এক
উত্তরে উড়ে যাচ্ছিল আলাদিনের জাদুর গালিচা। আর নিচ থেকে এক শিং মাছ ডাঙায় উঠে এলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহত কোন প্রেমিকের ছেঁড়া জুতোয় চড়ে। চেঁচিয়ে বললো, ‘কাল থেকে পশ্চিমে সবকিছু সাদা কালো হয়ে যাবে।’
আলাদিন উড়ে যেতে যেতে প্রশ্ন করলো, ‘কেন কেন শিং হে?’
জুতোর সামান্য জলে শুয়ে নদীর তীর থেকে শিং মাছ জবাব দিল, ‘কেন নয় তাই বলো, খোদার চোখে দুনিয়া দেখা আলাদিন হে?’
পশ্চিমের সিনেমাজগত সাদাকালো হয়ে গেল এ বছর। কারণ রোমা।
মেক্সিকো সিটি থেকে শুরু হয়ে ভেনিস। সেখান থেকে ফরাসী দেশ তো এরপর বৃটেনের মেঘলা আকাশের নিচে। তারপর নিশ্চিতভাবেই সাদাকালো হয়ে গেল আমেরিকা। রোমা কি আসলেই সিনেমার নামে এক হীরক খন্ড?
আর্টের নামে হৃদয়ের খুব গভীরে আলোড়ন তুলে দেয়া বিষণ্ণ এক সেলুলয়েড ম্যাজিক?
নাকি এ কেবল নাম সর্বস্ব ওভাররেটেড এক সাময়িক সিনেম্যাটিক উত্তেজনা?
আজকে আমরা জানব রোমা মুভির কাহিনী। মূলত কোন্ পারিপার্শ্বিকতার ভিত্তিতে পরিচালক মুভিতে তৈরি করেছেন আমরা আজকে অভিযাত্রীর পাতায় তাই জানব।
রোমা মুভির ট্রেইলার
দুই
গল্পটি ১৯৭০ সালের। স্থান মেক্সিকো সিটির কলোনিয়া রোমা নামের এলাকাটি।
ছবির শুরুর দৃশ্যটি ইঙ্গিত পূর্ণ। মোজাইক করা শুকনো ফ্লোর। শব্দ আসছে চারপাশ থেকে মৃদু। এরপর মেঝেটিকে ঢেকে দিচ্ছে সাবানগোলা জল। পরিস্কার ফ্লোরটি যেই স্থির হচ্ছে, বারবার সেই স্থিরতা ব্যাহত করছে জলের ধারা। চকচকে ভেজা ফ্লোরে পড়েছে এক টুকরো আকাশের ছায়া।
একটা এরোপ্লেন উড়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। কেন এ দৃশ্য ইঙ্গিতপূর্ণ, তা আমরা এই আলোচনার শেষে হয়ত অনুমান করতে পারবো।
দৃশ্যটি লম্বা হলে আমরা দেখতে পাব কাজটি করছে এক তরুণী। সে শুধু মেঝে পরিস্কার করেনা। এক মধ্যবিত্ত মেক্সিকান পরিবারের রান্না-বান্না, ঘর-গোছানো, বোরাস নামের পোষা কুকুরটিকে খেতে দেওয়া ও তার মল পরিস্কার করা সবকিছুই সে সামলায়।
সঙ্গে আছে আরেক সহকর্মী আদেলা আর মাঝবয়সি ড্রাইভার। পরিবারটি ডাক্তার আন্তোনিও আর তার স্ত্রী সোফিয়ার, এ দম্পতির চারটি উচ্ছল নানান বয়সি সন্তান ও তাদের দাদিমার।
এদের জীবন যাত্রায় নিঃশব্দ যাওয়া আসা সেই তরুণী কাজের মেয়েটির। অন্যদের সম্বোধনের জোরে আমরা জানতে পারি তার নাম ক্লেও। ঘর-গেরস্তির সকল কাজের পাশাপাশি ক্লেও বাচ্চাদেরও সামলায়। বাচ্চারা দারুণ পছন্দ করে তাকে। কে না করে? ক্লেও বিনয়ী, হৃদয়ে সরল ও কর্মে উজ্জ্বল, সৎ, স্বল্পভাষী।
পরিচালক কুয়ারোনের সাদাকালো ফ্রেমে প্রায় এক তৃতীয়াংশ সময় ধরে ঘুরতে থাকে মানুষগুলোর নিত্য জীবন যাত্রা। বাচ্চারা স্কুলে যাচ্ছে। দুষ্টুমি করছে। দাদীমার একমাত্র কাজ নাতি-নাতনীদের সঙ্গে যাওয়া আসা। রাত করে বাসায় ফিরছে পরিবার প্রধান ডাক্তার আন্তোনিও। তার বিশাল ফোর্ড গ্যালাক্সির এশট্রে ভর্তি ধ্বংসপ্রাপ্ত সিগারেট। রেডিওতে বাজছে ক্লাসিকাল মিউজিক। এসমস্ত সাদামাটা দৃশ্যাবলীর ভিতরে গল্প কোথায়? ড্রামা চাইনা আমরা একটা সিনেমা দেখতে বসে।
নিটোল একটা গল্প তো রোমা বলেই। অন্তত বলবে, সেই আশা আমরা করতে শুরু করি।
সিনেমাটি একে একে গল্পের সুতো ছাড়ে কয়েকটা।
নেপালী শিশুতোষ চলচ্চিত্র পাহুনা: ভীষণ মিষ্টি দুটি শিশুর হাসিকান্না- পড়তে ক্লিক করুন
শুরুর দিকেই ক্লেওর কাছে আসে এক যুবকের ফোন, ফার্মিন। আমরা আবিস্কার করি ফার্মিন মূলত ক্লেওর বয়ফ্রেন্ড। এক বদ্ধ ভাড়া করা কামরায় তাদের ছোট্ট প্রেমের দৃশ্যটিতে নুডিটিকে আমরা প্রচল দৃষ্টিভঙ্গির উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি। দেখি যে দিগম্বর সুঠামদেহী ফার্মিন বাথরুম থেকে একটা রড বের করে মার্শাল আর্টের কসরত দেখাচ্ছে ক্লেওকে।
ফার্মিনকে দেখছে ক্লেও, তার আঙ্গিক সৌষ্ঠবে মুগ্ধ হচ্ছে। সুতরাং একজন নারীর দৃষ্টিকোণ থেকে যৌন আবেদনময় মুগ্ধকর পুরূষ হিসেবে ফারমিনকে দেখতে হয়। ফারমিনের পয়েন্ট অব ভিউ যেহেতু এখানে গুরুত্বপূর্ণ না, ক্লেওর নুডিটি দেখাবার কোন প্রয়োজনীয়তা রাখেন না পরিচালক।
কাহিনীর অন্য সুতোটি ছাড়া হয় আন্তোনিও আর সোফিয়াকে ঘিরে।
আন্তোনিও পরিবার ছেড়ে কুইবেকে একটা সেমিনারের জন্য রওনা করে। আমরা দেখি সোফিয়া আবেগ ও বিষাদের মিশ্রণে তাকে জড়িয়ে ধরছে। চুমু খেতে চেষ্টা করছে। কিন্তু আন্তোনিও এসবে বিরক্ত ও অনিচ্ছুক। সে চলে যাওয়ার পর সোফিয়ার অভিব্যক্তিতে দারুণ আক্ষেপ ও আর ক্রোধ দেখি আমরা।
এর কিছুক্ষণ পরেই পরিচালক আমাদের দাঁড় করান সমাজের দুটি স্তরে দাঁড়িয়ে থাকা দু’জন নারীর প্যারালাল জীবনের মুখোমুখি।
ক্লেও প্রেগনেন্ট, এটা জানার পর তাকে ফাঁকি দিয়ে চলে যায় ফারমিন।
অন্যদিকে, আন্তোনিও যে কুইবেকে কনফারেন্সে যায়নি, রোমাতেই আছে, লিপ্ত আছে পরকীয়ায় তা আমরা জানতে পারি ধীরে ধীরে। সোফিয়া তার হাজবেন্ডের এই কীর্তি ধরে ফেলার পরেও বাচ্চাদের জানাতে পারেনা। লুকিয়ে রাখে।
ক্লেও যেমন সোফিয়াকে জানায় তার বাচ্চা হবে, বাচ্চার বাবা তাকে রেখে চলে গিয়েছে, একইভাবে অকস্মাৎ একটা ঘটনায় ক্লেও’ও জেনে যায় গৃহকর্তী সোফিয়ার জীবন তার থেকে ভিন্ন কিছু নয়।
তিন
খুব সাদামাটা না গল্পটা?
যদ্দুর স্মরণ করতে পারি, এমন গল্প বাংলাদেশের সিনেমা ও নাটকে অসংখ্যবার এসেছে।
গৃহকর্মী থেকে পোশাক শ্রমিক নারীরা এ ধরণের দুর্ঘটনার শিকার হন অহরহ। যুগ যুগ ধরে। মধ্যবিত্ত সমাজে শিক্ষিত সাবলম্বী নারীর ক্ষেত্রেও বিষয়টা অতিচেনা।
তাহলে মেক্সিকো সিটির ‘রোমা’ কোথায় আলাদা হতে পেরেছে তার খুব সাধারণ আর মোচড়হীন গল্পটি নিয়ে? সমালোচক আর ভালো সিনেমার দর্শকদের জগত কেন সাদাকালোয় এমন আচ্ছন্ন হয়ে গেল?
এবার আসুন আমরা কিছুটা ভেঙে ভেঙে দেখি।
রোমা কেন সাদাকালো? শুধুই কি সময়টা সত্তরের দশক, তাই? আমাদের মনে পড়ে যাবে স্পিলবার্গের শিন্ডলার্স লিস্টের কথা। তা সাদাকালো রাখবার পেছনে পরিচালকের যুক্তি ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের গণহত্যাকে সিম্বোলাইজ করা।
বলেছিলেন, ‘The Holocaust was life without light. For me the symbol of life is color. That’s why a film about the Holocaust has to be in black-and-white.’
রম্পারের দেয়া তথ্য অনুযায়ী জানতে পেরেছি যে, রঙিন ছবি হিসেবেই এটা শুট করা হয়েছিল প্রথমে। পরবর্তিতে যখন কুয়ারোন এডিট করছিলেন, তার মনে হল এ গল্পটি তিনি দর্শকদের সামনে উপস্থাপন করতে চান যেভাবে স্মৃতিচারণ করে মানুষ।
স্মৃতিতে কোন রঙ তো থাকেনা।
রোমা’র গল্পটি পরিচালকের নিজের জীবন ছেঁকে আনা। এ তাঁর শৈশবের স্মৃতি। পারিবারিক।
যে কারণেই নির্মাণ আর দৃষ্টিভঙ্গির দিক থেকে এ সিনেমাকে তীব্র ব্যক্তিগত বললে ভুল বলা হয়না। ফ্রেম বাই ফ্রেম, আমরা টের পাই দৃশ্যের আড়ালে যা লুকোনো থাকে, সেসব গোপনকে দৃশ্যমান করতে তার সুতীব্র ইচ্ছে।
সিনেমায় এক দৃশ্য থেকে আরেক দৃশ্যে যাওয়ার প্রক্রিয়াটি একটা বই পড়ার মত। পরিচালক নয়, যেন দর্শকই দৃশ্যগুলোর সঙ্গে এগিয়ে চলে মনোরম গতিবেগে।
এক হালি সন্তান নিয়ে সোফিয়ার যে সংগ্রাম, তা মিশে যায় ভুল প্রেমের চিহ্ন শরীরে বহন করে চলা নিস্তরঙ্গ ক্লেওর বিষণ্ণ মৌনতা। সে পুরো ছবিতে হাতে গোণা কয়েকটি বাক্য বলে। তবু তার সৌম্য, তার বেদনার যায়গাটি বুঝে নিতে আমাদের বেগ পেতে হয়না কোন।
অপর দিকে সোফিয়াকে আমরা দেখি বিষাদ চেপে রাখতে সে অক্ষম। রাতে মদ্যপ হয়ে বাসায় ফেরা। বাচ্চাদের সঙ্গে রাগারাগি। কিন্তু ক্লেওর প্রতি তার মমতাটি চাপা থাকেনা কখনও।
রোমার পটভূমি মেক্সিকোর রাজনৈতিক ইতিহাসের উত্তপ্ত এক সময়কালে। ১৯৬৯ সালে মেক্সিকো সিটিতে ঘটে যাওয়া কুখ্যাত এক ম্যাসাকার ঘটে গিয়েছে রাষ্ট্রীয় ইশারায়। সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনরত অনেক ছাত্র-ছাত্রী মারা গিয়েছিল ভাড়াটে সন্ত্রাসীদের গুলিতে।
ক্লেওর গর্ভ যন্ত্রণার সঙ্গে এই ম্যাসাকারকালীন উত্তপ্ত মেক্সিকো সিটিকে মিলিয়ে দেন কুয়ারোন। ক্লেওর জল ভাঙে, শহরে গোলাগুলি শুরু হয়। মানুষ প্রাণ নিয়ে ছুটছে যখন, ক্লেওর গর্ভ থেকে নতুন এক প্রাণ চায় পৃথিবীর আলো দেখতে।
কুয়ারোনের ডিস্টোপিয়ান সিনেমা ‘চিল্ড্রেন অব মেন’ যারা দেখেছেন, জেনে থাকবেন নারকীয় পরিবেশ তৈরিতে লোকটা কেমন দক্ষ ও গভীর।
রোমা’য় মানুষের তৈরি নরক নেমে আসে খুব স্বাভাবিকভাবে, মিছিলের গর্জন, মানুষের হৈচৈ, গুলির শব্দে যোগ হয় ক্লেওর গর্ভ যন্ত্রণার চিৎকার।
তারপর?
নিরবতা কি নামে?
চার
রোমা মানুষের বর্ণহীন জীবনের গোপন দিকটি উন্মোচনের চেষ্টা করে।
একে অন্যের আড়ালে আমাদের জীবনটি কি খুব আকর্ষণীয় কিছু?
ঝড়ের শেষে আমরা ঘুরে দাঁড়াবার চেষ্টা করি। সবাই যে তা পারে এমনও না। তবু মানুষের এই পতনের পর উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টাটিকে বড় করে দেখায় রোমা।
সিনেমার শুরুতে দেখানো সেই শুকনো ফ্লোরে জলের স্রোত ফিরে ফিরে আসার দৃশ্যটির কথা ভাবুন তো। একবার যে জল শুকনো করুণ পৃথিবীকে ভিজিয়ে দিতে শুরু করে, যতক্ষণ তা গড়িয়ে না যায় নালা দিয়ে, শুকিয়ে না যায় রোদে, অতক্ষণই তো আমাদের জীবন।
কংক্রিটের মেঝের মত করুণাহীন পৃথিবীকে ভিজিয়ে দেবার চেষ্টায় কোন কমতি রাখেনা মানুষ। কিন্তু শক্ত মোজাইকের মেঝেতে কি আর জল প্রবেশ করে?
আবার একই দৃশ্যকে অন্য ভাবেও দেখা যায়।
ঐ মেঝেটিই জীবন। সাবানগোলা জলের অনবরত ধারা জীবনকে ভাসিয়ে নিতে চায়, টলমল করে রাখতে চায়, দিতে চায় অস্থিরতা। কিন্তু যাকে আমরা দেখি বয়ে চলা জীবন, তা তো আসলে ঐ মেঝের মতই স্থির। কোথাও যায়না। সে শত ঝঞ্ঝাতেও যতক্ষণ পারে অটল থাকে।
আবার, ধরুণ, সেই এরোপ্লেনের কায়া যে জলের বিম্বে পড়লো, উড়ে গেল দূর আকাশ দিয়ে, সে কি আমাদের স্বপ্ন’র রূপক নয়? মুক্ত আকাশে পাখির মত উড়ে বেড়াবার?’
ছবির শেষ দৃশ্যটিতে ক্লেও সিঁড়ি বেয়ে উপরের দিকে উঠতে থাকে তার ছোট্ট ঘরটার দিকে। সে কি পতনের পর আবার তার উত্থানের ইঙ্গিতই দেয়না?
রোমা এমন অজস্র দৃশ্যের কারণেই সিনেমার চেয়ে আরও বেশি কিছু হয়ে ওঠে। সেলুলয়েডের দর্শনে যোগ করে এক নতুন পাঠ। ছবি শেষে সবকিছু আঁধার হয়ে যাবার পর বুঝতে পারি হৃদয়ের খুব গোপন কোন তন্তুতে যেন লেগেছে দারুণ আঘাত।
এক নজরে মেক্সিকান সিনেমা ‘রোমা’
চলচ্চিত্র: রোমা (২০১৮)
পরিচালক রোমা মুভিটিকে সুন্দরভাবে তাঁর ফুটিয়ে তুলেছেন মুভি পরিচালনায়। তখনকার সময়ে রোমাতে নারীদের যৌন হয়রানি নিয়ে ঘটে যাওয়া ঘটনাই মূলত তিনি তুলে ধরেছেন তাঁর নিপুণ পরিচালনায়।
Leave a Reply