দেশভাগ নাকি সম্পর্কের টানাপোড়েন | নীলকন্ঠ পাখির খোঁজে

Published:

Updated:

নীলকন্ঠ পাখির খোঁজে

Disclaimer

As an affiliate, we may earn a commission from qualifying purchases. We get commissions for purchases made through links on this website from Amazon and other third parties.

নীলকন্ঠ পাখির খোঁজে: 

দেশভাগ নাকি সম্পর্কের টানাপোড়েন?

শৌনক দত্ত


 
পৌরানিক কাহিনী পড়তে গিয়ে দেখি সমুদ্র মন্থন করে অমৃত পেতে হলে বিষ শুষে নিতে হবে কাউকে, কে সেই বিষ পান করবে? শিব সেই বিষ তার কন্ঠে ধারন করেছিলেন, তারপর থেকে শিব নীলকন্ঠ নামে পরিচিত।
 
কোচবিহার রাজবাড়ীর দুর্গাপূজায় দশমীর দিন দেবীবাড়ীতে নীলকন্ঠ পাখি ওড়ানোর দিনগুলোতে নীলকন্ঠকে দেখি পাখির আদলে। আরো পরে বাড়ীর বইগুলোয় দেখি, সেই মিথ সেই পাখি আদল বদলে নিখোঁজ হয়ে বসে আছে। হাত ভরে ওঠে নীলকন্ঠ পাখির খোঁজে!
 
অতীন বন্দোপাধ্যায়ের “নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে” দেশভাগের বিষ উপাখ্যান হয়ে পরিচিত হলেও আমার কাছে তা চিরচেনা মানুষ এবং তার সম্পর্কের বয়ান। দেশ কাল ছাড়িয়ে কতগুলো সম্পর্কের যাপন দেশভাগের লেবাসে, বারবার কেন জানি মনে হয়, দেশ নামের ভূমন্ডল ঘিরে নানারঙের মানবিক সম্পর্কগুলোর ট্রাজেডি নিয়েই তার বিস্তার। আর বাস্তবিক দিক থেকেও দেশ তো দিন শেষে কতগুলো মানুষ, সমাজ, পরিবেশ নিয়ে আকূল সম্পর্কই!
 
এই যে বড়কর্তা, যিনি তার হারিয়ে যাওয়া পলিন ও ভালবাসার কাছে ঋণী, গোটা জীবনটা যিনি পথ চেয়ে কাটিয়ে দেবেন। যার গাৎচোরেৎশালা উচ্চারন জীবন, জিজ্ঞাসা, সময়, দেশকাল সবকিছুকে ছাপিয়ে এক মানবিক স্বীকারোক্তি- বেঁচে আছি।
 
সোনা চরিত্রটি যেন একটি স্বপ্নের ঘোর কিংবা দেশ ও সম্পর্কের আগামী ভবিতব্য। মানুষের কষ্টকর জীবনের কথা যেভাবে বলা হয়েছে তার সাথে নিপুনভাবে জুড়ে দেয়া হয়েছে বৈভব কিন্তু অন্তমিলে মানুষ ও তার মাঝে বেড়ে ওঠা গাছপালা, পশুপাখি আর প্রকৃতির কথাই মানবিক রূপ ছাড়িয়ে অরূপের আনন্দ, বেদনা পার করে অপার বিস্ময়ে মিশে যায় অর্জুন গাছের বাকলে লেখা কষ্টগাঁথায়। আর এখানেই বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে সম্পর্কের নীলকন্ঠ কিংবা নীলকন্ঠ পাখির খোঁজ।
 
একটি দেশের জনগন যেমন ধর্ম বর্ণের ঊর্ধ্বে সরলতায় সহবস্থানে বিশ্বাস করে, সম্পর্কে এই মানুষগুলোই হয় নিবেদিত প্রাণ আর তা যেন ফুটে ওঠে ঈশমের চরিত্রে। মানুষের গভীরে যে মানুষ থাকে ঈশম সেইজন। অর্জুন গাছের বাকলে লেখাগুলোর সাথে রোজ দেখা চিরচেনা মানুষ ও তার সম্পর্কের মতন জেগে থাকে গভীর অরণ্য!
 
কবরে শুয়ে থাকা চির দুঃখিনী জালালি, শৈশব হারানো তিন বন্ধু সামসুদ্দিন আর রঞ্জিত মালতীকে নিয়ে ছুটছে ধানের শীষ কুড়াতে, শৈশবের মুগ্ধতায় শিশু মনে দেখা দুর্গাপুজোর দিনে অমলা আর কমলা পরী সেজে ঘোড়ার গাড়িতে ঘুরে বেড়ানো, হয়তো কাঁঠাল গাছটার নীচে অপেক্ষারত ফতিমা তার প্রিয় সোনা ঠাকুর আসবে বিশ্বাসে অপেক্ষা করে, তারপর ওরা ছুটবে ধান খেতের আল ধরে।
 
দেশকাল ছাপিয়ে এইগুলো সম্পর্ক কি চিরদিনের নয়? সম্পর্কগুলোর ট্রাজিডিক বিস্তার কি হরহামেশা দেখা যায় না আজো? আজো কি কোন কোন ঘরে উকিঁ দিলে চোখে পড়ে না যেখানে বড় বৌমণি ঠাকুর বাড়িতে সন্ধ্যায় ধুপ দেয় আর ধন বৌ গেছেন রান্নার আয়োজনে।
 
এখনো তো রটে যায় ভাওতা বাজি যেভাবে স্থির হয়ে আছে ফকিরসাবের কিংবদন্তি বনে যাওয়া দেহটা, এখনো তো চোখে পড়ে কারো আবছায়ায় জুটন বসে আছে চুপচাপ, নরেন দাস এখনো বেঁচে আছে একটা শূন্য দৃষ্টি নিয়ে, আবেদালি এখনো কাঁদে তার কুলাঙ্গার ছেলের অসভ্য নষ্ট কাজের জন্য, আন্নুকে এখনো সন্দেহ করে ফেলু আর তার পঙ্গু হাতটা নিয়ে বিড়বিড় করে বলে উঠে – হালার কাউয়া…
 
সেই মাঠ, পাটক্ষেত, চারিদিকে সবুজ ধান আর নদীর জীবনে মানুষগুলির জীবন সংগ্রামের পাশে অর্জুনগাছ কি কেবলই মহাবৃক্ষ নাকি তার চেয়েও বেশি কিছু? সোনার অন্ধ ঠাকুরদার রঙিন সময় থেকে ফিকে হতে হতে দৃষ্টিহীন সময়েরও ঐতিহাসিক দলিল হয়ে থাকলো সেই গাছ। এই গাছের কাছেই রাখা আছে অভিমান, দাঙ্গা, সম্পর্কের টানাপোড়েন।
 
সোনা দেখল এক সকালে কিছু মানুষজন এসে ঘরগুলির ওপর উঠে টিনের স্ক্রু খুলে নিচ্ছে। আর টিনগুলো রাখছে আলাদা করে। সোনা একা হয়ে যাচ্ছে। তখন অর্জুন গাছটা তাকে বার বার হাতছানি দিচ্ছে। ঘর ভাঙা হচ্ছে বলেই গরীব মানুষজন ভীড় করে আসছে। টুকটাক জিনিসপত্র কুড়িয়ে নিচ্ছে। কিন্তু ঈশম আবার সেসব ফিরিয়ে আনছে।
 
সোনাদের নৌকা যখন চলতে শুরু করেছে, কর্তার কথা অমান্য করে ঈশম হাঁটছে, সে জানে সেই বিন্দু বিন্দু নৌকা থেকে এখনও কেউ একজন দেখছে। যতক্ষণ দেখা যায় দেখছে।
 
সেতো লিখে গেছে তার প্রাণের হাহাকার অর্জুন গাছের কাণ্ডে। যেন আবার তাদের ডাক দিলে ফিরে আসবে। রয়ে গেলো দেশ ছাপিয়েও একজন জ্যাঠা মশাইকে ছেড়ে যাবার চেয়েও বড় একটি সন্ধান, সে নীলকন্ঠ পাখির খোঁজে সোনা মহাবৃক্ষ অর্জুন গাছের বাকলে লিখে গেল, “জ্যাঠা মশাই আমরা হিন্দুস্তানে চলিয়া গিয়াছি। ইতি-সোনা।
 
কোন মানুষকে না বলে মহাবৃক্ষে লিখে যাওয়া কথাগুলো মানুষের বেদনা নিয়ে বেঁচে থাকে আর আমরা আবিষ্কার করি মানুষ মূলত মিলনে বিশ্বাসী। মানুষ সম্পর্কে বাঁচে।
 
 
বিকাল, বাসা
২০ জানুয়ারি, ২০১৯
 
 

About the author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Latest Posts

  • সর্দি থেকে মুক্তির উপায়, নাকের এলার্জি দূর করার উপায় | দ্রুত উপশম পেতে ঘরোয়া চিকিৎসা

    সর্দি থেকে মুক্তির উপায়, নাকের এলার্জি দূর করার উপায় | দ্রুত উপশম পেতে ঘরোয়া চিকিৎসা

    নাকের এলার্জি হচ্ছে নাকের ঝিল্লি প্রদাহের কারণে নাকের একটি সমস্যা। এটি সারা বিশ্বব্যাপী একটি স্বাস্থ্য সমস্যা। বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় ২০ থেকে ২৫ শতাংশ নাকের এই রোগে আক্রান্ত। নাকের এলার্জি কোন মারাত্মক ক্ষতিকর রোগ না হলেও এ রোগের কারণে দৈনন্দিন জীবন প্রবাহ ব্যাহত হয়। এলার্জিজনিত সর্দি এবং হাঁচি জীবনকে অতিষ্ট করে তোলে। এই রোগে হঠাৎ…

    Read more

  • কফ, কাশি দূর করার উপায় | সঠিক চিকিৎসাই হতে পারে কাশি দূরীকরণের মাধ্যম

    কফ, কাশি দূর করার উপায় | সঠিক চিকিৎসাই হতে পারে কাশি দূরীকরণের মাধ্যম

    গলায় বুকে কফ জমে থাকা বেশ বিরক্তিকর একটি সমস্যা। ঋতু পরিবর্তনের ফলে আবহাওয়া পরিবর্তন হয়। আর আবহাওয়ার এই দ্রুত পরিবর্তন আমাদের শরীর খাপ খাওয়াতে পারে না, যার কারণে সৃষ্টি হয় ঠান্ডা জ্বর ও সর্দি-কাশির। ঠান্ডা সর্দি কাশি এগুলো আমাদের কাছে খুব পরিচিত রোগ হলেও এই ঠান্ডা সর্দি কাশি থেকে আমাদের দেহে অনেক বড় বড় অসুখ…

    Read more

  • ওজন কমানোর উপায় ডায়েট চার্ট | সুস্থ স্বাভাবিক জীবন

    ওজন কমানোর উপায় ডায়েট চার্ট | সুস্থ স্বাভাবিক জীবন

    সুস্থ স্বাভাবিক এবং রোগমুক্ত জীবন আমরা কে না চাই। আর এই সুস্থ সুন্দর জীবন যাপন করার একমাত্র উপায় হচ্ছে শারীরিক ওজন ঠিক রাখা। কেননা ওজন বেড়ে গেলে যে কোন রোগের ঝুঁকি ও বেড়ে যায়। এজন্য বাড়তি ওজন অনেকের মানসিক অসুস্থির প্রধান কারণ। তাই রোগ প্রকোপ কমাতে এবং মানসিক শান্তির উদ্দেশ্যে আমাদের সকলের উচিত শারীরিক ওজন…

    Read more