গলায় বুকে কফ জমে থাকা বেশ বিরক্তিকর একটি সমস্যা। ঋতু পরিবর্তনের ফলে আবহাওয়া পরিবর্তন হয়। আর আবহাওয়ার এই দ্রুত পরিবর্তন আমাদের শরীর খাপ খাওয়াতে পারে না, যার কারণে সৃষ্টি হয় ঠান্ডা জ্বর ও সর্দি-কাশির। ঠান্ডা সর্দি কাশি এগুলো আমাদের কাছে খুব পরিচিত রোগ হলেও এই ঠান্ডা সর্দি কাশি থেকে আমাদের দেহে অনেক বড় বড় অসুখ বাসা বাঁধতে পারে। যার অন্যতম সহজ মাধ্যম হচ্ছে কফ। আমাদের শরীরে সাধারণত দুই স্থানে কফ জমা হয় গলায় ও বুকে। তবে ঠান্ডা থেকে জমা কফ একটা সময় এমনিতেই দূর হয়ে যায় কিন্তু তা অনেক সময়ের ব্যাপার। তাই গলায় ও বুকে খুব বেশি কফ জমলে শ্বাসকষ্ট দেখা যায়। ভাইরাসজনিত কারণেও কফ জমতে পারে। কফ, কাশি থেকে রেহাই পেতে আমাদের অবশ্যই জানতে হবে কাশি দূর করার উপায়।
সাধারণত শীতের সময় এসব ভাইরাসের সংক্রমণ বেশি হয়। তাই এসব ভাইরাসের সংক্রমণ হলে অবহেলার কোন সুযোগ নেই। একটু অসাবধানতাই হতে পারে মারাত্মক বিপদের কারণ। আপনার যদি, ব্রংকাইটিস এবং ক্রনিক অবাস্ট্রাকটিভ পালমোনারির ডিসিসের মত অসুখ থেকে থাকে তাহলে ফুসফুস থেকে কফ বের করা আপনার জন্য অনেক জরুরী। যদি কফ বের করা না হয় তাহলে হতে পারে নিউমোনিয়ার মত রোগ। এ সময় ফুসফুসের সংক্রমণের ঝুঁকি অনেক বেশি থাকে। বুকে কফ জমলে গলা ব্যথা, বুকে ভারি হওয়া, শ্বাসকষ্ট, কফ সৃষ্টিকারী কাশি এবং শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণের মতো লক্ষণ দেখা দিতে পারে। সময় মত চিকিৎসা না নিলে এগুলা আরো জটিলতার সৃষ্টি করে। তাই কফ, কাশি দূর করার সঠিক চিকিৎসা সম্পর্কে ধারণা রাখা বেশ প্রয়োজন।
গলার কফ বের করার উপায়
শীতের সময় বাহিরে ঠান্ডা বাতাসে আমাদের বুকে কফ জমে যায়। অনেক চেষ্টার পরেও এই কফ দূর করা যায় না। কিন্তু এই কফ দূর করার কিছু সহজ ঘরোয়া উপায় আছে। এগুলো নিয়মিত করলে অনেকখানি আরাম মিলবে। তাহলে চলুন গলার কফ বের করার উপায়, বুকের কফ বের করার ঔষধ সম্পর্কে জেনে নিই:
১) লেবু মধু: মধু অনেক উপকারী প্রাকৃতিক গুনাগুন সম্পন্ন। এটি শ্বাসতন্ত্রের ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস করতে এবং বুক থেকে কফ দূর করতে সাহায্য করে। এজন্য কুসুম গরম পানিতে লেবুর রস ও এক চামচ মধু দিয়ে একটি মিশ্রণ তৈরি করুন। নিয়মিত এটি পান করুন। অল্পদিনের মধ্যে কফ দূর হয়ে যাবে।
২) পেঁয়াজ: এক চামচ পেঁয়াজের রস, এক চামচ লেবুর রস, এক চামচ মধু এবং পরিমাণ মতো পানি একসাথে চুলায় জাল দিয়ে গরম করে নিন। এরপর কুসুম গরম এই পানি দিনে তিন থেকে চারবার পান করুন। দেখবেন অতি দ্রুত বুক থেকে কফ দূর হয়ে যাবে। আপনি চাইলে ছোট ছোট পেঁয়াজের টুকরাও খেতে পারেন।
৩) আদা: এক গ্লাস পানিতে এক টেবিল চামচ আদা কুচি ভালোভাবে মেশান। এবার এটিকে জ্বাল দিন, পানি ফোটার সময় এক চামচ মধু মেশান। এখন এটা প্রতিদিন তিন থেকে চারবার পান করুন।
৪) লবন পানি: লবণ পানি দিয়ে খুব সহজেই বুকের সর্দি ও কফ দূর করা যায়। শ্বাসতন্ত্র থেকে কফ দূর করতে সাহায্য করে লবণ। এজন্য এক গ্লাস কুসুম গরম পানিতে এক চা চামচ লবণ মিশিয়ে একটি মিশ্রণ তৈরি করুন। এবার এই মিশ্রণ দিয়ে দিনে দুই থেকে তিনবার কুলকুচি করুন।
শুষ্ক কাশি দূর করার উপায়
শীত আসলে শুরু হয় সর্দি-কাশির প্রকোপ। সাধারণত শীতকালে অতিরিক্ত ঠান্ডা লাগার কারণে এবং বিভিন্ন রোগ জীবাণুর আক্রমণের ফলে শুষ্ক কাশি হয়ে থাকে। চলুন জেনে নিই কাশির ঘরোয়া চিকিৎসা:
মধু: মধুতে আছে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও অ্যান্টিব্যাক্টরিয়াল উপাদান, যা শুষ্ক কাশি কমাতে সাহায্য করে। শুষ্ক কাশি দূর করার জন্য এক গ্লাস কুসুম গরম পানিতে এক চামচ মধু মিশিয়ে প্রতিদিন পান করতে পারেন। এছাড়াও চায়ে মধু ও লেবুর রস মিশিয়ে পান করতে পারেন।
মসলা চা: একটি পাত্রে অল্প পরিমাণ পানি নিয়ে পানিতে লবঙ্গ, দারুচিনি, এলাচ, গোল মরিচ, গরম মসলা ইত্যাদি মিশিয়ে জ্বাল দিন। এবার এই হারবাল টি পান করুন। এতে করে গলার প্রদাহ কমবে এবং কাশি দূর হবে।
রসুন: রসুনে আছে অ্যালিসিন উপাদান, যা জীবাণু ধ্বংসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। প্রতিদিন সালাদের সাথে রসুনের কুচি এবং গরম পানির সাথে রসুনের কুচি মিশিয়ে স্যুপ তৈরি করে খেতে পারেন।
খুশখুশে কাশি দূর করার উপায়
শীতের সময় ছোট থেকে বড় যে কোন বয়সী মানুষের অন্য যেকোনো রোগের তুলনায় ঠান্ডা লেগে কাশির সমস্যা বেশি হয়ে থাকে। এ সময় খুসখুশে কাশির পরিমান এতটাই বেড়ে যায় যে রাতে ঘুমানো মুশকিল হয়। কাশি হলে আমরা ফার্মেসি থেকে যে কাশির সিরাপ আনি এগুলোতে উপকারের চেয়ে অপকার বেশি। তাই চলুন জেনে নেই খুসখুসে কফ- কাশি দূর করার কিছু সহজ উপায়:
১) প্রথমত যদি ধূমপানের অভ্যাস থাকে তা বাদ দিতে হবে। এছাড়াও ধুমপায়ীদের কে এড়িয়ে চলতে হবে।
২) দিনে কমপক্ষে ১২ ক্লাস কুসুম গরম পানি পান করতে হবে।
৩) ঘরের মধ্যে মশা দূর করার এরোসল ও রুম ফ্রেশনার ব্যবহার করবেন না।
৪) প্রতিদিন কয়েকটি তুলসী পাতা চিবিয়ে খান। চাইলে চায়ের সাথে খেতে পারেন।
৫) দিনে কমপক্ষে তিনবার আধা, গোলমরিচ, দারুচিনি মেশানো লাল চা খান।
৬) সকালে ঘুম থেকে উঠেই এক চামচ মধু খান।
৭) প্রতিদিন হালকা গরম পানি দিয়ে গোসল করার চেষ্টা করুন। মনে রাখবেন সারা বছর গোসলের পানির তাপমাত্রা একই রাখা উচিত।
বুকের কফ বের করার ঔষধ
কফ দূর করার জন্য আপনি বেশ কয়েকটি ট্যাবলেট সেবন করতে পারেন। তবে কফ দূর করার জন্য ডাক্তাররা বেশিরভাগ সময়ে সিরাপ দিয়ে থাকেন। এই সিরাপ গুলো ব্যবহারের কয়েক দিনের মধ্যে আপনার গলার কফ নিরাময় হয়ে যায়। নিচে কফ দূর করার জন্য কিছু সিরাপ ও ট্যাবলেট এর নাম, বুকে কফ জমলে করণীয় দেওয়া হলো:
ট্যাবলেট,
১) মিউকোলিড ট্যাবলেট (Mucolyt Tablate)
২) অ্যালকফ কফজেল ট্যাবলেট (Alkof Cofgel Tablate) সিরাপ,
৩) Adovas-অ্যাডোভাস।
৪)Tusca Plus-তুসকা প্লাস।
৫) Ambrox-অ্যামব্রক্স।
৬) Ocof-ওকফ।
৭) Askorel-অ্যাসকোরেল।
ব্যবহারবিধি,
➣ Adovas-অ্যাডোভাস: এটি খাওয়ার পর দিনে ৩ বেলা দুই চামচ করে খেতে হবে। এই সিরাপের বাজার মূল্য ১০০ মিলি ৬৫ টাকা।
➣ Tusca Plus-তুসকা প্লাস: এটিও দিনে ৩ বেলা, খাওয়ার পর দুই চামচ করে। এই সিরাপের বাজার মূল্য ১০০ মিলি ৫০ টাকা।
➣ Ambrox-অ্যামব্রক্স: এটি গলা এবং বুকে জমাট বেঁধে যাওয়া কফ দূর করে থাকে। এই সিরাপ দিনে ৩ বেলা, খাওয়ার পর দুই চামচ করে সেবন করতে হবে। এই সিরাপের বাজার মূল্য ১০০ মিলি ৫০ টাকা।
➣ Ocof-ওকফ: নাক দিয়ে পানি পড়া, নাক বন্ধ হয়ে যাওয়া, গলায় জমাট বাধা কফ দূর করে থাকে। এটি দিনে ৩ বেলা, খাওয়ার পর দুই চামচ করে। এই সিরাপের বাজার মূল্য ১০০ মিলি ১০০ টাকা।
➣ Askorel-অ্যাসকোরেল: এই সিরাপটি গলার কফ নরম করে মলত্যাগের সাথে বের করে দেয়। এটি দিনে ৩ বেলা, খাওয়ার পর দুই চামচ করে। এই সিরাপের বাজার মূল্য ১০০ মিলি ৮০ টাকা।
কফ ও কাশি দূর করার ঘরোয়া উপায়:
শীত এলেই সর্দি-কাশি ও কফের সমস্যা দেখা দেয়। এর সাথে বাড়তি হিসেবে যোগ দেয় গলা ব্যথা। এটি মানুষ সাধারন সমস্যা হিসেবে দেখলেও এটি মানুষকে কম ভোগায় না। বিষয়টিকে মোটেও হালকাভাবে নেওয়া উচিত নয়। যদি সময় মত চিকিৎসা না করা হয়, তাহলে শ্বাস যন্ত্রের ক্ষতি হতে পারে। তবে এই সমস্যা সমাধানে রয়েছে ঘরোয়া কিছু উপায়, যা বেশ কার্যকর। চলুন তাহলে কফ ও কাশি দূর করার ঘরোয়া উপায় সম্পর্কে জেনে নেই:
১) লবণ ও পানি দিয়ে গার্গল করা: গলা দ্রুত পরিষ্কার করার জন্য লবনও পানি দিয়ে গার্গল করুন। এর জন্য এক গ্লাস কুসুম গরম পানিতে দুই থেকে তিন চামচ লবণ ভালোভাবে মেশান। এরপর এই পানি দিয়ে ভালোভাবে গার্গল করুন। দিনে দুই থেকে তিনবার এই পদ্ধতি ব্যবহার করলেই ভালো ফলাফল পাওয়া যায়।
২) মধু ও আদা: গলা ব্যথা ও শুষ্ক কাশি দূর করতে মধু আদা বেশ কার্যকর। এক চামচ আদার রসের সাথে এক চামচ মধু মিশিয়ে দিনে তিনবার খান। আদা গলা ব্যথা কমাতে বেশ কার্যকর আর মধু কাশি নিয়ন্ত্রণের সাহায্য করে ।
৩) ভেষজ চা: কফ ও কাশি দূর করতে ভেষজ চা খুবই কার্যকরী। পিপারমিন্ট চা গলা ব্যথা কমায়। কফের চিকিৎসাও এটি বেশ কার্যকর। এতে আছে এন্টি মাইক্রোবিয়াল, এন্টি ইনফ্লামেটরি, ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট গুণ। এগুলো শ্বাসনালীকে পরিষ্কার করতে বেশ সাহায্য করে।
৪) স্টিম নিতে পারেন: কফকে পাতলা করার জন্য স্টিম নিন। দিনে এক থেকে দুইবার এটি করতে পারেন। স্টিম নেওয়ার ফলে শ্বাসযন্ত্রের ট্রাক্টে আটকে থাকা কম পরিষ্কার হয়। গরম পানিতে কয়েক ফোটা এসেন্সিয়াল অয়েল মিশিয়ে নিলে এটি আরো কার্যকর।
৫) পুষ্টিকর খাবার: কফ ও কাশির সমস্যা দূর করার জন্য পুষ্টিকর খাবারের দিকে বেশি নজর দিন। যেমন, আনারস, আদা, রসুন, পেয়াজ ও গোল মরিচ ইত্যাদি বেশি বেশি খান।
সবশেষে, কফ ও কাশি কোন মারাত্মক রোগ না হলেও এটি দূর করা অত্যন্ত প্রয়োজন। এর মাধ্যমে শরীরে অন্যান্য রোগ বাসা বাঁধতে পারে। তাই কাশি দূর করার উপায় সম্পর্কে জেনে নিন এবং কফ-কাশি দূর করার জন্য উপরোক্ত চিকিৎসা গুলো মেনে চলুন। যদি এতেও কফ-কাশি দূর না হয় তাহলে অবশ্যই ডাক্তারের শরণাপন্ন হবেন এবং উপরে উল্লেখ করা প্রত্যেকটি ঔষুধ সেবনের আগে একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিবেন।
Leave a Reply