আমরা দৈনন্দিন জীবনে প্রতিদিন নতুন নতুন তথ্যের সাথে পরিচিত হচ্ছি। এসবের মধ্যে কোনটি মস্তিষ্কে স্থায়ী হচ্ছে, কোনটি মুছে যাচ্ছে। এই নিয়মে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য মস্তিষ্ক থেকে মুছে যায়। বিশেষ করে, ছাত্রছাত্রীরা সবচেয়ে বেশি এই সমস্যাটির সম্মুখীন হয়। প্রতিদিনের পড়াগুলো যথাযথভাবে মনে রাখা এবং সেগুলো পরীক্ষার খাতায় তুলে ধরা অনেকের জন্যে কঠিন হয়ে পড়ে।
তবে আড়াই পেটাবাইট ধারণ ক্ষমতার মস্তিষ্কে যেকোন তথ্য ধরে রাখা সম্ভব। তার জন্য শুধু প্রয়োজন পড়া মনে রাখার কৌশল অবলম্বন করা। যুগ যুগ থেকে এসব পদ্ধতি আত্মস্থ করার ক্ষেত্রে কার্যকরী ভূমিকা রেখে আসছে।
পড়া মনে রাখার কৌশল
আমরা অনেকে বিশেষ করে ছাত্র-ছাত্রীরা বিভিন্ন বিষয়ের গুরুত্বপূর্ণ তথ্যগুলো প্রায়শই ভুলে যাই। এক্ষেত্রে যদি কিছু কৌশল জানা যায় তবে কেমন হয়! চলুন আমরা আজকে জেনে নিই পড়া মনে রাখার কৌশলগুলো সম্পর্কে, যা জীবনে সফলতার কাজে সহায়তা করবেঃ
তথ্যগুলো সাজিয়ে গল্প তৈরী করুন
আমরা সু-সজ্জিত কোন গল্পকে সহজে মনে রাখতে পারি। কিন্তু খন্ড খন্ড তথ্য কিংবা লাইন মনে রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। তাই কোন নির্দিষ্ট টপিকের সকল তথ্যকে গল্প আকারে সাজিয়ে ফেলুন। এরপর আপনি একটি চমৎকার ধারাবাহিকতা পেয়ে যাবেন। ফলে কোথাও কোন তথ্য বাদ পড়ে গেলে আপনা থেকেই তা মনে পড়ে যাবে।
পড়া মুখস্থ করার ক্ষেত্রে অবস্তুগত বিষয়গুলোর কোন চরিত্র বানাতে পারেন। তারপর সেই চরিত্রায়নের ক্ষেত্রে ঐ জড় পদার্থের বৈশিষ্ট্যকে ধারণ করতে পারেন। এছাড়া কোন ঘটনা আত্মস্থ করতে তার ধারাবাহিকতা মনে রেখে মুখস্থ করার চেষ্টা করুন।
আবৃত্তি করে পড়ুন
তথ্যগুলোকে ধারাবাহিকভাবে সাজিয়ে গল্প তৈরী করার পর সেটিকে আবৃত্তির মাধ্যমে অভিনয় করে পড়ুন। এর ফলে পুরো গল্পটা আপনার স্মৃতিতে ধরে রাখতে সুবিধা হবে। একই সাথে, আপনি সেগুলো আনন্দের সাথে মনে রাখতে পারবেন। এক্ষেত্রে কারো সামনে আবৃত্তি করতে পারেন। আবৃত্তির পর অবশ্যই তথ্যগুলোর বিশ্লেষণ করুন। এসময় পুরো বিষয়কে এমনভাবে উপস্থাপন করুন যাতে তার বুঝতে সুবিধা হয়। কারো সামনে গিয়ে বলা সম্ভব না হলে, আয়নার সামনে গিয়ে নিজেই পুরো বিষয়টি উপস্থাপন করতে পারেন। পড়া বা কোন তথ্য মনে রাখার কৌশলের মধ্যে এটি ভালো একটি পদ্ধতি।
নেমোনিক
পড়া মনে রাখার গোপন কৌশল হিসেবে নেমোনিক পদ্ধতি বেশ কার্যকর ভূমিকা রাখে। এর সুবিধা হলো পরিচিত শব্দের সাথে মিল রেখে কোন শব্দকে মনে রাখা। এটি ভোকাবুলারি মনে রাখার ক্ষেত্রে সবচেয়ে কার্যকরী। কারণ ভোকাবুলারি পড়ার সময় অনেক নতুন এবং জটিল শব্দ আসে। তখন পূর্বের পড়া কোন শব্দের সাথে মিলিয়ে নিলে শব্দটি সোজা হয়ে যায়।
যেমনঃ Bacchanalian শব্দটির অর্থ Drunken Festivity অর্থ্যাৎ যে ফেস্টিভালে মূলত মদ্যপান করা হয়। এটিকে Mnemonically মনে রাখতে চাইলে আমরা অমিতাভ বচ্চন নামের সাথে মিলিয়ে নিতে পারি।
ধরুন, (অমিতাভ) বচ্চন (Bacchan) এর পার্টিতে হার্ড ড্রিংকসের সমারোহ থাকবে। সুতরাং অমিতাভ বচ্চনের হার্ড ড্রিংকস পার্টির সাথে মিলিয়ে Bacchanalian শব্দটি সহজে মনে রাখা যায়।
ছন্দ তৈরী করুন
কয়েকটি নাম একসাথে মনে রাখতে এই পদ্ধতি খুব কার্যকরী। নামগুলোকে একসাথে সহজ ছন্দে বেঁধে ফেলুন। তারপর তাল ও শব্দগুলো মনে রাখুন। এর ফলে ছন্দের শব্দগুলো আপনাকে ঐ তথ্যগুলোর কথা মনে করিয়ে দিবে। তাছাড়া এটি পড়ায় মনোযোগ ধরে রাখতেও সাহায্য করে।
এছাড়া আপনার পছন্দের কোন গানের সুরে কথা বসিয়ে কোন কিছু মনে রাখতে পারেন। পরবর্তীতে অবসর সময়ে গানটি শুনলে আপনার ঐ কথাগুলো মনে পড়বে। সুতরাং ঐ বিষয়টি মনে রাখতে আপনার সুবিধা হবে।
যেমনঃ বৈষ্ণব পদাবলির ৫ জন কবির নাম মনে রাখার ছন্দ হলো – “বলে বিদ্যা চন্ডী, জ্ঞান গোবিন্দ রবি”।
এখানে,
বলে = বলরাম
বিদ্যা = বিদ্যাপতি
চন্ডী = চন্ডীদাস
জ্ঞান = জ্ঞানদাস।
গোবিন্দ = গোবিন্দদাস
রবি = রবীন্দ্রনাথ
রেকর্ডিং
মানুষ স্বভাবতই একজন ভালো শ্রোতা। কোন তথ্য শুনে আমরা সহজেই মনে রাখতে পারি। গল্প বানিয়ে আবৃত্তি করে কিংবা ছন্দবদ্ধ কবিতাকে সুরে সুরে পড়ে সেগুলো রেকর্ড করে রাখতে পারেন। এর ফলে আপনি যেকোন সময় সেই রেকর্ডিং শুনতে পারবেন।
আপনার কাছে সবসময় খাতা-কলম কিংবা বই রাখার প্রয়োজন হবে না। তবে অবশ্যই স্পষ্ট কন্ঠে ও চমকপ্রদ ভঙ্গিতে রেকর্ড করুন। এর ফলে রেকর্ডিং শুনতে আপনি বিরক্তি অনুভব করবেন না। এটা পড়া মনে রাখার কৌশলের আরেকটি বিশেষ পদ্ধতি।
চিত্রকল্প কল্পনা করুন
পড়ার সময় কিংবা তথ্যগুলোকে প্রথম শোনার সময় একটি চিত্রকল্প চিন্তা করুন। এক্ষেত্রে নিজের কল্পনাশক্তিকে কাজে লাগান। পাশাপাশি সে বিষয়ের উপর ইন্টারনেটে স্থিরছবি খুঁজতে পারেন। এটি আপনাকে চিত্রকল্প তৈরী করতে সাহায্য করবে।
এছাড়াও ফিক্সড কিছু পয়েন্ট দিয়ে ডায়াগ্রাম তৈরী করতে পারেন। তারপর ডায়াগ্রামটিকে মনে রাখুন। সম্ভব হলে পুঁথিগত জ্ঞান থেকে বেরিয়ে এসে ব্যবহারিক জ্ঞান অর্জনে জোর দিন।
আপনার আশেপাশে থাকা যেকোন বস্তু দিয়ে একটা ইমেজ তৈরী করে পড়ার বিষয়ের সাথে সংযুক্ত করে নিন। যেমনঃ বাতাসের উপাদান মনে রাখার জন্যে কয়েকটি ছোট কাগজের টুকরো একসাথে করুন। প্রতিটি কাগজের টুকরোতে বায়ুমন্ডলের উপাদানের নাম লিখুন।
অতঃপর একটি পৃষ্ঠার উপর সবগুলো টুকরো রাখুন। কল্পনা করুন, পৃষ্ঠাটি বায়ুমন্ডল ও টুকরো কাগজ বায়ুর উপাদান। চিত্রটি মনে রাখার চেষ্টা করুন। পরবর্তীতে খুব সহজেই উপাদানগুলোর নাম মনে পড়বে।
আদ্যক্ষর মনে রাখুন
অনেক সময় একই টপিকে অনেকগুলো নাম কিংবা তথ্য মনে রাখতে হয়। একসাথে একাধিক নাম মনে রাখতে তাই বিশৃঙ্খলার সম্মুখীন হতে হয়। ছন্দ ছাড়াও আমরা আদ্যক্ষর ব্যবহার করে নতুন শব্দগুচ্ছ তৈরীর মাধ্যমে এসব সহজে মনে রাখতে পারি।
এক্ষেত্রে প্রতিটি শব্দের প্রথম অক্ষর নিয়ে একটি সহজ বাক্য তৈরী করা যেতে পারে। এর ফলে প্রতিটি আদ্যক্ষর আমাদেরকে সেই নামগুলো কিংবা তথ্যগুলো মনে করিয়ে দিবে। যেমনঃ সকল কারকে সপ্তমী বিভক্তি মনে রাখার নিয়ম – “পা গুটা দিপতি”।
অর্থ্যাৎ
পা – পাগলে কি না বলে। (কর্তৃকারকে ৭মী)
গু – গুরুজনে কর নতি। (কর্মকারকে ৭মী)
টা – টাকায় কি না হয়। (করণকারকে ৭মী)
দি – দীনে দয়া কর। (সম্প্রদানকারকে ৭মী)
প – পরাজয়ে ডরে না বীর। (অপাদানকারকে ৭মী)
তি – তিলে তৈল হয়। (অধিকরণ কারকে ৭মী)
লিংক করুন
নতুন পাওয়া তথ্য কিংবা পড়াকে পূর্বের কোন বিষয়ের সাথে সংযোগ করা যেতে পারে। এই পদ্ধতিতে পুরোনো তথ্য ঝালাই হয়ে যাবে এবং নতুন তথ্য আত্মস্থ করতে সুবিধা হবে।
তবে এই পদ্ধতির অনেকগুলো ধরণ রয়েছে। দুইটি একই প্রায় একই ধর্মী ঘটনাকে পরস্পরের সাথে জুড়ে দিয়ে মনে রাখতে পারেন।
যেমনঃ বাংলা সাহিত্যের প্রথম মহাকাব্য “মেঘনাদবধ কাব্য” প্রকাশ হয় ১৮৬১ সালে। আবার বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মও একই সালে। আপনি এই দুটো তথ্যকে একসাথে জুড়ে দিতে পারেন। অন্যদিকে, বঙ্গভঙ্গ রহিত হয় ১৯১১ সালে আর রবীন্দ্রনাথ নোবেল পান ১৯১৩ সালে।
অর্থ্যাৎ দুটো ঘটনা প্রায় একই সময়ে ঘটে কিন্তু তাদের মধ্যে পার্থক্য দুই বছর। এই পদ্ধতিতে আপনি একটি মনে রাখলেই আরেকটি মনে রাখতে পারবেন। এছাড়া বিপরীত ভাবে লিংকিং করেও মনে রাখতে পারেন।
যেমনঃ ডেবিট বলতে দাতা বুঝায়। অপরপক্ষে, ক্রেডিট বলতে ঠিক বিপরীত অর্থ্যাৎ গ্রহীতাকে বুঝায়। বিপরীতধর্মীতা ছাড়াও অনেকে ভুল থেকে কোন ঘটনা ভালো মনে রাখতে পারে।
যেমনঃ ধরুন, কারো জন্মদিন ফেব্রুয়ারী মাসের ২০ তারিখ। আপনি তাকে গত বছর ভুলবশত জানুয়ারীর ২০ তারিখে শুভেচ্ছা জানিয়েছিলেন। আপনি ভুলটি মনে রেখে তার সঠিক জন্মদিন মনে রাখতে পারেন।
লিংকিংয়ের মাধ্যমে আত্মস্থ করার আরেকটি পদ্ধতি হলো – পেগ মেথড অর্থ্যাৎ সমধর্মী শব্দের সাথে মিলিয়ে নতুন শব্দ মনে রাখা। যেমনঃ মাসকলাইয়ের বৈজ্ঞানিক নাম “ভিগনা মুনগো” (Vigna Mungo). আপনি “ভিগনা” কে “ভাঙা” এবং “মুনগো” কে “ম্যাংগো” অর্থ্যাৎ “ভাঙা ম্যাংগো” হিসেবে মনে রাখতে পারেন। তাহলে পরিচিত শব্দের মাঝেই নতুন শব্দকে খুঁজে পাবেন।
স্টিকি নোট
বড় বড় তথ্যকে আমরা সবচেয়ে বেশি ভুলে যাই। আপনি এই ধরণের বিষয় মনে রাখতে “স্টিকি নোট” পদ্ধতি অনুসরণ করতে পারেন। এর জন্যে তথ্যগত মোড় নির্বাচন করুন। তারপর সেই ঘটনার মোড় থেকে কিছু কি-ওয়ার্ড বের করুন। সেই কিওয়ার্ডগুলো একটি ছোট কাগজে লিখে রাখুন।
এরপর সেটিকে ঘরের ভেতর চোখের নাগালে কোন স্থানে লাগিয়ে রাখুন। এর ফলে ঐ কিওয়ার্ডগুলো আলাদা করে মনে থাকবে এবং সেগুলো ঘটনার কিংবা তথ্যের মোড় নির্দেশ করবে। যার কারণে পুরো ঘটনা খুব সহজেই আপনার মনে পড়বে।
মেথড অফ লোকি
গোয়েন্দা সিরিজ শার্লক হোমসের গল্পে এটি খুব বেশি ব্যবহৃত হয়। কোন তথ্যকে সহজে মনে রাখতে এই পদ্ধতি খুব কার্যকরী ভূমিকা রাখে। মূলত কোন তথ্যকে যথাযথ উপায়ে মনে রাখতে শার্লক হোমস এই পদ্ধতি ব্যবহার করতেন। এই পদ্ধতি অনুসরণ করতে কোন কিছুকে খুব ভালো করে পর্যবেক্ষণ করুন।
বিষয়টির পুরো বিস্তারিত মনে রাখুন। সেটির প্রতিটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিষয়ের সাথে মন সংযোগ করুন। অতঃপর চোখ বন্ধ করে সেগুলোকে নিয়ে পুনরায় ভাবুন। যেমনঃ একটি ঘরের ক্ষেত্রে এই পদ্ধতি প্রয়োগ করুন। সেক্ষেত্রে ঘরের প্রতিটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জিনিসের উপর দৃষ্টি রাখুন। প্রতিটি বিষয়ের ডিটেল খুব ভালো করে লক্ষ্য করুন।
তারপর চোখে বন্ধ করে সেই জিনিসগুলো কল্পনা করতে চেষ্টা করুন। এই পদ্ধতিতে খুব সহজে অনেক তথ্য স্মৃতিতে রাখা যায়।
পুনরাবৃত্তি
আমরা আমাদের পড়ার বিষয়গুলোর মধ্যে কেবল ১০-২৫% শতাংশ মনে রাখতে পারি। বাকি ৯০-৭৫% আমরা চর্চার অভাবে ভুলে যাই। বারবার কোন তথ্যকে পড়লে আমাদের স্মৃতিতে তার পুনরাবৃত্তি ঘটে। যার ফলে সে সম্পর্কে আমাদের পুরো ধারণা স্পষ্ট হয়। ফলে তথ্যটি ভুলে যাওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়।
এছাড়া প্রতিদিন ঘুমাতে যাওয়ার আগে সারাদিনের কাজকর্মকে পুনরায় মনে করার চেষ্টা করুন। এর ফলে আপনার স্মরণশক্তি বৃদ্ধি পাবে ও স্মৃতিতে নতুন তথ্যের ভিত্তি পোক্ত হবে। পাশাপাশি ঘুমের ভেতর সেসব তথ্যগুলো মস্তিষ্কে প্রোসেসিং হতে থাকবে।
মানুষের চেষ্টার কাছে যেকোন কিছুই পরাজিত হতে পারে। স্মৃতিও এর উর্ব্ধে নয়। শুধু যে পদ্ধতি আমাদের জন্যে বেশি কার্যকর তা খুঁজে নিতে হবে। সঠিকভাবে পড়া মনে রাখার কৌশল আর নিজ চেষ্টার মাধ্যমে আপনি এই নিত্য চ্যালেঞ্জে জয়ী হতে পারেন।
আপনার এই পথযাত্রায় অভিযাত্রীর পক্ষ থেকে শুভকামনা।
Leave a Reply