কৃমি আমাদের দেশের জনস্বাস্থ্যের জন্য বড় একটি সমস্যা। সচেতনার অভাবে বা এ বিষয়ে মানুষের পরিপূর্ণ জ্ঞান না থাকায় সুস্বাস্থ্য হতে বঞ্চিত হতে হয়। কৃমি মানুষের শরীরের সবচাইতে বড় ক্ষতিকর পরজীবী। কৃমি ছোট, বড়, বৃদ্ধ যেকোনো বয়সের মানুষেরই হতে পারে। তবে তুলনামূলক শিশুরা কৃমিতে বেশি আক্রান্ত হয়। মানব শরীরের বড় একটি শত্রু কৃমি। আপনি যতই পুষ্টিকর খাবার খান না কেন তা কোন কাজে আসবে না যদি আপনার শরীরে কৃমি থাকে। কারণ কৃমি সকল খাবারের পুষ্টি উপাদান চুষে নেয়। এর ফলে আমাদের দেহে পুষ্টিহীনতা দেখা দেয় ও নানা রোগের সৃষ্টি হয়। শরীরকে সুস্থ রাখতে কৃমি দূর করার উপায় জানতে হবে।
আমাদের দেশে শহরের মানুষের তুলনায় গ্রামের মানুষজন একটু বেশি কৃমিতে আক্রান্ত হয়। কারণ, গ্রামের মানুষরা খালি পায়ে চলাফেরা বেশি করে। মানুষ কয়েক প্রকারের কৃমিতে আক্রান্ত হয়। যেমন কৃমি, সুতা কৃমি, বক্র কৃমি, ফিতা কৃমি ইত্যাদি। কৃমি সংক্রমণ সাধারণত পানি ও খাবারের মাধ্যমে হয়ে থাকে। সব কৃমি একইভাবে সংক্রমিত হয় না। বাংলাদেশের মানুষ গোল কৃমি বা কৃমিতে বেশি আক্রান্ত হয়। এই কৃমি মানুষের পাকস্থলী ক্ষুদ্রান্তে বসবাস করে নানা রোগের সৃষ্টি করে। তাই আমাদের শরীরে কৃমির লক্ষণ দেখা দেওয়ার সাথে সাথেই কৃমির দূর করা প্রয়োজন। চলুন তাহলে জেনে নেই কৃমি থেকে মুক্তির উপায় গুলো সম্পর্কে:
কৃমির লক্ষণ ও উপসর্গ
আমাদের দেশে সাধারণত গুঁড়া কৃমি, পিনওয়ার্মকৃমি ও কেঁচো কৃমির সংক্রমণ সবচেয়ে বেশি হয়। পেটে কৃমি থাকলে কিছু উপসর্গ দেখা দেয়। এই উপসর্গগুলো হল:
১) পেটে গ্যাস হয়, পেট ফুলে যায়।
২) শরীর ক্লান্ত লাগে।
৩) পেটে ব্যথা হয়।
৪) ডায়রিয়া ও বমি বমি ভাব হয়, বমিও হয়।
৫) গুঁড়া কৃমি হলে মলদ্বারে চুলকানি হতে পারে।
৬) ওজন কমে যায়।
৭) আমাশয় হয়।
৮) পায়খানার সাথে সাথে কৃমি বের হতে পারে।
কৃমি দূর করার উপায়
কৃমি দূর করার জন্য ঔষধের পাশাপাশি কিছু ঘরোয়া উপায় আছে, যা সেবন করলে কৃমি থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। কিছু কিছু খাবারে কৃমিনাশক উপাদান আছে। এই খাবারগুলো কৃমি থেকে মুক্তি পেতে সাহায্য করে। চলুন তাহলে এই খাবারগুলো সম্পর্কে জেনে নেই:
১) রসুন: রসুন একটি শক্তিশালী কৃমিনাশক। এতে আছে উচ্চমাত্রায় সালফার যুক্ত অ্যামিনো এসিড। এছাড়াও রসুনে আরো আছে- অ্যান্টিফাঙ্গাল, অ্যান্টি ব্যাকটেরিয়াল ও অ্যান্টিসেপটিক বৈশিষ্ট্য। রসুন খাওয়ার উপায় হচ্ছে প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে খালি পেটে দুই থেকে তিনটি কাঁচা রসুনের কোয়া চিবিয়ে খেতে পারেন। এভাবে ৭ থেকে ১০ দিন নিয়মিত খেলে কৃমি থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে। এছাড়াও এক গ্লাস দুধে ৩-৪টি রসুনের কোয়া সিদ্ধ করে খেতে পারেন। এভাবে এক সপ্তাহ খেলে কৃমি দূর হয়ে যাবে।
কৃমির কারণে পায়ুপথে চুলকানি হয়। এই চুলকানি দূর করতে কয়েক কোয়া রসুনের সাথে পেট্রোলিয়াম জেলি মিশিয়ে একটি পেস্ট বানিয়ে নিন। এই পেস্ট পায়ুপথে লাগালে চুলকানি কমে পাশাপাশি কৃমির ডিমও নষ্ট হয়।
২) কাঁচা পেঁপে: কাঁচা পেঁপেতে পাইপান নামক এক ধরনের এনজাইম পাওয়া যায়। এটি এন্টি হেলমান্থেটিক হিসাবে কাজ করে। পেঁপের বীজে ক্যারেমিন নামক এক ধরনের উপাদান থাকে যা গুঁড়াকৃমির বিরুদ্ধে অত্যন্ত কার্যকর। এজন্য এক গ্লাস পানিতে বা দুধে এক চা চামচ গুঁড়ো পেঁপের বীজ মিশিয়ে একটি মিশ্রণ তৈরি করতে হবে। এই মিশ্রণটি খালি পেটে তিন থেকে চারদিন খেতে হবে। অথবা এক গ্লাস পানি কিংবা গরম দুধের সাথে এক চামচ পরিমাণ কাঁচা পেঁপের রস ও এক চামচ মধু মিশিয়ে একটি মিশ্রণ তৈরি করে ৩ দিন খেলে কৃমি দূর হয়ে যায়।
৩) নারকেল: নারকেলে আছে কৃমিনাশক বৈশিষ্ট্য। নারকেল কৃমির চিকিৎসা, বিশেষ করে গুঁড়া কৃমির চিকিৎসায় বেশ কার্যকর। কৃমি দূর করতে প্রতিদিন দুই থেকে তিন চামচ কুড়ানো নারকেল খেতে পারেন।
৪) কুমড়ো বীজ: এতে আছে কিউকারবিটাসিন নামক এক ধরনের পদার্থ যা কৃমিনাশক হিসেবে বেশ কার্যকর। এজন্য কুমড়োর বীজ ভেঙ্গে গুঁড়ো করে নিতে হবে। এক টেবিল চামচ মধুর সাথে এক চামচ গুঁড়ো কুমড়ো বীজ মিশিয়ে প্রতিদিন সকালে খালি পেটে খাবেন। দেখবেন খুব তাড়াতাড়ি কৃমি থেকে মুক্তি পেয়ে যাবেন।
৫) নিম: প্রাচীনকাল থেকে ঘরোয়া চিকিৎসায় নিমের ব্যবহার হয়ে আসছে। পেটের কৃমি ধ্বংস করতে নিম বেশ কার্যকর। কৃমি দূর করার জন্য নিম পাতা বেটে এর রস বের করে খেতে পারেন। নিম পাতার রস বেশি তেতো। তাই চাইলে মধু মিশিয়ে নিতে পারেন।
বাচ্চাদের কৃমি হওয়ার লক্ষণ
বড়দের কৃমি হলে খুব সহজে বোঝা যায় কিন্তু বাচ্চাদের কৃমি হলে সহজেই বোঝা যায় না। এজন্য বাবা-মা হিসেবে আপনাকে সচেতন থাকতে হবে বাচ্চাদের কৃমি হয়েছে কিনা। পেটে ব্যথার লক্ষণ ও কৃমির লক্ষণ প্রায়ই হয়ে থাকে। চলুন বাচ্চাদের কৃমি হওয়ার লক্ষণ গুলো সম্পর্কে জেনে নেই:
১) মলদ্বারে চুলকানি বাচ্চাদের কৃমি হওয়ার লক্ষণ গুলোর মধ্যে প্রধান লক্ষণ ।
২) ছোট বাচ্চারা যদি কোন কারণ ছাড়াই অস্বাভাবিক আচরণ করে যেমন খামচি দেয়, কামড় দেয় তাহলে বুঝে নিতে হবে কৃমির সমস্যা বেড়েছে।
৩) প্রায় সময় মলের সাথে কৃমি বের হয়ে আসে। এজন্য কৃমি হয়েছে কিনা সন্দেহ হলে বাচ্চাদের মলের দিকে খেয়াল করতে হবে।
৪) যদি দেখেন বাচ্চা ঘন ঘন থুথু ফেলছে তাহলে বুঝে নিবেন হয়তো বাচ্চার পেটে কৃমি হয়েছে।
৫) যদি বাচ্চার ঘন ঘন পেট ব্যাথা হয় এবং খাবারের প্রতি অরুচি হয় তাহলে বুঝে নিবেন হয়তো কৃমি হয়েছে।
বাচ্চাদের কৃমি তাড়ানোর ঘরোয়া উপায়
কৃমির লক্ষণগুলো প্রকাশ পেলে সরাসরি ঔষুধ খাওয়ানোর আগে শিশুদের কৃমি দূর করার উপায় হিসেবে কিছু ঘরোয়া মাধ্যম কার্যকর ভূমিকা পালন করে। নিম্নলিখিত খাবার গুলো বাচ্চাদের কৃমি দূর করার জন্য খাওয়াতে পারেন:
১) কাঁচা পেঁপে: কাঁচা পেঁপেতে পাপাইন নামক এক ধরনের এনজাইম আছে, যা কৃমিনাশক হিসেবে কাজ করে এবং অন্ত্রের মধ্যে কৃমিকে ধ্বংস করে। তাই শিশুর কৃমি দূর করতে কাঁচা পেঁপে খাওয়ানো যেতে পারে।
২) রসুন: রসুন প্রাকৃতিক কৃমিনাশক এজেন্ট, যা পরজীবী কৃমিনাশ করতে অত্যন্ত কার্যকর।
৩) ক্যারাম বীজ: ক্যারাম বীজ থাইমল সমৃদ্ধ, এটি অন্ত্রের পরজীবী বৃদ্ধি প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে। ক্যারাম বীজ গুড়ের সঙ্গে মিশ্রিত করে শিশুকে খাওয়াতে হবে।
৪) কুমড়ো বীজ: কুমড়ো বীজে কিউকারবিটাসিন আছে, যা কৃমিদেরকে পক্ষাঘাতগ্রস্ত করতে সাহায্য করে এবং শরীরের মধ্যে কৃমির বেঁচে থাকা প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে।
৫) করোলা: করোলা পেটের কৃমিকে ধ্বংস করতে সহায়তা করে। করলা রসের সাথে পানি ও মধু মিশিয়ে শিশুকে খাওয়াতে পারেন। তাহলে এটার তিক্ত স্বাদ থাকবেনা।
৬) নিম: নিমের একটি পরজীবী বিরোধী বৈশিষ্ট্য আছে যা বিভিন্ন অন্ত্রের কৃমি ধ্বংস করতে উপকারী। তাই শিশুর কৃমি প্রতিরোধে নিমের পাতার রস খাওয়াতে পারেন।
৭) গাজর: গাজরে আছে ভিটামিন এ, যা শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় এবং অন্ত্রের পরজীবীদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সাহায্য করে। শিশুর কৃমি দূর করার জন্য শিশুকে খালি পেটে গাজর খাওয়ান।
৮) হলুদ: হলুদ একটি অ্যান্টিসেপটিক, যা কৃমি দূর করতে বেশ সাহায্য করে।
৯) নারকেল: নারকেলে শক্তিশালী পরজীবী বিরোধী বৈশিষ্ট্য আছে যা কৃমির চিকিৎসার জন্য বেশ উপকারী। শিশুর কৃমি দূর করার জন্য শিশুকে নারকেল তেল খাওয়াতে পারেন।
১০) লবঙ্গ: লবঙ্গ কৃমি ও কৃমিতে বিদ্যমান কৃমির ডিম ধ্বংস করতে পারে। লবঙ্গ খেলে ভবিষ্যতে কৃমি হওয়ার সম্ভাবনাও থাকে না। তাই শিশুর কৃমি দূর করার জন্য শিশুকে লবঙ্গ খাওয়ান।
কৃমি থেকে বাঁচতে যা করবেন ও যা করবেন না:
কৃমির দূর করতে হলে প্রথমে জানা দরকার এটি কেন হয়। কৃমি অনেক কারণে হয়ে থাকে। যেমন – অনিরাপদ পানি পান করা, নোংরা পরিবেশ, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভাস, খালি পায়ে হাঁটা ইত্যাদি । এছাড়া আরো কিছু কারণ রয়েছে। চলুন তাহলে আজ জেনে নেই কৃমি থেকে বাঁচতে কি কি করতে হবে এবং কি কি করতে হবে না:
১) বাড়ির সবাই প্রতি তিন মাস পর পর অ্যালবেনডাজল সেবন করতে পারেন। মেবেনডাজল হলে পর পর তিন দিন খেতে হবে এবং সাত দিন পর আরও একটা ডোজ খাওয়া যায়। শিশুদেরকেও এইভাবে সিরাপ খাওয়াতে হবে। শিশুদের সিরাপ খাওয়ানোর আগে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
২) অনেকের একটা ভুল ধারণা আছে যে মিষ্টি বা চিনি খেলে কৃমি হয়। কিন্তু এটা ঠিক নয়। মিষ্টি বা চিনির সাথে কৃমির কোন সম্পর্ক নেই। বরং অস্বাস্থ্যকর খাবার খেলেই কৃমি হয়। তাই অস্বাস্থ্যকর খাবার পরিহার করুন।
৩) কৃমি হলে সাধারণত পায়ুপথ চুলকায়। শিশুরা না বুঝে সেখানে হাত দেয় আবার সেই হাত মুখে দেয়। এভাবেই সংক্রমণ ছড়াতে থাকে। তবে শুধুমাত্র পায়ুপথ চুলকানো মানে কৃমি হয়েছে এমন নয়। এর অন্যান্য আরো উপসর্গ আছে। তাই শিশুদের ক্ষেত্রে এদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
৪) অনেকেরই একটা ভুল ধারণা আছে যে গরমকালে কৃমিনাশক খাওয়া যাবেনা। এই ধারণাটি ভুল। গরম, বর্ষা, শীত যখন খুশি তখন কৃমিনাশক খেতে পারেন। তবে খেয়াল রাখবেন খাওয়ার পরে বা ভরা পেটে খাবেন।
৫) অনেকেই মনে করেন কৃমিনাশক ঔষধ অনিরাপদ। কিন্তু কৃমিনাশক ঔষুধ নিরাপদ, এর কোন পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া নেই। তবে অনেকের পেট ফাঁপা ও বমি বমি হতে পারে।
৬) সব সময় নিরাপদ ও বিশুদ্ধ পানি খাবেন এবং যে কোন খাবার খাওয়ার আগে বিশেষ করে শাকসবজি ও মাংস খাওয়ার আগে ভালোভাবে ধুয়ে নিন এবং শৌচাগার ব্যবহারের পর অবশ্যই সাবান দিয়ে ভালোভাবে হাত কচলে ধুয়ে নিবেন।
৭) বাহিরের অপরিষ্কার অপরিচ্ছন্ন খাবার না খাওয়াই ভালো এবং শিশুদের মাঠে খালি পায়ে খেলতে দিবেন না।
৮) শুধুমাত্র গ্রামের রাস্তায় থাকা শিশুদের কৃমি হয় এই ধারণাটি সম্পূর্ণ ভুল। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে যে কারো কৃমি সংক্রমণ হতে পারে। তাই নিয়মিত কৃমিনাশক খাওয়াই ভালো।
সবশেষে, আজকে আমরা জানলাম কৃমি হলে কি কি সমস্যা হয় ও ঘরোয়াভাবে কৃমি দূর করার উপায় সম্পর্কে। কৃমির ডিম পেটে গেলে কৃমির সংক্রমণ হয়। তাই কৃমির সংক্রমণ প্রতিরোধে আমাদের স্বাস্থ্য সচেতন হতে হবে। খাওয়ার আগে ও পরে এবং মলত্যাগের পর ভালোভাবে সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার অভ্যাস করতে হবে এবং যে কোন খাবার বিশেষ করে শাকসবজি ফলমূল খাওয়ার আগে ভালো ভাবে নিরাপদ পানি দিয়ে ধুয়ে নিতে হবে এবং সব সময় হাত পরিষ্কার রাখতে হবে ও হাতের নখ ছোট রাখতে হবে। ঘরোয়া চিকিৎসাতে কাজ না হলে কৃমির চিকিৎসায় অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।
Leave a Reply