প্রিয় কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের উক্তি নিশ্চিতভাবে আপনাকে প্রভাবিত করতে পারে জীবন সম্পর্কে অনুধাবন করতে। আমরা এমন কিছু চিরন্তন বানী নিয়ে কথা বলবো আজকে। তার আগে একটু এই মহান মানুষটি সম্পর্কে কিছু তথ্য জেনে নেওয়া যাক।
সময়কাল সত্তর দশক। বলছি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলের ৫৬৪ নাম্বার রুমের রসায়নশাস্ত্রের এক ছাত্রের কথা। ঢাবিতে ভর্তির আগে নিজের মেধার পরিচয় দিয়েছেন ম্যাট্রিক পরীক্ষায় রাজশাহী বিভাগে দ্বিতীয় স্থান অর্জনের মাধ্যমে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে রেজাল্টে তার প্রতিভার স্বাক্ষর। কিন্তু রসায়ন শাস্ত্রের বিক্রিয়া নয়, বরং মানবমনের বিক্রিয়াই তাকে বেশি টানত। তাই মুহসীন হলে থাকতেই লেখে ফেললেন নাতিদীর্ঘ উপন্যাস “নন্দিত নরকে”।
তবে নন্দিত নরকে দিয়েই তার লেখার হাতেখড়ি নয়। “শঙ্খনীল কারাগার” দিয়ে তার উপন্যাস লেখা শুরু। স্বাধীনতার সময় দুটির কোনটিই প্রকাশ সম্ভব হয় নি। তাই স্বাধীনতার পর, ১৯৭২ সালে প্রকাশ পায় নন্দিত নরকে খান ব্রাদার্স থেকে।
এরপর হুমায়ূন আহমেদের রথ শুরু হয়।এই রথযাত্রায় লিখেছেন দুশর উপরে বই। তার জনপ্রিয় কিছু লেখা ইংরেজি, জাপানিজ ও রাশিয়ান অনুদিতও হয়েছে।
শুধু লেখার মাধ্যমে চিত্রকল্প অংকন নয়, পর্দায় মানুষকে তা দেখিয়েছেন ১৫টি চলচ্চিত্র, ১১টি ধারাবাহিক নাটক আর ৮৭টি প্যাকেজ নাটকের মাধ্যমে। জিতেছেন জাতীয় পুরষ্কারও।
বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে বই পড়ার যে জোয়ার এসেছিলো তা দীর্ঘ চার দশক নেতৃত্ব দিয়েছেন এই কালজয়ী লেখক।
আজ অভিযাত্রীর এই আয়োজনে থাকছে হুমায়ুন আহমেদের উক্তি, যার মধ্যে দিয়ে তার জীবনদর্শনের নানান দিক উঠে এসেছে। তাহলে হুমায়ূন আহমেদ উক্তি সম্পর্কে আমরা বিস্তারিত জেনে নেই।
হুমায়ূন আহমেদের উক্তি | একজন কথাসাহিত্যিকের কিছু কথা
০১.
সুখ কিভাবে লাভ করা যায় কিংবা সুখের সংজ্ঞাটা কেমন হতে পারে? ১৯৮৫ সালে বিটিভিতে প্রচারিত “এইসব দিনরাত্রি” নাটকের একটি মধ্যবিত্ত পরিবারের গল্প বুনে তা দেখিয়েছেন হুমায়ন আহমেদ।
জনপ্রিয় এই নাটকের এই সংলাপে তিনি সুখ আর সুখী মানুষের জীবন নিয়ে একটি দর্শনলব্ধ উক্তি দেন। তিনি বলেন,
“যারা সুখী হয় তাদের মধ্যে সুখী হবার বীজ থাকে। জল, হাওয়া এবং ভালোবাসায় সেই বীজ থেকে গাছ হয়”।
[এইসব দিনরাত্রি]
০২.
মধ্যবিত্ত জীবনের রূপকার হুমায়ুন আহমেদ ১৯৮৯ সালে প্রকাশ করেন তার লেখা উপন্যাস “রজনী”। বাস্তবতাকে নিয়ে লেখা এই উপন্যাসে তিনি মানবজীবনে এক চরম সত্য উল্লেখ করতে গিয়ে বলেন,
“মানুষ হয়ে জন্মানোর সবচেয়ে বড় কষ্ট হচ্ছে মাঝে মাঝে তার সবকিছু পেছনে ফেলে চলে যেতে ইচ্ছা করে, কিন্তু সে যেতে পারে না। তাকে অপেক্ষা করতে হয়। কিসের অপেক্ষা তাও সে ভালমত জানে না”।
[রজনী]
০৩.
ভালোবাসা আর ভালোবাসাবাসি ব্যাপারটা সবার জীবনে আসে। কখনো তা হয় পারস্পারিক সত্ত্বার, কখনো বা একপাক্ষিক সত্ত্বার। মানুষের জীবনে এই সত্যটাকে উদঘাটন করেছেন সাহিত্যের এই প্রবাদ পুরুষ। তিনি বলেন,
“ভালবাসাবাসির ব্যাপারটা হাততালির মতো। দুটা হাত লাগে। এক হাতে তালি বাজে না।
অর্থাৎ একজনের ভালবাসায় হয় না……”
০৪.
সত্য আর মিথ্যে দুটোর সংজ্ঞা যেমন মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ, তেমনি দুটোর বৈশিষ্ট্যও একদম বিপরীত মুখী। হুমায়ূন আহমেদের ভাষায় বলা যায়,
“তুমি দশটি সত্য এর মাঝে একটি মিথ্যা মিশিয়ে দাও, সেই মিথ্যাটিও সত্য হয়ে যাবে
কিন্তু তুমি দশটি মিথ্যার মাঝে একটি সত্য মিশাও, সত্য সত্যই থেকে যাবে সেটি আর মিথ্যা হবে না,
সত্য আসলেই সুন্দর…”
০৫.
প্রতিটা মানুষ পরিণত হতে চায়। আর এর জন্য তার ব্যক্তিগত অভ্যাসটা জরুরী সবার আগে। কি ধরণের অভ্যাস প্রয়োজন? এর উত্তর হুমায়ূন স্যারের একটি উক্তি-
“কখনো কখনো তোমার মুখটা বন্ধ রাখতে হবে। গর্বিত মাথাটা নত করতে হবে এবং স্বীকার করে নিতে হবে যে তুমি ভুল।
এর অর্থ তুমি পরাজিত নাও, এর অর্থ তুমি পরিণত এবং শেষ বেলায় জয়ের হাসিটা হাসার জন্য ত্যাগ স্বীকারে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।”
০৬.
মিথ্যে আমাদের আত্মার জন্য একটি স্লো-পয়জন। ১৯৯৩ সালে প্রকাশিত তিথির নীল তোয়ালে উপন্যাসে তেমনটা ধরা পড়ে হুমায়ূন উক্তিতে-
“মিথ্যা বলা মানে আত্মার ক্ষয়। জন্মের সময় মানুষ বিশাল এক আত্মা নিয়ে পৃথিবীতে আসে।
মিথ্যা বলতে যখন শুরু করে তখন আত্মার ক্ষয় হতে থাকে। বৃদ্ধ বয়সে দেখা যায়, আত্মার পুরোটাই ক্ষয় হয়ে গেছে”।
[তিথির নীল তোয়ালে]
০৭.
পাওয়া আর না পাওয়া কিংবা পাওয়ার বেদনা আর না পাওয়ার বেদনা ছিলো হুমায়ূন স্যারের জীবন জুড়েই। অধ্যাপনা শুরু আর তারপর আবার অধ্যাপনার ইতি টানা সাহিত্যের জন্যে।
আবার সাহিত্যিক থেকে নাট্যকার হয়ে উঠা। সবই ছিলো তার জীবনে। আবার মনের অন্তর্দ্বন্দে হয়ত অনেক না পাওয়া ছিলো। তাই তিনি বলেন,
“যা পাওয়া যায়নি, তার প্রতি আমাদের আগ্রহের সীমা থাকে না।
মেঘ আমরা স্পর্শ করতে পারি না বলেই মেঘের প্রতি আমাদের মমতার সীমা নেই”।
০৮.
প্রিয় মানুষের কাছে অবহেলিত না হয়ে পুরো জীবন কাটিয়েছেন এমন মানুষ খুব কম। অবহেলায় ভালোবাসার অবস্থান কেমন হয়? কিংবা অবহেলার পর অবহেলিত মানুষের অবস্থা কেমন হয়, কি হয় ভবিষ্যৎ? তা জানা যায় এই উক্তিটির মাধ্যমে-
“যখন মানুষের খুব প্রিয় কেউ তাকে অপছন্দ, অবহেলা কিংবা ঘৃণা করে তখন প্রথম প্রথম মানুষ খুব কষ্ট পায় এবং চায় যে সব ঠিক হয়ে যাক । কিছুদিন পর সে সেই প্রিয় ব্যক্তিকে ছাড়া থাকতে শিখে যায়।
আর অনেকদিন পরে সে আগের চেয়েও অনেক বেশী খুশি থাকে যখন সে বুঝতে পারে যে কারো ভালবাসায় জীবনে অনেক কিছুই আসে যায় কিন্তু কারো অবহেলায় সত্যিই কিছু আসে যায় না”।
০৯.
ভালোবাসা, আবেগ, গভীর প্রেম নিয়ে তিনি বলেন,
“গভীর প্রেম মানুষকে পুতুল বানিয় দেয়। প্রেমিক প্রেমিকার হাতের পুতুল হন কিংবা প্রেমিকা হয় প্রেমিকের পুতুল।
দুজন এক সঙ্গে কখনো পুতুল হয় না। কে পুতুল হবে আর কে হবে সূত্রধর তা নির্ভর করে মানসিক ক্ষমতার উপর।
মানসিক ক্ষমতা যার বেশী তার হাতেই পুতুলের সুতা”।
১০.
ভালোবাসা নিয়ে তিনি আরো বলেন-
“ভালবাসাবাসির জন্যে অনন্তকালের প্রয়োজন নেই। একটি মুহূর্তই যথেষ্ট।”
১১.
ব্যক্তি জীবনে হুমায়ূন আহমেদ দুইবার বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। ১৯৭৬ সালে গুলতেকিন খানকে বিয়ে করেন। তারপর ১৯৯০ সাল থেকে কাজের সুবাদে সখ্যতা বাড়তে থাকে মেহের আফরোজ শাওনের সাথে।
ফলে ২০০৩ সালে বিবাদ বিচ্ছেদ সম্পন্ন করে সে বছরই শাওনকে বিয়ে করেন তিনি। শাওন-হুমায়ূন দম্পতির ঘরে দুই পুত্র সন্তান আসে। নিনিত তাদের একজন। নিনিতকে হুমায়ূন স্যার কতটা ভালোবাসতেন তা বোঝা যায় তার এই উক্তির মাধ্যমে।
“আমি কখনো অতিরিক্ত কিছুদিন বাঁচার জন্য সিগারেটের আনন্দ ছাড়ার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। আমি ভেবে রেখেছিলাম ডাক্তারকে বলব, আমি একজন লেখক।
নিকোটিনের বিষে আমার শরীরের প্রতিটি কোষ অভ্যস্ত। তোমরা আমার চিকিৎসা করো, কিন্তু আমি সিগারেট ছাড়ব না। তাহলে কেন ছাড়লাম?
পুত্র নিনিত হামাগুড়ি থেকে হাঁটা শিখেছে। বিষয়টা পুরোপুরি রপ্ত করতে পারেনি। দু-এক পা হেঁটেই ধুম করে পড়ে যায়। ব্যথা পেয়ে কাঁদে। একদিন বসে আছি। টিভিতে খবর দেখছি। হঠাৎ চোখ গেল নিনিতের দিকে।
সে হামাগুড়ি পজিশন থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে। হেঁটে হেঁটে এগিয়ে আসছে আমার দিকে। তার ছোট্ট শরীর টলমল করছে। যেকোনো সময় পড়ে যাবে এমন অবস্থা। আমি ডান হাত তার দিকে বাড়িয়ে দিতেই সে হাঁটা বাদ দিয়ে দৌড়ে হাতের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে বিশ্বজয়ের ভঙ্গিতে হাসল।
তখনই মনে হলো, এই ছেলেটির সঙ্গে আরও কিছুদিন আমার থাকা উচিত। সিগারেট ছাড়ার সিদ্ধান্ত সেই মুহূর্তেই নিয়ে নিলাম।”
১২.
ভালোবাসা কিংবা ঘৃণা দুটোর বিপরীতে আমাদের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভালোবাসার মানুষটিকে আমরা কাছে পাচ্ছি কিনা। ২০১২ সালে কাকলী প্রকাশনী থেকে প্রকাশ হওয়া “দাঁড়কাকের সংসার কিংবা মাঝে মাঝে তব দেখা পাই’ উপন্যাসে এমনই কিছু একটা বলেন হুমায়ূন আহমেদ। তিনি বলেন,
“ভালোবাসা আর ঘৃণা আসলে একই জিনিস। একটি মুদ্রার এক পিঠে “ভালোবাসা” আরেক পিঠে লেখা ঘৃণা। প্রেমিক প্রেমিকার সামনে এই মুদ্রা মেঝেতে ঘুরতে থাকে।
যাদের প্রেম যতো গভীর তাদের মুদ্রার ঘূর্ণন ততো বেশি। এক সময় ঘূর্ণন থেমে যায় মুদ্রা ধপ করে পড়ে যায়। তখন কারো কারোর ক্ষেত্রে দেখা যায় “ভালোবাসা” লেখা পিঠটা বের হয়েছে, কারো কারো ক্ষেত্রে ঘৃণা বের হয়েছে।
কাজেই এই মুদ্রাটি যেন সবসময় ঘুরতে থাকে সেই ব্যবস্থা করতে হবে। ঘূর্ণন কখনো থামানো যাবে না।”
: (দাঁড়কাকের সংসার কিংবা মাঝে মাঝে তব দেখা পাই)
১৩.
চলুন, প্রেমের শূন্যতা সম্পর্কে জেনে আসা যাক হুমায়ুন আহমেদের উক্তির মাধ্যমে,
“প্রেমে পড়া মানে নির্ভরশীল হয়ে পড়া। তুমি যার প্রেমে পড়বে সে তোমার জগতের একটা বিরাট অংশ দখল করে নেবে।
যদি কোন কারণে সে তোমাকে ছেড়ে চলে যায় তবে সে তোমার জগতের ঐ বিরাট অংশটাও নিয়ে যাবে। তুমি হয়ে পড়বে শূন্য জগতের বাসিন্দা”।
১৪.
১৯৯২ সালে প্রকাশ হয় অনীশ। মিসির আলী সিরিজের এই উপন্যাস ব্যাপক জনপ্রিয় হয় সবার মাঝে। এই উপন্যাসে মেয়ে মানুষের প্রকৃতি নিয়ে বলতে গিয়ে তিনি বলেন,
“প্রকৃতি শুধুমাত্র মেয়েদের মধ্যেই বিপরীত গুণাবলীর দর্শনীয় সমাবেশ ঘটিয়েছে, মেয়েকে যেহেতু সব সময়ই সন্তান ধারণ করতে হয়, সেহেতু প্রকৃতি তাকে করল– শান্ত, ধীর, স্থির।
একই সঙ্গে ঠিক একই মাত্রায় তাকে করল- অশান্ত, অধীর, অস্থির”।
: (অনীশ)
১৫.
২০০৩ সালে প্রকাশ হয় হিমু সিরিজের “সে আসে ধীরে”। হিমুকে কল্পনা করতে করতে হুমায়ূন আহমেদ বলেন,
“পুরুষের হচ্ছে ভালোবাসা ভালোবাসা খেলা।
মেয়েদের ব্যাপার অন্যরকম, তাদের কাছে ভালোবাসার সঙ্গে খেলার কোন সম্পর্ক নেই। একটা মেয়ে যখন ভালোবাসে তখন তার ভালোবাসার সাথে অনেক স্বপ্ন যুক্ত হয়ে যায়। সংসারের স্বপ্ন, সংসারের সঙ্গে শিশুর স্বপ্ন।
একটা পুরুষ যখন প্রেমে পড়ে তখন সে শুধু তার প্রেমিকাকেই দেখে আর কাউকে নয়”।
: (সে আসে ধীরে)
একজন বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক হলেন হুমায়ূন আহমেদ। জীবনে চলতি পথে কাজে লাগবে এমন কিছু উক্তি আআমদের সামনে রেখে গেছেন এই কথাসাহিত্যিক। হুমায়ূন আহমেদের উক্তি গুলো কেমন লাগলো? কোন্ উক্তিটি আপনাদের সবচেয়ে ভাল লেগেছে তা জানাতে ভুলবেন না কিন্তু!!
Leave a Reply