তারেক মাসুদ : গতানুগতিক ধারার বিপরীতে বাংলাদেশের একজন চলচ্চিত্র পরিচালক

Published:

Updated:

চলচ্চিত্র পরিচালক তারেক মাসুদ

Disclaimer

As an affiliate, we may earn a commission from qualifying purchases. We get commissions for purchases made through links on this website from Amazon and other third parties.

বাংলাদেশের চলচ্চিত্র জগতে নতুন ধারার চলচ্চিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে আলোচিত নাম যার, তিনি হলেন তারেক মাসুদ। গতানুগতিক বাণিজ্যিক ধারার বাইরে গিয়ে তিনি সিনেমার পর্দায় নিয়ে এসেছেন মানুষের জীবনে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন বাস্তব ঘটনা এবং দ্বন্দ্ব সংঘাতের গল্প।

জাতীয় আত্মপরিচয়, লোকজ ধর্ম ও সংস্কৃতির পাশাপাশি দেশের সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় নানা অসঙ্গতি তার সিনেমায় ফুটে উঠত নিখুঁতভাবে।

তারেক একাধারে একজন বাংলাদেশী চলচ্চিত্র পরিচালক, প্রযোজক, চিত্রনাট্যকার, লেখক এবং গীতিকার। চলচ্চিত্র জগতের এমন কোনো বিভাগ নেই যেখানে তিনি তার প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেননি। অন্য ধারার সিনেমা নির্মাণ করে তিনি বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকে নিয়ে গেছেন আন্তর্জাতিক পর্যায়ে।

২০০২ সালে তার পরিচালিত মাটির ময়না কান চলচ্চিত্র উৎসবে ডিরেক্টরস ফোর্টনাইটসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জন করে। এছাড়া তিনি এ চলচ্চিত্রের জন্য বাংলাদেশের ২৭ তম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের অধীনে শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যকারের পুরস্কার লাভ করেন।

স্বল্পদৈর্ঘ্য, পূর্ণদৈর্ঘ্য, প্রামাণ্যচিত্র ও অ্যানিমেশন মিলিয়ে মাসুদ নির্মাণ করেছেন মোট ১৬টি চলচ্চিত্র। ২০১২ সালে বাংলাদেশ সরকার চলচ্চিত্রে তার অসামান্য অবদানের জন্য তাকে দেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান একুশে পদকে ভূষিত করে।

দীর্ঘ তিন দশক ধরে শুধু সিনেমার জন্য কাজ করে মাসুদের জীবন হয়ে উঠেছিল শুধু সিনেমার। তার মনে চলচ্চিত্র নির্মাণের ভাবনা ছাড়া আর কোনো ভাবনা ছিল না।

আমাদের আজকের আলোচনা স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রকারদের মধ্যে অন্যতম তারেককে নিয়ে, যার নতুন ধারার সিনেমা নির্মাণের সংগ্রাম বাংলাদেশের চলচ্চিত্র জগতে যোগ করেছিল এক নতুন মাত্রা।

চলচ্চিত্র পরিচালক তারেক মাসুদ

তারেক মাসুদের প্রাথমিক জীবন

১৯৫৬ সালের ৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলার ভাঙ্গা উপজেলার নূরপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন চলচ্চিত্র জগতের অন্যতম এই ব্যক্তিত্ব। তার পুরো নাম আবু তারেক মাসুদ। তবে তিনি আ তা মাসুদ নামেও পরিচিত। তার মায়ের নাম নুরুন নাহার মাসুদ ও বাবার নাম মশিউর রহমান মাসুদ।

মাসুদের প্রথম পড়াশোনা শুরু হয় ভাঙ্গা ঈদ্গা মাদ্রাসায়। এরপর ঢাকার লাল বাগের একটি মাদ্রাসা থেকে তিনি মৌলানা পাস করেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পর মাসুদ সাধারণ শিক্ষা অর্জনের জন্য ফরিদপুরের ভাঙ্গা পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন।

এখানে তিনি প্রাইভেট পরীক্ষার মাধ্যমে প্রথম বিভাগে এস.এস.সি পাস করেন। পরবর্তীতে তিনি আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজে ভর্তি হন। কিন্তু সেখানে মাত্র ছয় মাস পড়াশোনা করার পর বদলি হয়ে নটরডেম কলেজে যান এবং মানবিক বিভাগে এইচএসসি পাস করেন।

তারেক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাস বিষয়ে অনার্স ও মাস্টার্স ডিগ্রী অর্জন করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালীন সময়েই তিনি স্বপ্ন দেখতেন বাংলাদেশের চলচ্চিত্র নিয়ে কাজ করার।  প্রায় সময় ঢাকা আর্ট কলেজে তথা বর্তমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে দেখা যেত তাকে।

পাশাপাশি তিনি লেখক শিবির, বাম আন্দোলন এবং বাংলাদেশের চলচ্চিত্র আন্দোলনের সাথে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। আশির দশকের মধ্যভাগে শুরু হয় স্বাধীনধারার চলচ্চিত্র আন্দোলন। মাসুদ ছিলেন এই আন্দোলনের অগ্রগণ্য পরিচালক। এছাড়া তিনি দেশে বিদেশে চলচ্চিত্র বিষয়ক অসংখ্য কর্মশালা এবং কোর্সে অংশগ্রহণ করেন।

বলিউডের ভবিষ্যৎ সুপারস্টার কে?- জানতে ক্লিক করুন

চলচ্চিত্র জীবন

১৯৮২ সালের শেষ দিকে মাসুদ বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ থেকে ফিল্ম অ্যাপ্রিসিয়েশন কোর্স শেষ করেন। এরপর তিনি তার প্রথম প্রামাণ্যচিত্র ‘আদম সুরত’ নির্মাণ শুরু করেন। তার এই প্রামাণ্যচিত্রটি ছিল প্রখ্যাত বাংলাদেশী শিল্পী এস এম সুলতানের জীবনের উপর।

১৯৮৯ সালে মুক্তি পাওয়া আদম সুরত নির্মাণ করতে মাসুদের সময় লেগেছিল প্রায় ৭ বছর। তবে আদম সুরতের আগেই ১৯৮৫ সালে মুক্তি পায় তার পরিচালিত প্রথম স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘সোনার বেড়ি’।

১৯৯৫ সালে তারেক এবং তার স্ত্রী ক্যাথরিন মাসুদ মিলে নির্মাণ করেন ‘মুক্তির গান’। মুক্তিযুদ্ধের ফুটেজনির্ভর এই প্রামাণ্যচিত্রটি মূলত স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় সংগঠিত ‘বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রামী শিল্পী সংস্থা’ নামের ভ্রাম্যমাণ গানের দলকে নিয়ে। যারা গানের মাধ্যমে বাঙালি জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ করতেন মুক্তিযোদ্ধোদের।

তারেক ও ক্যাথরিন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় মার্কিন চলচ্চিত্র নির্মাতা লিয়ার লেভিনের ক্যামেরাবন্দী করা ২০ ঘন্টার একটি ফুটেজ সংগ্রহ করেন। একটি পূর্ণাঙ্গ চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য লেভিনের ফুটেজের সাথে বিভিন্ন উৎস থেকে সংগৃহীত মুক্তিযুদ্ধের অন্যান্য উপাদান একত্র করে তারা নির্মাণ করেন মুক্তির গান।

যা তাকে বংলাদেশের চলচ্চিত্র অঙ্গনে এনে দিয়েছিল ব্যাপক পরিচিতি। ‘মুক্তির গান’ ১৯ তম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে শ্রেষ্ঠ প্রামাণ্যচিত্রের পুরস্কার লাভ করে। বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক জহির রায়হানের ‘স্টপ জেনোসাইড’ এর পর মাসুদের ‘মুক্তির গান’ প্রামাণ্যচিত্রটিই মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম প্রামাণ্য দলিল হিসেবে পরিচিত।

১৯৯৭ সালে ফিল্ম সাউথ এশিয়া থেকে মুক্তির গান বিশেষ সম্মাননা অর্জন করে। সেসময় মুক্তির গান প্রামাণ্যচিত্রটি সারা দেশে বিকল্প পরিবেশনায় প্রদর্শন করা হয়।

এই চলচ্চিত্র দেখে ১৯৯৮ সালে সাধারণ মানুষের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ব্যক্ত প্রতিক্রিয়ার ভিত্তিতে তারেক নির্মাণ করেন ‘মুক্তির কথা’ নামের একটি ভিডিও চলচ্চিত্র।

২০০২ সালে মাসুদের পরিচালনায় মুক্তি পায় তার প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘মাটির ময়না’। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রাক্বালে পূর্ব পাকিস্তানের উদ্বেগের পটভূমিতে মাসুদ তার মাদ্রাসা জীবনের অভিজ্ঞতা ফুটিয়ে তুলেছেন এই চলচ্চিত্রে।

মাটির ময়না এডিনবার্গ, মন্ট্রিল, কায়রো সহ বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হয়। বাংলা সিনেমা হিসেবে বিদেশী ভাষার চলচ্চিত্রে অস্কারের জন্য এই ছবিটি প্রথম মনোনয়ন পায়।

এছাড়া কান চলচ্চিত্র উৎসবে মাটির ময়না ফিপ্রেস্কি আন্তর্জাতিক সমালোচক পুরস্কার অর্জন করে। এবং ২০০৩ সালে এটি করাচি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে সেরা ছবির পুরস্কার লাভ করে।

চলচ্চিত্র পরিচালক তারেক মাসুদ

২০০৬ সালে তারেক নির্মাণ করেন প্রথম ডিজিটাল চলচ্চিত্র ‘অন্তর্যাত্রা’। এই ছবিতে দুই প্রজন্মের মধ্য দিয়ে তিনি দেশত্যাগ, উদ্বাস্তু দশা আর দেশে ফেরার অনুভূতি কে তুলে ধরেছেন নিখুঁতভাবে।

২০০৮ সালে মাসুদ ‘রানওয়ে’র নির্মাণ কাজ শুরু করেন। ‘রানওয়ে’ চলচ্চিত্রের কাহিনী ছিল সমসাময়িক বাংলাদেশের বিভিন্ন ঘটনা নিয়ে। এটি ছিল মাসুদের নির্মিত শেষ পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র। ২০১০ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত রানওয়ের জন্য তিনি মেরিল প্রথম আলো সমালোচক পুরস্কার লাভ করেন।

২০০৯ সালে বের হয় তারেক ও ক্যাথরিনের স্বল্পদৈর্ঘ্যের থ্রিলার ছবি ‘নরসুন্দর’। মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে তৈরি ১৫ মিনিট দৈর্ঘ্যের ‘নরসুন্দর’ একটি উর্দু ভাষার চলচ্চিত্র।

মাসুদের অসম্পূর্ণ চলচ্চিত্র কাগজের ফুল এর বিষয়বিস্তু ছিল ১৯৪৭ সালের দেশবিভাগ নিয়ে। এটি ছিল মাটির ময়নার পূর্ববর্তী পর্ব। ২০১১ সালের ১৩ ই আগস্ট তারেক তার কাগজের ফুল চলচ্চিত্রের শ্যুটিংস্পট নির্বাচন করে ফেরার পথে মানিকগঞ্জের ঘিওরে এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন।

ব্যক্তিগত জীবন

তারেকের পরিবারে রয়েছে তার স্ত্রী ক্যাথরিন মাসুদ, তাদের ছেলে বিংহাম পুত্রা মাসুদ নিশাদ এবং তার ছোট ভাই নাহিদ মাসুদ। ক্যাথরিন এবং তারেক ঢাকায় অডিও ভিশন নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন। চলচ্চিত্র নির্মাণ ছাড়া মাসুদের আগ্রহের বিষয় ছিল লোকসঙ্গীত এবং লোকজ ধারা।

চলচ্চিত্রকার তারেক তার সিনেমায় সাধারণ মানুষের জীবনের গল্পকে তুলে ধরবেন বলে অন্যান্য চলচ্চিত্রকারের মত বাণিজ্যিক ধারায় সিনেমা তৈরিতে ব্যস্ত হননি। তার নির্মিত চলচ্চিত্রের সংখ্যা খুব বেশি না হলেও, তিনি তার কাজের মধ্য দিয়ে সিনেমাপ্রেমীদের মনে বেঁচে থাকবেন সবসময়। 

About the author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Latest Posts

  • সর্দি থেকে মুক্তির উপায়, নাকের এলার্জি দূর করার উপায় | দ্রুত উপশম পেতে ঘরোয়া চিকিৎসা

    সর্দি থেকে মুক্তির উপায়, নাকের এলার্জি দূর করার উপায় | দ্রুত উপশম পেতে ঘরোয়া চিকিৎসা

    নাকের এলার্জি হচ্ছে নাকের ঝিল্লি প্রদাহের কারণে নাকের একটি সমস্যা। এটি সারা বিশ্বব্যাপী একটি স্বাস্থ্য সমস্যা। বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় ২০ থেকে ২৫ শতাংশ নাকের এই রোগে আক্রান্ত। নাকের এলার্জি কোন মারাত্মক ক্ষতিকর রোগ না হলেও এ রোগের কারণে দৈনন্দিন জীবন প্রবাহ ব্যাহত হয়। এলার্জিজনিত সর্দি এবং হাঁচি জীবনকে অতিষ্ট করে তোলে। এই রোগে হঠাৎ…

    Read more

  • কফ, কাশি দূর করার উপায় | সঠিক চিকিৎসাই হতে পারে কাশি দূরীকরণের মাধ্যম

    কফ, কাশি দূর করার উপায় | সঠিক চিকিৎসাই হতে পারে কাশি দূরীকরণের মাধ্যম

    গলায় বুকে কফ জমে থাকা বেশ বিরক্তিকর একটি সমস্যা। ঋতু পরিবর্তনের ফলে আবহাওয়া পরিবর্তন হয়। আর আবহাওয়ার এই দ্রুত পরিবর্তন আমাদের শরীর খাপ খাওয়াতে পারে না, যার কারণে সৃষ্টি হয় ঠান্ডা জ্বর ও সর্দি-কাশির। ঠান্ডা সর্দি কাশি এগুলো আমাদের কাছে খুব পরিচিত রোগ হলেও এই ঠান্ডা সর্দি কাশি থেকে আমাদের দেহে অনেক বড় বড় অসুখ…

    Read more

  • ওজন কমানোর উপায় ডায়েট চার্ট | সুস্থ স্বাভাবিক জীবন

    ওজন কমানোর উপায় ডায়েট চার্ট | সুস্থ স্বাভাবিক জীবন

    সুস্থ স্বাভাবিক এবং রোগমুক্ত জীবন আমরা কে না চাই। আর এই সুস্থ সুন্দর জীবন যাপন করার একমাত্র উপায় হচ্ছে শারীরিক ওজন ঠিক রাখা। কেননা ওজন বেড়ে গেলে যে কোন রোগের ঝুঁকি ও বেড়ে যায়। এজন্য বাড়তি ওজন অনেকের মানসিক অসুস্থির প্রধান কারণ। তাই রোগ প্রকোপ কমাতে এবং মানসিক শান্তির উদ্দেশ্যে আমাদের সকলের উচিত শারীরিক ওজন…

    Read more