মানুষের জীবনে দাম্পত্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। দাম্পত্য জীবন সুখের না হলে বা বুঝার জায়গাতে মিল না হলে জীবন হয়ে উঠতে পারে বিষাদময়। বৈবাহিক জীবনে ছোট ছোট কিছু ভুলের কারণে প্রবাহমান জীবনের সঠিক রাস্তা হতে ছিটকে পড়তে পারি আমরা । অথচ একটু সচেতন হলে এড়ানো যায় এসব সমস্যা।
জগত সংসারে নারী ও পুরুষ একে অপরের সাথে সৃষ্টিলগ্ন থেকে জড়িত। সৃষ্টিকর্তা একে অন্যকে পরিপূরক করে দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন। যার কারণে নারী-পুরুষের বৈবাহিক বন্ধন একটি স্বর্গীয়, সামাজিক এবং শাশ্বত বিষয় হিসেবে বিবেচ্য হয়। পুরো জীবনের একটি সিদ্ধান্ত নিতে পরিবার ও ভবিষ্যৎ দম্পতি অনেক কিছু যাচাই-বাছাই করতে থাকেন।
তারপর ব্যাটে-বলে মিলে গেলে দু’জনের সম্মতিতে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে সারাজীবন একে অন্যের হয়ে যান। কিন্তু সুখের আশায় বুক বাঁধলেও সেই বুকের পাঁজর সবার ক্ষেত্রে অক্ষত থাকে না। সংসার জীবন কারো কারো কাছে স্বর্গীয় আশীর্বাদ না হয়ে নরকীয় অভিশাপ হয়ে যায়। দুজনের মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টায় না পারতে পেরে একটা সময় আলাদা হবার সিদ্ধান্তও চলে আসে।
পৃথিবীর কোন সুস্থ সংস্কৃতি বিবাহ বিচ্ছেদকে সমর্থন করে না। কিন্তু মনের সমর্থন যেন উর্ব্ধে চলে যায় সবকিছুর। পশ্চিমা বিশ্বে বিবাহ বিচ্ছেদ একটি শঙ্কার নাম সেতো অনেক আগের কথা। আর আমাদের দেশে সম্প্রতি হয়ে উঠছে।
ডয়চে ভেলের একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায় –
“ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের দু’টি এলাকায় ২০০৬ সাল থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত তালাক কার্যকর হয় ২৩০৯টি, যার মধ্যে ১৬৯২টি স্ত্রী কর্তৃক আর স্বামী কর্তৃক ৯২৫টি৷ ২০১০ থেকে ২০১৪ সালের জুলাই পর্যন্ত তালাকের সংখ্যা ৩৫৮৯টি৷ এর মধ্যে ২৩৮১টি স্ত্রী কর্তৃক আর স্বামী কর্তৃক হয়েছে ১২০৮টি৷ এই পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যায়, তালাক দেয় পুরুষ ৩০ শতাংশ, আর নারী ৭০ শতাংশ৷”
অন্যদিকে সম্প্রতি একটি জাতীয় দৈনিকের প্রথম পাতায় বিবিএসে একটি রিপোর্টের বরাত দিয়ে বলা হয় –
“ঢাকায় প্রতি ঘন্টায় গড়ে একটি তালাকের ঘটনা ঘটছে”।
সংবাদমাধ্যমগুলোর এমন প্রতিবেদনের বিভিন্ন কেস স্টাডিতে দেখা যায় কোন একটি নির্দিষ্ট পক্ষ সবসময় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে না। বরং দুজনই বা কখনো কখনো সন্তানের উপরও এর প্রভাব পড়ছে।
এখন প্রশ্ন আসতেই পারে, “এত তালাকের ঘটনা কেন?” তালাক কিংবা বিচ্ছেদের ঘটনার পেছনে মূলত দায়ী আমাদের বৈবাহিক জীবনের কিছু ভুল। চলুন এক নজরে দেখে নেওয়া যাক এমন ১০টি ভুলের কথা।
দাম্পত্য জীবনের ১০টি ভুল
বিবাহিত জীবনের সমস্যা একটি বড় ধরনের সমস্যা। ছোট ছোট বিভিন্ন কারণে ধীরে ধীরে এই সমস্যাগুলো বাড়তে থাকে আর এক সময়ে ফাটল ধরে সংসার জীবনে। ১০ টি গুরুত্বপূর্ণ ভুল, যা সংসার ফাটলের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, সেটাই আজকের আলোচ্য বিষয়।
১) নেতিবাচক মনোভাবঃ
পৃথিবীতে কেউ সাধু নয়। ভালো-মন্দের মিশ্রণে মানুষ গড়ে উঠে। সঙ্গীর ভালো দিকগুলো অবিষ্কার করতে হবে। শুধু আবিষ্কার নয়, সেগুলোর প্রশংসা করতে হবে। যেন প্রেয়সীর মনে সবসময় আনন্দ বিরাজমান থাকে। মনে প্রাণে বিশ্বাস করতে হবে এবং আপনার সঙ্গীকে বুঝিয়ে দিতে হবে যে তাঁর সেই ভালো দিকগুলোর জন্যে আপনি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করছেন। আগেই নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করা হতে বিরত থাকুন ।
এবার আসি খারাপ দিকের কথায়। যে মানুষের মাঝে একটিমাত্রও ভালো দিক আছে, তিনি ভালোর গুরুত্ব একটু হলেও বুঝবেন। নেতিবাচক দিকগুলোর জন্যে তাকে দোষারোপ না করে তাকে ভালো হবার জন্যে সাপোর্ট দিন। কম্প্রোমাইজ করে একসাথে পথ চলা হবে সবচেয়ে ভালো সমাধান, যা দাম্পত্য জীবনকে সুখকর করে তুলবে।
২) সঙ্গীর কথা না শোনাঃ
ডয়চে ভেলের রিপোর্টে কয়েকজন নারীর সাথে কথা বলে জানা যায়, বৈবাহিক জীবন তাদের কাছে কারাগারের মত মনে হওয়াতে মুক্ত জীবন তাদের কাম্য ছিলো। ঠিক একই বিষয়টি পুরুষের ক্ষেত্রেও। একবার ভাবুন, আপনি সারাজীবন একটা মানুষের সাথে কাটাবেন অথচ সে বক্তব্য প্রকাশে স্বাধীনতা পাচ্ছে না। কতটা অমানবিক!
এতে করে তার মনে হতেই পারে – আপনি প্রতিনিয়ত তাকে অবজ্ঞা করছেন। মনে হতে পারে, আপনি তাকে যথাযথ উপায়ে বুঝতে পারছেন না। আপনি যদি কাউকে বুঝতে চান তাহলে আপনার প্রথম কাজ হবে তাকে শোনা। আর আপনি যদি আপনার প্রিয় মানুষটিকে বুঝতেই না পারেন, তাহলে হয়ত আপনি নিজেও পূর্ণ হতে পারবেন না।
৩) শারীরিক ঘনিষ্ঠতার অভাবঃ
একটা বন্ধনে আবদ্ধ হবার পরে আপনাদের খুব ভালো কিছু সময় কাটানো প্রয়োজন। এই ভালো সময়গুলো একটা ভালো ভিত গড়ে দিতে পারে আপনাদের মাঝে। সংকোচ কাটানোর একটা উপায় হিসেবেও এটিকে ধরা যেতে পারে।
আর যতক্ষণ না পর্যন্ত আপনি সংকোচ কাটাতে পারছেন ততক্ষণ পর্যন্ত সঙ্গীর সাথে সহজ হওয়া আপনার জন্যে দুরূহ হয়ে পড়বে। যাতে অন্য মানুষটি এটাও ভাবতে পারে, আপনি তাকে মানসিক দিক থেকে এখনো স্বীকৃতি দেন নি।
৪) অসততাঃ
কমিটমেন্টের সবচেয়ে বড় জায়গাটি হলো সততা। আপনি যদি আপনার সঙ্গীর সাথে সৎ থাকতে পারেন, তাহলে দুজনের মধ্যে খুব ভালো একটা বোঝা-পড়া গড়ে উঠবে। তবে অবশ্যই এই বিষয়টি দুজনের মধ্যে থেকেই আসতে হবে।
এতে করে আপনার সঙ্গী নিজেকে খুব ভাগ্যবান মনে করবে আপনার মত একজনকে পেয়ে। সুতরাং আপনি তার পাশে থাকলে আপনা থেকেই তার মধ্যে একটা তৃপ্তি চলে আসবে। এক ছাদের নিচে থাকার জন্যে আত্মতৃপ্তিও অনেক গুরুত্বপূর্ণ।
৫) নিজেকে সঙ্গীর সব মনে করাঃ
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের একটি বিখ্যাত উক্তি আছে, “বড় প্রেম শুধু কাছেই টানে না, দূরেও ঠেলে দেয়”। প্রায়োরিটি নিয়ে আমাদের সবার খুব ভালো রকমের একটা সমস্যা আছে। যেমনঃ স্বামী যখন অফিসের কাজে ব্যস্ত থাকার কারণে দুপুরের খাবারটা সারতে পারেননি, তখন স্ত্রী ক্ষেপে আগুন। কেন? কারণ স্বামী কেন দুপুরের খাবারের ফাঁকে কথা বলল না।
স্ত্রী তখন ভেবে নিতে আরম্ভ করে তিনি তার স্থানটি হারিয়ে ফেলছেন। কিন্তু বস্তুত, পুরো পৃথিবীতে আপনি ছাড়াও তার একটা দুনিয়া আছে। সেখানে তাকে ইনভলভ থাকতে হয়। তাকে সে সময়টুকু ছেড়ে দিন, বোঝাপড়া আরো ভালো হয়ে উঠবে।
৬) খোটা দেওয়াঃ
খোটা দিয়ে কথা বলাটা সংসার জীবনে হয়ত সবচেয়ে বেশি ঘটে। যদিও এসব আমাদের সংস্কৃতিতে এমনভাবে চলে এসেছে যে, তাতে তেমন কোন প্রভাব পড়ে না। কিন্তু আপনার সঙ্গী কিন্তু এসব নিয়ে একটা সময় বাধ্য হয়ে ভাবতে শুরু করে। আর আপনার কাছ থেকে আড়াল করে কষ্টও পায়।
এগুলো দিনে দিনে জমতে জমতে আপনি তার কাছে চরিত্রের একটা খারাপ দিক প্রকাশ করে ফেলেন। স্বর্গীয় ব্যাপারটা তখন চলে যেতে থাকে। কারণ আপনাকে কেউ কষ্ট দিলে আপনি নিজেও ভুলতে পারবেন না। ভুলতে ভুলতে একটা সময় কিছু একটা অবশিষ্ট থেকে যাবে।
৭) আগ্রহ হারিয়ে ফেলাঃ
ডেল কার্নেগীর একটা লেখায় পড়েছিলাম, “তিনি বলছেন, অফিস থেকে বাড়িতে যাওয়ার সময় একটা গোলাপ ফুল নিয়ে যাবেন। গোলাপ ফুল নিয়ে যাওয়ার কারণ আহামরি কিছু না। শুধু আপনার সঙ্গীকে একটু জানান দেওয়া আপনি এখনো তাকে ভালোবাসেন, আপনাদের প্রেম এখনো পুরোনো হয়ে যায়নি”।
এতে আপনার প্রতি তার আগ্রহ জন্মাবে। একই লেখায় কার্নেগী চল্লিশ হাজার বিবাহ বিচ্ছেদ নিষ্পত্তি করা জজ জোসেফ সারাফ বরাত দিয়ে বলেন, বৈবাহিক সম্পর্কের মূল ভিত্তি এসব ছোট ছোট সম্ভাষণ, ছোট ছোট অনুভূতি। কারণ এগুলো ভালো সম্পর্কের চেইন।
৮) ডিভোর্স ভাবনাঃ
সুখ এমন একটি শব্দ, যা রাতারাতি অর্জন করা সম্ভব নয়। কিন্তু কষ্টকে আপনি রাতারাতি অর্জন করতে পারবেন। একটা সম্পর্ক ভালো যাচ্ছে না তার মানে এই না যে, তা কখনো ভালো যাবে না। দুজন দুজনকে সময় দিন।
আপনি যদি অল্পতেই ডিভোর্সের কথা মাথায় নিয়ে আসেন তাহলে তা আপনার মাথায় বিঁধে যাবে। একটা সময় পান থেকে চুন খসলেই আপনি ডিভোর্স চাইবেন। আপনার এমন আবদার অপর মানুষটিকে সম্পর্কের প্রতি ক্লান্ত করে তুলবে। আপনি যতবার এটি চাইবেন ততবার এই ঘটনার পুরনাবৃত্তি হবে। শেষমেশ বাজে কিছুও ঘটে যেতে পারে।
৯) “ধন্যবাদ” না বলাঃ
খুব ক্লিশেড লাগতে পারে। কিন্তু আপনার একটি ‘ধন্যবাদ’ আপনাকে বড় করে তুলবে। আপনাদের জীবনকে করে তুলবে আরো সহজ আর প্রেমময়। আপনার ভেতর বিন্দুমাত্র ইগো থাকলেও তা ভেঙে যাবে এই একটি শব্দতে।
পাশাপাশি এর কারণে আপনার প্রিয় মানুষটি আপনার সুখের কারণে সুখী হতে পারবে। সম্পর্কের ভীত আরো মজবুত হয়ে উঠবে।
১০) টাকা-পয়সা ইস্যু হয়ে উঠাঃ
ছোটবেলা আমরা সকলেই একটা সহজ কথা পড়েছি, Money can’t buy happiness. তাহলে ছোটবেলা থেকে পড়ে আসা এই সহজ কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ কথা মানতে বাধা কোথায়। বিচ্ছেদে যাওয়া বেশিরভাগ দম্পতির প্রধান সমস্যাগুলোর মধ্যে এটি একটি।
হয়ত অভাব ঘরে ঢুকলে ভালোবাসা জানালা দিয়ে পালায়। কিন্তু এটাও তো বলায় যায়, “যদি হয় সুজন, তেঁতুল পাতায় ন জন”। অর্থনৈতিক সমস্যা হলে পাশাপাশি বসে বোঝাপড়ার মধ্য দিয়ে সমাধান করুন। বিচ্ছেদ হয়ে গেলে সমস্যার সমাধান হবে– ব্যাপারটি এমন নয়। বরং বাড়তেও পারে।
সবশেষে, সকল দম্পতির দাম্পত্য জীবন হয়ে উঠুক সুখকর আর ভালোবাসার চাদরে মুড়ে দিয়ে শুরু হোক তাঁদের জীবন। “অভিযাত্রী”-র পক্ষ থেকে শুভকামনা রইল প্রতিটি দম্পতির জন্য।
Leave a Reply