প্রিয় জয়া আহসান! দেবী সিনেমার পর ‘নিশীথিনী’ আপনাকেই করতে হবে!

দেবী সিনেমায় জয়া আহসান

আপনাকে যদি প্রশ্ন করা হয়, দেবী সিনেমা কেন দেখবেন?

দর্শক সমাজের বড় একটি অংশ বলবেন ছবিটি হুমায়ুন আহমেদের অন্যতম সর্বোচ্চ পাঠকনন্দিত উপন্যাস বা তার সৃষ্ট মিসির আলি সিরিজের প্রথম উপন্যাস দেবীর গল্প অবলম্বনে নির্মিত বলে। দর্শক সমাজের কেউ কেউ বলতে পারেন মিসির আলি এবং সাথে জয়া আহসান ও চঞ্চল চৌধুরী সবাইকে একসাথে এক সেলুলয়েডের পর্দায় পাচ্ছেন বলেই দেবী দেখা উচিত।
দেবী দেখতে যাওয়ার আগে প্রথমত যে কাজটি আপনাকে করতে হবে, উপন্যাসটি পড়া থাকলে তা মাথা থেকে ঝেরে ফেলতে হবে।
সিনেমা আর উপন্যাসের নিজস্ব জগতের তেজ সম্পূর্ণই আলাদা।
তবে মিথ্যা বলব না, দেবী দেখতে বসে আমার মনেও বইয়ের মিসির আলী, রানু বারবার মনের মধ্যে উঁকিঝুঁকি মারছিল বৈকি, কিন্তু সিনেমার ওপেনিং সিন এতই স্ট্রং সিনেমাটিক এলিমেন্টে ভরপুর যে, বই থেকে আমাকে একটানে সিনেমার সিটেই বসিয়ে দিল দেবী।

মিসির আলীকে দেখলাম খুটিয়ে খুটিয়ে! আরে এতো সেই মিসির আলি যাকে মিসির আলি সিরিজের প্রথম উপন্যাস পড়েই কল্পনায় দেখেছিলাম।

আবারও হুমায়ূন স্যার মাথায় চেপে বসল, তার উপন্যাসের শক্তিই মনোজগতে বারবার প্রভাব বিস্তার করতে চায়।
তবে কিছুক্ষণের মধ্যেই পর্দার মিসির আলী আমাকে গ্রাস করা শুরু করল উপন্যাসকে দূরে ঠেলে।

চঞ্চল চৌধুরী যে কোন বয়সের যে কোন চরিত্র কীভাবে রপ্ত করেন এবং কিভাবে ফুটিয়ে তুলেন তা এর আগেও তার অভিনীত মনপুরা, টেলিভিশন, আয়নাবাজিতে দেখে মুগ্ধ হয়েছি।

জয়া আহসানের দেবীতে সিনেমা দেখলাম এক আধ পাগলা এক সাইকোলজির অধ্যাপককে যিনি মুহূর্তে অপরিচিত রানুর অদ্ভুত জগতে নিজেকে জড়িয়ে ফেলছেন পরম মমতায়।

দেবী সিনেমায় চঞ্চল মিসির আলি চরিত্রে
দেবী সিনেমায় চঞ্চল মিসির আলি চরিত্রে

দেবীর রানু যখন মিসির আলির সামনে কথা বলা শুরু করেন তখন থেকেই আমি তার অভিনয় দেখে শিহরিত হচ্ছিলাম ৷ জয়া আহসানের রানু হয়ে ওঠাটা কী সাবলিল। অভিনয়, এক্সপ্রেশন কী সুন্দর! কী শিহরণ জাগানো! এ ছবিতে সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং ক্যারেক্টার ছিল রানু’র। সে একবার স্বাভাবিক থাকে তো পরক্ষণেই অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে। এই যে রূপান্তর, এটা চরিত্রকে নিজের মধ্যে ধারন না করতে পারলে অভিনয় করা অসম্ভব। এই জায়গায় নিজের অন্যতম সেরা কাজটা করে দেখালেন জয়া আহসান। তার চোখের ভাষা, সংলাপ প্রক্ষেপণ, শারীরিক অভিব্যক্তি, সবকিছুই যেন ছিল সেরার চেয়েও সেরা। তিনি যেন জয়া নন, তিনি রানু। হুমায়ূন আহমেদের রানু, অনম বিশ্বাসের রানু। দেবী’র রানু!!

দেবী সিনেমায় জয়া আহসান
দেবী সিনেমায় জয়া আহসান

আলাদা করে চোখে পড়েছে নিলুকে। নিলুর চরিত্রে শবনম ফারিয়া অসাধারণ । ওর সংশয়, দ্বিধা, প্রেমে পড়ার আড়ষ্টতা, নতুন একটু বয়সে-বড় সখীকে পাবার আনন্দ, ছোটবোনের সঙ্গে খুনসুটি এসবে মায়াকাড়া লেগেছে।

আনিস চরিত্রে অনিমেষ আইচ খুব ন্যাচারাল ছিলেন চরিত্র রূপায়নে। তিনি নামকরা নাঠ্যনির্মাতা সবাই জানি, তার যে অসাধারণ অভিনয়ের গুণও রয়েছে তা দেবী দেখার পর অনুভব করবেন।
আর হ্যাঁ, অনিমেষ আইচ কিন্তু মিসির আলি সিরিজের কয়েকটি গল্প নিয়ে খন্ড নাটক বানিয়েছিলেন এবং হুমায়ুন আহমেদ তার সেই নাটক দেখে প্রশংসাও করেছিলন।

ইতিহাসের সেরা ৫টি নিষিদ্ধ চলচ্চিত্র

ইরেশ যাকেরের অভিনয় তার মতোই স্বভাবসুলভ ছিল দেবীতে। ‘আহমেদ সাবেত’ চরিত্রটিকে তিনি ভিন্নমাত্রা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন, আরেকটু দেখার ক্ষুধা তৈরি হতে হতেই শেষ হয়ে যায় চরিত্রটি।

দেবীর অন্যতম চমৎকার দিক হলো বিজিএম (ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক) ও সাউন্ড ডিজাইন। উত্তেজনাকর মুহূর্তগুলোকে আবহ সংগীত যেভাবে এগিয়ে নিয়ে গেছে তা প্রশংসার দাবিদার। কিছু জায়গায় বিজিএম এর ব্যবহার এমন ছিল যে হলশুদ্ধ মানুষ আতকে উঠছিল।

ফটোগ্রাফি আর লাইট ডিজাইনে চেনা বাস্তবতার ভিজ্যুয়ালে অচেনা জগতের ঘোর লাগা শুরু করে। ছবিটির সিনেমাটোগ্রাফি চমৎকার ছিল, এডিটিং এ সময় দেয়া হয়েছে বোঝা গেছে।

নিলুর চরিত্রে শবনম ফারিয়া
নিলুর চরিত্রে শবনম ফারিয়া

অনম বিশ্বাস যে নতুন কিছু করবে প্রথম সিনেমায় সেই আস্থা ছিল।
তার স্টোরি টেলিংয়ের সবচেয়ে সুন্দর জায়গাটা হলো দর্শকের সাথে গল্পটা বেশ কানেক্ট করেছে। অপ্রয়োজনীয় দৃশ্যে তেনা প্যাঁচানো নাই, প্রয়োজনীয় দৃশ্যগুলোই গল্পকে এগিয়ে নিয়েছে সাবলিলভাবে।

ইরাক আমেরিকা যুদ্ধের গোপন কাহিনী নিয়ে সিনেমা গ্রিন জোন

দেবীর প্রমোশনে যে নতুন চমক দেখিয়েছেন তার জন্য দেবী টিমকে সাধুবাদ জানাতেই হয়। পাবলিসিটি ডিজাইন যে একটা সিনেমা রিলিজে কতবড় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তা পরবর্তী অনেক সিনেমার জন্য উদাহরণ হয়ে থাকবে। এজন্যও টুপি খোলা সালাম জয়া আহসানের জন্য।

এত্ত যে ভালো ভালো কথা বলেই গেলাম একটানা, কোথাও কী কোন অতৃপ্তি নেই ?
শেষটায় পরিচালকের কৃপণতা চোখে পরার মত। মনে হচ্ছিল- গল্পটা আরেকটু বড় হলে পূর্নতা পেতো।

অন্যদিকে উপন্যাসটির প্রকাশকাল ১৯৮৫। সেই অাশির দশকের প্রেক্ষাপটেই উপন্যাসটি রচিত।
‘দেবী’ ছবি টি ২০১৮ সালের প্রেক্ষাপটে নির্মিত। হলে থাকা অবস্থায় মনে হচ্ছিল, অাশির দশকে প্রেক্ষাপটে ছবিটি নির্মিত হলে দর্শকের চোখে আরও বিশ্বাসযোগ্যতা ও আস্থা ফুটিয়ে তোলা যেতো।  চিঠির স্থলে ফেসবুক বড্ড বেমানান লাগছিল। চিঠির বিষয়টা কত সুন্দরভাবেই না হুমায়ুন স্যার উপন্যাসে ফুটিয়ে তুলেছেন।
যদিও বিষয়টি পরিচালকের স্বাধীনতা। নির্মাতা হয়তো চেয়েছেন বইয়ের গল্পকে এ সময়ের ছাঁচে ফেলে সাজাতে।

ঈদের সেরা পাঁচটি নাটক

দেবী উপন্যাস নিয়ে যখন শুনলাম মুভি বানানো হবে তখন থেকেই ফ্যাসিনেশন হাই ছিলো, কি করছে মিসির আলীকে নিয়ে। মিসির আলিকে কি সত্যিই সেলুলয়েডের পর্দায় হাজির করা সম্ভব?

যাই হোক শেষপর্যন্ত ‘দেবী’ আপনাকে হতাশ হওয়ার সু্যোগ দিবে না!
যারা বাংলা সিনেমার দর্শক নিয়ে চিন্তিত তারা দর্শক নিয়ে চিন্তা না করে গল্প নিয়ে চিন্তা করুন। কারণ ভাল গল্প হলে দর্শক এমনিতেই হলে গিয়ে সিনেমা দেখবে।

আমি ‘দেবী’ দেখে তৃপ্ত। একটা দাবী কিন্তু প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে, ‘দেবী’র পর এর দ্বিতীয় কিস্তি ‘নিশীথিনী’ নিয়ে আসা জয়া আহসানের দায়িত্ব হয়ে দাড়িয়েছে।
প্রিয় জয়া, আপনি কিন্তু ভুলবেন না, ‘নিশীথিনী’ আপনাকেই করতে হবে।

শেষাংশে বলবো-
“রানু যেমন চায়নি নীলুর ক্ষেত্রে কখনো কোন বিপদ ঘটুক, তেমনি মন্দির থেকে হারিয়ে যাওয়া কোন এক দেবীও চায়নি তা রানুর ক্ষেত্রে। রানু নীলুদের ক্ষেত্রে এই ‘দেবীর’ শক্তির চাওয়াটা তাই কেবল রূপকই নয় বরং প্রাসঙ্গিক এবং সব সময়ের। সাহিত্য আর সিনেমায় দেবীর মূল বিষয়বস্তু নিয়ে এই আলোচনা তাই চলতে থাকুক।

Share this

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top