গত ২ দশক ধরে ডেঙ্গুর ভয়াবহতা ধীরে ধীরে বেড়েই চলেছে। সবচাইতে ভয়ংকর কীটপতঙ্গ জনিত মানব রোগে পরিণত হয়েছে এই ডেঙ্গু। বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে সবচাইতে বেশি আঘাত হেনেছে। ডেঙ্গু হচ্ছে এডিস গোত্রের স্ত্রী মশাবাহিত এক ধরনের ভাইরাস। এই ভাইরাসটিতে সংক্রমিত মশার কামড়ের মাধ্যমে ডেঙ্গু জীবাণু মানুষের শরীরে ছড়ায়। কোন আক্রান্ত ব্যক্তি থেকে অন্য কোন ব্যক্তির কাছে এই রোগ ছড়ায় না। কারণ এটি ছোয়াচে রোগ নয়। এটি একমাত্র সংক্রমিত কোন ব্যক্তির গায়ের মশা অন্য কোন ব্যক্তিকে কামড়ালে তখন ওই মানুষটি ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়। সংক্রমিত মশার সংস্পর্শে আসলে যেকোনো বয়সের মানুষেরই ডেঙ্গু হতে পারে। ডেঙ্গু রোগের লক্ষণ ও প্রতিকার সম্পর্কে জেনে সতর্ক থাকলে এ রোগ থেকে উপশম পাওয়া যায়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ডেঙ্গু ভয়াবহ একটি রূপ ধারণ করেছে। এটি গ্রীষ্মমন্ডলীয় উপক্রান্তীয় অঞ্চলে বেশি হয়। বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়া এবং দক্ষিণ আমেরিকার শহর গুলোতে বেশি দেখা যায়। সারা বছর বিশ্বকাপে লক্ষ লক্ষ ডেঙ্গু সংক্রমণ ঘটে এবং প্রতিবছর গড়ে প্রায় 40 হাজার মানুষ ডেঙ্গু রোগে মারা যায়। ডেঙ্গু রোগের সংক্রমনের সবচেয়ে বেশি সম্ভাবনা থাকে এপ্রিল মাসে। কারণ প্রাক- গ্রীষ্ম ও বর্ষা সময় এই রোগের প্রকোপ বৃদ্ধি পায়। তুলনামূলকভাবে জুন জুলাই মাস থেকে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা হ্রাস পায়।। সঠিক চিকিৎসার অভাবে এই রোগে রোগীর মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।
সময় এবং অঞ্চল ভেদে রোগ মহামারি আকারও ধারণ করতে পারে। বিশেষ করে বাংলাদেশে এটা দিন দিন বেশ ভয়ংকর রূপ ধারণ করছে। তাই আমাদের ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ নির্ণয়, চিকিৎসা ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা সম্পর্কে আরো সচেতন হওয়া উচিত। সচেতন থেকে কিভাবে ডেঙ্গু রোগ থেকে রেহাই পাওয়া যায়, তাই নিয়ে আজকের আলোচনা:
ডেঙ্গু রোগের লক্ষণ
ডেঙ্গু জ্বর হচ্ছে একটি মশা বাহিত ভাইরাস ঘটিত রোগ। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রথমবার আক্রান্ত ডেঙ্গু রোগীর শরীরে বিশেষ কোন উপসর্গ বা লক্ষণ দেখা যায় না। খুবই অল্প কিছু ক্ষেত্রেই রোগের প্রভাব গভীর হয়। যদি আমরা আগে থেকেই ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ ও দ্রুত প্রতিকারের সহজ এবং কার্যকরী উপায় গুলো জেনে থাকি, তবে এই রোগ সারাতে সহজ হবে। চলুন দেখে নেয়া যাক ডেঙ্গু জ্বরের সিনটম গুলো:
ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ কি কি:
১) মাত্রাতিরিক্ত জ্বর (104°F)
২) বমি বমি ভাব।
৩) চোখে ব্যথা অনুভূতি হওয়া।
৪) মাংসপেশীতে প্রচুর পরিমাণে যন্ত্রণা হয়।
৫) ত্বকের বিভিন্ন স্থানে ফুসকুড়ি দেখা দেয়।
৬) মাথা ঘোরায়।
৭) মাথায় প্রচুর যন্ত্রণা হয়।
৮) গ্রন্থি ফুলে যায়।
এই লক্ষণগুলো সাধারণত ৪ থেকে ১০ দিনের মধ্যে দেখা যায় এবং ২-৭ দিন পর্যন্ত স্থায়ী থাকে। প্রথমবারের তুলনায় দ্বিতীয়বার যদি ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয় সেক্ষেত্রে ভয়াবহতা বৃদ্ধি পায়।
ডেঙ্গু জ্বর গুরুতর পর্যায়ে গেলে আরও কিছু লক্ষণ দেখা দেয়। লক্ষণ গুলো হলো:
১) বারবার বমি হওয়া।
৩) পেটে প্রচন্ড পরিমাণে ব্যথা অনুভূত হওয়া।
৪) পাতলা পায়খানা হয়।
৫) মাড়ি ও নাক থেকে রক্তপাত হয়ে থাকে।
৬) প্রসাব এবং মলের সাথে রক্তপাত হয়।
৭) শরীর ক্লান্ত হয়ে যায়।
৮) বিরক্তি এবং অস্থিরতা দেখা দেয়।
৯) শ্বাস-প্রশ্বাস দ্রুত হয়।
১০) ত্বকের নিচে রক্তক্ষরণ দেখা দিতে পারে।
এই লক্ষণ গুলো এতটাই ভয়ঙ্কর যে রোগীকে মৃত্যুর দিকে টেনে নিতে পারে। এই পরিস্থিতিকে ডেঙ্গু শক সিনড্রোম (ডিএসএস) বলা হয়। তাই এই লক্ষণগুলো প্রকাশ পেলে রোগীকে খুব দ্রুত ডাক্তারের শরণাপন্ন করা উচিত, অন্যথায় রোগীর মৃত্যু হতে পারে।
ডেঙ্গু জ্বর নির্ণয়ের প্রক্রিয়া:
২০১৯ সালে আমাদের দেশের সরকার দেশের সকল বেসরকারি হাসপাতালগুলোকে ডেঙ্গু জ্বরের চিকিৎসার খরচ ও চিকিৎসার পূর্বে পরীক্ষার হার নির্ধারণ করেছে।
জ্বরের তিন দিনের মধ্যে ডেঙ্গু নির্ণয়ের জন্য পরীক্ষা এনএস-১ অ্যান্টিজেন টেস্টের সর্বোচ্চ ফি ৫০০ টাকা। পরবর্তী পর্যায়ে ডেঙ্গুনির্ণয়ের জন্য আরো দুটি পরীক্ষা আইজিজি এবং আইজিএম এর সর্বোচ্চ ফি ৫০০ টাকা এবং কমপ্লিট ব্লাড কাউন্ট (সিবিসি) এই পরীক্ষা ৪০০ টাকা নির্ধারণ করেছে।
ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ ও চিকিৎসা
ডেঙ্গু জ্বরের জন্য এখন পর্যন্ত নির্ধারিত কোন ঔষধ আবিষ্কার হয়নি। তবে গবেষকরা কাজ করে যাচ্ছেন ডেঙ্গু জ্বরের ঔষধ আবিষ্কারের জন্য। এছাড়া ডেঙ্গু জ্বর ঘরোয়া চিকিৎসার মাধ্যমে কমে যায়। আমাদের যদি ডেঙ্গু জ্বরের চিহ্ন ও দ্রুত প্রতিকারের সহজ এবং কার্যকরী উপায় গুলো জানা থাকে তবে আমরা দ্রুতই এর চিকিৎসা শুরু করতে পারব। চিকিৎসকরা ডেঙ্গু জ্বরের চিকিৎসায় কিছু ঔষধ দিয়ে থাকেন:
ডেঙ্গু জ্বরের চিকিৎসায় চিকিৎসকরা প্যারাসিটামল জাতীয় ঔষধ দিয়ে রোগীর যন্ত্রণা এবং জ্বরের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করেন। এবং Non Steroidal ঔষুধের মাধ্যমে রক্তকরণের সম্ভাবনাকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। রোগীর অবস্থা অতিরিক্ত খারাপ হলে হাসপাতালে ভর্তি এবং ডাক্তারদের তদারকির মাঝে রাখা খুব জরুরী। হাসপাতালে ডাক্তাররা ডেঙ্গু রোগীদের শিরায় (IV) ইলেক্ট্রোলাইট (লবণ) তরল দেয়। এর ফলে শরীরে লবন ও পানির যোগান বজায় থাকে।
ডেঙ্গু জ্বরের ঘরোয়া চিকিৎসা
ডেঙ্গু জ্বরের নিয়ন্ত্রণের জন্য ঘরোয়া চিকিৎসা সবচেয়ে বেশি কার্যকর। তবে এগুলোর উপর একেবারেই নির্ভরযোগ্য হওয়া উচিত নয়। ডেঙ্গুর লক্ষণ গুলো দেখা দেওয়ার সাথে সাথেই চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করবেন এবং ডেঙ্গু টেস্ট করে নেবেন। তবে ডেঙ্গু জ্বর প্রতিরোধে ঘোরায়া চিকিৎসা বেশ কার্যকর। তাহলে চলুন জেনে নেই ডেঙ্গু জ্বরের ঘরোয়া চিকিৎসা, ডেঙ্গু হলে করণীয়:
১) পেঁপে পাতার জুস: ডেঙ্গু জ্বরে রোগীর প্লেটলেটের পরিমাণ কমে যায়। এ সমস্যা সমাধানে পেঁপে পাতার জুস দুর্দান্ত কাজ করে। এটি শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। ডেঙ্গু জ্বরের সময় কয়েকটি পেঁপে পাতা নিয়ে রস বের করে দিনে অত্যন্ত ২ বার অল্প পরিমাণে পান করবেন। দেখবেন এতে করে খুব ভালো ফলাফল পাবেন।
২) গিলয় জুস: গিলয় সংস্কৃতি ভাষায় যার অমৃত, অর্থ অমরত্বের শিকড়। আয়ুর্বেদিক চিকিৎসায় গিলয়ের ব্যবহার প্রচুর। ডেঙ্গু জ্বর প্রতিকারে গিলয়ের জুস বেশ কার্যকর। এটি বিপাকে সাহায্য করে এবং অনাক্রম্যতা তৈরি করে। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ডেঙ্গু জ্বর থেকে মুক্তির প্রথম শর্ত। এই জুস প্লেটলেটের সংখ্যাও বাড়াতে সাহায্য করে। কয়েকভাবে গিলয় খাওয়া যেতে পারে। প্রথমত গিলয়ের শিকড়কে গুঁড়ো করে বা স্যুপে সিদ্ধ করে খাওয়া হয় । এছাড়াও এক গ্লাস পানিতে গিলা গাছের দুটি কাণ্ড সিদ্ধ করে খেতে পারেন। অন্যথায় এক কাপ ফুটন্ত পানিতে কয়েক ফোটা গিলয়ের রস মিশিয়ে দিনে দুইবার পান করতে পারেন। তবে হ্যাঁ, মনে রাখবেন গিলয়ের রস বেশি খাওয়া উচিত নয়।
৩)পেয়ারার জুস: পেয়ারাতে আছে প্রচুর পরিমাণ ভিটামিন ‘সি’, যা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হলে আপনি প্রতিদিন এক কাপ করে পেয়ারার রস দিনে দুইবার পান করতে পারেন। পেয়ারার রস খেতে না চাইলে তাজা পেয়ারাও খেতে পারেন।
৪) মেথি বীজ: মেথিতে আছে ভিটামিন ‘সি’, ‘কে’ এবং প্রচুর পরিমাণে ফাইবার, যা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। মেথি দিয়ে চিকিৎসার জন্য আপনাকে এক কাপ গরম পানিতে মেথির বীজ রেখে দিয়ে তা ঠান্ডা করতে হবে এবং এই পানি দিনে অত্যন্ত দুইবার পান করতে হবে।
ডেঙ্গু জ্বরের রোগীদের জন্য খাবার
ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগীদের জন্য পুষ্টিকর খাবার দাবার বেশ গুরুত্বপূর্ণ। পুষ্টিকর খাবারদাবার রোগ প্রতিরোধ বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। ডেঙ্গু রোগীদের জন্য উপকারী কিছু খাবারের তালিকা নিচে দেখুন:
১) ভিটামিন সি যুক্ত খাবার যেমনঃ শাকসবজি, সাইট্রাস ফল, লেবু, বেরি ইত্যাদি।
২) জিংক যুক্ত খাবার যেমনঃ মটরশুঁটি, বাদাম, সামুদ্রিক খাবার ইত্যাদি।
৩) আয়রন যুক্ত খাবার যেমন মাংস, মটরশুঁটির ইত্যাদি।
৪) নারকেলের পানি।
৫) পেঁপে।
৬) ওটোমিল
এর পাশাপাশি প্রচুর পরিমাণে পানি পান করা দরকার শরীরকে হাইড্রেট করার জন্য।
ডেঙ্গু রোগ হলে যেসব খাবার খাওয়া যাবে না
ডেঙ্গু রোগ হলে সহজে হজম হয় না এসব খাবার খাওয়া যাবেনা। এসব খাবার খাওয়ার ফলে রোগী সুস্থ হওয়ার বিপরীতে উল্টো অসুস্থ হয়ে যাবে। ডেঙ্গু হলে যেসব খাবার খাবেন না সেগুলো হলো:
১) ভাজাপোড়া
২) অতিরিক্ত তৈলাক্ত খাবার
৩) আমিষ
৪) চর্বি
ডেঙ্গু জ্বরের প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা:
ডেঙ্গুজ্বর প্রতিরোধের সবচেয়ে ভালো উপায় হচ্ছে সংক্রামিত মশার কামড় থেকে নিজেকে রক্ষা করা। যার জন্য মশার বংশবিস্তার হয় এইরকম সকল স্থান পরিষ্কার রাখতে হবে। চলুন দেখে নেই ডেঙ্গু প্রতিরোধের উপায় গুলো:
১) বাড়ির ভেতরে মশা নিরোধক ব্যবহার করা।
২) সূর্য অস্ত যাওয়ার সাথে সাথে বাড়ির সকল জানালা দরজা লাগিয়ে দেওয়া। ঘুমানোর সময় অবশ্যই মশারি ব্যবহার করা।
৩) বাড়ি থেকে বের হলে সব সময় ফুল হাতা শার্ট, লম্বা প্যান্ট, পায়ে মোজা, পুরো শরীর ঢেকে বের হওয়ার চেষ্টা করতে হবে।
৪) মশার বংশবিস্তার হয় এমন সব জায়গাগুলো খুঁজে বের করতে হবে। যেমনঃ পুরনো টায়ার, বাড়ির সানসেট, ক্যান বা ফুলের টবে জমে থাকা বৃষ্টির পানি। তাই এগুলো নিয়মিত পরিষ্কার করতে হবে।
৫) বাড়ির কোন সদস্য যদি ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়, সেক্ষেত্রে খুব সতর্কের সাথে থাকতে হবে। মশার কামড় থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য সকল ধরনের ব্যবস্থা নিতে হবে।
পরিশেষে, ডেঙ্গু জ্বরের চিকিৎসা ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা সম্পর্কে জ্ঞানার্জন ডেঙ্গু প্রতিরোধে সাহায্য করে। এজন্য প্রতিটি মানুষের উচিত ডেঙ্গু সম্পর্কে যথেষ্ট ধারণা রাখা, কারণ এটি কখন কিভাবে আক্রমণ করবে তা কেউ জানে না। শুধু নিজেদের নয় ডেঙ্গু থেকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য পৃথিবীকে বসবাস যোগ্য রাখতে হলে আমাদের উচিত এখনি ডেঙ্গু নির্মলে সোচ্চার হওয়া। আশা করি এই আর্টিকেলের মাধ্যমে ডেঙ্গু রোগের লক্ষণ ও দ্রুত প্রতিকারের সহজ এবং কার্যকরী উপায় গুলো আপনাদেরকে জানাতে সক্ষম হয়েছি। আমাদের সাথে থাকার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।
Leave a Reply