রমা থেকে সুচিত্রা সেন হয়ে উঠা, এক চিরসবুজ মহানায়িকার গল্প

Published:

Updated:

মহানায়িকা সুচিত্রা সেন

Disclaimer

As an affiliate, we may earn a commission from qualifying purchases. We get commissions for purchases made through links on this website from Amazon and other third parties.

বাংলা সিনেমার ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট নায়িকার কথা ভাবলেই চোখের সামনে উঠে আসে তাঁতের শাড়ি পড়া, কপালে কালো টিপ আর মাঝ বরাবর সিঁথি করা হালকা লম্বাটে মুখের গড়নের এক যুবতী নারীর ছবি।

বাংলা চলচ্চিত্রে নতুন ভাবধারার সৃষ্টির এই মানুষটি যদি জন্ম না নিতেন তাহলে সেলুলয়েডে রোমান্টিক জুটি কতটা প্রাণবন্ত হতে পারে, তা হয়ত আমাদের ভাবনার অতীতে থেকে যেত। জ্বী, বলছি রমা দাশগুপ্তের কথা, যিনি রমা থেকে সুচিত্রা সেন হিসেবেই নিজেকে প্রতিষ্ঠি করেছেন।

আর সেই প্রাণবন্ত জুটির নাম উত্তম-সুচিত্রা। বাংলাদেশে আলো বাতাসে বেড়ে উঠা এই চিরসবুজ নায়িকা পাড়ি জমিয়েছিলেন ’৪৭ এর দেশভাগের আগে কলকাতায়। শিল্প আর নাচ-গান-অভিনয়ের সাথে তার যে সম্পৃক্ততা তা কলকাতায় গিয়ে অতটা ছেদ পড়েনি।

সুন্দর মুখশ্রী আর এইসব গুণের কারণে অভিষেক ঘটান টালিগঞ্জের পর্দায়। এক বড় পরিচালক তাকে প্রণয়ের প্রস্তাব দিয়ে প্রত্যাখ্যাত হলে সুচিত্রা সম্পর্কে বলেন, “দেখব রমা কী করে হিরোইন হয়! যদি হয় তো আমার হাতের তালুতে চুল গজাবে

এরপর রমার অর্থ্যাৎ সুচিত্রার নিজেকে প্রমাণ করতে খুব বেশি সময় লাগেনি। স্টার খ্যাতি পাবার পর, সেই পরিচালককে বলে বসেন, “দেখি দেখি, আপনার হাতটা হাতের তালুতে চুল গজানোর কথা ছিল তো! আমি তো হিরোইন হয়ে গিয়েছি”।

বাকপটু সুচিত্রা অভিনয়ে এসেছিলেন বিয়ের পর। তবে নিজের থেকে স্বামী আর শ্বশুর বাড়ির আগ্রহই বরং বেশি ছিলো। অভিনয়ের কারণেই কিনা তা ঠিক জানা নেই, তবে স্বামীর সংসার বেশিদিন টিকেনি। আবার আইনগত যে ডিভোর্স তাও হয় নি তার। তাহলে কি ঘটেছিলো আসলে; বা কেনই ডিভোর্স নেননি সুচিত্রা? 

এমন আরো অনেক প্রশ্নের উত্তর খুঁজার চেষ্টা করবো আমরা অভিযাত্রীর আজকের আলোচনায়। সুচিত্রা সেনের জীবনের আদ্যপান্ত জানতে শেষ অব্দি সাথেই থাকুন। 

মহানায়িকা সুচিত্রা সেন

রমার জীবন এবং রমা থেকে সুচিত্রা সেন হয়ে ওঠার গল্প

১৯৩১ সালের ৬ই এপ্রিল পাবনার তৎকালীন সিরাজগঞ্জ মহুকুমার ভাঙাবাড়ি গ্রামে নানীর বাড়িতে জন্ম গ্রহণ করেন। রেওয়াজ অনুসারে মামা বাড়িতে জন্ম নেওয়া কৃষ্ণাকে বেশ কয়েক দিন পরে নিয়ে আসা হয় পাবনা শহরের গোপালপুরের পৈত্রিক বাড়িতে।

কৃষ্ণার শৈশব-কৈশোর কেটেছে সেখানেই। সমবয়সীদের কাছে কৃষ্ণা এবং ছোটদের কৃষ্ণাদি। বাবা করুনাময় দাসগুপ্ত ছিলেন পাবনা পৌরসভার স্যানিটারি ইন্সপেক্টর ও পাবনার অশোক স্কুলের প্রধান শিক্ষক আর মা ইন্দিরা ছিলেন গৃহিণী। তিনি ছিলেন কবি রজনীকান্ত সেনের নাতনী।

করুনাময়ের তিন ছেলে আর পাঁচ মেয়ের মধ্যে তিনি ছিলেন পঞ্চম। সুচিত্রা জন্মের সময় খুব একটা ফর্সা ছিলেন না। শ্যামা বর্ণের একটা ছাপ ছিলো। গায়ের রঙের সাথে মিল রেখে তার নাম দেওয়া হলো কৃষ্ণা। নামটি দিয়েছিলেন পিতামহ জগবন্ধু দাশগুপ্ত।

কিন্তু করুণাময় হয়ত খুশি ছিলেন না এই নামে। কেননা পরবর্তীতে তিনি মেয়ের নাম দেন রমা। তবে পারিবারিক নাম কৃষ্ণা’ই থাকে। কারণ জগবন্ধুর উপরে কথা বলার সাহস ছিলো না দাশগুপ্ত পরিবারের কারো। তবে পাবনা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সহপাঠীদের কাছে রমা নামেই বেশি পরিচিত ছিলেন তিনি।

কারণ স্কুলে ভর্তি হওয়ার সময় পারিবারিক পদবী রমা দাশগুপ্ত নাম হয়। এমনকি সুচিত্রা হবার পরেও, তিনি যখন কয়েকবার বাংলাদেশে মানে পাবনাতে আসেন তখনও অনেকে তাকে রমা বলেই সম্বোধন করতেন। রমা পাবনা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে লেখাপড়া করা অবস্থায় জড়িত ছিলেন স্কুলে এবং বনমালী ইনস্টিটিউটে নাচ-গান, আবৃত্তির সাথে।

ভীষণ স্মার্ট ও আধুনিক মন-মানসিকতার অধিকারী ছিলেন কৃষ্ণা। বাংলার গভর্নর জন এন্ডারসনের স্ত্রী পাবনা বালিকা বিদ্যালয়ে এলে তার সম্মানে কৃষ্ণার নেতৃত্বে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ‘ঋতুরঙ্গ’ মঞ্চস্থ হয়।

রমা কৈশোরে ইছামতি নদী, পদ্মার তীরে বেড়াতে, গাছে উঠে ফল খাওয়া, বৃষ্টিতে ভিজে আনন্দ উপভোগ ছাড়াও নদীতে নৌকাবাইচ দেখতে যেতেন। সাজতেন প্রিয় বাসন্তী পূজোয়। তার প্রিয় রাত ছিল কালীপূজোর রাত। দোলের দিন রমা বৈষ্ণব পদাবলীর রাধিকা সাজতেন।

মহানায়িকা সুচিত্রা সেন
পাবনায় সুচিত্রা সেনদের পৈত্রিক ভিটা

১৯৪৭ এর শুরুর দিকে রমার বড় বোন উমার বিয়ে হয়। এরপর অনিবার্য দেশভাগের কথা ভেবে করুনাময়-ইন্দিরা দম্পতি পাঁচ কন্যা উমা, রমা, হেনা, লিনা, রুনা আর দুই ছেলে নিমাই ও চার বছরের গৌতমকে নিয়ে কলকাতায় চলে যান। এরপর তাদের পুরো পরিবারকে আর পাবনাতে দেখা যায়নি।

করুনাময় দাশগুপ্ত পাবনার বাড়ি জেলা প্রশাসনের কাছে ভাড়া দিয়ে বোনের বাড়ি শান্তিনিকেতনে পরিবার নিয়ে চলে যান। সেখানে কিছুদিন থাকার পর ভুবনডাঙ্গা গ্রামে নিজে বাড়ি তৈরি করেন।

এবছরই পুরীতে সপরিবারে বেড়াতে যান রমা। সেখানে চোখে পড়ে যান মেরিন ইঞ্জিনিয়ার দিবানাথ সেনের ঠাকুমার। আদর সোহাগ আর বাড়তি শাসন পেয়ে বেড়ে উঠা রমা তখন বিয়ের জন্যে পুরোপুরি প্রস্তুত না হলেও কলকাতার বনেদি পরিবার দেখে না করতে পারেননি করুনাময়।

বিয়েটা যখন হয় তখন রমার বয়স ১৬ বছর। দিবানাথের বাবা ছিলেন ব্যরিস্টার আদিনাথ সেন। দিবানাথের পরিবারের আদিনিবাস ছিলো ঢাকার গ্যান্ডেরিয়ায়। বিয়ের পর, স্বামীর নামের বরাতে রমা দাশগুপ্ত হয়ে যান রমা সেন।

৩২ বালিগঞ্জ প্লেসের প্রাসাদোপম বাড়ি অর্থ্যাৎ শ্বশুরবাড়িতে যাওয়ার পর, অনেকটা নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন রমা। কেননা তার শ্বশুরবাড়ির পরিবেশের সাথে মানিয়ে নেওয়া তার জন্যে কঠিন ছিলো। শ্বশুরবাড়ির আগাগোড়া ছিলো আভিজাত্যে টুইটম্বর।

স্বামী  খুব কাছের মানুষ হওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন তিনি। পরে রমা জানতে পারেন দিবানাথের বেপরোয়া জীবনযাপনকে সংযত করতে শ্বশুর আদিনাথ সেন পুত্রবধূ করে তাকে ঘরে এনেছেন।

এরই মধ্যে পাড়ার ছেলেদের চোখে পড়ে যান রমা। নিজ পাড়ায় “নটীর পূজা” নাটকে প্রথম অভিনয় করলেন তিনি। অভিনয়ের কারিশমা দেখিয়ে সবাইকে মুগ্ধ করে দিলেন। এরপর ঘটে গেল রমার জীবনের সবচেয়ে বর টার্নিং পয়েন্ট। রমার শ্বশুরের প্রথম পক্ষের স্ত্রীর ভাই বিমল রায় ছিলেন পেশায় ফিল্মমেকার।

তিনি রমাকে প্রথম দেখায় মুগ্ধ হন, সিনেমায় কাজ করার প্রস্তাব দেন। রমা অনুমতির জন্যে তার শ্বশুরকে বলেন। তার শ্বশুর এবং স্বামী উভয়ই রাজি হন। এক্ষেত্রে জানা যায়, স্বামীর আর্থিক অস্বচ্ছলতা অন্যতম কারণ ছিলো রমাকে অভিনয় করতে অনুমতি দেওয়ার প্রধান কারণ।

মহানায়িকা সুচিত্রা সেন

এই ঘটনাটি তার বিয়ের আড়াই বছরের মাথায় ঘটে। তবে প্রথম চলচ্চিত্রে কাজ করার অভিজ্ঞতা সুখকর ছিলো না তার জন্যে। কারণ ১৯৫২ সালে “শেষ কোথায়” নামের একটি বাংলা ছবিতে তিনি  অভিনয় করেন যা অজ্ঞাত কারণে মুক্তি পায়নি। এই ছবিতে তিনি রমা সেন নামেই কাজ শুরু করেন।

ছবি মুক্তি না পেলেও সিনেমা পাড়ায় যাতায়াত ছিলো রমার। যাতায়াতের সুবাদে নজরে পড়ে যান সুকুমার দাশগুপ্তের সহকারী নীতিশ রায়ের। তার সুবাদে “সাত নম্বর কয়েদি” চলচ্চিত্রে কাজ পেয়ে যান। এই ছবিতেই নীতিশ রায় তার নাম দেন সুচিত্রা।

তারপর থেকে সুচিত্রা সেন নামেই সিনেমা পাড়ায় পরিচিত হতে থাকেন। “সাত নম্বর কয়েদি”তে সিলেক্ট হবার পেছনে তার মূল যোগান দেয় মনভোলানো হাসি, স্বচ্ছ গভীরতায় ডুবে যাওয়া মায়াবী চোখ আর মিষ্টি কন্ঠ। ‘সাত নম্বর কয়েদী” ছবিতে অভিনয় করার পর সুচিত্রা সেন পিনাকী মুখার্জি পরিচালিত “সংকেত” ছবিতে অভিনয় করেন ।

তার পরের ছবি অর্থাৎ নীরেন লাহিড়ীর “কাজর” ছবির মাধ্যমে ১৯৫২ সালে রমা সেন পাল্টিয়ে “সুচিত্রা সেন” নামে আত্মপ্রকাশ করেন তিনি ।

একে একে চলচ্চিত্রে কাজ আর সফলতা নিয়ে উল্কার বেগে ছুটতে থাকেন সুচিত্রা। ১৯৫৩ সালেই ‘ভগবান শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য’ ছবিতে তিনি অভিনয় করেছিলেন বিষ্ণুপ্রিয়ার চরিত্রে। আর এই ছবিটিই তার জীবনকে পাল্টে দিয়েছিল।

তার অভিনীত চলচ্চিত্রে গৌরী প্রসন্ন মজুমদারের লেখা গান, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গীত পরিচালনা ও সন্ধ্যা রায়ের প্লেব্যাক ৩টি রমা সেনকে সুচিত্রা সেন হতে সাহায্য করেছে। একই বছর মহানায়ক উত্তরকুমারের সাথে তাঁর প্রথম ছবি “সাড়ে চুয়াত্তর” মুক্তি পায়।

বক্স অফিসে সাড়া ফেলে দেয় এই ছবি। একইসাথে বাংলা চলচ্চিত্র পায় নতুন এক রোমান্টিক জুটি। এই জুটি এরপর অভিনয় করে প্রায় ৩০টির মত ছবিতে। এই জুটি তখন আকাশচুম্বী সফলতা পেতে শুরু করে। উত্তম একবার মন্তব্য করেই বসলেন, “রমা যেন আমাকে পূর্ণ করল”।

এটি ছিলো তার ফিল্ম ক্যারিয়ারের প্রথম হিট ছবি। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। সুচিত্রার চলন-বলনের নিজস্ব স্টাইল যেন ক্রমেই অনুকরণীয় হয়ে উঠেছিলেন যুবতীদের কাছে। তার শাড়ি পরা বা চুল বাঁধার কেতা ছিলো পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে কলকাতা, ঢাকার বাঙ্গালি সমাজে আভিজাত্য এবং ফ্যাশন সচেতনতার প্রতীক।

উত্তম কুমার ছাড়াও সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, অশোক কুমার, বসন্ত চ্যাটার্জীর সহ বেশ কিছু নায়কের সঙ্গে জুটি বেঁধে অসাধারণ কিছু ছবি উপহার দিয়েছেন তিনি । ‘দেবী চৌধুরানী’ ছবিতে রঞ্জিত মল্লিকের স্ত্রী হিসেবেও অভিনয় করেছেন সুচিত্রা সেন ।

মহানায়িকা সুচিত্রা সেন

১৯৫৩ থেকে ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত ১৯টি ছবি মুক্তি পায়। ‘শাপ মোচন’, ‘হারানো সুর’, ‘ওরা থাকে ওধারে’, ‘মরনের পরে’, ‘গৃহ প্রবেশ’, ‘পথে হল দেরি’, ‘ইন্দ্রাণী’, ‘সপ্তপদী’, ‘গৃহদাহ’, ‘হার মানা হার’, ‘হসপিটাল’, ‘সাথীহারা’, ‘আলো আমার আলো’, ‘সাত পাকে বাঁধা’, ‘সাগরিকা’, ‘দত্তা’ প্রভৃতি সিনেমায় সুচিত্রা সেন তার অসাধারণ প্রতিভার সাক্ষর রেখেছিলেন।

১৯৬৩ সালে ‘সাত পাকে বাঁধা’ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য মস্কো চলচ্চিত্র উৎসবে সুচিত্রা সেন ‘সিলভার প্রাইজ ফর বেস্ট অ্যাকট্রেস” জয় করেন। তিনিই প্রথম ভারতীয় অভিনেত্রী যিনি কোনো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে পুরস্কৃত হয়েছিলেন।

সুচিত্রা বাংলা ছবির পাশাপাশি হিন্দী ছবিতেও অভিনয় করেছেন। ১৯৫৫ সালেই দেবদাস করেছেন। ১৯৫৫ সালের দেবদাস ছবির জন্য তিনি শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর পুরস্কার জিতেন। দোনন্দকে নিয়ে করেছেন ‘বাম্বাই কা বাবু’ ও ‘সরহদ”।

আর গুলজারের পরিচালনায় ‘আঁধি’ ছবিতে ইন্দিরা গান্ধীর চরিত্রে তার অভিনয় সকলকে মুগ্ধ করেছিল। এরপর ‘মমতা’ এবং ‘আঁধি’ সিনেমার জন্য ফিল্ম ফেয়ার পুরস্কারের মাধ্যমে সুচিত্রার অভিনয় প্রতিভার প্রতি কুর্ণিশ জানিয়েছিল বলিউড

এছাড়াও বাংলা চলচ্চিত্রে সপ্তপদী (১৯৬১), উত্তর ফাল্গুনী (১৯৬৩), আলো আমার আলো (১৯৭২) ও আধি (হিন্দি) ছবির জন্য বেঙ্গল ফিল্ম জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর পুরস্কার পান। হিন্দি ছবি মমতার জন্য তৃতীয় মস্কো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উত্সবে সেরা অভিনেত্রীর, ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক পদ্মশ্রী (১৯৭২) ও পশ্চিমবঙ্গ সরকার কর্তৃক বঙ্গবিভূষণ পুরস্কার (২০১২) অর্জন করেন।

২০০৫ সালে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে দাদা সাহেব ফালকে সম্মাননা ভূষিত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে সুচিত্রা সেন দিল্লি যেতে হবে বলে সবিনয়ে তা প্রত্যাখ্যান করেন।

তিনি সত্যজিৎ রায়, রাজ কাপুরকে পর্যন্ত ফিরিয়ে দিয়েছেন। সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে ছবি করতে রাজি ছিলেন সুচিত্রা। কিন্তু শর্ত দিয়েছিলেন সত্যজিৎ তার সঙ্গে যতদিন কাজ করবেন ততদিন অন্য ছবিতে কাজ করা চলবে না। সুচিত্রা এর উত্তরে বলেছিলেন, সেটা কি করে হয়?

যারা তাকে সুচিত্রা সেন বানিয়েছেন তাদের তো বাদ দেওয়া চলবে না। তবে তিনি কথা দিয়েছিলেন সত্যজিৎ বাবুর জন্য বেশি সময় দেবেন। কিন্তু পরদিন প্রযোজক যখন চুক্তিপত্রের খসড়া নিয়ে এলেন তাতে এক্সক্লুসিভ আর্টিস্ট কথাটি লেখা দেখে সঙ্গে সঙ্গে সেটি ছুড়ে ফেলে দিয়েছিলেন। ফিরিয়ে দিয়েছিলেন প্রযোজককে।

আর রাজ কাপুরের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেবার পেছনে ছিল অন্য গল্প। রাজ কাপুর নাকি সুচিত্রাকে প্রেম নিবেদন পর্যন্ত গিয়েছিলেন। একদিন বালিগঞ্জের বাড়িতে এসেছিলেন রাজ কাপুর সিনেমার প্রস্তাব নিয়ে। সাদা সুট, সাদা নেকটাই আর হাতে একরাশ লাল গোলাপ নিয়ে সুচিত্রার পায়ের কাছে বসে তার প্রযোজিত কোন ছবিতে কাজ করার জন্য বলেছিলেন।

সুচিত্রা তখনই তাকে না বলে দিয়েছিলেন। এমনকি সে সময়ে একটি সিনেমা করার জন্যে সুচিত্রা ২ লাখ টাকা নিতেন যা অনেক প্রতিভাবান অভিনেতার থেকেও বেশি ছিলো।

এদিকে, ১৯৬১ সালে উত্তম-সুচিত্রার সপ্তপদী ছবি মুক্তির পর ১৯৬২ সালে এই দুই তারকার পর্দা বিচ্ছেদ ঘটে। ১৯৫২ থেকে ১৯৬২ সাল পর্যন্ত এই জুটি ১০ বছরে মোট ২৫টি ছবিতে কাজ করেন। ১৯৬২ সাল থেকে ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত উত্তম সুচিত্রা আর কোনো ছবিতে কাজ করেননি।

১৯৬৭ থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত মাত্র ৫টি ছবিতে পুনরায় একসাথে কাজ করেছেন। ২৬ বছরের চলচ্চিত্র ক্যারিয়ারে ১৯৫২ সাল থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত ৫৩টি বাংলা ও ৭টি হিন্দি মিলিয়ে মোট ৬০টি ছবিতে কাজ করেন ভারতবর্ষের মহানায়িকা সুচিত্রা সেন।

এরমধ্যে ১৯৫৭-৫৮ সালে সুচিত্রার সংসারে ভাঙন ধরে। উত্তরকুমারের সাথে ঘনিষ্টতা বাড়তে থাকার কারণে সংসার জীবনে কলহ লেগেই থাকত। ১৯৬৩ সালে সুচিত্রা সেন আলাদা হলেন দিবানাথের কাছ থেকে। ডিভোর্স নয়, আইনগত বিচ্ছেদও নয়। শুধু আলাদা।

সুচিত্রা দিবানাথের বালিগঞ্জের বাড়ি ছেড়ে প্রথমে ম্যুর অ্যাভিনিউতে তারপর নিউ আলীপুরে থাকা শুরু করেন। ১৯৬০ সালে প্রাক্তন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী শচীন চৌধুরীর বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের বাড়িটি কিনে নিজের মতো করে সাজিয়ে নেন সুচিত্রা সেন।

দিবানাথ আমেরিকায় পাড়ি জমান। দীর্ঘ ২২ বছরের যন্ত্রণাদায়ক দাম্পত্যজীবনের অবসান হয় সুচিত্রা সেনের ২৯ নভেম্বর ১৯৬৯ সালে দিবানাথের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে। ১৯৭৮ সালে “প্রণয় পাশা” মুক্তির পর তিনি চলে যান লোকচক্ষুর অন্তরালে।

মহানায়িকা সুচিত্রা সেন

ব্যক্তিজীবনে উত্তম-সুচিত্রা খুব কাছাকাছি ছিলেন। উত্তকুমারের সঙ্গে যে ৩০টি ছবি করেছেন তাতে সুচিত্রা-উত্তম জুটির রোমান্স এতটাই স্বাভাবিক ও স্বচ্ছন্দ ছিল যে কখনোই তা অভিনয় বলে মনে হয়নি। আর দুজনের এই রসায়নের কারণেই মেয়ে মুনমুন সেন পর্যন্ত একবার মাকে বলেছিলেন, মা তোমার উত্তমকুমারকে বিয়ে করা উচিত ছিল।

শুনে সুচিত্রা শুধু হেসেছিলেন। আসলে সুচিত্রা-উত্তমের মধ্যে যে প্রবল আন্ডারস্ট্যান্ডিং চলচ্চিত্রে রুপ পেয়েছে তা আগে কখনো হয়নি। আর তাই সত্যজিৎ রায় পর্যন্ত বলেছেন, পৃথিবীতে খুব কম জুড়ি আছে যাদের মধ্যে বন্ডটা এত ম্যাজিকাল। তিনি প্রযোজকদের উত্তমকুমারের উপরে তার নাম লিখতে বাধ্য করেছিলেন। সকলে সেটা মেনেও নিয়েছিল।

আর তাই উত্তম-সুচিত্রা জুটি না হয়ে হয়েছিল সুচিত্রা-উত্তম জুটি। তবে উত্তম কুমারের মৃত্যু সুচিত্রার মনোজগতে এক আলোড়ন তুলেছিলো। ১৯৮০ সালের ২৪শে জুলাই হঠাৎ মারা গেলেন উত্তম কুমার। গভীর রাতে শহর যখন নীরব, সবাই যখন প্রিয় মহানায়ককে শেষ বিদায় জানিয়ে ঘরে ফিরে এসেছে, তখন নিভৃতে দেখা করতে গেলেন সুচিত্রা।

ভবানীপুরে উত্তম কুমারের পৈতৃক বাড়িতে গিয়ে ছবিতে মালা পরিয়ে শেষ সাক্ষাৎটুকু করলেন। সেবার সুচিত্রা উত্তমের মুখ অবয়ব ছুঁয়েই বাড়ি ত্যাগ করেন। সুচিত্রার এই ব্যথিত মন তাকে সবার থেকে আড়াল করে। আবার অনেকে বলেন, দীক্ষাগুরুর মৃত্যুর পর তিনি লোক চক্ষুর আড়ালে চলে যান।

২০১৩ সালে বেশি অসুস্থ হয়ে পড়ার পর আবার আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেন সুচিত্রা। এবং ২০১৪ সালের ১৭ জানুয়ারি ভারতীয় সময় সকাল ৮টা ২৫ মিনিট নাগাদ কলকাতার বেল ভিউ হাসপাতালে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে সুচিত্রা সেনের মৃত্যু হয়।

সুচিত্রা চলে গিয়েছেন, রেখে গিয়েছেন তার অনবদ্য অভিনয়, মনভোলানো হাসি আর বাংলা সিনেমার স্বর্ণময় অধ্যায়। এভাবেই আমাদের কাছে চির অম্লান হয়ে থাকবেন আমাদের রমা, আমাদের সুচিত্রা।

About the author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Latest Posts

  • সর্দি থেকে মুক্তির উপায়, নাকের এলার্জি দূর করার উপায় | দ্রুত উপশম পেতে ঘরোয়া চিকিৎসা

    সর্দি থেকে মুক্তির উপায়, নাকের এলার্জি দূর করার উপায় | দ্রুত উপশম পেতে ঘরোয়া চিকিৎসা

    নাকের এলার্জি হচ্ছে নাকের ঝিল্লি প্রদাহের কারণে নাকের একটি সমস্যা। এটি সারা বিশ্বব্যাপী একটি স্বাস্থ্য সমস্যা। বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় ২০ থেকে ২৫ শতাংশ নাকের এই রোগে আক্রান্ত। নাকের এলার্জি কোন মারাত্মক ক্ষতিকর রোগ না হলেও এ রোগের কারণে দৈনন্দিন জীবন প্রবাহ ব্যাহত হয়। এলার্জিজনিত সর্দি এবং হাঁচি জীবনকে অতিষ্ট করে তোলে। এই রোগে হঠাৎ…

    Read more

  • কফ, কাশি দূর করার উপায় | সঠিক চিকিৎসাই হতে পারে কাশি দূরীকরণের মাধ্যম

    কফ, কাশি দূর করার উপায় | সঠিক চিকিৎসাই হতে পারে কাশি দূরীকরণের মাধ্যম

    গলায় বুকে কফ জমে থাকা বেশ বিরক্তিকর একটি সমস্যা। ঋতু পরিবর্তনের ফলে আবহাওয়া পরিবর্তন হয়। আর আবহাওয়ার এই দ্রুত পরিবর্তন আমাদের শরীর খাপ খাওয়াতে পারে না, যার কারণে সৃষ্টি হয় ঠান্ডা জ্বর ও সর্দি-কাশির। ঠান্ডা সর্দি কাশি এগুলো আমাদের কাছে খুব পরিচিত রোগ হলেও এই ঠান্ডা সর্দি কাশি থেকে আমাদের দেহে অনেক বড় বড় অসুখ…

    Read more

  • ওজন কমানোর উপায় ডায়েট চার্ট | সুস্থ স্বাভাবিক জীবন

    ওজন কমানোর উপায় ডায়েট চার্ট | সুস্থ স্বাভাবিক জীবন

    সুস্থ স্বাভাবিক এবং রোগমুক্ত জীবন আমরা কে না চাই। আর এই সুস্থ সুন্দর জীবন যাপন করার একমাত্র উপায় হচ্ছে শারীরিক ওজন ঠিক রাখা। কেননা ওজন বেড়ে গেলে যে কোন রোগের ঝুঁকি ও বেড়ে যায়। এজন্য বাড়তি ওজন অনেকের মানসিক অসুস্থির প্রধান কারণ। তাই রোগ প্রকোপ কমাতে এবং মানসিক শান্তির উদ্দেশ্যে আমাদের সকলের উচিত শারীরিক ওজন…

    Read more