রাহুল দ্রাবিড় : ক্রিকেট বিশ্বে এক অভেদ্য দেওয়ালের গল্প

Published:

Updated:

রাহুল দ্রাবিড়ের জীবনী

Disclaimer

As an affiliate, we may earn a commission from qualifying purchases. We get commissions for purchases made through links on this website from Amazon and other third parties.

স্টিভ ওয়াহ-র উক্তিটি ছিলো এমন, প্রথম ১৫ মিনিটের মধ্যেই আপনি তাঁর উইকেট নেওয়ার চেষ্টা করুন, যদি তা না পারেন তাহলে বাকিদের উইকেট নেওয়ার চেষ্টা করুন।

মনে হয় আন্দাজ করতে পারার কথা। নাম তাঁর রাহুল দ্রাবিড়। ঈশ্বর প্রদত্ত প্রতিভার মালিক হয়তো তিনি ছিলেন না। কিন্তু খেলার মাঠের একাগ্রতা, সহনশীলতা, একনিষ্ঠ ব্যাটিংই তাকে বানিয়েছে ক্রিকেটের অন্যতম এক সেরা ব্যাটসম্যান।

রাহুল দ্রাবিড়ঃ গল্পের শুরু

১৯৭৩ সালের ১১ জানুয়ারি মধ্যপ্রদেশের ইন্দোরে এক মারাঠি পরিবারে জন্মগ্রহণ হয় তাঁর । পুরো নাম ছিল রাহুল শারদ দ্রাবিড়। তবে বাবা-মায়ের কাজের সুবাদে তাদের ব্যাঙ্গালোর শিফট হতে হয়।

বাবা ছিলেন এক জ্যাম কোম্পানির কর্মকতা, মা স্থাপত্যবিদ্যার অধ্যাপিকা। ছোট বেলায় খুব জ্যাম খেতে পছন্দ করতেন বলে সবাই তাকে আদর করে জ্যামি বলে ডাকতো।

মূলত স্কুল ক্রিকেট দিয়েই তার ক্রিকেটের হাতে খড়ি শুরু। চেন্নাস্বামী স্টেডিয়ামে একবার সামার ক্যাম্প চলছিল। সেখানেই রাহুল নজরে আসেন সাবেক ভারতীয় ক্রিকেটার কেকি তারাপোরের। এরপর কর্ণাটকের হয়ে খেলছেন অনুর্ধ ১৫, ১৭ ও ১৯ দলে।

কলেজে পড়াকালীন কর্ণাটকের হয়ে রঞ্জি ট্রফিতে তার অভিষেক ঘটে। সেই দলে তার সাথে খেলেছিলন ভারতের আর এক সাবেক ক্রিকেটার অনিল কুম্বলে। বেশ কয়েক বছর রঞ্জি ট্রফিতে ভাল খেলার সুবাদে ভারতীয় নির্বাচকদের নজরে আসেন তিনি।

রাহুল দ্রাবিড়ের জীবনী

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক

১৯৯৬ সালে শ্রীলংকার বিপক্ষে একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক হয় তাঁর। অভিষেক ম্যাচ খুব একটা সুখের ছিল না। তবে টেস্ট ক্রিকেটের অভিষেকেই দ্রাবিড় ঠিকই নিজের জাত চিনিয়েছেন। সেই বছরই ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ঐতিহাসিক লর্ডস ক্রিকেট গ্রাউন্ডে তার টেস্ট অভিষেক।

সেঞ্চুরি থেকে তখন দ্রাবিড় মাত্র ৫ রান দূরে। এমন সময় ক্রিস লুইসের এক ইনসুইং বলে আউট হয়ে সাজঘরে ফেরেন। সেই বছর শেষে সাউথ আফ্রিকার কাছে প্রথম টেস্টে মাত্র ৬৬ রানে অল আউট হয় ভারত।

দ্রাবিড় করেন ২৭ রান। পরবর্তীতে তাকে ৩ নং পজিশনে খেলতে দেওয়া হয়। ৩য় টেস্টে খেলোয়াড় দ্রাবিড় তুলে নেন ক্যারিয়ারের প্রথম টেস্ট শতক।

১৯৯৭ সালে ইন্ডিপেন্ডেন্স কাপে পাকিস্তানের বিপক্ষে চেন্নাই এ করেন একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ক্যারিয়ারের প্রথম সেঞ্চুরি। মাঝখানে টেস্ট ক্রিকেটে ভাল করলেও একদিনের ক্রিকেটে তাঁর পারফর্মেন্সে কিছুটা ভাটা পড়েছিল। যদিও ওয়ানডে ক্রিকেট কখনো টেস্টের মতো করে খেলেননি।

১৯৯৯ বিশ্বকাপে কেনিয়ার বিপক্ষে শচীনকে সাথে নিয়ে গড়েছিলেন ২৩৮ রানের পার্টনারশিপ। সেই ম্যাচে নিয়মিত উইকেটরক্ষক নয়ন মংগিয়া ইঞ্জুরির কবলে পড়লে গ্লাভস হাতে তিনিই নেমে পড়েন উইকেটকিপিং করতে।

পরের ম্যাচে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সৌরভ-দ্রাবিড় এর ৩১৮ রানের জুটি; যা বিশ্বকাপ ক্রিকেটে সর্বোচ্চ। এতে দ্রাবিড়ের অবদান ছিল ১৪৫। ২০০০ সালে শচীন অধিনায়কত্ব থেকে পদত্যাগ করলে অধিনায়কের দায়িত্ব আসে সৌরভ গাঙ্গুলির হাতে।

দ্রাবিড় নির্বাচিত হন সহ-অধিনায়ক হিসেবে। ২০০১ সালে ইডেন গার্ডেন অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ভিভিএস লহ্মণকে সাথে নিয়ে গড়েন ঐতিহাসিক ৩৭৬ রানের জুটি।

ভারতীয় ক্রিকেট টিমের অধিনায়কত্ব 

২০০৫ সালে সৌরভ অধিনায়কত্ব থেকে পদত্যাগ করলে দ্রাবিড়কে অধিনায়ক ঘোষণা করা হয়। ২০টি টেস্ট এবং ৬২টি একদিনের ম্যাচে ভারতের হয়ে নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি।

২০০৭ সালে বিশ্বকাপ ক্রিকেটে ভারত প্রথম রাউন্ড থেকে বাদ পড়লে ব্যর্থতার দায় মাথায় নিয়ে অধিনায়কত্বের দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়াতে হয় তাঁকে।

২০০৩ সালে বিয়ে করেন ডা. বিজেতা পেন্ডারকারকে। দুই পরিবারের মধ্যে জানাশোনা আগে থেকেই ছিল। বিয়েটা হয়েছিল ঐতিহ্যবাহী মারাঠী রীতিতে।

তবে তাদের পরিবারের অনুরোধে তাদের বিয়ের ছবি মিডিয়া প্রকাশ করেনি। ২০০৫ সালে জন্ম নেয় তাদের প্রথম সন্তান সামিত। ২য় সন্তান অভয় জন্ম নেয় ২০০৯ সালে।

রাহুল দ্রাবিড়ের জীবনী

২২ গজের অর্জন 

১৬ বছরের ক্যারিয়ারে টেস্ট খেলেছেন ১৬৪টি, রান করেছেন ১৩,২৮৮টি। ৩৩৪টি ওডিআই ম্যাচে তার রান সংখ্যা ১০,৮৮৯। টেস্ট এবং ওডিআই ম্যাচে ভারতের এক আস্থার প্রতীক ছিলেন তিনি।

টেস্ট ক্রিকেটটা অনেকের কাছে বোরিং লাগলেও তিনি যেন টেস্ট ক্রিকেটেই খুঁজে পেয়েছিলেন ক্রিকেটের আসল অর্থ। ১৬৪টি ম্যাচে সম্মুখীন হয়েছেন ৩১,২৬৮টি বলের, যা শচীনের চাইতেও ঢের বেশি। টেস্ট ক্যারিয়ারের ৫টি ডাবল সেঞ্চুরি প্রত্যেকটির স্কোর ছিল আগেরটির থেকে বেশি।

ক্যারিয়ারের প্রথম দিকে ইনসুইং বলে আউট হতেন অনেক। কিন্তু নিরলস পরিশ্রম তাঁকে অমানবিক বানিয়ে দেয়। পিচে তার ব্যাট যেন ছিল এক অভেদ্য দেওয়াল। যে দেওয়াল ভেদ করে তাকে আউট করাটা ছিল বোলারদের জন্য রীতিমত এক কষ্টসাধ্য ব্যাপার।

‘দ্য ওয়াল’ নামটা যেন একমাত্র তার নামের সাথেই মানায়। ফিল্ডার হিসেবে সবচেয়ে বেশি ক্যাচ নেওয়ার কৃতিত্বটাও তাঁর। মোট ক্যাচ নিয়েছেন ২১০টি। সবগুলো টেস্ট প্লেয়িং দলের বিরুদ্ধেও তাঁর রয়েছে সেঞ্চুরি।

অবসরের পর রাহুল দ্রাবিড় 

২০১৫ সালে নিয়োগ পান ভারতীয় অনূর্ধ্ব-১৯ দলের কোচ হিসেবে। কাজ করেছেন এ দল নিয়েও। মাঝখানে ভারতীয় দলের প্রধান কোচ হিসেবেও তার নামের গুঞ্জন উঠেছিল। সব কিছুকে ভিত্তিহীন বলে তিনি জানান, ছোটদের নিয়ে কাজ করতে তিনি বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন।

জাতীয় দল নিয়ে তিনি এখন ভাবছেন না। রিশাভ পান্ত, করুণ নায়ার এর মতো উদীয়মান ক্রিকেটাররা তাঁর হাতেই তৈরি। সম্প্রতি তাঁর অধীনে অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ ক্রিকেটে অস্ট্রেলিয়াকে ৮ উইকেটে হারিয়ে শিরোপা জিতেছে ভারতীয় অনূর্ধ্ব-১৯ দল।

এত বর্ণাঢ্য এক ক্যারিয়ারে যে কখনো সমালোচনার মুখোমুখি হননি তা কিন্তু নয়। ২০০৪ সালে মুলতান টেস্ট চলাকালীন শচীন ১৯৪ রানে অপরাজিত থাকাকালীন দ্রাবিড় ইনিংস ঘোষণা করেন। তার এমন আচরণ ক্রিকেট ভক্তকূলে অনেক সমালোচনার জন্ম দিয়েছিল।

গত বছরের ২৭ জানুয়ারি ব্যাঙ্গালোর বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাকে ডক্টরেট উপাধি দেওয়ার বিষয়ে একটা প্রস্তাব পাঠায়। তবে তিনি সেটি নাকচ করে দেন।

দ্রাবিড় জানায়, তিনি এই পুরস্কারের যোগ্য নন। পড়াশোনা কিংবা গবেষণার মাধ্যমে যেদিন তিনি যোগ্য হবেন সেদিনই নিবেন এই উপাধি।

২০১২ সালের মার্চের ঘটনা। হঠাৎ করেই ব্যাঙ্গালোরের চেন্নাস্বামী স্টেডিয়ামে ডাকলেন এক প্রেস কনফারেন্স। ততক্ষণে সবার মাঝে একটা বলাবলি শুরু হয়ে গিয়েছিল এর নেপথ্যে কারণ। অনেকে বুঝে নিয়েছিল অবসর নিতে যাচ্ছেন তিনি।

দীর্ঘ দিনের সতীর্থ অনিল কুম্বলে, তৎকালীন ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড এর সভাপতি এন শ্রীনিবাসন বোর্ড কর্মকতা এদের সকলের সামনেই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় জানান তিনি। কিছুটা ম্লান মুখ নিয়েই বসে ছিলেন সাংবাদিকদের সামনে।

বলেছেন, “যে জায়গায় আমি ১৬ বছর ধরে আছি সেটা ছেড়ে দেওয়াটা এতটা সহজ নয়। আমি যা অর্জন করেছি তাতে আমি খুশি। এটাই উপযুক্ত সময় নতুনদের হাতে দায়িত্ব তুলে দেওয়ার।

কিছুটা গম্ভীর গলাতেই কথাগুলো বলেছিলেন দ্রাবিড়। এক যুগেরও বেশি সময় ধরে যে জায়গায় দাঁড়িয়ে ছিলেন আজ হঠাৎ করেই সে জায়গায় থেকে দূরে সরে যাওয়ার কষ্টটা নিজের মধ্যেই ধরে রেখেছিলেন তিনি।

তবে এ সিদ্ধান্ত তিনি হঠাৎ করেই নিয়েছিলেন কি? এর আগে ২৪-২৮ জানুয়ারি অস্ট্রেলিয়ার সাথে ২য় টেস্টে দুই ইনিংসে করেন ১ ও ২৫ রান। তখন কেই বা জানত এটিই হবে দ্রাবিড়ের শেষ আন্তর্জাতিক টেস্ট ম্যাচ।

একমাত্র তিনিই হয়তো জানতেন, ভারতীয় ক্রিকেটে তার সময় শেষ হয়ে আসছে। সেই সিরিজে ভারত হারে ৪-০ ব্যবধানে। এর আগে ২০১১ সালে আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি থেকে অবসর নেন। সেবছরই ইংল্যান্ডের বিপক্ষে খেলেন ক্যারিয়ারের শেষ একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচ।

সময় আসলে তো অবসর নিতে হয় সবার কিন্তু কিংবদন্তিরা হারান না! তাঁদের মনে রাখতে বাধ্য করে তাঁদের কীর্তি। খেলোয়াড় রাহুল দ্রাবিড় তেমনই একজন ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ। তিনি খেলা থেকে হয়ত অবসর নিয়েছেন কিন্তু সকলের মনে জায়গা করে নিয়েছেন ঠিকই! সবসময়কার সেরা খেলোয়াড় হিসেবে নিজের স্থান তৈরি করে নিয়েছেন।

About the author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Latest Posts

  • সর্দি থেকে মুক্তির উপায়, নাকের এলার্জি দূর করার উপায় | দ্রুত উপশম পেতে ঘরোয়া চিকিৎসা

    সর্দি থেকে মুক্তির উপায়, নাকের এলার্জি দূর করার উপায় | দ্রুত উপশম পেতে ঘরোয়া চিকিৎসা

    নাকের এলার্জি হচ্ছে নাকের ঝিল্লি প্রদাহের কারণে নাকের একটি সমস্যা। এটি সারা বিশ্বব্যাপী একটি স্বাস্থ্য সমস্যা। বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় ২০ থেকে ২৫ শতাংশ নাকের এই রোগে আক্রান্ত। নাকের এলার্জি কোন মারাত্মক ক্ষতিকর রোগ না হলেও এ রোগের কারণে দৈনন্দিন জীবন প্রবাহ ব্যাহত হয়। এলার্জিজনিত সর্দি এবং হাঁচি জীবনকে অতিষ্ট করে তোলে। এই রোগে হঠাৎ…

    Read more

  • কফ, কাশি দূর করার উপায় | সঠিক চিকিৎসাই হতে পারে কাশি দূরীকরণের মাধ্যম

    কফ, কাশি দূর করার উপায় | সঠিক চিকিৎসাই হতে পারে কাশি দূরীকরণের মাধ্যম

    গলায় বুকে কফ জমে থাকা বেশ বিরক্তিকর একটি সমস্যা। ঋতু পরিবর্তনের ফলে আবহাওয়া পরিবর্তন হয়। আর আবহাওয়ার এই দ্রুত পরিবর্তন আমাদের শরীর খাপ খাওয়াতে পারে না, যার কারণে সৃষ্টি হয় ঠান্ডা জ্বর ও সর্দি-কাশির। ঠান্ডা সর্দি কাশি এগুলো আমাদের কাছে খুব পরিচিত রোগ হলেও এই ঠান্ডা সর্দি কাশি থেকে আমাদের দেহে অনেক বড় বড় অসুখ…

    Read more

  • ওজন কমানোর উপায় ডায়েট চার্ট | সুস্থ স্বাভাবিক জীবন

    ওজন কমানোর উপায় ডায়েট চার্ট | সুস্থ স্বাভাবিক জীবন

    সুস্থ স্বাভাবিক এবং রোগমুক্ত জীবন আমরা কে না চাই। আর এই সুস্থ সুন্দর জীবন যাপন করার একমাত্র উপায় হচ্ছে শারীরিক ওজন ঠিক রাখা। কেননা ওজন বেড়ে গেলে যে কোন রোগের ঝুঁকি ও বেড়ে যায়। এজন্য বাড়তি ওজন অনেকের মানসিক অসুস্থির প্রধান কারণ। তাই রোগ প্রকোপ কমাতে এবং মানসিক শান্তির উদ্দেশ্যে আমাদের সকলের উচিত শারীরিক ওজন…

    Read more