কাচবন্দি সিম্ফনির শব্দ পুকুরে ডুব | মাহরীন ফেরদৌসের নতুন বই

কাচবন্দি সিম্ফনি

কাচবন্দি সিম্ফনি | মাহরীন ফেরদৌসের নতুন বই:

কাচবন্দি সিম্ফনির শব্দ পুকুরে ডুব

মোস্তাফিজুর রহমান শুভ


সাহিত্যের সকল মাধ্যমের মাঝে কবিতাকে যদি প্রাচীন এবং কঠিনতম মাধ্যম ধরা হয়ে থাকে, তাহলে তার পরপরই ছোটগল্প স্থান পাবে। ছোটগল্প যুগে যুগে সময়ের সাথে ক্রমশই হচ্ছে আধুনিক এবং একইসাথে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। সব ছোটগল্পকে তাই গল্প বলা গেলেও সব গল্পমাত্রই হয়ত ছোটগল্প না।

জীবনের নানা অনুভূতি, ঘটনা-দূর্ঘটনা ও অসঙ্গায়িত আখ্যানকে নতুন রূপে উপস্থাপনকে ছোটগল্প বলা যেতে পারে। আবার অল্প কথায় অধিক ভাব প্রকাশকেও ছোটগল্প বলা যেতে পারে। এরসাথে ‘শেষ হইয়াও হইল না শেষ’ অনুভূতিটুকুকেও বলা যায় গল্পের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। যা উল্লেখ না করেও অনেক কিছুই বলে দিয়ে যায়। সে কারণেই ছোটগল্পের আবেদন অন্যরকম।

আজ এমন একটি বই নিয়ে বলছি যে বইয়ের লেখকের নাম মনে করিয়ে দেয় তার পূর্বের বইগুলোর কথা। যে বইয়ের শব্দের সাথে আমার চমৎকার কিছু সময় কেটেছে। গল্পের শেষে এসে পুরো গল্পটাই পাঠকের হাতে তুলে দিয়ে তাদেরকে নিজের মত একটি কল্পনার রাজ্য তৈরি করার যে অবাধ স্বাধীনতার সাথে কথা সাহিত্যিক এবং গল্পকার মাহরীন ফেরদৌস আমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন, সেই লেখনীর সূত্র ধরেও লেখাটা শুরু করা যায়।

কোথা থেকে শুরু করি?

আচ্ছা, বাহুল্য বাদ দিয়ে সরাসরি বরং কাচবন্দি সিম্ফনির কাছে চলে যাওয়া যায়। বইটি নিয়েই আজ কথা হোক। বইটি হাতে নিয়েই এর চমৎকার প্রচ্ছদের পর যে বিষয়টি সবার আগে চোখে পড়ে, তা হচ্ছে সূচিপত্রকে তিন অধ্যায়ে ভাগ করা। যা বইটির প্রতি আগ্রহ বাড়িয়ে দেয়।


হারাও
বইয়ের প্রথম অধ্যায় ‘হারাও’। আমিও হারানোর পণ নিয়েই গল্পের পাশে আর শব্দের সাথে হাঁটতে শুরু করেছিলাম। শব্দ কী আমাকে হারাতে সাহায্য করেছিলো বাক্যের পথ বেয়ে? তা না হলে নিজের তৈরি করা একটা জগতের মাঝে দিন কাটানো গল্পের ‘আমি’ কিংবা গল্পকথক ছেলেটি এবং অনেক দূরে কোথাও চলে যাওয়ার কথা ছিল যে কোঁকড়া চুলের প্রজ্ঞা, তাদের সাথে সাথে আমিও কেন স্পাইডার লিলির মৃদুমন্দ ঘ্রাণ পাবো? 

অথবা সেই লাল দেয়ালের সবুজ মানিপ্ল্যান্টে ছেয়ে থাকা জীর্ণ বাড়ি, তাকেই বা কেন দেখতে পাবো ছবির মত? আমি কি গল্পের কেউ? নাকি গল্প আমাকে ততক্ষণে বন্দী করে ফেলেছে? সেই বাড়িটার ছাদ, কয়েক বছর পরে সেই ছাদে বাসাবাঁধা একটা খেয়ালি বিকেল….

আচ্ছা, সেই বিকেলের গল্পটা কেমন হবে? সূর্যের কমলা রঙের আলো কি সেই বিকেলে আনন্দের গল্প লিখবে? নাকি বিমর্ষতায় ডুবে যাওয়া এক বিকেল হয়ে রইবে?

গল্পটা শেষ করে বাইরে বের হওয়ার তাড়া ছিল, কিন্তু আমি বসে রইলাম। কিংবা কে জানে, ঐ বাড়িটার সামনেই হয়তো দাঁড়িয়ে রইলাম তখন। কোন এক বিকেলে এখানে যে গল্প বুনবে সময়, তার অপেক্ষায় হয়তো! অথচ সত্যিই আমার তাড়া ছিল। কিন্তু আমিই কি জানতাম, অনেক আগেই আমি নিজেকে হারিয়ে বসে আছি কাচবন্দি সিম্ফনির ‘হারাও’ অধ্যায়ের ‘নিঝুম বিদায়বেলা’ গল্পের শব্দের কাছে?


ডুব

সেই সন্ধ্যায় আসলে আমার কোন কাজ ছিল না। ঘরে ফেরার তাড়া বা ব্যস্ততাও না। কিন্তু গল্পের ‘আমি’র তাড়া ছিল। ফেরার তাড়া। ব্যস্ততাহীন সেই সন্ধ্যায় কাচবন্দি সিম্ফনির শব্দের পুকুরে ডুব দিতে নেমে কখন যেন বইয়ের পাতায় ভাসতে ভাসতে একতলা এক বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াই। বাড়ির দু’পাশের দেয়ালে শ্যাওলার পুরু আস্তরণ। মরচে পড়া টিনের চালের একটা অংশ হেলে পড়ে আছে। এই বাড়িতে কারো থাকার কথা নয়। তবু যেন কেউ থাকে। আমি যেন একটা পরিবারকে দেখি। পরিবারের ছোট ছেলেটাকে দেখি। দেয়াল ধরে হাঁটতে হাঁটতে বড় হতে দেখি। বয়স বাড়তে দেখি। বাড়িটারও বয়স বাড়ে। তারপর একদিন….নাহ! আর কিছু দেখতে পাই না! শূন্যতা কেমন শ্যাওলার মত ছেয়ে থাকে চারপাশ। বড়িটা কি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে? দীর্ঘ দীর্ঘশ্বাস? এরপর কোন একদিন বড় হয়ে যাওয়া সেই ছোট ছেলেটাকে ফিরতে দেখি। এখন সে ক্লান্ত হতে জানে। জীবন যাপনের জটিলতায়, হিসেবের খাতায় অভিমান জমাতে জানে। কিন্তু বাকিরা কোথায়?

ছেলেটাকে ফিরতে দেখে হয়তো ধুলোর মত শূন্যতাকে ঝেড়ে ফেললো বাড়িটা, কিন্তু সবটুকু কি আর ঝেড়ে ফেলা যায়? আর, সত্যিকার অর্থেই কি আমাদের ফেরা হয়? আমরা কী ফেরার মত করে ফিরতে পারি? 


গল্পের নাম ‘বিষাদের ডাকনাম’। ডুব অধ্যায়ের এই গল্পটা শেষ হতেই আমি এক ধরণের আকুলতা বোধ করি। একটি বাড়ির কাছে ফেরার আকুলতা। যে বাড়ির দেয়ালে দেয়ালে এখনো আমার শৈশবের গল্প আছে, যে বাড়ির বাতাসে এখনো আমার শৈশবের ঘ্রাণ আছে। আর আমার পরিচিত সেই মানুষদের জন্য আকুলতা, যারা এখন অতীত হয়েছে।


বিদায়বেলা

গল্পের নাম ‘চৈতালি সন্ধ্যায় সামরিন ও আমি’। বিদায়বেলা অধ্যায়ের এই গল্পটা নিয়ে যখন বসি তখন বেশ রাত। কিন্তু গল্পের শুরু এক সকাল থেকে। গল্পের ‘আমি’র নাম অনিক। যে এক শীতের সকালে জানতে পারে গত রাতে তার পাশে যে ঘুমিয়েছিলো, সে সামরিন আসলে রাতে বাসায় ছিল না। তার স্ত্রী সামরিন, গত রাতে তার বান্ধবীর বাসায় ছিলো৷ কী অদ্ভুত! তাহলে যে এই বিছানায় ঘুমালো, সে কে ছিল? 

চিন্তায় ছেদ পড়ে যখন কলিংবেল বাজিয়ে আবার সামরিনই ঘরে ঢোকে। অনিক আশায় থাকে তার স্ত্রী তাকে বলবে, রাতে সে বাসায়ই ছিলো। সকালে হয়তো কোন প্রয়োজনে বাইরে গিয়েছিলো। কিন্তু সে এমন কিছু বলে না। অনিকের চিন্তা বাড়ে। সেই চিন্তা বইয়ের পাতা ছেড়ে গুটি গুটি পায়ে কখন যেন আমার ভেতরেও বিস্তৃত হয়। মধ্যরাতে দেয়াল ধরে হেঁটে বেড়ানো কোন টিকিটিকি ডেকে যায় টিক টিক টিক। 

সময় বয়ে যায়। আর সময়ের সাথে বিভাজিত হতে থাকে সামরিন। সামরিন এক, সামরিন দুই, সামরিন তিন…
তবে কি আসল সামরিন বলে কেউ নেই? ছিল না কখনো? অনিক উত্তর খোঁজে। ভুল হলো একটু। শুধু অনিক নয়, আমিও তার সাথে উত্তর খুঁজে চলি। সামরিনকে খুঁজে চলি…

আমার মস্তিষ্কে অজস্র ঘুণপোকা শব্দ করতে থাকে গল্পের সাথে সাথে।

হারাও, ডুব, বিদায় বেলা, এই তিন অধ্যায় মিলিয়ে সর্বমোট ১০টি গল্প আছে কাচবন্দি সিম্ফনিতে। আমি এখানে মাত্র ৩টি গল্প নিয়ে লিখলাম। এই বইয়ের সব থেকে শক্তিশালী গল্প মনে হয়েছে ‘উপহার’ গল্পটিকে। খুব ভিন্নরকমের গল্প, কিন্তু এত বেশি চিন্তার খোরাক জাগায়! আর এতসব চমৎকার বুননের গল্পের মাঝে ‘হেমন্ত’ গল্পটি নিয়ে আমার একটু অতৃপ্তি রয়ে গেছে। এই গল্পটি নিয়ে গল্পকার চাইলে আরও কাজ করতে পারতেন।

এছাড়া প্রতিটি গল্পই আসলে আমাকে মুগ্ধ করেছে। লেখকের সব থেকে বড় সফলতা তিনি শব্দে শব্দে ছবি আঁকতে পেরেছেন। শব্দের সাথে সাথে আমি যেন পরিস্কারভাবে সব চরিত্রকে দেখতে পাচ্ছিলাম। তাদের জীবন যাপন, তাদের আনন্দ, বিষাদ, যাপিত জীবনের জটিলতা…

ছবির মত ভেসে উঠছিলো একের পর এক! আর হ্যাঁ, ঠিক পূর্বের মতই গল্পের শেষে এসে তিনি গল্পগুলো পাঠকের হাতে তুলে দিয়েছেন। পাঠককে দিয়েছেন কল্পনার রাজ্য তৈরির অবাধ স্বাধীনতা।

বইটি সম্পর্কে লেখক বলেন, ‘বন্ধ জানালায় বাধা পেয়ে দেয়ালের আড়ালে বেঁচে থাকা মানুষগুলোর কাছে ছুটে যেতে চায় অসংখ্য গল্প, কখনো না তৈরি হওয়া কোনো সিম্ফনির মতো… ’।

‘কাচবন্দি সিম্ফনি’ পড়তে গিয়ে আক্ষরিক অর্থেই গল্পগুলো ছুটে এসেছে আমার কাছে। আমি হারিয়েছি, কখনো ডুবে গিয়েছি শব্দের মাঝে আর বিদায় বেলায় এসে মনে হয়েছে, লেখক আরো কিছু গল্প রাখলেই পারতেন! আরো কিছুটা সময় না হয় মুগ্ধতায় কাটতো!

এভাবেই শব্দের বুননে আমাদের মুগ্ধ করে রাখুন মাহরীন ফেরদৌস। আপনার চোখ দিয়ে আমাদের প্রবেশ করান অজস্র গল্পজগতে। আমার মতো অনেকেই সেই অপেক্ষায় আছে। আরও থাকবে। আর চমৎকার কিছু সময় উপহার দেয়ার জন্য রইলো ভালোবাসা। কাচবন্দি সিম্ফনির আশ্চর্য্য সুরে মুগ্ধ হোক প্রতিটি পাঠক।


বইয়ের নাম – কাচবন্দি সিম্ফনি
লেখিকা – মাহরীন ফেরদৌস
প্রকাশনী- পেন্সিল পাবলিকেশনস
মূল্য- ১৫০টাকা (ডিসকাউন্টের পর)
বইটি পাওয়া যাবে ঢাকায় ৫৭৩ নাম্বার স্টলে এবং সিলেটে ৫ নাম্বার স্টলে।


এছাড়াও অনলাইনে রকমারিডটকম থেকেও অর্ডার করতে পারেন এই লিংকে ক্লিক করে: 

মাহরীন ফেরদৌসের নতুন বই কাচবন্দি সিম্ফনি 


অভিযাত্রীতে প্রকাশিত জনপ্রিয় লেখক মাহরীন ফেরদৌসের আরও কিছু লেখা পড়ুন: 

মাহরীন ফেরদৌসের গল্প | ভুলে থাকার গল্প

মানুষ শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করতে চায় | ডা. মোস্তফা মোরশেদ আকাশের আত্মহত্যা 

Share this

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top