ধারাবাহিক উপন্যাস: যখন থামবে কোলাহল | তৃতীয় কিস্তি

মারুফ ইমনের উপন্যাস: যখন থামবে কোলাহল

অভিযাত্রী ডট কমে প্রতি বৃহস্পতিবার প্রকাশিত হচ্ছে তরুণ লেখক মারুফ ইমনের ধারাবাহিক উপন্যাস যখন থামবে কোলাহল।

আগের পর্বগুলো পড়তে ক্লিক করুন:

মারুফ ইমনের উপন্যাস: যখন থামবে কোলাহল

প্রথম কিস্তিদ্বিতীয় কিস্তি | তৃতীয় কিস্তি চতুর্থ কিস্তি | পঞ্চম কিস্তি | ষষ্ঠ কিস্তি | সপ্তম কিস্তি | অষ্টম কিস্তি


যখন থামবে কোলাহল

(৩য় কিস্তি)


রেজা খান এখন বাথটাবে, তার পারসোনাল সেক্রেটারি রিচি তার বেডরুমে থাকে এ সময়টায়। কারন বাথটাবে প্রায় আধঘন্টা সময় নেন রেজা, তার ধারনা এই সময় তার অনুপস্থিতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কলগুলো আসে মোবাইলে। এমন গুরুত্বপূর্ণ যে, সারাদিনও তেমন কল দুবারের বেশি আসে না। সেটা হতে পারে প্রধানমন্ত্রীর পিএস এর ফোন, হতে পারে আমেরিকান কোন বায়ারের চিফের ভিডিও কল, আবার অনেক সময় কোন টিভি চ্যানেলের টকশোতে যাবার ফোন, যেখানে তার সাথে থাকবে কোন মন্ত্রী পর্যায়ের লোক। তাই সেগুলো এটেন্ড করতে রিচিকে থাকতে হয়।

রিচি আয়নায় তার ড্রেসটা বারবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছে, বস ড্রেসের প্রশংসা করেছে মানে এটা অবশ্যই সুন্দর। তবে সে যে খুব ফ্যাশন সচেতন তা না, এই চাকরিটা শুরু করার পর তার মধ্যে অনেক পরিবর্তন এসেছে, এই ড্রেস আপ আর ফিটফাট থাকা এখন তার প্রতিদিনের অন্যান্য কাজের মত অংশ হয়ে গেছে। বিশেষ করে, তার বস রেজা খান আনফিট লোক একদম পছন্দ করেন না, এটা সে এই ছ’মাসে ভালই টের পেয়েছে।

রেজা বের হলেন ঘড়ি ধরে ৩৩ মিনিট পর, যদিও বাথটাবের ঘড়িটা ইদানিং স্লো যাচ্ছে। তারপর টাওয়েলটা জড়িয়ে জানালার কাছে গেলেন। রিচির উচিত এই অবস্থায় বের হয়ে যাওয়া।

সে গলা খাকারি দিয়ে বলল, ‘স্যার, আমি কি নিচে ওয়েট করব?’

রেজা আবার তার রকিং চেয়ারটায় বসলেন। এখান থেকে একটু সকালের রোদটা পাওয়া যায়। ঢাকা শহরে এমনিতেই শীত বলে কিছু নেই, তার মধ্যে একটু আধটু কুয়াশা দেখতে ভাল্লাগে তার।

লোশনটা বুকে মাখতে মাখতে বললেন, ‘রিচি, তুমি কিসে পড়াশুনা করেছো যেন?’

রিচি এই প্রশ্নের কারন বুঝতে পারলো না। রেজা খুব ভাল করেই জানেন যে তার ব্যাকগ্রাউন্ড হিস্ট্রি। তবু জিজ্ঞেস করার মানে হল তিনি এই প্রশ্ন দিয়ে অন্য কোন কথায় ঢুকতে চান।

রিচি বলল, ‘স্যার। আমি দর্শনের ছাত্রী।’

রেজা বললেন, ‘দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য গলা দিয়ে নকল কাশি বের করা ভাল দেখায় না।’

 – সরি স্যার।

 – ইটস ওকে। কোন কল এসেছিল?

 – জ্বি, ফরেন মিনিস্ট্রির। একটা সেমিনার আছে শনিবার, আপনাকে ফরেন মিনিস্টারের সাথে স্পেশাল গেস্ট হিসেবে নাম দিতে চাচ্ছে।

 – ওহ, আজকাল চিফ গেস্টের পক্ষ থেকে বাকি গেস্ট ঠিক করে দেয় তাহলে। ভাল। তুমি কিছু বলেছো?

 – না স্যার, বলেছি দুপুরের আগেই জানাবো আপনার সাথে কথা বলে।

 – ভাল করেছো। এগারোটার দিকে কল দিয়ে বলে দেবে আমি যেতে পারছি না, তাই দুঃখিত।

 – ওহ। ঠিক আছে স্যার।

রিচির কন্ঠে কিছুটা আহত হবার মত শোনালো।

 – আমি না করার কারনটা কি তুমি আন্দাজ করতে পারলে?

 -না স্যার।

 – আমি আজ না গেলে ওখানে কোন ভার্সিটির প্রফেসরকে গেস্ট করা হবে। এটা আমার থেকে যারা সেখানে থাকবে তাদের বেশি ভাল্লাগবে। কিছু বুঝতে পারলে?

 – না স্যার।

 – থাক। না বোঝাও কখনো কখনো ভাল।

রিচি চুপ করে থাকে। রেজা তাকে বসতে বলেন, রিচি কিছুটা সংকোচ নিয়ে পাশের সোফায় বসে।

রেজা আবার বলেন, ‘তুমি দর্শনের ছাত্রী বলে আমি খেয়াল করেছি তুমি কিছুটা বিব্রতবোধ করো বলতে গিয়ে, এটা কেন?’

রিচি বলে, ‘তেমন কিছু না। অনেকে শুনলে কেমন করে তাকায় যেন।’

রেজা মুচকি হাসলেন, তিনি খুব কম এভাবে হাসেন।

‘তুমি জানো, আমি দর্শন পড়তে চেয়েছিলাম?’ রেজা কিছুটা গম্ভীরভাবে তাকান রিচির দিকে। তার মুখে আনন্দ ঘুরাফিরা করছে।

‘জানতাম না স্যার।’ রিচি উৎসাহী হয়ে বলে, বুঝা যাচ্ছে সে আরো কিছু শুনতে চায়।

রেজা বলতে থাকেন, ‘কেন পড়তে চেয়েছিলাম সে ঘটনা আরেকদিন বলবো হয়তো। তবে তোমাকে চয়েস করার ক্ষেত্রে এটি একটি বড় কারন ছিল, তুমি খুব ভালভাবে ফিলোসফিতে অনার্স মাস্টার্স করেছো। তোমার ফ্যামিলির কন্ডিশন ভাল না আমি জানি, নরমালি এসব ক্ষেত্রে ছেলেমেয়েরা বেশি টাকা বেতন পাওয়া যাবে এমন কিছুতে পড়তে চায়। তুমি সেটি চাওনি, সুযোগ থাকা সত্ত্বেও, ইটস রিয়েলি সারপ্রাইজিং।’

রিচির মুখে এক চিলতে হাসি, ‘থ্যাংক ইউ স্যার’।

রেজা গালে খোচাতে গিয়ে আবার বলেন, ‘তোমাকে যে স্যালারি দেয়া হয় তাতে তোমার খুশি থাকার কথা। আমি কি ঠিক বলছি?’

রিচি বলে, ‘জ্বি স্যার।’

রেজা বলেন, ‘তোমাকে আরেকটা প্রশ্ন করি?’

রিচি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ে।

 – ধনী লোকদের মধ্যেও স্বভাবের দিক থেকে কিছু ভাগ আছে। যেমন- কেউ আছে বাবা প্রচুর ধনসম্পদ রেখে মারা গেছে, ছেলে সেগুলো পেয়ে উত্তরাধিকার সূত্রে ধনী হয়। এরা সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মায়, সারাজীবন হয় বাবার রেখে যাওয়া সম্পত্তি ব্যয় করে নয়তো শেষ করে। একভাগ আছে, এরা অনেক কষ্ট করে অনেক ছোট থেকে টাকা উপার্জন করে ধনীদের কাতারে নাম লেখায়, এরা প্রচুর খাটতে পারে, অনেক স্ট্রাগল করে আবার অনেক কিছু হারিয়েও ফেলে। তবে অনুপ্রেরণা দিতে বিভিন্ন বইপত্র আর মানুষের মুখে মুখে তাদের নাম ছড়ায়, এরা যে একেবারে পুরোটা জীবন অনেস্ট থাকতে পারে তা না, তবে এরা একটা লিমিটের মধ্যে জীবনকে ভেবে অভ্যস্ত। আর আরেক দল হল আঙুল ফুলে কলাগাছ টাইপ। এদের সম্বন্ধে পত্রপত্রিকায় অনেক লেখা দেখতে পাবে, হয় ব্যাংক ডাকাতি করে, নয় অবৈধ বিদেশি কলের ব্যবসা করে ইত্যাদি।

রিচি এতক্ষণ শুনছিলো, সে ধীরে বলে, ‘জ্বী স্যার।’

 – আমার যে টাকাপয়সা তাতে আমাকে ধনী বা তার থেকেও বেশি কিছু বলা যায়। আমাকে তোমার এদের মধ্যে কোনভাগের লোক মনে হয়?

রিচি কিছু বলতে পারে না। রেজা উচ্চস্বরে হেসে উঠেন।

 – তোমাকে এখনই উত্তর দিতে হবেনা। তোমার পক্ষে এখনই দেয়া সম্ভবও না। পরে দিও। তুমি এখন নিচে যেতে পারো।

রিচি মাথা নাড়ায়। ব্যাগটা নিয়ে ঘর থেকে বের হয়। বের হতেই তার মনে হল কেউ দৌড় দিয়ে পালালো। মেঝেটা এখনো কাপছে। রিচি দ্রুত হেঁটে সিঁড়ির দিকে গিয়েও কাউকে দেখতে পেল না। তবে সে নিশ্চিত, কেউ দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে ছিল।

রেজা টাওয়েল খুলে একটা টি শার্ট গায়ে দেন। তার আর এখন শীত শীত লাগছে না। রিচির গায়ের সুগন্ধিটার কথা জিজ্ঞেস করা হয়নি। তবে সারাঘর সেটা ছড়িয়ে গেছে। রেজা প্রায়ই আশ্চর্য হন, যারা পারফিউম বানায় তারা কিভাবে পুরুষ আর মহিলাদের জন্য ঘ্রানটাকে আলাদা করেন। গায়ে নিয়ে ঘুরলেও ধরতে পারা যায় এটা পুরুষের না মহিলার পারফিউম। আর রেজা সেটা আরো ভালভাবে ধরতে পারেন, অনেকবার ধরেছেনও। একদিন কোন পারফিউম বানায় এমন কাউকে ডেকে জানতে হবে রহস্যটা। বিষয়টা খুব গুরুত্বপূর্ণ। রিচিকে একদিন বলে এটার খোঁজ করতে হবে। কারিগরের দিক থেকেও পুরুষ মহিলা আলাদা থাকতে পারে। এমন কাউকে পেলে রেজা তার একটা অতি গোপনীয় কথা তার কাছে বলবেন। খুব গোপন।


(চলবে)

উপন্যাসের সবগুলো পর্ব একসাথে:

প্রথম কিস্তিদ্বিতীয় কিস্তি | তৃতীয় কিস্তি চতুর্থ কিস্তি | পঞ্চম কিস্তি | ষষ্ঠ কিস্তি | সপ্তম কিস্তি | অষ্টম কিস্তি | নবম কিস্তি

Share this

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top