মারুফ ইমনের ধারাবাহিক উপন্যাস যখন থামবে কোলাহল:
আগের পর্বগুলো পড়তে ক্লিক করুন:
প্রথম কিস্তি | দ্বিতীয় কিস্তি | তৃতীয় কিস্তি | চতুর্থ কিস্তি | পঞ্চম কিস্তি | ষষ্ঠ কিস্তি | সপ্তম কিস্তি | অষ্টম কিস্তি | নবম কিস্তি | দশম কিস্তি | একাদশ কিস্তি | দ্বাদশ কিস্তি | ত্রয়োদশ কিস্তি | চতুর্দশ কিস্তি | পঞ্চদশ কিস্তি | ১৬’শ
যখন থামবে কোলাহল
(১৬’শ কিস্তি)
‘বিয়ার কাজ শেষ হইলো মাঝ রাইতে, কাজী আসতে দেরি হইছিলো ঝড় বৃষ্টিতে। উনার বাড়িতে উঠতেই আব্বা লোক মারফত খবর পাঠাইলেন আমার দাদী মইরা গেছে, আমি শুইনা মাটিতে বইসা পড়লাম। বললাম আমি যাব, কিন্তু পারলাম না। আব্বা আমারে যাইতে মানা করছে, সে একলাই দাফনের কাজে গেছে। দাদীর বয়স হইছিলো অনেক, আশির উপরে, আমি না গেলেও আব্বা গিয়া দেইখা আসতেন মাঝে মাঝে, আমার তার চেহারাও বেশি মনে নাই। আমি যতটা না কষ্ট পাইলাম, তার চেয়ে মনে অয় আমার শ্বশুরবাড়ির মানুষ বেশি ডরাই গেল।’ শরীফা এইটুকু বলে অনিন্দিতার দিকে তাকালো।
‘এখানে ভয় পাবার কি হল, বৃদ্ধ মানুষ মারা যেতেই পারে।’ আমি কিছুটা জোর দিয়ে বললাম।
শরীফা অনিন্দিতা কে বলল, ‘দিদি গো, আমার ছেরা ডারে এট্টু আইনা দিবা? কি জানি করে নিচে..’
অনিন্দিতা বোধহয় বুঝতে পারলো, তার এখন এখানে থাকাটা শরীফা চাচ্ছে না। তার চেহারায় ‘যেতে বাধ্য’ টাইপ একটা ব্যাপার লক্ষ্য করলো সাদাত। অনিন্দিতা যাবার আগে সাদাতের দিকে একবার তাকালো।
শরীফা আবার বলতে শুরু করলো, ‘গাঁও গেরামে বিয়ার দিন মরা মরলে সব দোষ আইসা পরে বউয়ের উপর। আমি মা মরা মাইয়া সেইডা বুঝি নাই। আমার শ্বাশুড়ি সেদিন রাইতে বললেন , অলক্ষণ নাকি আমি সাথে আনছি, কিছু হইতে পারে, তাই আমগো আলাদা থাকতে হইবো। আমরা তাই করলাম। তয় সে আইসা আমারে কইলো, কিছু লাগলে জানাইতে , আর ভয়ের কিছু নাই।’
‘দেখুন, আমাকে আপনি এসব কেন শোনাচ্ছেন, আমি বুঝতে পারছি না।’ সাদাত চেয়ারটায় ঢলে পড়লো। মাথা ব্যথা না হলেও তার বিরক্তি কমে নি।
‘আপনে কি বিয়া করছেন?’ শরীফার ঠোটের কোণায় একটু হাসি
‘নাহ’ সাদাত বলল।
‘বিয়ার রাইতে স্বামী স্ত্রী আলাদা থাকার বিষয় আপনে তাইলে বুঝবেন না। আমি বড় হইছি একলা, মা ছিল না। একদম নতুন একটা ঘরে আমারে রাইখা সবাই চইলা গেল, স্বামীও নাই। মনে হইলো কেউ কবরে রাইখা মাটি চাপা দিয়া চইলা গেছে। আমি সারারাত কান্নাকাটি করলাম। সকালে তারে আর পাইলাম না, গফরগাঁও গেল তেল আনতে। সন্ধার পরে আইলো, তার হাতে সাজগোজের অনেক জিনিস। আমি থাকি শরীর ঢাইকা, এসব দিয়া আমি কি করুম, বুঝলাম না। আমি জানতামও না কেমনে এইসব দিয়া সাজে। সে কইলো, তুমি সাজো আমি দেখুম। সে আমারে জোর কইরা মুখে তুইলা খাওয়াই দিল, কইলো মা মরা মাইয়ারা নাকি অনেক ভাগ্য ভালো হয়। জীবনে পরথম আমি আদর পাইলাম, সারারাত কান্দাকাটি করলাম, এশার পরে মুনাজাত করলাম লম্বা, তার লাইগা মাঝরাতে উইঠা তাহাজ্জুদও পড়লাম। তাহাজ্জুদ নামাযের কথা মাইনসেরে কইতে হয় না, তবু আপনেরে কইলাম।’
সাদাত খেয়াল করলো শরীফাকে একটু বেশীই দূর্বল লাগছে। কত আর বয়স হবে, পঁচিশ ছাব্বিশ। তার কথাবার্তা এখনো তেমন পরিণত না, বাচ্চাদের মত।
‘আপনে মনে হয় আমারে পোলাপান ভাবেন।’শরীফার কথায় চমকে গেল সাদাত। এই মেয়ে ভেতরের কথা বুঝলো কিভাবে।
‘আমি পোলাপানের মত এইটা উনিও বলেন। যাই হোক, আমি অনেকক্ষণ কথা কইলাম। আর দুইটা বইলা চইলা যামু। আমাদের বিয়া হইছে অনেকদিন, তয় এলাকায় আসছি বছর তিনেক। সে আমারে খুব আগলাইয়া রাখে। শ্বাশুড়ির সাথে আমার কোন বিবাদ হয় নাই। আমার স্বামী নাকি কি শুনছে, যে আমি তারে পর কইরা দিছি বিয়ার পর। তাই সে রাগ কইরা ঘর বাড়ি, ব্যবসা সব ছাইড়া এইখানে আসলো। তার রাগ বেশি আমি মানি, তয় সে লোক খারাপ না। একটা মানুষরে কোপাইয়া মারবে এমন মানুষ তো আরো না। আমি পেটে বাচ্চা রাখতে পারি না, দুইটা এর আগে নষ্ট হইছে কয়েক মাস বয়সেই। কতজন কত কথা বলল, সে আমারে এইসব নিয়া কোনদিন কিচ্ছু বলে নাই। আমার আব্বা মরে গেছে গত বছর। সে মেয়ের জামাই না, ছেলের মত সব কাজ করছে। আমার শ্বাশুড়িও আসছিলো, বলছে বাড়িতে ফিরা যাইতে আমাগো। সে বলছে, তার ইচ্ছা নাই।’
সাদাত তার কথা থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘দেখুন। আমি তাকে নিজে দেখেছি..’
শরীফা কান্নাভরা কণ্ঠে বলল, ‘সত্য আপনে কি তারে নিজে কোপাইতে দেখছেন? সে যদি মারতো, তাইলে তো পলাইয়াও যাইতে পারতো, যায় নাই। দেখেন, আমি মামলা মোকাদ্দমা বুঝিনা। তার সাজা হইলে হবে, আমার ক্ষমতা নাই কিছু করার। আমার শ্বাশুড়িও আসছিলেন, তারও বিশ্বাস হয় না। আপনের বাড়িওলা দাদাও তারে খুব ভাল পায়, এইটা সেইটা কাম করায় তারে দিয়া, সেও দেখবেন বিশ্বাস করবনা।’ বলেই কাঁদতে থাকে শরীফা। এর মাঝে অনি চলে আসে, তার কোলে বাচ্চাটা।
শরীফা নিজের চোখ মুছে তাকে কাছে টেনে নেয়। বলে, ‘জানেন, সাত বছর পর আমার পোলা হইছে, তার কি খুশি। সে বলছে, পোলারে অনেক শিক্ষিত করবো। পোলাও বাপ ছাড়া কিছুই বুঝে না। সারাদিন পিছে পিছে থাকে।’ শরীফা কাঁদতে থাকে। তার চোখের জল আর আর্তনাদ পুরনো এই বাড়িটির বারান্দায় একটা হাহাকার নিয়ে আসে যেন।
সাদাত নিজেকে এই অচেনা মেয়েটির সামনে হাত পা বাঁধা এক অসহায় হিসেবে আবিষ্কার করে। তার আর শরীফার অসহায়ত্বে খুব একটা ফারাক নেই। অথবা, কেউ সেটা খুজেঁও না। শুধুমাত্র তেল কিনতে গিয়ে আজগরের সে রাতে যে চরম ভাবের জন্ম, তার পরিণতি হবে নির্মম হত্যায় সেটা গণিতেও খাটেনা। অথচ, মানুষ অজান্তেই কত অংক মেনে জীবন চালায়। সে কিছুতেই বুঝতে পারে না, এমন ঘটনায় মানুষকে কেন ফেলে দেন বিধাতা, যেখানে মানুষের ক্ষমতা নেই সেখানে স্বাভাবিক থাকার। শরীফা আর কিছু না বলে কিছুক্ষণ পর চলে গেল। অনিন্দিতাও কেমন একটা মনমরা ভাব নিয়ে নিচে গেল।
সাদাত কিছু না খেয়েই বিছানায় গা এলিয়ে দিল, এক মিনিটও আর বসে থাকার জো নেই। তার মাথাটা একবার চক্কর দিয়ে উঠলো যেন। বিছানাটা তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরলো। দরজা থেকে একটা ছায়া ঘরের ভেতরে এসেছে। বিকেলের রোদ কমতে শুরু করেছে। সাদাত ঘোলা চোখে দেখলো দরজায় আবার শরীফা এসে দাড়িয়েছে, তার ছেলেটা তাকে ঘেষে পাশেই দাঁড়িয়ে।
অবাক করা ব্যাপার ছেলেটাও মায়ের মত তার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, সেই দৃষ্টি বলছে – আমার বাবা খুন করেনি, তাকে বের হতে দিন, বের হতে দিন। আবার তাকিয়ে তাদের কাউকে দেখতে পেল না সে। তবে, আওয়াজটা ভেসে আসছে। আশ্চর্য ! বাচ্চাটা এতজোরে কিভাবে চিৎকার করছে। কেউ তাকে টেনে দূরে নিয়ে যাচ্ছে কিন্তু আওয়াজটা কমছে না। স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। সারা গায়ে হঠাৎ কেমন শীত শীত লাগছে।
সাদাত হাতের আন্দাজে বিছানার একপাশ থেকে কাঁথাটা টান দিল, না দেখেই গায়ে জড়াতে লাগলো পাগলের মত। কিন্তু লম্বা দিকটা সে ছড়াতে পারছে না পায়ে। শোয়া থেকে এখন উঠতে গেলে যে শক্তি দরকার তাও নেই তার । আস্তে আস্তে চোখের দৃষ্টি হলুদ হয়ে গেল। সাদাত আধঘন্টার মত কাঁপতে কাঁপতে ঘুমিয়ে গেল, গভীর ঘুমে।
একবার যখন চোখ মেললো তখন চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার, তাকিয়ে আকাশ দেখলো। আশপাশে ঝিঝি পোঁকা ডাকছে, তার সমস্ত শরীর ঘামে ভেজা আর কেমন যেন দুলছে, তবে কেউ যেন তার গা মুছিয়ে দিচ্ছে, তাকিয়ে দেখতে ইচ্ছে করছে না, আকাশের দিকেই সাদাতের দৃষ্টি।
ঘরের বিছানায় শুয়ে কিভাবে সে আকাশ দেখছে সেটাও এখন ভাবতে মন চায় না। হয়তো এই তাকিয়ে থাকাটা সারারাত চলতে পারতো। কিন্তু বেশিক্ষণ চেয়ে থাকার আগেই আবার চোখ বুজে এল শীতল একটা বাতাসে। সাদাতের শরীর দুলছে তখনও, যেন তার বিছানাটা যাদুর পালঙ্কের মত উড়ে উড়ে যাচ্ছে। কোথায় যাচ্ছে তাও জানার দরকার নেই তার।
জিনাতের গায়ের চাঁদরটায় দেয়ালের চুন লেগে গেছে। সারারাত দেয়ালে গা লাগিয়ে কখনো বসে, কখনো শুয়ে ছিল। পিঠটাও ব্যথা করছে, তার পায়ের দিকে একটা কাঁথাকে বালিশ বানিয়ে মরার মত ঘুমাচ্ছে আনু। পুরনো সরকারী হাসপাতাল। উপজেলা হাসপাতালগুলো যতটা নোংরা হয় এটা তার চেয়েও অনেক বেশি নোংরা। পাশের বেডে শুয়ে আছে মেয়েটি, নাম ইয়াসমিন। মুখে একটা নল আর হাতে স্যালাইন পুশ করা। কোনরকমে বেঁচে গেছে।
মাইলাম খেয়েছে পাঁচটা, মারাত্নক ঘুমের ওষুধ। কোনরকম ধরাধরি করে নিয়ে আসা হয়েছে। জিনাতকে আসতেই হত, আনু কি মনে করে সাথে সাথে চলে এল। জিনাত ভেবেছিল হয়তো রাতে চলে যাবে, আনু গেল না। এখন মনে হচ্ছে ও থেকে ভালই হয়েছে। ইয়াসমিনের বাবা মা কে খবর দেয়া হয়েছে, তারা তখনই রওনা হয়েছেন লক্ষীপুর থেকে। নানাবাড়ি কাছে বলে এখানে থেকে পড়তো মেয়েটি, আগে নানাবাড়িতেই থাকতো। মাঝে মিরাজের সাথে সম্পর্ক নিয়ে সমস্যার জন্য মেয়েটি হোস্টেলে উঠে।
মিরাজ ওর নানাবাড়ির প্রতিবেশী, ওখানেই নাকি ওদের প্রেম। রাতভর ঘেটে এসব তথ্য যোগাড় করেছে আনু। আনু মেয়েটা যতটা বাঁচাল, তার চেয়েও বেশি বিরক্তিকর। তবু জিনাত তাকে দূর দূর করতে পারে না। মিরাজ এখন সম্ভবত থানায়। আত্নহত্যার চেষ্টা করেছে বলে পুলিশ ঝামেলা করছিলো হাসপাতালে এসে, মিরাজ সামলে নিয়েছে।
সে নিজেও মাঝরাত পর্যন্ত বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল একটানা। আশপাশে কাউকে ভীড়তে দেয় নি এই রুমে। আনুর ধারনা ছেলেটা ইয়াসমিন কে অনেক ভালবাসে, ইয়াসমিনই বুঝতে চায় না। সারারাত কানের কাছে ফিসফিস করে শেষরাতে ঘুমিয়েছে আনু। নিজে ঘুমালেও ঠিকই জিনাতকে জাগিয়ে রেখেছে নাক ডাকার শব্দে। মেয়ে মানুষ নাক ডাকলে এমনিতে কেমন দেখায়, আনুকে আরো বিশ্রী লাগছে। ডাক্তার বলেছে, সকালে একবার এসে দেখে যাবে, আপাতত বিপদ নেই।
জিনাতের চোখে ঘুম, তবে এখানে ঘুমানো যাবে না। মেয়েটার বাবা মা আসলে তারপর হোস্টেলে গিয়ে ঘুমানো যাবে। রুম থেকে বের হতেই একটা ঠাণ্ডা বাতাস তার গায়ে এসে লাগলো। করিডোরে একটা চাপা আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। কেউ যেন দূর থেকে মিছিল করে আসছে। না ঠিক মিছিল নয়, অনেক বিপদের সময় তাড়াতাড়ি করতে মানুষ যেমন অস্থিরতায় কথা বলে তেমন।
দোতলায় দাড়িয়ে নিচে রাখা এম্বুলেন্স আর কয়েকজন কে দেখা যায় আসা যাওয়া করতে। হালকা কুয়াশা আছে। আজ মনে হয় রোদ উঠবে না। জিনাত ভাবলো মেয়েটাকে একবার দেখে ডাক্তারকে আনতে যাওয়া দরকার। এমন সময় একটা চাকাওয়ালা বেডে করে একজন রুগীকে নিয়ে কয়েকজন স্টাফকে ছুটতে দেখা গেল। সাথে দুইজন মহিলা আর একজন পুরুষ। হয়তো রুগীর সাথে এসেছে। পাশের রুমে বেড ঢোকানোর সময় জিনাত রুগীর চেহারাটা একদিক থেকে দেখে দারুন অবাক হল। এ যেন তার অনেক দিনের চেনা মানুষ।
(চলবে)
উপন্যাসের সবগুলো পর্ব একসাথে:
প্রথম কিস্তি | দ্বিতীয় কিস্তি | তৃতীয় কিস্তি | চতুর্থ কিস্তি | পঞ্চম কিস্তি | ষষ্ঠ কিস্তি | সপ্তম কিস্তি | অষ্টম কিস্তি | নবম কিস্তি | দশম কিস্তি | একাদশ কিস্তি | দ্বাদশ কিস্তি | ত্রয়োদশ কিস্তি | চতুর্দশ কিস্তি | পঞ্চদশ কিস্তি | ১৬’শ