্ছে তরুণ লেখক মারুফ ইমনের ধারাবাহিক উপন্যাস যখন থামবে কোলাহল।
আগের পর্বগুলো পড়তে ক্লিক করুন:
মারুফ ইমনের উপন্যাস: যখন থামবে কোলাহল
প্রথম কিস্তি | দ্বিতীয় কিস্তি | তৃতীয় কিস্তি | চতুর্থ কিস্তি | পঞ্চম কিস্তি | ষষ্ঠ কিস্তি | সপ্তম কিস্তি | অষ্টম কিস্তি
যখন থামবে কোলাহল
(২য় কিস্তি)
প্রায় দুই ঘন্টা কেটে গেল। এ পাশ কিংবা ওপাশ, কোনদিক থেকেই ট্রেন আসার কোন লক্ষণ নেই। জিনাতের মন মেজাজ চরম খারাপ। সে তার বাবার উপর রেগে আছে, কোনরকম স্টেশনে রেখে তিনি বাসায় চলে গেছেন। ব্যাগে যে রুটি ভাজি নাস্তা ছিল জিনাত তার কিছুটা খেয়েছে, তেমন ক্ষুধা লাগেনি। কিন্তু তার মনে হচ্ছে যে ভদ্রলোক তাদের সাথে যাবেন, তার অনেক ক্ষুধা পেয়েছে। পৃথিবীর সব ক্ষুধার্ত মানুষের চেহারাতে আলাদা একটা প্যাটার্ন আছে, সহজেই তা ধরা যায়। জিনাত একটু পর পর তার দিকে তাকাচ্ছে। সে কিছুক্ষণ হেটে আবার বসে আবার হাটে। তার চেহারায় চরম বিরক্তি। আর স্টেশন মাস্টারের রুমে বোধহয় উনি চেচামিচিও করেছেন। কিছুক্ষন আগে খুব উচ্চবাচ্য শোনা যাচ্ছিল। জিনাতের মা সফুরা বেগম কিছুটা ভয় পেয়েছেন, কোন ঝামেলা না হয় আবার। তবে জিনাত বারবার লোকটার দিকে তাকায় আর তার কাজকর্মে মিটমিট করে হাসে।
ভদ্রলোকের নাম জানা হয়নি, তার বাবা তখন জিজ্ঞেস করেনি। মেয়ে হিসেবে সে গিয়ে নাম জিজ্ঞেস করবে সেটা দুঃসাহসের পর্যায়ে পড়ে। জিনাতের মা সফুরা মেয়েকে নিয়ে বিরক্ত। সকাল থেকে সে কোন কথা শুনছে না, যদিও কখনোই জিনাত মায়ের খুব অনুগত মেয়ে না। সফুরা চাননি সে আজকেই চলে যাক। দেশের অবস্থা ভাল না, প্রতিদিন কিছু না কিছু খারাপ খবর আসছেই। সরকার কিছুতেই ক্ষমতা ছাড়বে না আর বিরোধী দল আন্দোলন করে সরকার উৎক্ষাৎ না করে কিছুতেই ঘরে যাবে না। অবস্থার কোন উন্নতি নেই গত চার মাসে। ঢাকার অবস্থা আরো খারাপ। গাড়িতে প্রতিদিন আগুন দেয়ার খবর দেখে সফুরা খুব ভয় পান। গফরগাঁ ঠান্ডা জায়গা, শীতে আন্দোলন আরো জমে গেছে। তবু সফুরা মেয়েকে আসতে দিতে চাননি। মেয়ের জেদের কাছে কখনোই তিনি পারেন না, আজও পারেননি। ফাইনাল পরীক্ষার রুটিন দিয়েছে, অবরোধের কারণে কয়েকদিন পেছানো ছিল সব। কিন্তু সরকার থেকে কলেজগুলোতে চাপ দিয়েছে এসব হরতাল অবরোধ তোয়াক্কা না করতে। যে কোন সমস্যায় পুলিশ নাকি সাপোর্ট দেবে। তাই প্রিন্সিপাল সবাইকে কলেজে ফিরে পরীক্ষায় বসতে বলেছেন।
জিনাত অনেকটা জেদ করেই চলে যেতে চেয়েছে, তার এসব হরতাল অবরোধের তেমন ভয় নেই। সে ঘরকুনো মেয়ে, কোনরকম গিয়ে হোস্টেলে পড়ে থাকবে, আর বাইরে বের হবে না। তাই মায়ের না করা তাকে আটকে রাখতে পারেনি। সফুরা জোর করে হোস্টেল পর্যন্ত তার সাথে যাওয়ার জন্য চলে এসেছে। কিন্তু তাতে জিনাত খুশি না। সফুরা তার সাথে যাওয়া মানে সারা রাস্তা তাকে কঠোরভাবে গার্ডের মত ঢেকে রাখবে সে। নড়তে চড়তে দেবে না। কারো সাথে কথা বলা আরো অসম্ভব বিষয়। কিন্তু এই লোকটা থেকে কেন যেন দৃষ্টি সরাতে পারছেনা জিনাত। চেহারায় এমন একটা ভাব যেন অনেকদিন ধরেই তাকে চেনে সে। একবার মাত্র তার চোখের দিকে তাকিয়েছে সে, কিন্তু বারবার সেচোখ তার চোখের বাকি সব দেখার বস্তুকে অগ্রাহ্য করে দিয়েছে।
সফুরা একটু পর পর জিনাতের দিকে তাকাচ্ছে। সে নাস্তা পুরোটা না খেয়ে রেখে দিয়েছে। এর দু’রকম মানে হতে পারে- এক, সে হয়তো অন্য কাউকে বাকিটা খেতে দেবে আর দুই, সে পরে খাবে নাহয় ফেলে দেবে। কিন্তু সে এখনো সফুরাকে খেতে বলেনি, পরে খাওয়ার সম্ভাবনাও কম, কেননা সে গাড়িতে কিছু খাবেনা। জিনাত খাবার নষ্ট করেনা, তাই নাস্তা ফেলে দেবারও সম্ভাবনাও তেমন নাই।
একটু পরে জিনাত তার মাকে বলল, ’মা, লোকটার মনে হয় খিদে লেগেছে বেশি।’
সফুরা এই আশংকাই করছিলেন, তিনি কোনভাবে চাচ্ছেন না জিনাত লোকটার সাথে কথা বলুক। কিন্তু সে কথা বলার পথ বের করে ফেলার চেষ্টা করছে। সফুরা তাকে বুঝতে না দিয়ে বললেন, ‘কোন লোক? কার খিদে পেয়েছে?’
জিনাত বোরকা থেকে তার মুখ বের করে তার মায়ের দিকে চোখেচোখে তাকালো, এবার তার পুরো চেহারাটা বোঝা যাচ্ছে। বলল, ‘মা, তুমি খুব ভাল করেই জানো আমি কোন লোকের কথা বলছি। আমি তো ওই স্টেশন মাস্টারের কথা বলব না।’
সফুরা বললেন, ‘তুই কিভাবে বুঝলি তার খিদে লেগেছে? একটু আগেই তো দেখলাম আপেল খেল।’
-মা, সে একটা জায়গায় গত কয়েক মিনিটের মধ্যে একটানা দশ মিনিটও বসেনি। ব্যাগেও খুব সম্ভব কোন খাবার নেই। আমাদের তো নাস্তা অনেকটাই আছে, তাকে দিয়ে এসো।
-মানে? কি শুরু করেছিস? তোর বাবা এমনিতে রেখে হাওয়া হয়ে গেছে, তার মধ্যে ট্রেনের কোন খবর নেই। এখন আবার এখানে মেহমানদারী করতে অর্ডার করছিস !
-তুমি একটু বেশি রাগ করছো মা, এতটা রাগ না করলেও পারো। তুমি ভাল করেই জানো আমি রাগ দেখতে পারি না। খাবার তুমিও খাবে না, আমিও না। বেচারা স্টেশনেও কিছু পায়নি খেতে। তাই দিলে কি সমস্যা আমি বুঝতে পারছি না।
সফুরা মুনি ঋষির মত তাকালেন এমনভাবে যেন এই মুহূর্তে দৈব শক্তিতে পুড়ে ঝলসে যাবে জিনাত। তা হল না, জিনাত আবার দূরের বেঞ্চিটার দিকে তাকালো। লোকটা সেখানে নেই। হয়তো ট্রেন লেটের সাথে তার বেশি অভ্যস্ততা নেই। স্টেশনে দু’একজন চানাচুর ওয়ালা আর ভিখারী দেখা যাচ্ছে, তারা প্রতিদিনের মত হাজিরা দিতে এসেছে। এদের প্রত্যেকের মুখ জিনাতের চেনা। এই স্টেশনটাও তার খুব আপন আপন লাগে। আবার কোথাও একটা কষ্টের জায়গাও আছে এই স্টেশন ঘিরে। যতবার এখানে সে আসে সেই কষ্টরা একদল হয়ে ব্যঙ্গ করতে থাকে যেন ওর দিকে চেয়ে। সে জবাব দিতে চেয়েও দিতে পারে না।
আমি যেখানে বসে আছি তাকে কোনভাবেই স্টেশন মাস্টারের রুম বলা যায় না। একটা ভাঙা চেয়ার, একটা চৌকি আর লোহার এটা টেবিল। আশপাশে মরিচা পড়া কিছু ভাঙা লোহা আর কেরোসিনের স্টোভ, তাতে কেটলি বসানো, পানি গরম হচ্ছে। সব মিলিয়ে একজন অভাবগ্রস্থ ব্যচেলরের জন্য থাকার মত জায়গা, তবে ইঁদুরের ভাল উৎপাত আছে বোঝা যাচ্ছে। স্টেশন মাস্টারের নাম আলীরাজ, নামটা আমার পরিচিত মনে হচ্ছে। কোথায় যেন শুনেছি, কিন্তু মনে করতে পারছি না। লোকটার ভাল রকমের ধৈর্য আছে বোঝা যাচ্ছে। এসে কিছুক্ষণ ট্রেন আসার সময় জিজ্ঞেস করেছি, আলীরাজ সাহেব খুব আয়েশ করে আমার কথার জবাব দিলেন, ‘আসবে, আসবে। বসুন’
আমি বসতে গিয়ে পড়ে যাচ্ছিলাম, চেয়ারের পা একটা ভাঙা, কোনরকম একটা লোহার টুকরা দিয়ে বেধে রাখা হয়েছে। আলীরাজ আমাকে ধরে ফেললেন, ‘আহা! বলা উচিৎ ছিল। চেয়ারে আসলে কেউ বসেনা তো।’
আমি মেজাজ ঠিক রেখে বললাম, ‘দেখুন, আমার একটু আর্জেন্সি ছিল, বলতে পারেন এখন ট্রেন কতদূর এসেছে?’
আলীরাজ বললেন, ‘ভাই, বসেন। চা খান। আর্জেন্সি আমাদের সবার কম বেশি আছে।’
– আমি কোন মজা করছি না। আমাকে দুপুরের মধ্যে পৌছাতেই হবে। যদি জানেন কখন ট্রেন আসবে তো বলুন।
– আপনি কি চায়ে চিনি খান? আমার এখানে গুড়ো দুধ আছে, নাকি আদা চা খাবেন?
-আমি চা খেতে চাচ্ছি না।
-আরে খান।
বলে একটা মাঝারি সাইজ কাপে চা ঢালতে লাগলেন। আমি কিছু বলতে পারলাম না। আমার এখন বোধহয় বলার কিছু নেই ও।
আলীরাজ আশপাশে খুঁজে আরেকটা কাপ বের করে তাতেও চা ঢাললেন। একটা বিষয় অবাক লাগলো, তিনি আমার চেহারার অস্থিরতায় তেমন একটা ভাবছেন না। এমন যে, এই ঘটনা রোজকার ঘটে। আমার খুব ক্লান্ত লাগছে।
আলীরাজ বললেন, ‘চায়ে এক চামচ চিনি দিয়েছি, চলবে?
আমি মাথা নাড়লাম।
– আমার কাছে কোন খাবার নেই। আমি সকালে চা ছাড়া কিছু খাই না। তাই আর কিছু দিতে পারলাম না।
আমি হাত বাড়িয়ে চায়ের কাপ নিলাম। খালি পেটে চা কতটা ভাল হবে খাওয়া বুঝতে পারছি না।
এমন সময় দরজায় শুনি একটা মিহি গলা, ‘আসতে পারি?’
বোরকা পড়ে একজন ঢুকলো। বসে থাকা ওই দুজনের কেউ। আন্দাজ করলাম জিনাত নামের মেয়েটি হবে। তার হাতে পলিথিনে মোড়ানো কি যেন। আমার সিক্সথ সেন্স বলছে, জিনাত আমার জন্য খাবার নিয়ে এসেছে। আলীরাজ সাহেব বললেন, ‘আসুন।’
(চলবে)
উপন্যাসের সবগুলো পর্ব একসাথে:
প্রথম কিস্তি | দ্বিতীয় কিস্তি | তৃতীয় কিস্তি | চতুর্থ কিস্তি | পঞ্চম কিস্তি | ষষ্ঠ কিস্তি | সপ্তম কিস্তি | অষ্টম কিস্তি | নবম কিস্তি