“বিদ্যাশিক্ষার ডিগ্রী আছে জ্ঞানের কোনো ডিগ্রী নেই; জ্ঞান ডিগ্রীবিহীন ও সীমাহীন”। বলছি মুক্তবুদ্ধির প্রতীক ও যুক্তিবাদী দার্শনিক আরজ আলী মাতুব্বরের কথা। এই দূরদৃষ্টিসম্পন্ন মানবতাবাদীর জন্ম ১৯০০ সালের ১৭’ই ডিসেম্বর(১৩০৭ বঙ্গাব্দ, ১৩’ই পৌষ) বরিশাল জেলার চরবাড়িয়া ইউনিয়নের লামচরি গ্রামে। বাংলার একেবারে প্রত্যন্ত অঞ্চলের একজন গ্রাম্য কৃষক আজকের দার্শনিক আরজ আলী হয়ে উঠার গল্পটি একটি সংগ্রামের গল্প, একটি অনুপ্রেরণার গল্প।
দার্শনিক আরজ আলী মাতুব্বর
নিজ গ্রামের ভূস্বামী হওয়ার সুবাদে তাঁর প্রকৃত নাম ‘আরজ আলী’র সাথে যুক্ত হয় ‘মাতুব্বর’নামটি। তাঁর পিতার নাম এন্তাজ আলী। আরজ আলীর বয়স যখন মাত্র চার বছর তখনই তাঁর বাবা মারা যান। পিতার মৃত্যুর পর দেনার দায়ে মাকে নিয়ে পথে বসার উপক্রম হয়। নিজ গ্রামের এক মক্তবে পড়াশোনার ধাপ শুরু করেছিলেন তিনি। সেটাও দারিদ্রতার কারণে পিছিয়ে যায়।
কৃষিকাজে নিয়োজিত হওয়ার পর স্বেচ্ছায় আবার পড়াশোনা শুরু করেন৷ কৃষিকাজ করতে করতে ভূমি জরিপের কাজ অর্থাৎ আমিন পেশায় তাঁর সূক্ষ্ম দক্ষতা অর্জিত হয় এবং এ কাজটিকেই তিনি পেশা হিসেবে বেছে নেন।
বস্তুবাদী দার্শনিক
আরজ আলী ছিলেন একজন বস্তুবাদী দার্শনিক। এখন প্রশ্ন হলো, বস্তুবাদ কি?
বস্তুবাদ বা জড়বাদের মূলকথা হলো, জড়ই এ জগতের আদি উপাদান অর্থাৎ যাবতীয় বস্তুর মূল উপাদান জড় বা পরমাণু ও তার গতি। বস্তুবাদ হচ্ছে এমন এক তত্ত্ববিদ্যক মতবাদ(ontological theory), যা জড়কে বিশ্বজগতের আদি সত্ত্বা বলে মনে করে।
বস্তুবাদের মতে, এ জগতের যাবতীয় বস্তুই জড়ের আকর্ষণ ও বিকর্ষণের ফলে উদ্ভূত হয়। পাশ্চাত্য দর্শনের জনক নামে খ্যাত থেলিসের মতবাদে প্রথম বস্তুবাদের সাক্ষাত মেলে।
আরজ আলী প্রশ্ন করতে ভালোবাসতেন।
শুধু প্রশ্ন করেই তিনি ক্ষান্ত হননি, সেগুলোর উত্তর সন্ধানের চেষ্টা করেছেন। মানুষের জীবন ও প্রকৃতি সম্পর্কে তাঁর মনে কৌতুহল বা কোনোরকম প্রশ্নের উদয় হলে তিনি ‘বস্তুবাদ’ বিষয়টা নিয়ে নড়াচড়া করতেন। বই থেকে প্রাপ্ত জ্ঞান এবং নিজের অভিজ্ঞতার সমন্বয়ে তিনি নিজস্ব চিন্তার জগৎ তৈরি করতেন।
একজন মননশীল দার্শনিক ‘আরজ আলী’ হয়ে উঠার পিছনে এক ভয়ংকর এবং পীড়াদায়ক ঘটনা লুকিয়ে আছে।
আরজ আলীর কিশোর বয়সে তাঁর মা মারা যান। মা মারা যাবার পর তিনি হঠাৎ খেয়াল করলেন মায়ের কোনো ছবি তাঁর কাছে নেই। আসলে কোনোদিন ছবি তোলাই হয়নি। কিশোর বয়সের আবেগ থেকে তিনি বুঝলেন মায়ের একটা ছবি তুলে রাখা দরকার। যখন মাকে দেখতে মন চাইবে তখন যেন দেখতে পারেন।
তিনি বরিশাল শহর থেকে ফটোগ্রাফার এনে মৃত মায়ের ছবি তোলালেন। আমরা বলছি ১৯১৫-১৭ সালের দিকের কথা! সেই সময় গ্রামে ধর্মীয় কুসংস্কার আর গোঁড়ামি ছিলো প্রচন্ডভাবে। ছবি তোলা ছিলো ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। তাঁর উপরে আবার মৃত মানুষের ছবি তোলার তো প্রশ্নই উঠে না।
আরজ আলী তাঁর মৃত মায়ের ছবি তুলেছেন- এটা মসজিদের ইমাম সাহেব জানতে পারার পর তিনি জানাজা পড়তে অস্বীকৃতি জানায়। কোন মোল্লাই সেদিন জানাজা পড়াতে রাজি হয়নি। আরজ আলী সেখানে প্রশ্ন তুলেন, ছবি তুলে ভুল বা দোষ করলে তিনি করেছেন তাঁর মৃত মা তো কোন দোষ করেননি, তাই শাস্তি দিতে হলে তাকে দিক, তিনি মাথা পেতে নেবেন। কিন্তু তাঁর মা একজন নামাজী এবং পরহেজগার মহিলা ছিলেন তাঁর জানাজাটা যেন ঠিকমত পড়ানো হয়।
কিন্তু ইমাম সাহেব নিজের সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন। এই ঘটনা আরজ আলীর মনে গভীর ভাবে প্রভাব ফেলে এবং ধর্ম সম্পর্কে তাকে উৎসাহী করে তোলে।
তারপর থেকেই আস্তে আস্তে অন্ধকার, কুসংস্কার ও ধর্মীয় গোড়ামির বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু হয় আরজ আলীর। তাঁর লেখালেখির সবটাই ছিল ধর্মের নামে ব্যবসার বিরুদ্ধে।
আর্থিক অনটনের মধ্য দিয়ে মাতুব্বরের পক্ষে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রী অর্জন করা সম্ভব ছিল না। এই সত্যান্বেষী মানুষটির জ্ঞানের পিপাসা মেটানোর জন্য নিজ জেলার পাবলিক লাইব্রেরিরই ছিল একমাত্র এবং শেষ ভরসা। তাঁর প্রেম ছিল দর্শনের সাথে৷ তবে দুঃখের বিষয় হলো লাইব্রেরিতে দর্শনশাস্ত্রের তেমন বই ছিল না।
ঘটনাক্রমে বিএম মহাবিদ্যালয়ের দর্শনের শিক্ষক কাজী গোলাম কাদির তাঁর শেখার প্রতি আগ্রহ দেখে যারপরনাই বিমোহিত হন এবং কলেজের লাইব্রেরি থেকে বই ধার নেওয়ার ব্যবস্থা করে দেন।
শোনা যায় আরজ আলী তাঁর জীবনের ৮৬ বছরের প্রায় ৭০ বছরই লাইব্রেরিতে কাটিয়েছেন পড়াশোনা করে। এভাবেই সাধারণ একজন কৃষক থেকে হয়ে উঠেন দেশবরেণ্য দার্শনিক। দর্শন ছাড়াও ইতিহাস, ধর্ম, বিজ্ঞান বিষয়েও ছিল তাঁর অসামান্য পান্ডিত্য। তাঁর লেখার ধাঁচে ছিল নানামুখী জিজ্ঞাসার নকশা। নিজস্ব বিশ্বাস এবং অভিজ্ঞতার এক মহামিলন ঘটেছে তাঁর গ্রন্থসমূহে।
একজন প্রকৃত জ্ঞানী নিজে জ্ঞানার্জনের পাশাপাশি জ্ঞানদানেও সমান তৃপ্তি পেয়ে থাকেন। আরজ আলী জ্ঞান বিতরণের জন্য নিজের টাকায় গড়ে তুলেছিলেন ‘আরজ মঞ্জিল পাবলিক লাইব্রেরি’। এছাড়াও গরীব ও মেধাবী ছাত্রদের জন্য বৃত্তির ব্যবস্থা করেছেন।
আরজ আলীর পাণ্ডুলিপি
স্বশিক্ষায় শিক্ষিত এই মানুষটি বেশ কিছু সাহিত্য রচনা করেছেন, যা বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে। পাশাপাশি সাধারণ মানুষের জ্ঞানের জ্যোতি বাড়িয়ে দিয়ে জানার সীমানাকে করেছে অসীম। আরজ আলীর রচিত পাণ্ডুলিপির সংখ্যা মোট ১৫টি। এর মধ্যে তাঁর জীবদ্দশায় প্রকাশিত হয়েছিল ৪টি।
এই বইগুলো হলো- ‘সত্যের সন্ধান’ (১৯৭৩), ‘সৃষ্টি রহস্য’ (১৯৭৭), ‘অনুমান’ (১৯৮৩), ও ‘স্মরণিকা’ (১৯৮৮)। তাঁর কিছু লেখা ইংরেজীতে ভাষান্তর করা হয়।
তৎকালীন সময়ে লেখালেখির জন্য তিনি সমালোচিত ও অভিযুক্ত হয়েছিলেন। সেজন্য কিছুদিন তার লেখালেখি নিষিদ্ধ ছিল। আরজ আলী তাঁর প্রথম বইয়ের প্রচ্ছদ নিজেই আঁকেন। বইটি লিখেছিলেন ১৯৫২ সালে। প্রকাশিত হয় ১৯৭৩ সালে ‘সত্যের সন্ধানে’ শিরোনামে।
বইটি তাঁকে ‘শিক্ষিত ব্যক্তি’ হিসেবে সুনাম এনে দিয়েছিল। মুখবন্ধে তিনি লিখেছিলেনঃ “আমি অনেক কিছুই ভাবছি, আমার মন প্রশ্নে ভরপুর কিন্তু এলোমেলোভাবে। আমি তখন প্রশ্নের সংক্ষেপণ লিখতে থাকি, বই লেখার জন্য নয় শুধুমাত্র পরবর্তীকালে মনে করার জন্য। অসীম সমুদ্রের মতন সেই প্রশ্নগুলো আমার মনে গেঁথে আছে এবং আমি ধীরে ধীরে ধর্মীয় গণ্ডি হতে বের হতে থাকি।”
তিনি এই বইটিতে দার্শনিক প্রশ্নগুলোর ৬টি ধাপে তার প্রশ্ন ও তাদের যৌক্তিক ব্যাখ্যা তুলে ধরেন। সেগুলো হলোঃ
প্রথম ধাপ- আত্মা বিষয়ক। এখানে মোট প্রশ্নের সংখ্যা ৮টি।
দ্বিতীয় ধাপ- ঈশ্বর বিষয়ক। এই অংশে মোট প্রশ্ন ১১টি।
তৃতীয় ধাপ- পরকাল বিষয়ক। এই অংশে ৭টি প্রশ্ন।
চতুর্থ ধাপ- ধর্ম বিষয়ক। এই অংশে ২২টি প্রশ্ন।
পঞ্চম ধাপ- প্রকৃতি বিষয়ক। এই অংশে ১১ টি প্রশ্ন।
ষষ্ঠ ধাপ- অন্যান্য বিষয়। এই অংশে মোট ৯টি প্রশ্ন।
আরজ আলীর বিবাহ
বাংলা ১৩২৯ সালের ২৯শে অগ্রহায়ণ আরজ আলী ২১ বছর বয়সী লালমন্নেছার সাথে প্রথমবারের মতো বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাঁর প্রথম স্ত্রী তিনটি কন্যাসন্তান ও একটি এক পুত্র সন্তানের জন্ম দেন। এরপর পাশের গ্রামের ‘সুফিয়া’ নামের এক নারীকে বিয়ে করেন। এই সংসারে তাঁদের চারটি কন্যা ও দুইটি ছেলে সন্তানের জন্ম হয়েছিল।
আরজ আলীর মৃত্যু
আরজ আলী ১৯৮৫ সালের ১৫ই মার্চ ( ১৩২৯ সন; ১লা চৈত্র) ৮৬ বছর বয়সে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
তিনি মরণোত্তর চক্ষুদান করে যান এবং মেডিকেল শিক্ষার্থীদের গবেষণার জন্য শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ-এর এনাটমি বিভাগে মরণোত্তর দেহদান করে যান।
তিনি বাংলা একাডেমীর আজীবন সদস্যপদ (১৯৮৫), বাংলাদেশ লেখক শিবিরের ‘হুমায়ুন কবির স্মৃতি পুরস্কার’ (১৯৭৮) ও বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর (বরিশাল শাখা) সম্মাননা (১৯৮২) লাভ করেন। ‘বিজ্ঞানচেতনা পরিষদ’ প্রতি বছর তাঁর স্মরণে আরজ আলী স্মারক বক্তৃতার আয়োজন করে থাকে।
আরজ আলীর উক্তি
আরজ আলীর কিছু জ্ঞানগর্ভমূলক বাণী দিয়ে শেষ করা যাক-
– “জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে শুধু আপন বিশ্বাসই নয়, সকল মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া উচিত। সকল ধ্যান-ধারণা সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান লাভ করা দরকার প্রতিটি জ্ঞান পিপাসু মানুষের। শুধু সীমাবদ্ধ পরিমন্ডলে আবদ্ধ হলে চলেনা। সীমানাকে অতিক্রম করে যেতে হবে ক্রমান্বয়ে। এর মধ্যেই ক্রমশ অতিক্রম করা যাবে নিজেকে।”
– “বিদ্যাশিক্ষার ডিগ্রী আছে জ্ঞানের কোনো ডিগ্রী নেই; জ্ঞান ডিগ্রীবিহীন ও সীমাহীন।”
– “কোন ব্যক্তি যদি একজন ক্ষুধার্তকে অন্নদান ও একজন পথিকের মাল লুন্ঠন করে ও অন্য কাউকে হত্যা করে অথবা একজন গৃহিনীকে গৃহদান করে এবং অপরের গৃহ করে অগ্নিদাহ, তবে তাহাকে ‘দয়াময় ‘বলা যায় না।”
আজকে আমরা জানলাম সংগ্রাম করে আর নিজের কাজের প্রতি আগ্রহ থাকলে জীবনকে সফলতার দোর-গোড়ায় নিয়ে যাওয়া সম্ভব। আর এক গ্রাম্য কৃষক আরজ আলী মাতুব্বর তা করে দেখিয়েছেন তাঁর অদম্য ইচ্ছাশক্তির মাধ্যমে।
Leave a Reply