ধারাবাহিক উপন্যাস: যখন থামবে কোলাহল | অষ্টম কিস্তি

যখন থামবে কোলাহল অষ্টম

অভিযাত্রী ডট কমে প্রতি বৃহস্পতিবার প্রকাশিত হচ্ছে তরুণ লেখক মারুফ ইমনের ধারাবাহিক উপন্যাস যখন থামবে কোলাহল। আগের পর্বগুলো পড়তে ক্লিক করুন:

মারুফ ইমনের উপন্যাস: যখন থামবে কোলাহল

প্রথম কিস্তিদ্বিতীয় কিস্তি | তৃতীয় কিস্তি চতুর্থ কিস্তি | পঞ্চম কিস্তি | ষষ্ঠ কিস্তি | সপ্তম কিস্তি | অষ্টম কিস্তি


যখন থামবে কোলাহল

(অষ্টম কিস্তি)


সময়মত কেউ ফোন না ধরলে প্রচণ্ড রাগ হয় সফুরা বেগমের। তার মধ্যে জিনাতের বাবা এই সময়টায় সাধারনত ক্ষেত কামলাদের সাথে থাকে বলে মোবাইল দূরে থাকে। তাই ফোনে প্রায় আধঘন্টা ধরে চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু এই মুহূর্তে তাকে সফুরা বেগমের ভীষণ প্রয়োজন, একটা খবর জানানো দরকার। যেসব মহিলার স্বামী ব্যবসা বা অন্যান্য কাজে ব্যস্ত থাকায় সংসারে ভাল খেয়াল রাখতে পারে না, তারা সাধারনত একটা সময় পরে সংসারের অনেক ব্যাপারে সেই স্বামীকে আর কোন সিদ্ধান্ত নিতে দেন না, নিজেই কর্তৃত্ব করেন। সফুরা বেগম সেই শ্রেণীরই। কিন্তু এক্ষেত্রে কোন ঝামেলা হলে তারা স্বামীকে সবার আগে জানান এই ভয়ে যে, পরে জানলে তার খবর আছে। সফুরা জানে সংসারের কোন বিষয়ে জিনাতের বাবা নাক গলাবে না, কিন্তু ঝামেলার কথা না জানালে পরে সফুরার আর বলার কোন রাস্তা থাকবে না। তাই অন্তত ফোনে জানিয়ে রাখা ভাল।

জিনাতকে সকাল থেকে পাওয়া যাচ্ছে না, সকাল না বলে ভোর বলাই ভাল। তার ফোনটাও সে রেখে গেছে। সফুরার ঘুম ভেঙেছে সেই সাতটায়, তখন থেকেই সে রুমে নেই। তিনি এখন আছেন জিনাতের হোস্টেলে। হোস্টেলের সুপারকে বলা হয়েছে, তবে এই ঘটনায় তাকে খুব একটা তৎপর বলে মনে হল না। সফুরা প্রথমে ভেবেছিলেন হয়তো কলেজের কোন কাজে বাইরে গেছে। যদিও কলেজের কাজেও এত ভোরে বের হবার কোন কারন নেই, তখন কলেজের গেটও খুলবে না। সন্দেহ শক্ত হয়, যখন তিনি বুঝতে পারলেন জিনাত তার কাপড়ের ব্যাগটা নিয়েই বেরিয়ে গেছে। পাশের রুমের মেয়েটির নাম আনু, তাকে জিজ্ঞেস করেও জানা গেল না। অথচ তার সাথে এই দুদিনে জিনাতের ভাল অন্তরঙ্গতা দেখেছেন। দুজন বারান্দার মোড়ায় বসে ঘন্টার পর ঘন্টা আড্ডা দেয় নাওয়া খাওয়া ভুলে। কালরাতেও অনেকবার জিনাতকে ডেকে ঘুমাতে আসতে বলে সফুরা নিজেই কখন ঘুমিয়ে গেছেন মনে নেই। এক ঘুমে রাত পার। ইদানিং ঘুমের ওষুধ খেয়ে ভালোই ঘুম হচ্ছে তার। কিন্তু এখন বিকাল তিনটা বেজে গেছে, মেয়ের কোন খোঁজ নেই– এটা তার বাবাকে জানাতে হবে।

আনু তার রুমেই ছিল। সফুরা যখন ওর ঘরে ঢুকলেন তখন সে কাপড় বদলাচ্ছিলো। কোনরকমে সে সালোয়ারটা বুকে ধরেই সফুরার দিকে তাকালো। সফুরা লজ্জা পেয়ে গেল, মুখ ঘুরিয়ে ‘একটু জিনাতের ঘরে আইসো’ বলেই তিনি চলে আসলেন। একটা শব্দ করে মেয়েটার রুমে ঢোকা দরকার ছিল, শত হলেও যুবতী মেয়ে। সফুরার বেশি দুশ্চিন্তা করতে পারেন না, তখন এসব উল্টো পাল্টা কাজ করেন। আনু মিনিট দশেক পরেই জিনাতের ঘরে আসলো। কাল রাতে দুটো পর্যন্ত জিনাতের সাথে আনুর কথা হয়েছে, তার কাছে এমন কিছু মনে হয়নি যে জিনাত এভাবে কাউকে কিছু না বলেই চলে যাবে। জিনাতের সব বান্ধবী আর কলেজে ফোন করা শেষ, সে কোথাও যায়নি। আনু মেয়েটিও খুব চিন্তায় পড়ে গেছে। তার মাথায় কিছুই আসছেনা। হোস্টেলে যে বাকি মেয়েদের সাথে সে খুব একটা মেশে তাও না। সব মেয়েদের থেকে জিনাতকে একটু আলাদাই লাগে। কলেজের জুনিয়র হলেও আনুর সাথে জিনাতের চলাফেরা অনেকটা বন্ধুর মতই। খুব বেশি কলেজ আর হোস্টেলের বাইরেও থাকে না যে কোন জায়গায় খোঁজ নেবার জন্যে বলা যায়।

জিনাতের বাবা আজিমুদ্দিন যখন ফোন দিলেন তখন আসরের আযান হচ্ছে, সাড়ে চারটা বাজে। সফুরা তার কথা শুনেই বুঝলেন, মাত্র ক্ষেত থেকে এসেছেন, গলায় ক্লান্তির জন্য কথা থেমে থেমে বলছেন। ফোন বাড়িতে রেখে গিয়েছিলেন বলে ধরতে পারেননি। সফুরা কিছুটা ভয় নিয়েই বললেন, ‘জিনাতের বাবা, সেতো সকাল থাইকা ঘরে নাই।’

ওপাশ থেকে আজিমুদ্দিনের কথা শোনা গেল, ‘কে ঘরে নাই?’

‘আপনার মেয়ে।’

‘ঘরে নাই বলে সে শুধু আমার মেয়ে হয়ে গেলো? তুমি যে তার সাথে গেছো, সে তোমার মেয়ে না?’

‘এহন কি করব বুঝতেছি না, আপনে কি আসবেন?’ বলতে গিয়ে গলাটা ধরে এলো সফুরার।

‘আমি আসবো না। আমার ধারনা সে দূরে কোথাও যায় নাই। চইলা আসবে, তুমি চিন্তা করোনা। তুমি ইদানিং একটু বেশি চিন্তা কর, সেটা কমাও। আমি এখন ব্যস্ত আছি, কামলারা টাকা নিতে বইসা আছে। সন্ধার দিকে ফোন দিবনি। না আসলে ব্যবস্থা নিবো। রাখলাম।’ বলেই আজিমুদ্দিন ফোন রেখে দিলেন।

সফুরা অবাক হয়ে গেলো। পৃথিবীর খুব কম বাবা আছে মেয়ের নিখোঁজে শুনে এভাবে কথা বলতে পারে। তবে সফুরা তার স্বামীকে চেনেন। আজিমুদ্দিন আসলে সফুরার থেকেও বেশি চিন্তা করবেন এখন মেয়েকে নিয়ে। কামলাদের সব কাজ বাদ দিয়ে হয়তোবা অনেককে ফোন দেয়া শুরু করবেন। গফরগাঁও আজিমুদ্দিনের জীবনের একটা বড় অংশ কেটেছে, তাই অনেক লোকের সাথে তার পরিচয়। তিনি তাদের মাধ্যমে লোক লাগাবেন মেয়েকে খুজঁতে। এমনকি সফুরা দেখেছেন, জিনাত একা হোস্টেলে থাকলেও তিনি অন্য লোকের মাধ্যমে খোঁজখবর নিতেন জিনাতকে না জানিয়েই। সফুরা জিনাতের বিছানায় শুয়ে পড়লেন, তার গা গরম হচ্ছে। আনু মেয়েটাকে ডাকা দরকার। মেয়েটার নিজেরও পরীক্ষা, তাই ঘরে এনে বসিয়ে রাখা যায় না। তার মধ্যে আনুকে ঠিক সুবিধারও মনে হয় না তার কাছে, কেমন যেন অগোছালো আর দায়সারা স্বভাবের। একটা মেয়ে তার সর্বোচ্চ গোপনীয়তার অবলম্বন করে দুটো ব্যাপারে- যখন সে কাপড় বদলায় বা গোসল করে, আরেকটা হল যখন মাসিক হয়। এই মেয়ের হয়তো সে ব্যাপারে আলাদা গুরুত্ব নেই। সফুরা নিজেও এসময় হোস্টেলে ছিলেন, এরশাদের আমলে। তখনও বাইরের মেয়েদের থেকে হোস্টেলে থাকা মেয়েদের তার বরাবরই আলাদা লাগতো। গার্লস হোস্টেল বলেই কাপড় চোপড়ের কোন ঠিক ঠিকানা থাকবেনা এটা তিনি মানতেই পারেন না।

সন্ধা হয়ে গেছে প্রায়। সফুরা টের পেলেন তার শীত লাগছে, চোখের পাতা কাপছে আর ঘরটা ঘোলা লাগছে। ভালোরকম জ্বর যে আসছে তা অনেকটা নিশ্চিত। এসময় আনু ঘরে এলো, তার গায়ে একটা চাঁদর জড়ানো।

‘আন্টি, জিনাত আপু তো মেসেজ দিলো। ঘুমাই ছিলাম তাই আসতে পারি নাই।’ আনু খাটের কাছে এসে বলল।

‘কখন দিছে? সে কই? আসবে কখন?’ বলতে বলতে সফুরা উঠে বসলো খাটে।

আনু কিছু বলার আগেই জিনাত এসে ঢুকলো ঘরে। তার কাধে সেই ব্যাগ, চেহারা কালো হয়ে গিয়েছে আর শুকনো লাগছে।

‘মা, তুমি শুয়ে আছো কেন? কি হইছে?’ জিনাত দ্রুতবেগে ব্যাগটা রেখে সফুরার কাছে খাটে এসে বসলো, তার হাতের তালু ধরে তাকিয়ে রইলো।

‘আমার কিছু হয় নাই। তুমি কিছু না বইলা কই গেছো? সারাদিন কোন খোঁজ নাই।’ সফুরার গলা কাঁপছে, সারাদিন কিছু না খাওয়ার ফলে সে আর শক্তি পাচ্ছে না।

‘মা, আমি তোমাকে রাতেও বলছি আমি কলেজের কয়েকজনের সাথে শীতের কাপড় দিতে যাবো এক জায়গায়। তবু তুমি চিন্তা করে এই হাল করছো?’

‘কখন বললা? আমি… রাতে কখন..’

জিনাত চুপ করে গেল। আনুর দিকে তাকাতেই সে বলল, ‘আমি ঘুমাই ছিলাম, মেসেজ দেখাতে পারি নাই।’

এবার জিনাত কিছুটা রেগে গেলো। ‘মেসেজ তো কিছুক্ষন আগে দিছি, কিন্তু তোমাকেও তো রাতেও বললাম। তুমি তারে বলতে পারতা।’

আনু মাথা নিচু করে ফেললো। এ সময় তার কিছু বলা ঠিক হবে না, চলে যাওয়াই ভালো। কারো দুশ্চিন্তা দেখতে ইদানিং তার ভালোই লাগে। সে জানতো জিনাত কোথায় আছে, মেসেজ দেয়ার সময়ও সে জেগে ছিল, তবু সে কিছু বলেনি।

‘আন্টির মাথায় পানি দিতে হবে আপু, অনেক জ্বর মনে হচ্ছে।’ বলে অপরাধীর মত দাঁড়িয়ে থাকলো সে। সফুরা এখন চুপ করে চোখ বন্ধ করে আছে। জিনাত সফুরার কপালে হাত রাখলো, তার চোখ বেয়ে কয়েক ফোটা জলও গড়িয়ে পড়লো। সে জানে এই মহিলা তাকে অনেক অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে জীবনে, তবু সে তার মা। সবচেয়ে খারাপ মাও হয়তো পৃথিবীর অনেকের চেয়ে বেশি মায়া জমিয়ে রাখে সন্তানের জন্য। সে মায়াতে এক বিন্দু খাঁদ নেই। জিনাত জানে সেও সফুরাকে কত ভালবাসে।

রাত বারোটার দিকে ঘাম দিয়ে সফুরার জ্বর নেমে গেলো। পুরোটা সময় সে একদিকে ফিরে শুয়ে ছিল। জিনাত প্যারাসিটামল খাইয়ে গা হাত পা মুছে দিলো আর আনু মাথায় পানি দিলো। জ্বর নামার পর সফুরার কাপড় বদলে দিলো জিনাত। আনুও পুরোটা সময় পাশেই বসে ছিলো। মাঝে কয়েকবার চোখ খুলে শুধু সফুরা শুধু বলল, ‘আমার কিছু হয় নাই’ আর জিজ্ঞেস করলো, ‘আমাকে রাতে বলছিলা? আমার তো কিছুই মনে নাই।’

আজিমুদ্দিন এর মাঝে বার দুয়েক ফোন দিয়েছিলো। তার কথায় তেমন চিন্তার লেশ পাওয়া গেল না, ফোনে আশপাশের শব্দে মনে হল সে বাড়িতে বেশ আড্ডা জমিয়েছে।

হোস্টেলের পাশের দোকান থেকে গেটের গার্ড দিয়ে জিনাত পরোটা আনালো, সাথে ডিম পোজ আর ফ্লাস্কে করে চিনিছাড়া দুধ চা। রাতে যে সফুরা ভাত খাবে না তা সে জানে। জিনাত তাকে উঠিয়ে খাইয়ে দিলো জোর করে। খাওয়ার পর আরেকটা ঘুমের বড়ি খেয়ে সফুরা ঘুমিয়ে গেলো, রাত তখন এগারোটা। তার মাথার কাছে দেয়ালে ঠেস দিয়ে জিনাত জানালা দিয়ে আকাশে তাকাতেই বিরাট চাঁদটা দেখতে পেল, থালার মত। ভরা জোছনা জিনাতের ভালো লাগে না, ইজ্জতপুর স্টেশনের সেই রাতের কথা মনে পড়ে যায়।


(চলবে)

উপন্যাসের সবগুলো পর্ব একসাথে:

প্রথম কিস্তিদ্বিতীয় কিস্তি | তৃতীয় কিস্তি চতুর্থ কিস্তি | পঞ্চম কিস্তি | ষষ্ঠ কিস্তি | সপ্তম কিস্তি | অষ্টম কিস্তি | নবম কিস্তি

Share this

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top