ধারাবাহিক উপন্যাস: যখন থামবে কোলাহল | ষষ্ঠ কিস্তি

মারুফ ইমনের উপন্যাস: যখন থামবে কোলাহল

অভিযাত্রী ডট কমে প্রতি বৃহস্পতিবার প্রকাশিত হচ্ছে তরুণ লেখক মারুফ ইমনের ধারাবাহিক উপন্যাস যখন থামবে কোলাহল। আগের পর্বগুলো পড়তে ক্লিক করুন:

মারুফ ইমনের উপন্যাস: যখন থামবে কোলাহল

প্রথম কিস্তিদ্বিতীয় কিস্তি | তৃতীয় কিস্তি চতুর্থ কিস্তি | পঞ্চম কিস্তি | ষষ্ঠ কিস্তি | সপ্তম কিস্তি | অষ্টম কিস্তি


যখন থামবে কোলাহল

(ষষ্ঠ কিস্তি)


এলাকার নাম পাগলা। উঠেছি গত সপ্তাহে, এখানে প্রজেক্ট ৩ মাসে শেষ হবার কথা। মানুষ পাগল হয় শুনেছি তবে পুরো এলাকার নাম পাগলা হবার মর্মার্থ কি তা জানিনা। এলাকার মানুষজন যা দেখলাম, আমার কাছে অপ্রকৃতিস্থ লাগেনি বরং অনেক শান্ত লেগেছে। নদী পাড় হয়ে আমার কাজ শেষ করতে করতে সন্ধা হয়ে গেল। পাড় ধরে হেটে বাজারের দিকে যাচ্ছি। কুয়াশায় চরাঞ্চল সাদা একটা চাদরে ঢাকা পড়েছে বলে মনে হচ্ছে। আমার গায়েও শীত করছে, তবে ব্যাগ থেকে কাপড় বের করার আলসেমিতে তা আর বের করা হচ্ছে না। নিয়াজ কে একটা ফোন দিয়ে জানিয়ে দেয়া দরকার, খালা চিন্তা করবে। কিছু কিছু মহিলা দুশ্চিন্তা করতে খুব পছন্দ করে, তাদের চিন্তার পাইপলাইন সবসময় সমৃদ্ধ থাকতে হয় নানা ইস্যুতে, আমার খালাও তেমন। বাবা মায়ের সম্পর্ক মন্দ যাবার পর থেকে খালা বোধহয় আমাকে আরো বেশি আদর করতে শুরু করেছেন, আর বেশি আদর থেকে বেশি দুশ্চিন্তার সৃষ্টি। শরীর বড্ড ক্লান্ত লাগছে। দ্রুত হেটে বাসায় ফিরে একটা ঘুম দিতে পারলে ভাল হত। জিনাত মেয়েটাও বোধহয় ঘুমিয়ে আছে, তারও তো ট্রেনে দাড়িয়ে থাকতে হয়েছে অনেকক্ষণ। জিনাত মেয়েটা যথেষ্ট বুদ্ধিমতী, তার সাথে আরেকবার দেখা হওয়া দরকার। ধাঁধার উত্তরটাও ভেবে পাওয়া যায়নি।

হামিদ ফার্মেসির সামনে সন্ধার পর থেকে ভীড় মন্দ নয়। দোকানের মালিক কাম কম্পাউন্ডার ইদ্রিছ মিয়ার অবশ্য তাতে স্বস্তি নেই। কারন, লোডশেডিং। এমনিতে পল্লী বিদ্যুতের ইলেকট্রিসিটি যায় আর আসে, তার মধ্যে আবার কোথায় যেন খুঁটিতে ঝামেলা তাই সারানোর কাজ চলছে। সন্ধা থেকে তাই ইদ্রিছ মিয়ার সম্বল হারিকেন। ফার্মেসির নাম ‘হামিদ’ কেন তা জানা যায় নি। ইদ্রিছের বয়স পঞ্চাশের বেশি তো হবেই। কোন ছেলেপুলে নেই, দোকানে যে ১০-১২ বছরের হেল্পার আছে তার নাম তাঁরা মিয়া। তাঁরা মিয়া খুব কাজের, তবে পটপট করে বেশি।

দোকানের সামনে গিয়ে আমি কিছুটা থমকে গেলাম। এই সময়ে গ্রামটা একপ্রকার ঘুমিয়েই থাকে বলা যায়, আজ মোটামুটি ৮-১০ জনের মত লোক হামিদ ফার্মেসির ভেতরে ও বাইরে। ইদ্রিছ মিয়া খুব বদমেজাজী লোক। তার কাছে এত লোক কেন আসে আমি তার কারণ বের করতে পারিনি। এমনকি এলাকার মেম্বার গোছের কয়েকজনও দেখলাম তার কাছে ওষুধ নিতে আসে। বোঝাই যায় যতটা না তার হাতযশ আর ভাল ওষুধের জন্য, তার চেয়ে বেশি সখ্যতা রাখার জন্য।

ইদ্রিছ মিয়ার দোকানটিই বাজারে একমাত্র ওষুধের দোকান। হালকা প্যারাসিটামল আর ঠান্ডার ওষুধ কিনে নেয়াটা জরুরী হয়ে গেছে। তবে যে লাইন তাতে আগে বাজার কিনে নেয়াটাই ভাল হবে। বাজারটা বেশিক্ষণ খোলা থাকবে না। নদীর পাড়ে হওয়ায় কিছু তাজা মাছ পাওয়া যায়, আমি কাঁচকি মাছ নিলাম। মুদির দোকান থেকে তিনদিনের আন্দাজে চাল ডাল তেল আর পেয়াজ মরিচ মসলা নিলাম।

স্টোভে রান্নার জন্য নিতে হবে কেরোসিন। কেরোসিন বিক্রেতার নাম আজগর, কিলারদের মত চেহারা। মুখ ভর্তি দাড়ি, চুল লম্বা বাউলদের মত, চোখ লাল টকটকে, গলায় অনেক তাবিজ কবজ আর ময়লা একটা পাঞ্জাবি পরা। পেটানো শরীর, মনে হয় কেউ একটু উনিশ বিশ করলেই কেরোসিনে সব জ্বালিয়ে দেবে। কেরোসিন পাইট প্রতি দুই টাকা বেড়ে বিশ টাকা হয়ে গেছে বলে একজনকে বলতে শুনলাম, ‘কি মিয়া, দাম বাড়াইলা যে।’

আজগর নিচের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘গাড়ি আসে না তিনদিন। যোগান দিয়ে চলে, তারা বাড়াইছে।’

ক্রেতা লোকটাকেও দুস্থ মনে হল, নিচের দিকে ছেড়া লুঙ্গির সাথে তেল চটচটে একটা ফুল স্লিভ শার্ট, দেখেই বোঝা যায় গঞ্জের ফুটপাত থেকে কেনা। সে আজগরের কথায় সন্তুষ্ট হল বলে মনে হল না।

‘এল্লেইগ্যা দুই টেহা? আটানা একটেহা বাড়াও। কেরোসিন বেইচ্চা বিল্ডিং বানাইবা নাকি?’

আজগর তার দিকে একবার তাকিয়ে মাথা নিচু করলো। তারপর বলল, ‘তুমার কাছে বেচুম না।’

লোকটা প্রথমে আজগরের কথা ঠাট্টা মনে করলেও পরে সত্যি আর তার কাছ থেকে কেরোসিন কিনতে পারে নি। আমি একটা কাঁচের বোতল যোগাড় করে কোনরকম দুই পাইট তেল নিয়ে মানে মানে চলে আসলাম।

ইদ্রিছ মিয়া আমাকে দেখেই কেমন জানি তাড়াহুড়া শুরু করলো। সে ওষুধের প্যাকেটগুলো বন্ধ করতে করতে বলল, ‘এত লেটে আসছেন, দোকান তো বন্ধ করে দেব এখন।’

আমার কথা বাড়াতে ইচ্ছে হল না। কাধের ব্যাগ আর বাজার পাশে রেখে দুই জাতের ওষুধের নাম বলাতে সে আমার দিকে কেমন করে তাকালো। তারপর বলল, ‘হিস্টাসিন নাই, অন্যটা দেই?’

আমি মাথা নাড়লাম। এমন সময় পেছন থেকে একটা মেয়েলি কন্ঠ শোনা গেল, ‘আমারেও চাইরটা দিয়েন জেঠা।’

আমি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে দেখলাম সেখানে আমার বাড়িওয়ালার মেয়েটি, তার নামটা মনে পড়ছেনা, তবে মেয়েটি সুন্দর। হারিকেনের আলোতে হালকা পাড়ের শাড়ী আর ছিমছাম চেহারার মেয়েটিকে খুব স্নিগ্ধ লাগছিলো। সে আমার দিকে হয়তো লজ্জায় তাকাচ্ছে না, তবে এসময় মেয়েদের মনে কি খেলা করে তা লেখকেরা বইয়ে অনেকবার বলে গেছেন বলে কিছুটা টের পাচ্ছি।

আজকে রাতে জোছনা আমার মনে ছিল না একদম, মনে থাকলেও আপাতত মনে কোন রসকষ কাজ করছে না। তবে আমার পাশে যে মেয়েটি প্রায় নিঃশব্দে হাটছে তার পরিপাটি ভাব দেখে মনে হল, সে জোছনা উপভোগ করছে। কাধে ভারী ব্যাগ আর হাতে বাজার সদাই নিয়ে বাসায় যেতে আরো মিনিট বিশেক লাগবে বলেই মনে হচ্ছে। রাতে চেনা পথকেও খুব দূরের মনে হয়। এর কোন বিশেষ কারন আছে কি? আমি কি মেয়েটিকে কারন জিজ্ঞেস করলে সে উত্তর দেবে?

‘এত রাতে আপনি একা এলেন? ভয় করে নি?’ আমি মেয়েটিকে স্বাভাবিক করতে জিজ্ঞেস করলাম।

‘আমার ভয় ডর একটু কম। আসলে বাবা ঘরে বসার পর আমাকেই বলতে গেলে বাজার করতে হয় কিনা।’ মেয়েটি খুব সহজভাবে বলল। পাড়াগাঁয়ের একটা মেয়ে এত সুন্দর করে বলল, তার কথায় নেই কোন আঞ্চলিকতা কিংবা কথার টান। মেয়েটি কি বই টই পড়ে নাকি পারিবারিক কারনে ছোট থেকেই এভাবে বলে?

‘দিনে আসলেও পারেন, মেয়ে মানুষ এত রাতে?’

‘দিনে কাজ ছিল বেশি। আর ভয় ডরের আবার ছেলে মেয়ে ভাগ আছে নাকি? আমার তো মনে হয় আপনি ছেলে হয়েও আমার থেকে বেশি ভয় পাচ্ছেন। তাই না?’

আমি একবার মেয়েটির দিকে তাকালাম। তার কথা সত্যি, আমি আইল ভাঙা রাস্তা করে ক্ষেতের মধ্য দিয়ে যেতে একটু ভালই ভয় পাচ্ছি।

‘আপনার নামটা মনে নেই।’ আমি আগ বাড়িয়ে আবার কথা শুরু করলাম, কোন মনীষী বলেছেন ভয় পেলে অন্য প্রসঙ্গে কথা বলে মনকে ডাইভার্ট করে রাখতে হয়।

‘মনে থাকার কথা না, আসলে আমি আপনাকে আমার নাম বলিইনি।’

‘ওহ তাই?’

‘হ্যা। বাসা নেবার সময় আমি শুধু আপনাকে ঘর বুঝিয়ে দিয়েছি, পরে আপনি টাকা দিয়েছেন, এ পর্যন্তই। আপনি বাইরে ছিলেন বেশ কিছুদিন, আর কথা হয় নি।’

‘ওহ আচ্ছা।’

‘আমার নাম অনিন্দিতা। না বললেও আপনি জানতে পারতেন, কেননা বাবা সারাদিন আমাকে ‘অনি’ বলে ডাকতেই থাকে।’

অনিন্দিতার কথা শুনে নিজেকে খুব বোকা মনে হচ্ছে। একটা দোতলা বাড়ির উপরতলায় থেকে নিচতলায় থাকা মেয়েটির এতবার নাম ধরে ডাকার পরেও তার নাম না জানা বোকামির পর্যায়েই পড়ে।

আমরা যখন ‘লাহিড়ী বাড়ি’তে পৌছালাম, তখন মনে হল পুরো বাড়িটাই ঘুমুচ্ছে। অনিন্দিতা খুব সন্তর্পণে কাঠের গেট খুলে ঢুকলেও তার বাবার ডাক শোনা গেল, ‘কিরে অনি, এলি?’

অনি ‘হুম, বাবা’ বলে আমার সাথে আর কথা না বলে ঘরে চলে গেল।

বাড়িতে আমার জানামতে লোক ছয়জন। অনিন্দিতা, তার বাবা, তার কাকা, কাকীমা, কাকার মেয়ে আর একটা কুকুর। তারও একটা নাম থাকার কথা, আমি জানিনা। বলে রাখি, এলাকায় প্রজেক্টের কাজে এর চেয়ে ভাল বাড়ি আর পাইনি। ব্রাহ্মণ একটা পরিবার একটা মুসলমান অবিবাহিত ছেলেকে এত সহজে ঘর দেয় নি। তবে, অভাবের সংসারে কূল রক্ষা করতে অনেক সময় যে শিথিল হতে হয় তার প্রমাণ আমার এখানে থাকাটা। আলু ভর্তা আর গরম ভাতে ঘি দিয়ে কোনরকম খেয়ে শুতে অনেক রাত হয়ে গেল।


(চলবে)

উপন্যাসের সবগুলো পর্ব একসাথে:

প্রথম কিস্তিদ্বিতীয় কিস্তি | তৃতীয় কিস্তি চতুর্থ কিস্তি | পঞ্চম কিস্তি | ষষ্ঠ কিস্তি | সপ্তম কিস্তি | অষ্টম কিস্তি | নবম কিস্তি

Share this

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top