আপনি কি জানেন পৃথিবী কেন ঘোরে ? আপনার মনে কি একবারও প্রশ্ন জাগেনি এই বিশাল পৃথিবী কি আসলেই ঘুরছে? ঘুরলে কিভাবে ঘুরছে?
এরিস্টটল ও টলেমি বলেছিলেন, ‘পৃথিবী স্থির। মহাবিশ্বের কেন্দ্র হচ্ছে এই পৃথিবী। একে কেন্দ্র করে অবিরাম ঘুরে চলেছে সূর্য ও অন্যান্য গ্রহ-নক্ষত্র। ‘পৃথিবী স্থির না গতিশীল-এ নিয়ে অতীতে বিজ্ঞানীদের মাঝে কম তর্কবিতর্ক হয়নি। কারণ, তখন পৃথিবী ও সৌর জগত সম্পর্কে মানুষের ধারণা ছিল অনুমান ও দার্শনিক ভাবানুবাদ সম্পর্কিত।
১৬০৯ সালে বিজ্ঞানী গ্যালিলিও’র দূরবীক্ষণ যন্ত্র আবিষ্কার জ্যোতির্বিজ্ঞানে আধুনিকতার ছোঁয়া নিয়ে আসে। গ্যালিলিও দূরবীক্ষণ যন্ত্র আবিষ্কার করে গ্রহ নক্ষত্রগুলো পর্যবেক্ষণ করা শুরু করেন। পরবর্তীতে এরিস্টটল ও টলেমির চার হাজার বছরের পুরানো প্রতিষ্ঠিত বৈজ্ঞানিক তত্ত্বকে ভুল প্রমাণ করে কোপার্নিকাস ও গ্যালিলিও বলেন, সৌরজগতের প্রাণকেন্দ্র আসলে সূর্য। পৃথিবী তাকে অনুসরণ করে মাত্র।
একসময় বিজ্ঞানীরা প্রমাণ করেন, পৃথিবী কেবল সূর্যের চারদিকে নয়, নিজ অক্ষের উপরও প্রতিনিয়ত ঘুরছে। কিন্তু পৃথিবীর এই ঘূর্ণনের কারণ কি? সৃষ্টির শুরু থেকেই কি পৃথিবী এই একই গতিতে অবিরাম ঘুরে চলেছে? নাকি এই ঘূর্ণন সময়ের সাথে বৃদ্ধি বা হ্রাস পাচ্ছে?
পৃথিবীর এই বিরামহীন ঘূর্ণনের কারণ নিয়ে আলোচনা করার আগে, পৃথিবীর উৎপত্তি সম্পর্কে কিছু কথা বলতে হয়।
পৃথিবীর উৎপত্তি কীভাবে হয়েছিল?
বিজ্ঞানীদের ধারণা, কোটি কোটি বছর পূর্বে ছোট অথচ ভীষণ ভারী ও গরম একটা বস্তুপিন্ড বিস্ফোরিত হয়ে সকল দিকে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। এ বিস্ফোরণ কে বলা হয় মহাবিস্ফোরণ বা বিগ ব্যাং। মহাবিশ্বের সকল শক্তি, পদার্থ এবং মহাকাশের সবকিছুর সৃষ্টি এই বিস্ফোরণ থেকে। মহাবিস্ফোরণের পর মহাকাশ বিভিন্ন গ্যাস ও ধূলিকণার মেঘে পরিপূর্ণ ছিল। এই মেঘকে বলা হয় নেবুলা।
মহাকর্ষের কারণে এই গ্যাস ও ধূলিকণা গুলো পরস্পরের নিকটবর্তী হয়ে একসময় প্রচণ্ড শক্তি নিয়ে একে অপরের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। এদের কেন্দ্রীয় অংশের তাপমাত্রা ২০০,০০০ ডিগ্রী সেলসিয়াসের মত হলে হাইড্রোজেন পরমাণুর মধ্যে ফিউশন প্রক্রিয়া শুরু হয়। ফলে নিঃসৃত হতে থাকে বিপুল পরিমাণ তাপ ও আলোক শক্তি।
এভাবেই সৃষ্টি হয় মহাবিশ্বের প্রথম নক্ষত্রের। একই প্রক্রিয়ায় মহাবিশ্বের সকল নক্ষত্রেরও সৃষ্টি হয়।
আমাদের সৌরজগতের সূর্য এমনই একটি নক্ষত্র। নতুন জন্ম নেওয়া সূর্যের চারপাশেও ছিল গ্যাস ও ধূলিকণার মেঘ। যা থেকে পরবর্তীতে বিভিন্ন গ্রহ-উপগ্রহের সৃষ্টি হয়। প্রায় ৪.৬ বিলিয়ন বছর আগে এই ঘূর্ণায়মান গ্যাস ও ধূলিকণা একত্রিত হয়েই সৃষ্টি হয়েছিলো পৃথিবীর।
পৃথিবী কি?
সূর্য থেকে দূরত্ব অনুযায়ী পৃথিবী হচ্ছে তৃতীয়, সর্বাপেক্ষা অধিক ঘনত্বযুক্ত এবং সৌরজগতের পঞ্চম বৃহত্তম গ্রহ। সূর্য হতে এটির দূরত্ব প্রায় ১৫ কোটি কি.মি। পৃথিবীর অপর নাম “বিশ্ব” বা “নীলগ্রহ “। লাতিন ভাষায় এই গ্রহের নাম “টেরা (Terra)।
মানুষ সহ কোটি কোটি প্রজাতির আবাসস্থল হল পৃথিবী । পৃথিবীই একমাত্র মহাজাগতিক স্থান যেখানে প্রাণের অস্তিত্বের কথা বর্ণনা করা হয়েছে। ৪৫৪ কোটি বছর আগে পৃথিবী গঠিত হয়েছিল। এক বিলিয়ন বছরের মধ্যেই পৃথিবীর বুকে প্রাণের আবির্ভাব ঘটে। ধারনা করা হচ্ছে, আরও ৫০ কোটি বছর পৃথিবী প্রাণধারণের সহায়ক অবস্থায় থাকবে।
পৃথিবী কেন ঘোরে?
লস অ্যাঞ্জেলসের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানী Smadar Naoz ব্যাখ্যা করেন, ‘সৌর জগতের পূর্বাবস্থায় সকল ভগ্নাবশেষ সূর্যকে কেন্দ্র করে প্রায় একই দিকে ঘুরছিল। পৃথিবীর আকার যত বাড়তে থাকে, বিস্ফোরণের ফলে সৃষ্ট ভগ্নাবশেষের সাথে এর সংঘর্ষও বাড়তে থাকে। ফলে পৃথিবী ও সৌর জগতের প্রায় সবকিছু একটি নির্দিষ্ট দিকে ঘুরতে শুরু করে।‘
কিন্তু, প্রাথমিক অবস্থায় সৌর জগত কেন ঘুরছিল?
গ্যাস ও ধূলিকণা মেঘের মধ্যে সংঘর্ষের ফলে অধিকাংশ গ্যাস ঘনীভুত হয়ে যখন সূর্য গঠন করে, তখন বাকি উপাদানগুলো সূর্যের চারপাশে ভাসতে থাকে। কিন্তু একটি নির্দিষ্ট বিন্দুতে কিছু গ্যাস এবং ধূলিকণা তাদের দিক পরিবর্তন করে ঘুরতে শুরু করে।
ফলে গ্যাস ও ধূলিকণার মেঘে সংঘর্ষের সৃষ্টি হয় এবং মেঘের ঘূর্ণন গতি বৃদ্ধি পায়। গতি বাড়ানোর জন্য স্কেটাররা যেমন তাদের হাত এবং পা ভেতরের দিকে গুটিয়ে রাখে, এই ব্যাপারটাও ঠিক তেমনই।
মহাবিশ্বে কোনো কিছু একবার ঘুরতে শুরু করলে, এটি সাধারণত ঘুরতেই থাকে। ঘূর্ণায়মান সৌর জগতের কৌণিক ভরবেগের কারণেই এমনটা হয়ে থাকে। কৌণিক ভরবেগ বস্তুর ঘুরতে থাকার প্রবণতা নির্দেশ করে। ফলে সৌর জগত গঠনের শুরু থেকেই সকল গ্রহ-নক্ষত্র প্রায় একই দিকে ঘুরে চলেছে। আমাদের পৃথিবীও একই কারণে নিজ অক্ষের উপর এবং সূর্যকে ঘিরে অবিরাম ঘুরছে।
কিছু গ্রহের আবার নিজস্ব গতি রয়েছে। যেমন, শুক্রগ্রহ, প্লুটো ও ইউরেনাস। পৃথিবী যেখানে পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে ঘুরছে। সেখানে শুক্রগ্রহ ঘুরছে পৃথিবীর বিপরীত দিকে অর্থাৎ, পূর্ব থেকে পশ্চিমে। প্লুটো ও ইউরেনাসের ক্ষেত্রেও একই ধরণের ঘূর্ণন গতি লক্ষ করা যায় ।
কিভাবে এই গ্রহগুলো তাদের পথ পেয়েছে সে সম্পর্কে নিশ্চিত না হলেও, বিজ্ঞানীরা কিছু ধারণা দিয়েছেন। শুক্র গ্রহের ক্ষেত্রে সম্ভবত কোনো ধরণের সংঘর্ষ এর বিপরীত ঘূর্ণনের কারণ। আবার এমনও হতে পারে, প্রাথমিক অবস্থায় অন্য গ্রহের মত শুক্রও একই দিকে ঘুরতে শুরু করেছিল।
কিন্তু সময়ের সাথে গ্রহের পাতলা আবরণের উপর সূর্যের মধ্যাকর্ষণ শক্তি এবং গ্রহের অন্তঃস্থল ও বাইরের উজ্জ্বল আবরণের মধ্যে ঘর্ষণের ফলে এর দিক পাল্টে যায়।
২০০১ সালে নেচার ম্যাগাজিনে প্রকাশিত এক গবেষণায় বলা হয়, সূর্য এবং অন্য উপাদানগুলোর মাধ্যাকর্ষণ শক্তি শুক্রগ্রহের ধীর গতি এবং বিপরীত দিকে ঘোরার কারণ হতে পারে। ইউরেনাসের ক্ষেত্রেও বিজ্ঞানীরা একটি বড় ধরণের সংঘর্ষকে এর বিপরীত গতির কারণ বলে মনে করেন। নাওজ বলেন, ঘূর্ণন এই মহাবিশ্বের একটি মৌলিক বৈশিষ্ট্য।
গ্রহাণু ঘুরছে, নক্ষত্র ঘুরছে, এমনকি গ্যালাক্সিও ঘুরছে। যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় মহাকাশ সংস্থা নাসা অনুসারে, সৌর জগতের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি একবার ঘুরে আসতে সময় লাগে ২৩০ মিলিয়ন বছর।
মহাবিশ্বের কিছু ঘন ও দ্রুত ঘূর্ণায়মান বস্তুর নাম পালসার, যা বৃহদায়তন নক্ষত্রের দেহাবশেষ। কিছু পালসারের ব্যাস প্রায় একটি শহরের সমান হয়ে থাকে এবং এগুলো সেকেন্ডে একশ বার ঘুরতে পারে। ২০০৬ সালে খেতাব পাওয়া সবচেয়ে দ্রুতগতির পালসার হল Terzan 5ad, যা সেকেন্ডে ৭১৬ বার ঘোরে।
ব্ল্যাক হোল বা কৃষ্ণগহ্বর এর থেকেও দ্রুততর। ২০০৬ সালের Astrophysical Journal Found এর এক গবেষণায় বলা হয়, GRS 1915+105 নামের একটি কৃষ্ণগহ্বরের ঘূর্ণন গতি সেকেন্ডে প্রায় ৯২০-১১৫০ বার।
মহাবিশ্বের বিভিন্ন বস্তুর গতি সবসময় বৃদ্ধি পাবে এমনটা নয়। এদের গতি হ্রাসও পায়। নাওজ বলেন, সূর্য গঠনের প্রাক্বালে এটি নিজ অক্ষের উপর চার দিনে একবার আবর্তন করত। বর্তমানে এর আবর্তনকাল ২৫ দিন।
এমনকি পৃথিবীর গতি ও সময়ের সাথে হ্রাস পাচ্ছে। পৃথিবীর উপর চাঁদের মাধ্যাকর্ষণ বল-ই এর গতি হ্রাস পাওয়ার কারণ। ২০১৬ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, পৃথিবীর ঘূর্ণন গতি বিগত ২,৭৪০ বছরে প্রায় ৬ ঘণ্টা হ্রাস পেয়েছে।
অভিযাত্রীর এই আয়োজনে জানতে পারলাম, পৃথিবী কেন ঘোরে? গত একশ বছরে পৃথিবীর গতি প্রায় ১.৭৮ মিলিসেকেন্ড করে কমছে। আগামী বছরগুলোতে সৌরজগতের উপর পৃথিবীর ক্রমহ্রাসমান গতি কিরূপ প্রভাব ফেলবে, সেটা হয়ত বিজ্ঞানীরাই ভালো বলতে পারবেন।
Leave a Reply