২০০৪ সাল। বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া তিন ছাত্র। তারা পড়াশুনার পাশাপাশি চাকরী করতেন অনলাইন ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান পেপালে। এখানেই তাদের মধ্যে বেশ ভাল একটা বন্ধুত্ব তৈরি হয়। ভাল চাকরী, ভাল বেতন। জম্পেশ কাটিয়ে দিতে পারতেন জীবনটা।
কিন্তু কাজ ও পড়াশুনার পাশাপাশি কোথাও যেন বেশ বড় একটা অপূর্ণতা! কারণ, যার ইচ্ছা উদ্ভাবন এবং নিজে উদ্যোগী হয়ে কিছু করার, সে কেন শুধু টাকার জন্য অন্যের কাজ করে সময়টা ব্যয় করবেন? আর এখান থেকেই শুরু YouTube প্রতিষ্ঠার গল্প।
তিন বন্ধুর একটা জায়গায় খুব মিল, তারা কিছু একটা করতে চায় এবং একেবারে নিজেদের মতো করে। কিন্তু কি করা যায়, কি করা যায়- ভেবে পাচ্ছিলেন না।
সময় গড়িয়ে যায়। একসময় তাদের মধ্যে একটা যোগাযোগের গ্যাপ পড়ে যাওয়ায়, সেই ইচ্ছাটা আর বাস্তবে রূপ দেওয়া সম্ভব হয় না।
তারপর হুট করেই তাদের উপর একটা ধাক্কা এলো। ebay নিজেদের ই-কমার্স ব্যবসার গতি বৃদ্ধির লক্ষ্যে কিনে নিল পেপালকে। একই সাথে চাকরী হারাতে হল তিনজনকেই। এখন উপায়??
তারা তিনজন নড়েচড়ে বসলেন। ভাবলেন, যেহেতু চাকরী নেই, পুরনো পরিকল্পনাটা নিয়ে নতুন করে ভাবার এখনই সবচেয়ে উপযুক্ত সময়।
একদিন সময় নির্ধারণ করে এক বন্ধুর বাড়িতে বসলো মিটিং। একেকজন তাদের নতুন নতুন আইডিয়া আর পরিকল্পনা বলতে বলতেই হঠাৎ তাদের মাথায় আসে একটা ভিডিও শেয়ারিং ওয়েবসাইট তৈরি করলে কেমন হয়? শুরু হল, এটা নিয়ে রিসার্স।
তারা দেখলেন, ইন্টারনেটের বিভিন্ন বিষয়ে ভাল ভাল ওয়েবসাইট আছে, কিন্তু ভিডিও শেয়ারিংয়ের জন্য খুব ভাল মানের কোন ওয়েবসাইট নেই। তাদের মার্কেট রিসার্সের ফলাফল বেশ ইতিবাচক, প্রচুর সম্ভাবনা দেখলেন এই ভিডিও শেয়ারিং সাইট নিয়ে।
সুন্দর পিচাই, ভারতের সাধারণ একটি পরিবার থেকে কীভাবে আজ গুগলের CEO?
YouTube প্রতিষ্ঠার গল্প
২০০৫ সালের ১৪ই ফেব্রুয়ারি প্রেমময় একটি দিনে YouTube.com নামের ডোমেইন নিবন্ধন করে ফেলা হল। এর নামকরণের আইডিয়া নিয়ে যদিও এখন পর্যন্ত নানান রহস্য প্রচলিত আছে, কিন্তু কেউই এর প্রকৃত ঘটনা উদ্ধার করতে পারেননি।
এরপর কাজে নেমে গেলেন। দুইজন কম্পিউটার প্রকৌশলী ও একজন ডিজাইন এক্সপার্ট- এই তিন বন্ধু মিলে শুরু করে দিলেন ওয়েবসাইট ডিজাইনের কাজ। বারবার পরিবর্তন, সংশোধন করে করে অবশেষে সুন্দর একটা ডিজাইন দাঁড়িয়ে গেল।
মানুষ কেন ব্যর্থ হয়? জীবনের প্রথম ধাপে ব্যর্থ হওয়ার ১০টি কারণ!
২৩ এপ্রিল “মি এট জু” নাম দিয়ে ইউটিউবের প্রথম ভিডিওটি আপলোড হল। ১৮ সেকেন্ডের ভিডিওটি জাভেদ করিম আপলোড দেন। ওহ! নামটা বলে ফেলেছি? তাহলে পুরোটাই জেনে নিন- ইউটিউবের উদ্ভাবক তিন বন্ধুর মধ্যে প্রথম উদ্যোক্তা জাভেদ করিম। তিনি একজন বাংলাদেশী বংশোদ্ভুদ।
বাংলাদেশী জাভেদ করিম
ইউটিউবের উদ্যোক্তা জাভেদের বাবা নাইমুল ইসলাম একজন বাংলাদেশি গবেষক। ১৯৭৯ সালে জন্ম হয় জাভেদ করিমের। তাঁর বাবা ১৯৯২ সালে স্বপরিবারে পাড়ি জমান আমেরিকায়। সেখানে স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কম্পিউটার প্রকৌশল বিদ্যায় পড়াশুনা করেন জাভেদ।
রামানুজন, গণিত জগতের এক আশ্চর্য বরপুত্র
চাঁদ হার্লি এবং স্টিভ চেনও হলেন youtube প্রতিষ্ঠাতা, যারা তার অন্য দুই বন্ধু ও সহযোগি । প্রথম CEO হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন চাঁদ হার্লি।
এবার মূল প্রসঙ্গে ফিরে আসি-
জাভেদ করিম নিজেই তার নামে তৈরি চ্যানেল (jawed) থেকে প্রথম ভিডিওটি আপলোড করেন। তখন কে জানত এই ভিডিও ইতিহাসের একটা অংশ হতে যাচ্ছে? তিনি সান দিয়াগো পার্কে হাতিশালার সামনে দাঁড়িয়ে এই ১৮ সেকেন্ডের ভিডিওটি করেন।
ভিডিওটি দেখলে এখন হয়ত আপনার হাসি পেতে পারে। জাভেদ করিম লাজুক লাজুক চেহারা নিয়ে ভিডিওতে বর্ণনা করছিলেন। ক্যামেরার সামনে দাঁড়াতে যে মোটেও অভিজ্ঞ নন তিনি, তা ভিডিও দেখলে বোঝা যায়।
আর তখন কি আর আজকের মতো সবার হাতে হাতে মোবাইল ফোন বা ডিজিটাল ডিভাইসের দখল ছিল? হয়ত এই প্রথমবার তিনি নিজ চোখে হাতি দেখছেন। তার কাছে হাতি দেখে অনুভূতি অনেকটা এরকম-
“আমরা এখন হাতির সামনে দাঁড়িয়ে আছি। মজার ব্যাপার হল, সত্যি সত্যি ওদের বিশাল বড় শুঁড়। আর এটা অসাধারণ! এবং বলতেই হয়, এখানে অনেকগুলো হাতি আছে।”
ভিডিওতে হাতির সামনে দাঁড়িয়ে জাস্ট এটুকুই কথা বলা।
তারা ২০০৫ সালের মে মাসে ইউটিউবের পরীক্ষামূলক সংস্করণটি উন্মুক্ত করেন। কিন্তু পরীক্ষামূলক এই ভার্সনটি খুব অল্প সময়ের মধ্যেই ছড়িয়ে পড়তে থাকে। দ্রুত বাড়তে থাকে এর ব্যবহারকারীর সংখ্যা।
শুরুতে যদিও ইউটিউবকে নিয়ে প্রতিষ্ঠাতাদের চিন্তা ছিল ভিডিওর মাধ্যমে বিনোদন বা শেয়ারিং করে স্রেফ মজা করা। কিন্তু খুব অল্প সময়ে তুমুল জনপ্রিয়তা ইউটিউবকে ব্যবসায় রূপ দেওয়াটা হয়ে উঠে সময়ের দাবি।
স্বপ্ন এবং সাফল্য
শুরুতে যদিও নিজেদের অর্থ ভাগাভাগি করে এটা পরিচালনা শুরু করেছিলেন তাঁরা কিন্তু পরীক্ষামূলক সংস্করণে ব্যবহারকারী অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাওয়ায় দরকার হয়ে পড়ল প্রচুর হোস্টিং স্পেস। ইউটিউবকে পরীক্ষামূলক ভার্সন থেকে পুরোপুরি উন্মুক্ত করে দিতে দরকার প্রচুর টাকা।
ভাবনায় পড়ে গেলেন, কোথায় পাবেন এতো টাকা? তারা ঘুরতে থাকেন ভেনচার ক্যাপিটালিস্ট বা বিনিয়োগকারীদের দাঁড়ে দাঁড়ে। তাদের পরিকল্পনা শুনে বিনিয়োগ করতে রাজি হয় স্কুইয়া ক্যাপিটালিস্ট।
তারপর ২০০৫ সালের নভেম্বর মাসে “ব্রডকাস্ট ইওরসেলফ” শ্লোগান নিয়ে বিশ্বব্যাপী উন্মুক্ত হয় ইউটিউব। এরপর সামনে এগিয়ে যাওয়ার পালা। জনপ্রিয়তা বাড়ার সাথে সাথে বাড়তে থাকে বিনিয়োগ।
ইউটিউব বিক্রি হয়ে গেলো
কিন্তু ২০০৬ সালে এসে ঘটে গেল আরেক উল্লেখযোগ্য ঘটনা। সার্স ইঞ্জিন জায়ান্ট গুগল ১৬৫ কোটি ডলারের বিনিময়ে কিনে নেয় ইউটিউবকে। জাভেদ নিজ অংশে পেলেন ৬ কোটি ৪০ লাখ ডলার। পরবর্তীতে এই টাকা তিনি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ব্যবসায়িক আইডিয়া শুরু করতে ব্যবহার করেন।
YouTube প্রতিষ্ঠার গল্প তো জানলেন!
YouTube.com নাম নিয়ে মজার একটা গল্প
YouTube নামের আইডিয়া কোথা থেকে এসেছে তা নিয়ে প্রতিষ্ঠাতাদের কেউ মুখ খোলেননি। তবে এর ডোমেন নাম নিয়ে একটা বড়সড় মামলা সামলাতে হয়েছিল তাদের। utube.com নামে অন্য একটা ওয়েবসাইট ছিল।
ইউনিভারসেল থেকে U নিয়ে তারা এই নামকরণটি করেন। কিন্তু হুট করে YouTube এর জনপ্রিয়তা বেড়ে যাওয়ার তাদের ঐ সাইটে প্রচুর ভুল ইউজার যেতে শুরু হল। অবস্থা এমন যে, এতো বেশি ইউজার YouTube মনে করে তাদের সাইটে (utube.com) যাচ্ছে যে ওভারলোডের কারণে সাইট ডাউন হয়ে যেত।
এ কারণে তারা ইউটিউবের বিরুদ্ধে মামলা করে দেয়। কিন্তু পরিবর্তিতে অবশ্য এই অত্যাচারের হাত থেকে রক্ষা পেতে নিজেরাই তাদের ডোমেন নাম পরিবর্তন করে ফেলে utubeonline.com রাখে।
YouTube বিষয়ে বর্তমান কিছু পরিসংখ্যান- গুগলের পর সবচেয়ে বেশি মানুষ বিভিন্ন বিষয়ে জানতে ইউটিউবে এসে সার্স করে।
পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ভিডিও প্লাটফর্ম YouTube. প্রতিমাসে ইউটিউব নিয়মিত ব্যবহার করেন প্রায় ২ বিলিয়ন মানুষ, যা পুরো ইন্টারনেট দুনিয়ার অর্ধেক (৪ বিলিয়ন)।
প্রতিদিন ৩০ মিলিয়নের বেশি মানুষ YouTube দেখছে, আর প্রতি মিনিটে প্রায় ৩০০ ঘন্টা ভিডিও আপলোড হচ্ছে! ভাবতে পারছেন, এক বাঙালি উদ্যোক্তার হাত ধরে কি এক জিনিস তৈরি হল? সেই সাথে আজকের আর্টিক্যালের মাধ্যমে আমরা জানতে পেরেছি ইউটিউব এর প্রতিষ্ঠাতা কে?
Leave a Reply