আমাদের দেশে ডায়রিয়া অতি পরিচিত একটি রোগ। সারা বিশ্ব জুড়ে প্রায় ২৫০ কোটি মানুষ স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা ব্যবহার করতে পারেনা এবং ৭৮কোটি মানুষ নিরাপদ পানি পান করতে পারেনা। যার ফলে নিম্ন আয়ের দেশে ডায়রিয়ার হার সবচাইতে বেশি। এসব দেশে তিন বছরের নিচের শিশুরা বছরের প্রায় তিনবার ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়। এর সাথে সাথে বড়রাও কম বেশি ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে থাকে। পাতলা পায়খানা হলে করণীয় কি, তা জানা থাকলে এই রোগ না হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে।
বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার মতে পাঁচ বছরের কম বয়সী প্রায় ১৭০ কোটি শিশু প্রতিবছর ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয় এবং ৫ লক্ষ ৩০ হাজার শিশুর মৃত্যু হয়। বিভিন্ন কারণে ডায়রিয়া হতে পারে। সাধারণত ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া ও অস্বাস্থ্যকর খাবার দাবার খাওয়ার ফলে ডায়রিয়া হয়। এই কারণে পাতলা পায়খানা স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক বেশি নরম হয়ে যায়।
পাতলা পায়খানা হয়েছে মানে ডায়রিয়া হয়েছে এর কোন মানে নেই, পাতলা পায়খানা প্রায় সময়ই হতে পারে কিন্তু এক দিনে তিনবারের বেশি পাতলা পায়খানা হলেই ডায়রিয়া বলা হয় এবং বারবার ঘন ঘন পাতলা পায়খানা হলেও সেটি ডায়রিয়া হিসাবে ধরা হয়। তাহলে চলুন জেনে নেই পাতলা পায়খানা হওয়ার কারণ, ডায়রিয়া হলে করণীয় কি সে সম্পর্কে। ঘরোয়া পদ্ধতিতে নিরাময়ের ঔষুধ কি:
ডায়রিয়া কি
বারবার পাতলা পায়খানা হলে তাকে ডায়রিয়া বলে। ২৪ ঘন্টার মধ্যে তিনবারের চেয়েও বেশি পাতলা পায়খানা হলে তাকে ডায়রিয়া বলা হয়। এটা পরিপাকতন্ত্রের সঙ্গে সম্পৃক্ত একটি ব্যাধি। ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, হরমোন জনিত সমস্যা থেকেও ডাইরিয়া হয়। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায়, দিনে তিনবারের বেশি নরম ও পাতলা পায়খানা হলে তাকে ডায়রিয়া বলে। এমতাবস্থায়, পাতলা পায়খানা হলে করণীয় কি তা জেনে রাখা ভালো।
ডায়রিয়ার প্রকারভেদ
ডায়রিয়া মূলত ৩ ধরনের হয়ে থাকে।
১) একিউট ওয়াটারি ডায়রিয়া। এই ডাইরিয়া পাতলা পায়খানা ১৪ দিনের বেশি স্থায়ী হয় না।
২) পারসিসটেন্ট ডায়রিয়া। এই ডায়রিয়া হলে ১৪ দিনের বেশি পাতলা পায়খানা স্থায়ী হয়।
৩) ডিসেন্টি ডায়রিয়া। এই ডায়রিয়াতে পাতলা পায়খানার সাথে রক্ত বের হয়।
ডায়রিয়া হওয়ার কারণ
ডায়রিয়া বিভিন্ন কারণে হয়ে থাকে। ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়াতে আক্রান্ত হলে ডায়রিয়া হওয়ার সম্ভবনা থাকে। এছাড়া খাবারদাবার ঠিক না থাকলেও ডায়রিয়া হতে পারে। আরো কয়েকটি কারণে ডায়রিয়া হয়, চলুন সেগুলো সম্পর্কে জেনে নিই, সেই সাথে :
১) ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়ার কারণে।
২) ফুড পয়েজিংয়ের কারণে ডায়রিয়া হতে পারে।
৩) দূষিত ও নোংরা পানি খাওয়ার কারণে ডায়রিয়া হয়ে থাকে।
৪) অনেক সময় অস্বাস্থ্যকর মিষ্টি জাতীয় বা দুধ জাতীয় খাবার খেলে ডায়রিয়া হয়।
৫) অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাস করার ফলে ডায়রিয়া হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
৬) পচা ও বাসি খাবার খাওয়ার কারণেও ডাইরিয়া হয়।
৭) বাহিরের খোলা খাবার খাওয়ার কারণেও ডায়রিয়া হয়ে থাকে।
৮) হজম ঠিকমত না হলে, বদ হজমের কারণেও ডাইরিয়া হয়।
৯) মাঝে মাঝে কোন ঔষধের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াও ডায়রিয়া হওয়ার কারণ হতে পারে।
ডায়রিয়া রোগের লক্ষণ
১) কিছুক্ষণ পর পর পায়খানার বেগ লাগে।
২) পায়খানায় চাপ দিলে অপেক্ষা করতে পারে না। যে কারণে পোশাকে পায়খানা করে ফেলে।
৩) পেটে ও তলপেটে তীব্র ব্যথা হয়।
৪) বারবার বমি হয়।
৫) শরীরে ক্লান্তি অনুভব করে ও শরীর নিস্তেজ হয়ে যায়।
৬) ঠান্ডা জ্বর হয়।
৭) মাথা ঘুরায় ও মাথাব্যথা অনুভব হয়।
৮) পাতলা পায়খানার সঙ্গে রক্ত বের হয়।
ডায়রিয়া ও পাতলা পায়খানা হলে ঘরোয়া উপায়
পাতলা পায়খানা মূলত হজমের সমস্যার কারণে হয়ে থাকে। কিন্তু জীবাণুর সংক্রমণ, খাদ্য বিষক্রিয়া, হঠাৎ খাদ্যের পরিবর্তন ইত্যাদি কারণেও হতে পারে। এ রোগে চিকিৎসা না নিলে পানি শূন্যতা ও শরীরের লবণের ভারসাম্যহীনতা হতে পারে। ডায়রিয়ার চিকিৎসার জন্য কিছু ঔষুধ পাওয়া গেলেও এর কিছু ঘরোয়া প্রতিকার রয়েছে, যা খুব দ্রুত সুস্থতা ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করে। চলুন জেনে নেই ঘন ঘন পাতলা পায়খানা হলে করণীয় কি। পাতলা পায়খানা হলে ঘরোয়া উপায় বা ঘরোয়া পদ্ধতিতে নিরাময়ের ঔষুধ কি:
১) খাবার স্যালাইন: পাতলা পায়খানা ও ডায়রিয়া হলে আমরা কম বেশি সবাই জানি স্যালাইন খেতে হয়। প্রতিবার পাতলা পায়খানার পর আধা লিটার পানিতে একটি স্যালাইন মিশিয়ে খাবেন। এক্ষেত্রে স্যালাইন না থাকলে আপনি ঘরোয়া পদ্ধতিতে স্যালাইন তৈরি করে খেতে পারেন। পাশাপাশি ডাবের পানি, ভাতের মাড়, চিড়া ভেজানো পানি ইত্যাদি খেতে পারেন।
২) পানি: পাতলা পায়খানা ও ডাইরিয়া হওয়ার কারণে শরীর থেকে প্রচুর পরিমাণে পানি ও লবণ বের হয়ে যায়। এজন্য স্বাভাবিকের তুলনায় একটু বেশি পানি পান করুন। প্রতিদিন গড়ে ৮ থেকে ১২ প্লাস পানি পান করা উচিত। এতে করে শরীরের বিষাক্ত পদার্থ ও ব্যাকটেরিয়া বের হয়ে যাবে।
৩) ফলের রস: পাতলা পায়খানা ও ডায়রিয়ার কারণে শরীর দুর্বল হয়ে যায়, শরীরের শক্তি থাকে না। তাই বেশি বেশি ফলের রস পান করুন, যা শরীরের পানি শূন্যতা দূর করবে ও শরীরে শক্তি যোগান দেবে।
৪) মধু: মধু প্রাকৃতিক গুনাগুন সম্পন্ন একটি উপাদান। মধু পাতলা পায়খানা দূর করতে বেশ কার্যকর। এজন্য আপনাকে এক গ্লাস কুসুম গরম পানিতে এক চামচ মধু, এক চামচ দারুচিনি নিয়ে একটি মিশ্রণ তৈরি করতে হবে। দিনে দুই থেকে তিনবার এই মিশ্রণটি পান করুন। দেখবেন খুব দ্রুত পাতলা পায়খানা থেকে মুক্তি পাবেন।
৫) কলা: পাতলা পায়খানা ও ডায়রিয়া দূর করতে কাঁচা ও পাকা কলা দুটিই উপকারী। আপনি পাকা কলার সাথে অল্প টক দই নিয়ে ব্লেন্ড করে খেতে পারেন এবং কাঁচা কলা সিদ্ধ করে ভর্তা বানিয়ে সাথে লেবুর রস মিশিয়ে খেলেও উপকার পাবেন। এটা খুবই কার্যকর।
৬) জিংক ট্যাবলেট: পাতলা পায়খানা হলে জিংক ট্যাবলেট খেতে পারেন। এটা গবেষণা প্রমাণিত যে জিংক ট্যাবলেট খেলে পাতলা পায়খানা এক-চতুর্থাংশ কমে যায়। তবে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী খাওয়া ভালো।
৭) লেবু পানি: লেবুতে আছে এন্টি ইনফ্লামেটরি উপাদান। যা পাতলা পায়খানা বন্ধ করতে বেশ কার্যকর। এজন্য আপনাকে লেবু থেকে রস বের করে এক গ্লাস হালকা কুসুম গরম পানিতে এক চামচ চিনি ও এক চামচ লবণ মিশিয়ে শরবত তৈরি করুন। পাতলা পায়খানা দূর করতে এটি স্যালাইনের মত বারবার পান করুন। দেখবেন খুব দ্রুত পাতলা পায়খানা দূর হয়ে যাবে।
৮) দই: দই-তে আছে প্রোবায়োটিক, যা হজম শক্তি বাড়াতে সাহায্য করে। তাই পাতলা পায়খানা বা ডায়রিয়া হলে দিনে দুই থেকে তিন কাপ দই খাবেন।
৯) সরষে বীজ: সরষে বীজে আছে অ্যান্টি ব্যাকটেরিয়াল উপাদান, যা পাতলা পায়খানা বন্ধ করার জন্য বেশ কার্যকর। এক বাটি পানিতে ২-৪ চামচ সরিষা বীজ নিয়ে এক ঘন্টা ভিজিয়ে রাখুন। পাতলা পায়খানা থেকে দ্রুত মুক্তি পেতে চাইলে এই পানি দিনে ৩থেকে ৪ বার পান করুন।
ডায়রিয়া ও পাতলা পায়খানার ঔষধ
ডায়রিয়া ও পাতলা পায়খানার ঔষধ অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী সেবন করা ভালো। ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া কোন ঔষধ সেবন করাই উচিত নয়।
বাচ্চাদের পাতলা পায়খানা হলে করণীয় কি
বাচ্চাদের পাতলা পায়খানা খুব সাধারণ একটি বিষয়। শিশুরাই সবচেয়ে বেশি এই রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকে। চলুন এবার জেনে নেওয়া যাক, শিশুর ঘন ঘন পায়খানা হলে করণীয় সম্পর্কে। ঘরোয়া পদ্ধতিতে নিরাময়ের উপায়, বাচ্চাদের পাতলা পায়খানার ওষুধের নামঃ
প্রায় প্রায়ই বাচ্চাদের পাতলা পায়খানা দেখা যায়। এমন অবস্থায় স্যালাইন, সরবত, ডাবের পানি ,লেবু পানি ইত্যাদি খাওয়াতে পারেন। অবস্থা বেশি খারাপ হলে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবেন। ডায়রিয়া ও পাতলা পায়খানা হলে বাচ্চাদের শরীর থেকে পুষ্টি উপাদান বের হয়ে যায়। তাই শিশুদের ঔষধের পাশাপাশি পুষ্টিকর খাবারও খাওয়াতে হবে। ছয় মাসের কোন শিশুদের শুধুমাত্র মায়ের বুকের দুধ খাওয়াতে হবে। ঔষধ সেবনের ক্ষেত্রে, বাচ্চাদের পাতলা পায়খানার ওষুধের নাম না জেনে খাওয়ানো উচিত নয়। যেকোনো ঔষধ খাওয়ানোর আগে ডাক্তারের পরামর্শ অবশ্যই নিতে হবে।
ডায়রিয়া প্রতিরোধে করণীয়, পাতলা পায়খানা বন্ধ করার উপায়
পাতলা পায়খানা বন্ধ করার উপায় জেনে নিজেকে সুস্থ রাখার জন্য অবশ্যই যেকোন পদক্ষেপ নিতে হবে। কিছু পদক্ষেপ হলোঃ
১) স্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাস করতে হবে।
২) নিরাপদ জীবাণুমুক্ত বিশুদ্ধ পানি পান করুন।
৩) রোটা ভাইরাসের টিকা গ্রহণ করতে হবে।
৪) শিশুদেরকে অত্যন্ত ছয় মাস পর্যন্ত শুধুমাত্র মায়ের বুকের দুধ পান করান।
৫) ডায়রিয়া হওয়ার কারণে শরীর থেকে লবণ ও পানি বের হয়ে যায়। শরীরে পানি শূন্যতা দেখা দেয়। তাই, রোগীকে বারবার খাবার স্যালাইন দিতে হবে।
৬) নিজের স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে।
৭) পচা ও বাসি খাবার খাওয়া যাবেনা।
৮) অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের খাবার – দাবার ও বাহিরের খাবার-দাবার বর্জন করুন।
৯) স্যানিটারি যুক্ত পাকা পায়খানা ব্যবহার করতে হবে।
১০) নিয়মিত গোসল ও ব্যক্তিগত পরিছন্নতা বজায় রাখুন।
১১) অতিরিক্ত গরম ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে কাজ করবেন না।
১২) সব সময় ফুটানো পানি খাওয়ার চেষ্টা করুন।
১৩) বাহির থেকে আসার পর সব সময় দুই হাত সাবান দিয়ে পরিষ্কার করুন।
১৪) রান্নাবান্না করার আগে ও খাবার পরিবেশন করার আগে সবসময় ভালোভাবে হাত ধুয়ে নিবেন।
১৫) মলত্যাগের পর সাবান দিয়ে ভালোভাবে হাত ধুয়ে নিবেন।
সবশেষে, ডায়রিয়া একটি পানিবাহিত রোগ।। বিভিন্ন ধরনের ব্যাকটেরিয়া থেকে এ রোগের সৃষ্টি হয়। এ রোগ থেকে মুক্তির প্রধান উপায় হচ্ছে নিজের সচেতনতা। তাই আমাদের নিজের স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতন হতে হবে এবং সব সময় নিরাপদ পানি পান করতে হবে এবং সেনেটারি যুক্ত পাকা ল্যাট্রিন ব্যবহার করতে হবে। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাস করা যাবে না।
অতিরিক্ত গরম ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে কাজ করা থেকে বিরত থাকতে হবে এবং সব সময় চেষ্টা করতে হবে বাহিরের খাবার না খাওয়ার। তবেই ডায়রিয়া রোগকে মোকাবেলা করা সম্ভব। পাতলা পায়খানা হলে করণীয় কি তা জানতে পারলে খুব সহজেই এর থেকে প্রতিকার পাওয়া সম্ভব।
আশা করি, পাতলা পায়খানা ও ডায়রিয়া রোগের লক্ষণ, ঘরোয়া পদ্ধতিতে নিরাময়; এই আর্টিকেল এর মাধ্যমে আপনাদেরকে কিছুটা হলেও সমাধান দিতে পেরেছি। সুস্থ থাকুন, ভালো থাকুন। আমাদের সাথে থাকার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।
Leave a Reply