জয় গোম্বামীর সুবিখ্যাত, ‘মালতীবালা বালিকা বিদ্যালয়’ কবিতার নামহীন নবম শ্রেণী পড়ুয়া কথক একদা তার ভালোবাসার মানুষ বেণীমাধবের কাছে আকুলতা নিয়ে প্রশ্ন রেখেছিল-
“বেণীমাধব, বেণীমাধব, তোমার বাড়ি যাবো
বেণীমাধব, তুমি কি আর আমার কথা ভাবো?”
কবিতায় বেণীমাধবের নতুন প্রেমিকা জুটে যাওয়ার খবর পাওয়া গেলেও, নবম শ্রেণীর সেই কিশোরীকে সে আদৌও মনে রেখেছে কিনা, তার হদিশ আমাদের পাওয়া হয়না। এক তরফা কেবল জানতে পারা যায়, নামহীনা কথক সময় উজিয়েও মনে রেখেছে তার কৈশোরের প্রেম আর প্রেমিক বেণীমাধবকে।
হাত গলে প্রেম পড়ে গেলেই সব চুকেবুকে গেছে, এমন নিরেট বাস্তবতায় বাঁধা পড়ে না সবার হৃদয়। কবিতার কথকও সেই বোকাদের দলের। তাই তার ভোলা হয়নি বেণীমাধবকে। ‘অভ্যেস বলে কিছু হয় না এ পৃথিবীতে, পাল্টে ফেলাই বেঁচে থাকা’র শাসনে লক্ষীমন্ত হয়ে ঘর সংসারে মন দেয়াও হয়নি তার।
কারো কারো কাছে প্রথম প্রেম জন্মদাগের মত। শরীর জুড়েই থেকে যায়। সময়ে খানিক ফিকে হয়ত হয়, কিন্তু একেবারে ধুয়েমুছে যায় না। সেদিনের সেই কিশোরী, এক সময় নিজের পাড়ায় সেলাই দিদিমণি হিসেবে পরিচিতি পায়, তার মন জুড়ে তখনও বেণীমাধব। তখনও সে ভাবতে ভালোবাসে-
‘এ ভ্রমণ আর কিছু নয়, কেবল তোমার কাছে যাওয়া।’
সেই আকুতিতেই তার প্রশ্ন, প্রেমিক বেণীমাধব এখনও তার কথা ভাবে কিনা।
বেণীমাধব, বেণীমাধব, তোমার বাড়ি যাবো
সার্থক দাশগুপ্ত নির্মিত ‘মিউজিক টিচার’ হিন্দি চলচ্চিত্রটির সাথে জয় গোস্বামীর ‘মালতীবালা বিদ্যালয়’ কবিতাটির আদৌও কোনো সম্পর্ক আছে কিনা আমার জানা নেই। চলচ্চিত্রের কেন্দ্রীয় চরিত্রের নাম বেণীমাধব ছাড়া আর কিছুতেই কবিতার সাথে এর মিল নেই। সিনেমার চরিত্রের নাম যদি অরুণ, বরুণ, বা কিরণ হতো, তবে কবিতাটিকে এখানে টেনেহিঁচড়ে প্রাসঙ্গিক করার চেষ্টা চলতো না, বলাই বাহুল্য।
মালতীবালা বালিকা বিদ্যালয়
‘মালতীবালা বালিকা বিদ্যালয়’ যতবার পড়া হয়েছে, সেলাই দিদিমণিটির জন্য বুকের ভেতর কেমন একটা করেছে। তার উত্তরহীন প্রশ্নের মুখে, অনেক সময় একটা উত্তর জুড়ে দিতে ইচ্ছা করেছে। নেটফ্লিক্সের সৌজন্যে ২০১৭ সালে প্রারম্ভিক মুক্তিপ্রাপ্ত ‘মিউজিক টিচার’ দেখে কেন জানি মনে হলো, এতদিনে কবিতার সেলাই দিদিমণিটি হয়ত তার প্রশ্নের উত্তর পেলেন! যদিও পুরো বিষয়টাই আমার মনগড়া, তবুও মনকে স্বান্ত্বনা দিতে অলীক কল্পনা মন্দ কী, তা যখন কারো জন্যেই ক্ষতিকর নয়! তাই ‘মিউজিক টিচার’ কে ‘মালতীবালা বিদ্যালয়’ কবিতার সেলুলয়েডীয় সিকুয়েল হিসেবে কেন জানিনা ভাবতে ভালো লেগেছে।
সিনেমার বেণীমাধব তার প্রেমিকাটিকে সঙ্গোপনে মনে করে। পুরনো দিনের ভেতর খুঁজে পায় সুখ, একই সাথে যন্ত্রণাও। কিন্তু প্রকাশ্যে নিরন্তর তার প্রতি দেখায় বিতৃষ্ণা।
দীর্ঘ আট বছর পর জ্যোৎস্না, যে কিনা হালে মুম্বাইয়ের নামকরা গায়িকা, তার শহরে ফেরার খবরে সিমলার আনাচ কানাচ থেকে বাতাস বুঝি নৈঃশব্দের ভাঁজ খুলে বেণীমাধবের কানেকানে ফিসফিসিয়ে বলে-
“বেণী মাধব, তুমি কি আর আমার কথা ভাবো?”
ভাবে বটে বেণীমাধব, খুব ভাবে। কিন্তু সপাটে সেকথা স্বীকার করতেও তার বিরক্তি। পাহাড় ঘেরা ছোট্ট সিমলা শহরটা যখন দারুণ উচ্ছ্বাসে মাইক আর পোস্টারে ছড়িয়ে দিতে থাকে বিশেষ একজনের ফেরার কথা। নরসুন্দর থেকে শুরু করে পাড়ার ক্লাবের চ্যাংড়া ছেলেটাও যখন অহেতুক অথচ উদ্দেশ্যমূলক কৌতূহলে বিশেষ মানুষটার কথা সামনে আনতে থাকে; সবার উপস্থাপিত সেসব খবরে বেণীমাধবের দুঃখ কেমন বিষাদ পাখি হয়ে উড়াউড়ি শুরু করে। খুব সন্তর্পণে আপাতত শান্ত, আপনাতে আপনি বিভোর বেণী মাধবের আচরণের খোলস খুলে কাছাকাছি হতে চায় তার বিগত অতীত। স্মৃতির আঁচে পুড়তে থাকে বেণীমাধব- আপাতত একা। অথচ শহর জুড়ে তার আগমনী বার্তায় কিংবা ‘সে আসছে’ বোনের এমন উত্তেজনা দেখে বেণীমাধবের অবজ্ঞা চিবুক নাড়ে ছদ্ম বিরক্তি নিয়ে।
দর্শকের বুঝে নিতে একদমই কষ্ট হয় না, যার সেনসেশনাল অ্যাপিয়ারেন্সের অপেক্ষায় আছে পাহাড়কে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকা ছোট্ট শহর সিমলা, জ্যোৎস্না রায় নামের সেই মানুষটির সাথে বেণীমাধবও জড়িয়ে আছে একই নিবিড়তায়। এই দুটি মানুষকে জুড়ে যে অতীত, তার কিছু খণ্ডিত অংশ দর্শক দেখতে পান পর্দায়। গল্পটা উঠে আসতে থাকে ফ্ল্যাশব্যাকের হাত ধরে। আর দশটা প্রেম কাহিনি থেকে খুব আলাদা না মিউজিক টিচারের কাহিনি। তবে কাহিনি বর্ণনার সরলতা, সিমলার নিজস্ব নৈসর্গিক সৌন্দর্য, ‘মিউজিক টিচার’ এ আলাদা একটা টিউন জুড়ে দিয়েছে, এ কথা বলতেই হয়।
অনেক দর্শকই হয়ত, ধ্যাৎ! দেখবো না যাঃ, ‘সেই তো রাণী সেই তো রাজা, সেই তো একই ঢাল তলোয়ার’ বলে উঠতেই পারেন। কিন্তু মিউজিক টিচারের সাথে শেষ পর্যন্ত হেঁটে যেতে পারলে, দর্শক খুব হতাশ হবেন না। অন্তত আমি হইনি। সিনেমার শেষটায় ‘বাজলো বুকে সুখের মত ব্যথা’র রেশটা সব সিনেমায় এতটা দক্ষতায় ওঠে আসে না। অন্তত গতানুগতিক হিন্দি সিনেমায় সেটা পাওয়া যায় না।
চলচ্চিত্র মিউজিক টিচার
‘মিউজিক টিচার’কে সোজা সাপ্টাভাবে, ‘এ ফিল্ম এ্যাবাউট রিগ্রেট’, ‘লেটিং গো অফ দ্য পাস্ট এণ্ড মুভিং অন’ এর তকমা দিয়ে দেয়াই যায়। একই সাথে, এটাকে নিরন্তর অপেক্ষায় থাকা কিছু মানুষকে হাত ধরে তাদের গন্তব্যে টেনে নেবার সিনেমাও বলা যেতে পারে। গন্তব্যে পৌঁছানের সে গল্পে, সন্তানের সাক্ষাৎ পাওয়ার আকাঙ্ক্ষায় উদগ্রীব বাবার চিরপ্রস্হান কিংবা গীতা নামের চরিত্রটির ‘ওদের ভালো হোক’ এর নীরব উচ্চারণটুকু রেখে সন্তর্পণে বিদায়ে যেমন মন ভারাক্রান্ত হয়; একই সাথে দীর্ঘ আট বছর পর জ্যোৎস্না আর বেণীমাধবের আবার দেখা হবার মেলোড্রামাহীন আচরণ ‘জুড়িয়ে দিলো মন আমার’ বলার মত ভালোলাগার মুহূর্ত তৈরি হওয়াটাও উপভোগ্য।
কেন বেণীমাধবের অনুশোচনা, দীর্ঘ আট বছরে কেন জ্যোৎস্না তার প্রিয় বেণীদার সাথে যোগাযোগ রাখেনি, বাবার ডায়েরির ভেতর উর্মির অপরিচিত নারীর ছবি খুঁজে পাওয়া, মা নীনা গুপ্তার ‘সব আমারই কারণে’ আক্ষেপের গভীরে লুকিয়ে থাকা সত্যিগুলো যেন প্যাজলের মত গোটা কাহিনিতে ছড়িয়ে দিয়েছেন চলচ্চিত্র পরিচালক সার্থক দাশগুপ্ত। অথচ কোথাও নিয়ন্ত্রণহীনতার লক্ষণ নেই। পরিমিতিবোধের শিল্পিত প্রকাশ দেখা গেছে ‘মিউজিক টিচার’এর শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত। খুব মোটা দাগে খাপে খাপ মেলানোর ভঙ্গিতে গল্প না বলে কিছুটা আড়াল, কিছুটা আলগোছে রাখার ব্যাপারটা অনেক দর্শকই উপভোগ করবেন মনে করি।
ছিমছাম স্ক্রিপ্ট, অসাধারণ লোকেশন, চমৎকার সঙ্গীতায়োজন, আর অনবদ্য সিনেমাটোগ্রাফি ‘মিউজিক টিচার’ এ দক্ষ পার্শ্বচরিত্রের ভূমিকায় থেকেছে আগাগোড়া। অভিনয়ে প্রায় প্রত্যেকেই যথেষ্ট সুবিচার করেছেন। বিশেষ করে প্রধান তিন চরিত্র মানব কাউল(Manav Kaul), অমৃতা বাগচী(Amrita Bagchi), দিব্যা দত্ত(Divya Dutta)’র কথা না বললেই না। সব মিলিয়ে ‘মিউজিক টিচার’ উপভোগ্য টীম এ্যাফোর্ট দিয়েছে। পুরো টীমকে ধন্যবাদ।
সার্থক দাশগুপ্ত পরিচালিত ‘মিউজিক টিচার’ একটি হিন্দি চলচ্চিত্র, যেখানে জয় গোস্বামীর ‘মালতীবালা বিদ্যালয়’ কবিতার মিশ্রণে চলচ্চিত্রের আদ্যোপান্ত সাজানো। এখানে কবিতার নায়িকা আর মুভির নায়িকার একই নাম প্রকাশ করে চলচ্চিত্র সাজানো হয়েছে।
Leave a Reply