বান্দরবান এক সৌন্দর্যের লীলাভুমি। পাহাড়, ঝর্ণা, ঝিরি, আঁকাবাঁকা রাস্তা মন কেড়ে নেয় আমার! এই বিশাল সৌন্দর্যের মধ্যে এক অপরূপ সৌন্দর্যের নাম তিনাপ সাইতার ঝর্ণা।
ভোর ৫টা গাড়ির মধ্যে ঘুম ভেঙে জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি সূর্য আস্তে আস্তে তার আভা ছড়াচ্ছে আর আঁধার কেটে যাচ্ছে। নিমেষেই সকাল হয়ে গেলো। সকাল ৬টা বান্দরবান শহরে পৌছলাম! রূপসী বাংলা হোটেলে ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করে জীপে বসে রওনা দিলাম রোয়াংছড়ির উদ্দেশ্যে, আমরা ২৮ জন।
বান্দরবানের তিনাপ সাইতার ঝর্ণা
বান্দরবানের আঁকাবাঁকা রাস্তার থ্রিল জিনিসটা কম এই দিকটায়। তাই জীপে দাঁড়িয়ে যেতে কষ্ট কম হয়েছে, আর এভাবে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে যাওয়াটা বিপদজনক হলেও আমি বেশ উপভোগ করি।
হালকা ঝিরঝির বৃষ্টি হচ্ছে কারণ সময়টা ২৯ জুন ২০১৮, সকালবেলার ঘটনা। মাত্র ২০/২৫ মিনিটেই পৌছে যাই রোয়াংছড়ি! আর্মি ক্যাম্পে সব নিয়ম নির্দেশনা শেষ করে নৌকা ঘাটে পৌঁছলাম। আমাদের সাথে গাইড হিসেবে আছেন লালক্রশ দাদা! আমাদের গলায় গান আর পাশে প্রকৃতি সব মিলিয়ে অসম্ভব ভালো লাগা।
নৌকা ভ্রমণ আমার সব থেকে প্রিয়। নদীর সাথে মানুষের একটা আদি সম্পর্ক রয়েছে। নদী ভালো লাগে না এমন মানুষ পৃথিবীতে আছে বলে আমার মনে হয় না। আর সেই নদীটা যদি হয় বান্দরবানে তাহলে তো কথাই নেই। এ এক অন্যরকম অনুভূতি।
মাত্র ১৫ থেকে ২০ মিনিট পর আমাদের আরেক ঘাটে নামিয়ে দিলেন মাঝি ভাই। সেখান থেকে ট্রেকিং শুরু হবে! সবাই নিজ নিজ ছবি আর সমতলে হাঁটা ট্যুরমেটদের নিয়ে এগিয়ে চলছি! এ হাঁটার মধ্যে এক অন্যরকম ভালোলাগা আছে। উঁচুনিচু এসব পাহাড়েও অনেক মায়া আছে, তার উপর ঝিরঝির বৃষ্টিতে পা পিছলে যাবার ভয়ও। তবে সাথে ভালো ট্রেকিং সু আর হালকা ব্যাগ থাকলে ট্রেকিং কিছুটা সহজ ও নিরাপদ হয়!
বগাকাইন লেক প্রকৃতির এক অনন্য সৃষ্টি -পড়তে ক্লিক করুন
কেউ স্লো আবার কেউ ফাস্ট, এই নিয়েই আমরা এগোতে থাকি রনিন পাড়ার দিকে। পাহাড়ি এলাকার আম আর আনারস অসম্ভব সুস্বাদু হওয়ায় কয়েক দফায় তা খেয়ে আবার রওনা দেই! এ পথে কোনো ঝিরি পথ নেই, তবে একটা ছোট ঝিরি, যা রাস্তার কিছু অংশ ঘেঁষে গেছে। সবাই সেখানে যে যার মত গামছা আর শরীর ভিজিয়ে আবার হাঁটা শুরু করি!
কিছুদূর গিয়ে এক উঁচু পাহাড়ের চূড়ায় যখন পৌঁছলাম, আকাশ দেখে মনে হল এই বৃষ্টি নামছে, আর মেঘেরা লুকোচুরি খেলছে পাহাড়ের গায়ে। অপরুপ এ দৃশ্য ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়!
বিকেল ৪:৩০ রনিন পাড়া আর্মি ক্যাম্পে, ব্যাগ চেকিং এবং উপদেশ নির্দেশ শেষে রনিন পাড়া পৌঁছতে পৌঁছতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেলো!
আমাদের গাইড লালক্রশ দাদার বাসা এই রনিন পাড়াতে। পাড়ার একেবারে শেষের দিকে লালক্রশ দাদার বাড়ি। আমরা যখন সেখানে পৌঁছলাম তখন সন্ধ্যা শেষ হয়ে রাত নেমে এসেছে পাহাড় ঘেরা এই জনপথে।
মাচার ঘর। সাধারণত পাহাড়ি ঘর এমনি হয়। দুটো বড় ঘর, এক ঘরে আমরা সব মেয়ে আর আরেক ঘরে ছেলেরা থাকবো, এই নির্দেশনা পেয়ে যে যার মত ফ্রেশ হয়ে খাওয়ার অপেক্ষায় রইলাম।
পাহাড়ি বেগুন আর শুটকি রান্না দিয়ে ভাত খেয়ে বিশ্রাম নিলাম! অনেকে ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়লেন, কিন্তু আমার ঘুম আসছে না, কারণ সেদিন পূর্ণিমার রাত ছিল!
‘পাহাড়ে এসেছি আবার পূর্ণিমা পেয়েছি, কিন্তু সেই পূর্ণিমায় আড্ডা না দিয়ে সারা রাত ঘুমিয়ে কাটিয়েছি!’ এর চেয়ে বড় অপরাধ আর কিছু হতে পারে না। নিজেকে কখনো ক্ষমা করতে পারবো না।
আমরা কয়েকজন মিলে চাঁদের আলোর নিচে বসলাম। সমতল আর পাহাড়ের পূর্ণিমা এক নয়। এ আলো অন্যরকম। এ আলো ঘোর ধরিয়ে দেয়, নেশায় আচ্ছন্ন করে তোলে। রাতে নিরবতার মাঝেও পাহাড়গুলো অদ্ভূত অদ্ভূত শব্দ করে উঠে। এই শব্দেরা টান দিতে চায়, পাহাড়ে উড়তে শেখায়, নিজের ভিতরের আত্মাটাকে চিনতে শেখায়।
পাহাড়ের ঐ পূর্ণিমার আলো এখনও আমার মনে পড়ে। যা ব্যস্ত শহরে পাওয়া যায় না! রাতের খাওয়া, গানের আসর শেষে সবাই যে যতটুকু জায়গা পেয়েছি তাতে বালিশ বা কম্বলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়লাম!
সকাল ৬টা কেউ একজন ডাকছে। তাকিয়ে দেখলাম, অনেকেই উঠে পড়েছে। ঘরের বাইরে ব্রাশ হাতে বের হলাম। সকালে রনিন পাড়ার আরেক রূপ দেখে নাস্তা শেষে সবাই রেডি হয়ে রওনা হয়েছি মূল আকর্ষণ তিনাপের পথে!
আরেকজন গাইড যুক্ত হলো আমাদের সাথে। জিয়ান দাদা। আমরা ১২ জন একটু ফাস্ট ট্রেকার হওয়ায় আমাদের সাথে আগে দেওয়া হল গাইড জিয়ান দা’কে! পাহাড়ি পথে সাথে একটা লাঠি রাখাটাও অনেক গুরুত্বপূর্ণ। সবাই একটা করে বাশের লাঠি নিয়ে যাত্রা শুরু করলাম।
এ পথে জোঁক অনেক। সাবধান না হলে দেখবেন রক্ত খেয়ে এক একটা জোক ঢেপু হয়ে গেছে, অথচ আপনি টেরও পাননি। জোকের সাথে এক্কা দোক্কা খেলা এবং মাঝেমধ্যে হাসির অংশ হওয়া ট্রেকিংয়ের মজার পার্ট।
সাবধানতা ছাড়া জোঁক থেকে বাঁচার কোনো উপায় নেই! তবে লবণ সাথে রাখাটা আবশ্যক। লবণ জোঁকের গায়ে পড়ার ১/২ সেকেন্ডে ছেড়ে দেয়। তাই আমি অন্য কিছু না রেখে লবণ পলিথিনে নিয়ে প্যান্টের পকেটে রেখে দিয়েছি। চোখে পড়লেই জোঁকের গায়ে দিয়ে লবণ ছিটিয়ে দিচ্ছি।
তবে পাহাড়ের সৌন্দর্য বাদ পড়া যাবে না। সাধারণত পাহাড়ের চূড়ায় মেঘের খেলা দেখা যায়। চোখ জুড়ানো সবুজ প্রকৃতি আর পাহাড়ের অন্য রকম এক গন্ধ নিলে বেঁচে থাকার ইচ্ছেটা আরও বেড়ে যায়! এ পথে অনেকটা ঝিরিপথ থাকায় হাঁটার কষ্ট কম। ঝিরিপথ আমার সবসময় অনেক প্রিয়। পানির মধ্যে পাথরের উপর দিয়ে হেঁটে চলা। বেশ ঠান্ডা লাগে আর রোদ পড়ে না গায়ে। তবে খুব পিচ্ছিল জায়গাগুলোতে সাবধানে যেতে হয়।
প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টার ট্রেকিং শেষের দিকে। জিয়ান দাদা জানালেন, আর অল্প একটু পথ। একটু আধটু শব্দও পাওয়া যাচ্ছে। আওয়াজ শুনে তাকে দেখার জন্য পা আরও দ্রুত চলতে লগলো।
প্রথম দেখা এবং প্রথম দেখাতে মনে হলো দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরি। কিন্তু ঝর্ণা তো, জড়িয়ে না ধরতে পারলেও তার শীতল পানিতে নিজেকে ভিজিয়ে তৃপ্ত হওয়া যায়। অসম্ভব সুন্দর তার রূপ। যেন এক রূপসী ঝর্ণা!
প্রস্থের দিক দিয়ে বান্দরবারের বড় ঝর্ণা তিনাপ সাইতার। এত পাহাড়ি পথ পাড়ি দেওয়াটা নিমেষে তুচ্ছ মনে হয় এই অপার্থিব সৌন্দর্যের কাছে!
প্রায় ১ ঘণ্টা ভিজেছি তার শীতলতায়। পরের টিম প্রায় দেড় ঘণ্টা পর আসলে শুকনো খাবার সবাই মিলে একসাথে খেয়ে আমরা ১২ জন আবার আগে আগে সেই একই পথে ফিরে এলাম রনিন পাড়ায়!
পাড়ার মাঠে ছোট ছোট বাচ্চাদের ফুটবল খেলা চলছে। চা খেতে খেতে তা দেখা হলো। এদিকে রাতে আর্জেন্টিনার ৪ গোলে হেরে যাওয়ার ম্যাচ বেশ হৈহুল্লোর সাথে দেখা হলো। তমুল তর্ক বেঁধে গেলো ব্রাজিল আর্জেন্টিনার সমর্থকদের মধ্যে।
জম্পেষ এক আড্ডা শেষে চাঁদনি রাত উপভোগ করে যে যার মত বরাদ্দ জায়গাটুকুতে ঘুমিয়ে পড়লাম।
পরদিন সকালে আবার ডাকাডাকিতে ঘুম ভাঙ্গলো । মনটা একটু খারাপ হয়ে গেলো। পাহাড় আমার ভালোবসার জায়গা। এ প্রকৃতি ছেড়ে যাওয়াটা বড়ই কষ্টসাধ্য। মাঝে মধ্যে মনে হয় শহরের কোলাহল ছেড়ে এই পাহাড়ে যদি স্থায়ীভাবে থাকতে পারতাম!
নাস্তা এবং পরে সেই মিষ্টিময় আনারস কাড়াকাড়ি করে খেয়ে রওনা হলাম একই পথে রোয়াংছরির দিকে। এবারে বৃষ্টিতে ভিজতে হয়েছে বহুবার, কারণ পাহাড়ের বৃষ্টি এই আসে এই যায়! তবে এটা প্রকৃতির দেওয়া বোনাস ভালোবাসা।
প্রতিবার বান্দরবান ছেড়ে আসার সময় আমার মন খারাপ হয়ে যায়, ভালোবাসার টান অনুভব হয়! তাই প্রতিবারই এসে পরেরবার আবার যাওয়ার প্ল্যান করি।
সুন্দরী তিনাপের সৌন্দর্য চোখে মুখে শরীরে মেখে অতৃপ্তি নিয়ে আবার ব্যস্ত নগরীতে ফিরে আসতে হয়।
কিভাবে যাবেন তার একটা সংক্ষিপ্ত ট্যুর প্লান দিলাম
কখন কোথায় কত খরচ হলো এসব আমার মনে থাকে না। আমি সাধরণত দলের সাথে যাই।এবারের সঙ্গী ছিল “ট্যুর গ্রুপ বিডি” তাদের সাথে ভ্রমণ করা হয় বেশি আমার। গেলে একসাথে ২০ থেকে ৩০ জন। অনেক মানুষ একসাথে গেলে মজা, মাস্তি, আনন্দ বেশি হয় আবার খরচও কম পড়ে। তাছাড়া কোথায় কত টাকা খরচ হলো এটা মনে রাখা বেশ বিরক্তিকর। তাই কিভাবে যাবেন সেটা শুধু বলছি।
♥ প্রথমে ঢাকা থেকে বান্দরবন যেতে হবে। ঢাকার শ্যামলি, কল্যানপুর, গাবতলি থেকে অনেক বাস পাবেন। এসব বাস দিনে রাতে বিভিন্ন সময়ে ঢাকা ছেড়ে যায়। এসি, নন-এসি দু ধরণের বাসই চলে।
♥ বান্দরবনে পৌঁছানোর পর সেখান থেকে জিপে করে রোয়াংছড়ির উদ্দেশ্যে যাত্রা করতে হবে। ভাড়া দরদাম করে ঠিক করতে হবে।
♥ রোয়াংছড়ি পৌঁছানোর পর একজন গাইড সাথে নিতে হবে। পরিচিত থাকলে আগে থেকে ঠিক করে রাখতে পারেন। ঠিক করে না রাখলেও সমস্যা নাই। সেখানে পেয়ে যাবেন অনেক।
♥ এরপর সেখান থেকে আপনাকে যেতে হবে রনিনপাড়াতে। অদ্ভুত সুন্দর এক পাহাড়ি গ্রাম। সেখানে আপনাকে রাতটা কাটাতে হবে। খরচ অনেক কম।
♥ সকালে উঠে হালকা নাস্তা সেরে গাইডকে সাথে নিয়ে ঘুরে আসুন সুন্দরী ঝর্ণা তিনাপ সাইতার থেকে।
আমরা সবাই জানি, অপূর্ব সুন্দর আমাদের এই বাংলাদেশ। এ দেশের প্রতিটি কোণা যেন সৌন্দর্যে ভরপুর। তিনাপ সাইতার ঝর্ণা, তার মধ্যে একটি। ভ্রমণ পিপাসু মানুষের জন্য বান্দরবানে ঘুরতে গিয়ে ঝর্ণার পানি উপভোগ করা অনেকটা আনন্দের, তা যে ঘুরতে গিয়েছে সেই বলতে পারবে অনায়াসে।
সবার প্রতি অনুরোধ, ঘুরতে গিয়ে যেখানে সেখানে ময়লা বিশেষ করে প্লাস্টিকের কিছু ফেলবেন না।
Leave a Reply