বিপিএল নিয়ে হতাশা
গতকাল শেষ হয়েছে বিপিএল-২০১৯ এর সিলেট পর্ব। ঢাকায় প্রথম পর্ব এবং সিলেটে দ্বিতীয় পর্ব শেষ হওয়ার পর এবারের বিপিএল নিয়ে পর্যালোচনা করতে গেলে শুধু হতাশ হতে হবে। লেখার পর লেখা শেষ করা যাবে কিন্তু হতাশা ফুরাবে না।
এবারের বিপিএলের প্রচার প্রচারণাও ছিল কম। নির্বাচনের কারণে প্রচার প্রচারণা হয়নি ঠিকমতো বলেছেন বিসিবির কর্তাব্যক্তিরা। বিসিবির সরাসরি নেতৃ্ত্বে এটাই প্রথম আয়োজিত বিপিএল। শুরু হওয়ার আগে কথাবার্তা শুনে মনে হচ্ছিল এবার হয়তো প্রেক্ষাপট পরিবর্তন হবে।
বিপিএল খেলোয়াড়দের তালিকাটা একটু দেখুন
অন্য সব বারের বিপিএল থেকে এবারের বিপিএলের খেলোয়াড় তালিকা দেখলে তালিকা অনেক বেশি সমৃদ্ধ। ডেভিড ওয়ারনার, স্টিভ স্মিথ, এবিডির মতো তারকারা আছেন এবার। আশরাফুলের পাঁচ বছর পর ফেরা। যদিও স্মিথ প্রথম দুই ম্যাচ খেলার পর ইনজুরির কারণে ফেরত গিয়েছেন। এত বেশি তারকা খেলোয়াড়দের কারণে এবার আশা করা হচ্ছিল, খেলা হবে জমজমাট।
হতাশার গল্পটা শুরু করব দেশীয় প্লেয়ারদের ব্যর্থতা নিয়ে। বোলাররা ভালো করছেন। মাশরাফি ১০ উইকেট নিয়ে সবার উপরে। তাসকিন আহমেদ হয়তো নিজেকে আবার ফিরে পাচ্ছেন। স্পিনাররাও ভালো করছেন।
কিন্তু দেশের ব্যাটসম্যানদের হাতে রান নেই। তামিম রান পাচ্ছেন না, জাতীয় দলের ওপেনিং সঙ্গী লিটনও ফ্লপ। যদিও সিলেটে এসে খেলেছেন ৭০ রানের এক ইনিংস। সাব্বিরের কাছে ছিল এবার ফেরার মঞ্চ। সুযোগ নষ্ট করছেন হেলায়। তবু গতদিন ৮৫ করায় রক্ষা। নিজের জাত চিনিয়েছেন এদিন। সৌম্য সরকার যেনো ১০ এর গন্ডি পারই হতে পারছেন না। দল থেকেই তো বাদ পড়লেন। সাকিব সাকিবসুলভ ব্যাটিং করেছেন মাত্র একটি ম্যাচে।
মাহমুদউল্লাহ-র অধিনায়কত্ব বিপিএলের সময় সূর্যের আলোর মতো কিরণ ছড়ায়। এবার মাহমুদউল্লাহ রান তো পাচ্ছেনই না তাঁর উপর দল হারছে। মাঝে মধ্যে ব্যাট ঝলকানি দিলেও ম্যাচ হারছেন। মুশফিক দুইটি ইনিংসে ভালো খেলেছেন। কিন্তু প্রেসার মোমেন্টে গিয়ে আউট হচ্ছেন বারবার। একই ধরনের ভুল করছেন বারবার। শান্ত, নাসির, মোসাদ্দেকরাও ফ্লপ। জুনায়েদ সিদ্দিক, অলক কাপালিরা তরুণদের থেকে ভালো খেলছেন। আফিফ মাত্র এক ম্যাচে ভালো খেলেছেন।
তবে জাতীয় দলের বোলাররা ফাটিয়ে দিচ্ছেন তা বলতে হবে। মেহেদী হাসান মিরাজ, মাহেদী হাসান, নাঈম হাসান কিংবা আলিস ইসলাম, এই তরুণরা আলো কেড়ে নিয়েছেন নিজেদের দিকে।
দেশীয় ব্যাটসম্যানরা ব্যর্থ হচ্ছেন। এর একটি দোষ কি পিচের উপর বর্তায়? টি-টুয়েন্টি চার ছয়ের খেলা কিন্তু রান যেনো ১২০ পার হতে চায় না! অসমান বাউন্স, টার্নিং উইকেট কি আদর্শ উইকেট? দুই একটা ম্যাচ ছাড়া দলের রান ১৫০ এর বেশি হয়নি।
পাওয়ার হিটিংয়ের ব্যাটসম্যানরা ভালো করছেন, বাকিরা ফিকে! বিপিএলের পিচ তৈরি নিয়ে আক্ষেপ তো আজকের নয়। তাহলে পিচের পরিবর্তন হচ্ছে না কেনো? সিলেটে গতদিনে রান হয়েছে দুই ম্যাচ মিলিয়ে ৭৯১! এমন পিচ এর দরকার তো ছিল প্রথম থেকে। তাহলে গামিনি ডি সিলভাকে এত কষ্ট করে রাখার দরকার কি যদি প্রয়োজন মত উইকেট না বানাতে পারেন।
শুধুমাত্র ঢাকার পিচে যে সমস্যা তা নয়। সমস্যা সিলেটের পিচও দেখাচ্ছে। প্রথম ম্যাচে ১২৮ রান চেজ করতে পারল না রাজশাহী কিংস। পরের ম্যাচে মাহেদী জাদুতে সিলেট কুপোকাত। পিচের অবস্থা এত খারাপ যে বল পড়লে পিচে স্পট পড়ে যাচ্ছে। যার মানে ঠিক মতো পরিচর্যা না করলে পরের দিন থেকে র্যাংক টার্নার পিচে পরিণত হবে। যদিও পরবর্তী দিন থেকে পিচের উন্নতি দেখা গিয়েছিল।
শম্বুকগতির খেলা যদি বিপিএলে দর্শক না আসার একটি কারণ হয়, তাহলে দ্বিতীয় কারণটি হবে ভুল সময়ে ম্যাচ অনুষ্ঠিত হওয়া। বছরে একবার ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট হয় সেটাতেও আমাদের অনেক ভুল করতে হবে। কোন দেশের টি-টুয়েন্টি লিগ দুপুর ১২:৩০টায় শুরু হয়? দ্বিতীয় ম্যাচ শুরু হয় বিকেলে যা সন্ধ্যা সাতটা সাড়ে সাতটার মধ্যে শেষ হয়। চাকুরিজীবীরা খেলা দেখবেন কিভাবে? অথবা ছাত্ররা যাদের ক্লাস শুরু হয় ১০-১২টায়। প্রথম ম্যাচ ৪:৩০টায় দিয়ে পরের ম্যাচ যদি ৭:৩০টায় দেওয়া হতো তাহলে দর্শক সমাগম আরো বাড়ত! কি বুঝে এমন সময় কর্তারা নিলেন বেছে তা উনারাই বলতে পারবেন! কিন্তু সিলেট পর্বে হয়েছে একটু বাস্তব জ্ঞান। খেলার সময়গুলো সময়মতোই পড়েছে।
৩৫টি ক্যামেরা আনা হয়েছে। আনা হয়েছে স্পাইডারক্যাম এবং ড্রোন। রিভিউ এর ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। জিং স্টাম্প লাইটসও আনা হয়েছে। কিন্তু কষ্টের ব্যাপার কি জানেন? জিং স্টাম্প আনলেও তা আর লাগানো হয়নি নষ্ট বলে। রিভিউ এর ব্যবস্থা করা হয়েছে কিন্তু স্নিকো কিংবা আলট্রাএজ নেই। হটস্পটের তো আশাই করা যাবে না! একটি ম্যাচে স্টিভ স্মিথের আউট দেওয়া হয়েছে শুধুমাত্র আওয়াজ শুনে। এ যেনো পুরো এক সার্কাস। মাঠ থেকে এখনো টায়ার, পাইপ উঠে আসে। এরকম মাঠ পুরো পৃথিবীতে আর দুইটি নেই। ব্রডকাস্টিং ব্যবস্থার উন্নতি হবে বলে বলা হয়েছিল। কিন্তু সম্প্রচার দেখে মনে হয়, এর মান টিএনপিএল থেকেও খারাপ। গ্রাফিক্সের ভুলের কারণে একই ব্যাটসম্যান দুই প্রান্তে ব্যাটিং করে। খালেদ আহমেদ এর বয়স হয়ে যায় ১১৯।
জিং স্টাম্পস জ্বলা শুরু করেছে সিলেট পর্ব থেকে। একটু উন্নতি তো হলো।
আরেকটি হতাশার নাম ধারাভাষ্য। আতহার আলী খানের ধারাভাষ্য মাঝে মধ্যে বিরক্তি লাগলেও তাঁর ধারাভাষ্য ছাড়া বাংলাদেশের যেকোনো খেলা কিংবা বিপিএল এর খেলা অসম্পূর্ণ লাগে। কিন্তু নবাগত ইশতিয়াক আহমেদ এবং বয়োজ্যেষ্ঠ শামীম চৌধুরী হয় হাসির খোরাক হচ্ছেন কিংবা মাঝে মধ্যে চরম বিরক্ত করছেন। বল ব্যাটে লেগে লং অনে গিয়েছে আর ধারাভাষ্যকার বলে উঠে, ‘বোল্ড’। এজ কিংবা ভুল শট খেললেই যেনো ধারাভাষ্যর কক্ষে ‘আননেসেসারি’ এর বন্যা বয়ে যায়। জেনেরিক ওয়ার্ড বারবার ব্যবহার করা হচ্ছে। টি-টুয়েন্টি খেলাকে আকর্ষণীয় করতে মাঝে মধ্যে ধারাভাষ্য ভালো হওয়া জরুরি। প্রমাণ চাইলে ড্যানি মরিসন, ইয়ান বিশপদের কমেন্ট্রি শুনতে পারেন। মার্ক নিকোলাসের গুরু গম্ভীরতা আর রিচি বেনোর সুযোগ বুঝে টিপ্পনী মারা ধারাভাষ্যই তো ক্রিকেটকে করেছে আরো সেরা।
হতাশার খানিকটা মিটিয়েছেন ড্যানি মরিসন। এখন ধারাভাষ্যে একটু প্রাণ ফিরেছে।
আম্পায়াররা যে এবার ভালো করছেন তা বলা যাবে না। হিসাববিজ্ঞানের পরিপূরক নিয়ম যে খেলার মাঠেও চলে তা ওইদিন জানলাম। এক কথায় বিপিএলকে সার্কাস বানানোর পুরো বন্দোবস্ত করেছে এবার বিসিবি।
সবচেয়ে বেশি দরকার দেশী ব্যাটসম্যানদের ব্যাটে রান আসা। সিলেট, রাজশাহী, খুলনা এই তিন দল তরুণ ক্রিকেটারদের উপর ভরসা করে প্রতিদান পাচ্ছেন না। পরের বার যে আবার পাঁচ বিদেশী খেলানোর দাবি করবে না এই তিন দল তাঁর সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কেননা, আপনার নিজেকে প্রমাণ করার মঞ্চে আপনি যদি নিজেকে প্রমাণ করতে না পারেন তাহলে কেনো আপনাকে সুযোগ দেওয়া হবে?