কুমার সাঙ্গাকারা: একজন প্রতিভাবান ক্লাসিক ক্রিকেটারের গল্প

Published:

Updated:

কুমার সাঙ্গাকারার জীবনী

Disclaimer

As an affiliate, we may earn a commission from qualifying purchases. We get commissions for purchases made through links on this website from Amazon and other third parties.

নাইন্টি’জ কিড আমি। বড় হয়েছি ক্রিকেটার ব্রেট লি, শোয়েব আখতারদের টো-ক্রাসার ইয়র্কার দেখতে দেখতে। শচীনের স্ট্রেট ড্রাইভ, রিকি পন্টিং এর পুল, লারার লেট কাট কিংবা রাহুল দ্রাবিড়ের পারফেক্ট ডিফেন্স।

শেন-মুরালির ঘূর্ণি, ভেট্টোরির ভদ্রবেশে ব্যাটসম্যানদের কুপোকাত। ছাপ ফেলে গিয়েছেন অনেকেই। কিন্তু প্রভাবটা বেশি পড়েছিল শ্রীলঙ্কান এক বাঁহাতি ব্যাটসম্যানকে দেখে। তিনি আর কেউ নন, তিনি হলেন কুমার সাঙ্গাকারা

ওই সময় দেখতাম কাভার ড্রাইভ অনেক বাঘা বাঘা ব্যাটসম্যানরা সেট হওয়ার আগে খেলে না। কিন্তু এই একটা লোক! ইংল্যান্ডের সুইঙ্গিং কন্ডিশন। দুই উইকেট পড়ে গিয়েছে। উইকেটে এসে প্রথম বলেই কাভার ড্রাইভ! কি ছিল এই শটটার মধ্যে?

শচীনের স্ট্রেট ড্রাইভের মতো রাজকীয়তা নাকি মার্ক ওয়াহর ফ্লিকের মতো ইলিগেন্স? নাহ, শটটা ছিল নিঁখুত। পারফেক্টশনের আদর্শ সংজ্ঞা! এতটাও নিখুঁত হয় নাকি শট?

জ্যামিতিক ভাবেও নাকি পারফেক্ট তাঁর এই কাভার ড্রাইভ, বলেছেন অনেক ক্রিকেট এক্সপার্ট। হেড পজিশন, ফুট পজিশন, বটম হ্যান্ড; ভুল নেই কোথাও!

আমার নিজের চাইল্ডহুড হিরো। অ্যাভারেজ ব্যাটসম্যান থেকে হয়েছে অসাধারণ ব্যাটসম্যান। কিপার হিসেবে ওয়ান অফ অ্যা কাইন্ড।

কুমার সাঙ্গাকারার জীবনী

কুমার সাঙ্গাকারার জীবনী 

১৯৭৭ সালের ২৭শে অক্টোবর জন্মগ্রহণ করেন শ্রীলঙ্কার মাথালেতে। তাঁর পিতার নাম ছিল স্বর্ণকুমার সাঙ্গাকারা এবং মাতার নাম ছিল আনুশকা সুরাঙ্গানা। পরবর্তীতে পরিবারসহ ক্যান্ডিতে শিফট হোন স্বর্ণকুমার এবং ছেলেকে সেখানকার ট্রিনিটি কলেজে ভর্তি করিয়ে দেন।

পিতা ছিলেন একজন উকিল। তবে পুত্র যেখানে হাত দিচ্ছিলো তাই সোনাতে পরিবর্তন হচ্ছিল। সাঁতার এবং ব্যাডমিন্টনে স্কুল লেভেলে ন্যাশনালও জিতেন তিনি। কিন্তু হেডমাস্টারের পরামর্শে পরে ক্রিকেটে মনোযোগ দেন কুমার

কলেজ শেষে ভর্তি হয়েছিলেন আইন বিষয়ে স্নাতক করার জন্য। পরবর্তীতে ক্রিকেটের কারণে ছেদ পড়লেও শেষ করেন স্নাতক। সেজন্যই তিনি যতবার টিভিতে সাক্ষাৎকার দেন, এত সুন্দর করে কথা বলতে পারেন

২২ বছর বয়সে টেস্ট অভিষেক হয় সাঙ্গাকারার, তাও সাউথ আফ্রিকার সাথে। প্রথম ইনিংসে ২৩ রান করে আউট হোন সাঙ্গাকারা।

ওয়ানডে অভিষেক হয় পাকিস্তানের সাথে, যেখানে ৩৫ রান করেন তিনি এবং পরের ম্যাচেই ক্যারিয়ারের প্রথম ম্যান অফ দ্যা ম্যাচের পুরষ্কার পান সাউথ আফ্রিকার সাথে ৮৫ রান করার সুবাদে। সেবার সিরিজে ১৯৯ রান করে নিজের জায়গা পাকা করেন এই তরুণ।

একজন ক্লাসিক কুমার  

জুলাই, ২০০৬। সেবার শ্রীলঙ্কায় খেলতে আসে সাউথ আফ্রিকা। সেবার মাহেলার সাথে মিলে গড়েন ৬২৪ রানের ম্যারাথন জুটি। পাক্কা দুইদিন ধরে ব্যাটিং করেছিলেন তাঁরা।

দ্রুততম ৮০০০, ৯০০০, ১১০০০, ১২০০০ রানের মালিক তিনি। তিন নম্বরে নেমে সবচেয়ে বেশি সেঞ্চুরির(৩৭) মালিক তিনি, সেই সাথে বেশি রানের মালিকও। যে তিন নম্বরকে ধরা হয়ে থাকে ব্যাটিং পজিশনগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কঠিন পজিশন, সেখানেই ১১০০০-র উপর রান।

উইকেটকিপার-ব্যাটসম্যান হিসেবে ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি রান। বিশ্বকাপে টানা চার সেঞ্চুরি। এক পঞ্জিকাবর্ষে ২৮৬৮ রান! কিংবদন্তি মানদন্ডে নিজেকে নিয়ে গিয়েছিলেন সেবার।

দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান স্কোরার ক্রিকেট ইতিহাসে। টেন্ডুলকারের ঠিক পরে। ২০১৪ সালের টি-২০ বিশ্বকাপে পুরো টুর্নামেন্টে ফ্লপ ছিলেন কিন্তু ফাইনালে ৩৩ বলে ৫১ করে দলকে জেতান তিনি।

দুই ফরম্যাট মিলিয়ে ৬৩টি সেঞ্চুরি, ৯৩টি হাফ সেঞ্চুরি! বেস্ট আফটার শচীন? নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে। টেস্ট অ্যাভারেজ ছিল ৫৭.৪০, ওডিয়াই অ্যাভারেজ ৪২.০০!

এক কথায় অসাধারণ! ক্যাপ্টেন্সিতেও সফল ছিলেন তিনি। ১৫টি টেস্টের ৫টিতে জিতে হেরেছিলেন মাত্র তিনটিতে। ৪৫টি ওডিয়াই এর মধ্যে জিতেছিলেন ২৭টিতে। টি-২০ তে ২১ ম্যাচের ১২টাতে জয়।  

কাউড্রেতে লেকচার দিয়ে মন জয় করেছিলেন সবার। শ্রীলঙ্কান ক্রিকেটে চলা দুর্নীতিকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে ছিলেন তিনি। সবচেয়ে কম বয়সে লর্ডসের কাউড্রে সেন্টারে লেকচার দেওয়া ক্রিকেটার তিনি। একমাত্র ক্রিকেটার যে খেলা অবস্থায় এই অর্জন করতে পেরেছিলেন।

ওয়ানডের ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ স্টাম্পিং করেছেন তিনি। বুদ্ধিদীপ্ত স্লেজিংয়ে তটস্থ রাখতেন ব্যাটসম্যান। একবার তো ফেক রান আউট করে আহমেদ শেহজাদকে মাটিতে শুইয়ে পড়তে বাধ্য করেছিলেন।

ডাবল সেঞ্চুরির যুবরাজ বলা যায় সাঙ্গাকারাকে। ১১টি ডাবল সেঞ্চুরি করেছিলেন। তাঁর উপরে শুধুমাত্র একজনই। স্যার ডন ব্র্যাডম্যান! ৫০০০ এর রানের কোটা পার হওয়া খেলোয়াড়দের মধ্যে সর্বোচ্চ গড় ধারী ব্যাটসম্যান তিনি।

ক্যারিয়ারের পিকে থাকা অবস্থায় অবসরের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তিনি। না হলে আরামসে আরো তিন-চার বছর খেলতে পারতেন তিনি। যুব ক্রিকেটারদের দলে জায়গা করে দেওয়ার জন্য অবসর নিয়েছিলেন তাড়াতাড়ি।

বুঝতে পেরেছিলেন, শ্রীলঙ্কান দল তার উপর অতিরিক্ত নির্ভর করে ফেলেছিল। তাই চাচ্ছিলেন, কোন তরুণ এসে হাল ধরুক যা এখন পর্যন্ত কেউ ধরেননি। ফলে এখন শ্রীলঙ্কান নৌকা বিশ্ব ক্রিকেটে প্রায় ডুবি ডুবি অবস্থা।

অবসর নেওয়ার পরেও রান করেছেন অনেক। কাউন্টি সিজনে সেবার করলেন সর্বোচ্চ রান।

কুমার সাঙ্গাকারার জীবনী

ব্যক্তিগত জীবনে সাঙ্গাকারা 

ব্যক্তিগত জীবনে যমজ দুই সন্তানের পিতা তিনি। তাঁর স্ত্রীর নাম ইয়াহেলি, যিনি কিনা কিশোর বয়স থেকেই ছিলেন সাঙ্গাকারার সাথে। চ্যারিটিমূলক কাজের জন্য বিখ্যাত তিনি শ্রীলঙ্কায়।

‘থিংক ওয়াইস’ প্রকল্পের একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য তিনি যার কাজ এইচআইভি নিয়ে সচেতনতা সৃষ্টি। ইউনিসেফ এবং আইসিসির মিলিত একটি প্রকল্প এটি।

তিনি কেনো সেরা? কেন এত নিখুঁত!

রকম আমি বহুবার দেখেছি যে উইকেট পড়ে গিয়েছে, ওয়ান-ডাউনে তিনি নামলেন এবং খেলাটাকে টেনে জয়ের বন্দরে নিয়ে গেলেন তিনি। প্রথম বল তাঁর জোনে পড়লে তিনি মারবেনই সেটা যতই বিরুদ্ধ কন্ডিশন হোক না কেনো!

খেলার গিয়ার ঘুরাতে পারতেন যেকোনো সময়। পরিস্থিতি বোঝার ক্ষমতা ছিল অসাধারণ। ঘন্টার পর ঘন্টা ব্যাটিং করে ক্লান্তি বোধ করতেন না। আমাদের বাংলাদেশের সাথে তাঁর গড় ছিল ২০০ এর উপর।

যতবার তিনি ছিলেন, সেঞ্চুরি মেরে গিয়েছেন। শচীনও এত স্বাচ্ছন্দ্যে আমাদের সাথে রান করেননি। তাই ছোট দল বলে তাঁকে ছোট করার সুযোগ নেই। কাভার ড্রাইভ ছিল তাঁর ফেভারিট শট এবং তাঁর চেয়ে সুন্দর কাভার ড্রাইভ করতে আমি আর কাউকে দেখেছি কিনা মনে নেই।

এখনো কোথাও হাইলাইটস দেখালে মুগ্ধের মতো তাকিয়ে থাকি তাঁর দিকে। ২২ গজের এক শিল্পী তিনি। তুলির আচড়ের মতো ব্যাটটা চালিয়ে যে কিনা বলকে সীমানাছাড়া করেন। নিজেকে উন্নীত করেছেন ক্রিকেটের একজন ক্লাসিক খেলোয়ার হিসেবে। 

প্রিয় এই মানুষটির জন্য অভিযাত্রীর পক্ষে হতে রইলো অনেক অনেক ভালোবাসা।      

About the author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Latest Posts

  • সর্দি থেকে মুক্তির উপায়, নাকের এলার্জি দূর করার উপায় | দ্রুত উপশম পেতে ঘরোয়া চিকিৎসা

    সর্দি থেকে মুক্তির উপায়, নাকের এলার্জি দূর করার উপায় | দ্রুত উপশম পেতে ঘরোয়া চিকিৎসা

    নাকের এলার্জি হচ্ছে নাকের ঝিল্লি প্রদাহের কারণে নাকের একটি সমস্যা। এটি সারা বিশ্বব্যাপী একটি স্বাস্থ্য সমস্যা। বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় ২০ থেকে ২৫ শতাংশ নাকের এই রোগে আক্রান্ত। নাকের এলার্জি কোন মারাত্মক ক্ষতিকর রোগ না হলেও এ রোগের কারণে দৈনন্দিন জীবন প্রবাহ ব্যাহত হয়। এলার্জিজনিত সর্দি এবং হাঁচি জীবনকে অতিষ্ট করে তোলে। এই রোগে হঠাৎ…

    Read more

  • কফ, কাশি দূর করার উপায় | সঠিক চিকিৎসাই হতে পারে কাশি দূরীকরণের মাধ্যম

    কফ, কাশি দূর করার উপায় | সঠিক চিকিৎসাই হতে পারে কাশি দূরীকরণের মাধ্যম

    গলায় বুকে কফ জমে থাকা বেশ বিরক্তিকর একটি সমস্যা। ঋতু পরিবর্তনের ফলে আবহাওয়া পরিবর্তন হয়। আর আবহাওয়ার এই দ্রুত পরিবর্তন আমাদের শরীর খাপ খাওয়াতে পারে না, যার কারণে সৃষ্টি হয় ঠান্ডা জ্বর ও সর্দি-কাশির। ঠান্ডা সর্দি কাশি এগুলো আমাদের কাছে খুব পরিচিত রোগ হলেও এই ঠান্ডা সর্দি কাশি থেকে আমাদের দেহে অনেক বড় বড় অসুখ…

    Read more

  • ওজন কমানোর উপায় ডায়েট চার্ট | সুস্থ স্বাভাবিক জীবন

    ওজন কমানোর উপায় ডায়েট চার্ট | সুস্থ স্বাভাবিক জীবন

    সুস্থ স্বাভাবিক এবং রোগমুক্ত জীবন আমরা কে না চাই। আর এই সুস্থ সুন্দর জীবন যাপন করার একমাত্র উপায় হচ্ছে শারীরিক ওজন ঠিক রাখা। কেননা ওজন বেড়ে গেলে যে কোন রোগের ঝুঁকি ও বেড়ে যায়। এজন্য বাড়তি ওজন অনেকের মানসিক অসুস্থির প্রধান কারণ। তাই রোগ প্রকোপ কমাতে এবং মানসিক শান্তির উদ্দেশ্যে আমাদের সকলের উচিত শারীরিক ওজন…

    Read more