কোহিনুর হীরা। পৃথিবীজুড়ে বহুল আলোচিত একটি হীরা। কোহিনুরের সাথে গেঁথে আছে নানা মিথ, বিশ্বাস ও গল্প। কেউ কেউ ভাবেন এ হীরাটি ভীষণভাবে অভিশপ্ত। আবার হিন্দুরা বিশ্বাস করেন, কোহিনুর ছিল অর্জুনের বাহুর অলঙ্কার।
কোহিনুরের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল এটির ৩৩টি পাশ রয়েছে। এর রং শ্বেত শুভ্র। কোহিনুরকে সবচেয়ে নিখুঁতভাবে কাটা হীরা মনে করা হয় হয়। এর বর্তমান মূল্য ১০০ মিলিয়ন পাউন্ড বা ১২শ’ কোটি টাকা।
অনেকে মনে করেন, কাকাতিয়া রাজবংশের দেবীমন্দিরে দেবীর চোখ হিসেবে কোহিনুর ব্যবহার করা হতো। সবার বিশ্বাস, আলোচনা, দ্বন্দ্ব নিয়েই কোহিনুর এখনও পৃথিবীবাসীর কাছে ঐতিহাসিক রহস্যের নাম।
কোহিনুর নামের অর্থ ও কোহিনুর হীরার উৎপত্তি
কোহিনুর নামটি মুঘলদের দেয়া। ফারসি শব্দ কোহ–ই–নূর শব্দটি থেকে কোহিনুর শব্দটির উদ্ভব। কোহ–ই–নূর অর্থ আলোর পর্বত। পর্তুগিজ চিকিৎসক ও দার্শনিক গার্সিয়া দা ওরতো–এর রচনায় কোহিনুর সম্পর্কে বলা হয়েছে বলে মনে করেন গবেষকরা। তিনি ১৫৬১ সালে প্রকাশিত তাঁর ‘কোলোকুইজ অন দ্য সিম্পলস অ্যান্ড ড্রাগস অব ইন্ডিয়া’ গ্রন্থে বলেছেন, ভারতবর্ষের বৃহত্তম হীরা বিজয়নগরে সংরক্ষিত আছে। ধারণা করা হয়, উনি হয়তো কোহিনুরের কথাই বলেছেন।
বাবরনামাতে কোহিনুর সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায়। এ গ্রন্থে বাবর লিখেছেন, গোয়ালিয়রের রাজা বিক্রমজিতের পরিবারকে গ্রেফতার করার পর তারা হুমায়ুনকে কিছু রত্ন দিয়েছিল। বাবরকে প্রশংসাকারীরা বলেন এই রত্নের মধ্যে থাকা একটি হীরার মূল্য দিয়ে পুরো দুনিয়ার মানুষকে আড়াই দিন খাওয়ানো যাবে। বাবর বর্ণিত এই একটি হীরাই হচ্ছে কোহিনুর।
কোহিনুর হীরার ইতিহাস
কোহিনুরের সন্ধান পাওয়া যায় তের শতাব্দীতে। গবেষকদের মতে, ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশের গুন্টার জেলার সন্তোষনগর অঞ্চলের কল্লর খনি থেকে এ হীরাটি উত্তোলন করা হয়। কোহিনুরের সাথে ‘দরিয়া-ই-নূর’ নামে আরেকটি হীরাও উত্তোলন করা হয়। এটিকে কোহিনুরের জমজ বলা হয়ে থাকে।
কোহিনুরের প্রাথমিক ওজন ছিল ৭৯৩ ক্যারেট। কিন্তু ভেনিসের হীরা কর্তনকারী হরটেনসিও জর্জিস অদক্ষতার কারণে কোহিনুর কেটে ছোট করে ফেলেন। এর বর্তমান ওজন ১০৫ ক্যারেট।
কোহিনুর বহুল আলোচিত হলেও এটি কখনো বিক্রি করা হয়নি। সাম্রাজ্যে বদলের সাথে সাথে হীরাটিরও হাত বদল হয়েছে। আবার কোহিনুর চুরি করে নেয়ারও বহুল আলোচিত ইতিহাস রয়েছে। ঐতিহাসিকদের তথ্য মতে, কোহিনুর প্রথম দিকে মালবের রাজপরিবারের অধিকারে ছিলো। তখনও কোহিনুর এত আলোচিত হয়নি।
মুঘল আমলে এটি মুঘল সাম্রাজ্যের ঐতিহ্যের প্রতীক হয়ে ওঠে। যার কারণে মুঘল শাসকবৃন্দ কোহিনুরের প্রতি বিশেষ যত্নবান ছিলেন। এ শাসকদের অধিকারে কোহিনুর ২১৩ বছর ছিল। পরে আফগানদের কাছে ৬৬ বছর ও ব্রিটেনের অধিকারে ১৩৪ বছর পার করে হীরকখণ্ডটি। এটি বর্তমানে ব্রিটিশ রাজপরিবারের সম্পত্তি হিসেবে রয়েছে।
বাবরকে কোহিনুর হীরা কে উপহার দেন
মুঘল আমলে এটিকে ‘বাবরের হীরা’ বলা হত। পানিপথের যুদ্ধের পর বাবরকে এই হীরা উপহার দিয়েছিলেন তাঁর পুত্র হুমায়ূন। বাবর বা হুমায়ূন কেউ এ হীরাকে অলঙ্কার হিসেবে ব্যবহার করেননি। সম্রাট শাহাজাহান এসে প্রথমবারের মতো ময়ূর সিংহাসনের অলঙ্কার হিসেবে কোহিনুর ব্যবহার করেন।
কোহিনুর হীরা নিয়ে যায় কে
সম্রাট শাহাজাহানের পরে পারস্যের নাদির শাহ কোহিনুর লুট করেন। ১৭৪৭ সালে নাদির শাহর মৃত্যুর পর এটি আফগানিস্তানের আমির আহমদ শাহ দুররানির কাছে ছিল। পরবর্তীতে কোহিনুরের মালিক হন আহমদের বংশধর শাহ সুজা দুররানি। বহু ঘটনা শেষে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারত জয় করলে কোহিনুর চলে যায় ব্রিটেনের রাণীর দরবারে।
গবেষকরা স্থান বিবেচনায় কোহিনুরের ভ্রমণ পথ চিহ্নিত করেছেন। তাঁদের মতে, কোহিনুর বহু দেশ ও স্থান ভ্রমণ করেছে। কোহিনুর খনিতে তৈরি হয় পাঁচ হাজার বছর আগে, গুল্টারে।
তারপর ১৩০৪ সালে এটি মালওয়া, ১৩০৬ সালে অরুগাল্লু, ১৩২৩ সালে দিল্লি, ১৩৩৯ সালে সামরখা-, ১৫২৬ সালে দিল্লি, ১৭৩৯ সালে পারস্য, ১৮০০ সালে পাঞ্জাব, ১৮৪৯ সালে লাহোর, ১৮৫০ সালে যুক্তরাজ্য এবং বর্তমানে এটি টাওয়ার অব লন্ডনে রয়েছে।
কেন কোহিনুর অভিশপ্ত
কোহিনুরের অভিশাপ নিয়ে প্রচুর গল্প বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে আছে। বলা হয়, যে শাসকের অধীনে এ হীরাটি ছিল সে-ই হারিয়েছে তার সাম্রাজ্য, ধন-দৌলত। সম্রাট বাবর থেকে শুরু করে ব্রিটিশ রাজা পর্যন্ত, যিনিই এ হীরাটির অধিকারী হয়েছেন তার জীবনেরই নেমে এসেছে দুর্গতি। সিংহাসনচূত, সংঘাত, রক্তারক্তি, খুনাখুনির ইতিহাস তাই কোহিনুরের সাথে গাঢ়ভাবে লেপ্টে আছে।
কোহিনুরকে ভারত থেকে যুক্তরাজ্যে নেয়ার পথে কম ভোগান্তি হয়নি ব্রিটিশদের। এই ইতিহাসটুকু না বললেই নয়। ১৮৫০ সালের ১২ জানুয়ারি ডালহৌসি কোহিনুরকে ব্রিটেনে পাঠানোর নির্দেশ দেন। ৬ এপ্রিল কোহিনুরকে নিয়ে জলপথে ব্রিটেন রওনা দেয়া হয়। কোহিনুর নেয়া হচ্ছিল ব্রিটেনের রানীর জাহাজ মিডিয়ায়। যাত্রার কদিন পরেই জাহাজে যেন অভিশাপ লাগে। কলেরার মহামারিতে এসময় ১৩৫ জন ক্রু মারা যান।
এটাই শেষ নয়। এ জাহাজটি এর পর ঝড়ের কবলেও পড়ে। অনেক বিপত্তি শেষে ৩০ জুন মিডিয়া প্লাইমাউথ বন্দরে পৌঁছে। ওইসময়ই বিট্রিশ ও অন্যান্য সংবাদপত্রগুলো কোহিনুরের অভিশাপ নিয়ে লিখতে থাকে। বিট্রিনে যাওয়ার পর কোহিনুরের অন্য একটি বৈশিষ্ট্য আবিষ্কার হয়। সেটি হলো কোহিনুর কেবল পুরুষ শাসকদেরকেই অভিশাপ দিয়ে থাকে। নারীরা তার অভিশাপ থেকে আনুকুল্য পায়। যার কারণে কোহিনুরের অভিশাপ রানী এলিজাবেথের ক্ষেত্রে কোনো কাজে লাগেনি।
হীরার প্রকৃত মালিক
এটির মালিকানা নিয়ে এখনও দ্বন্দ্ব রয়েছে। ভারতবাসী মনে করে, ব্রিট্রিশরা কোহিনুর চুরি করে বা পাচার করে নিয়ে গেছে।
২০১৬ সালের এক রায়ে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট বলেছেন, ‘‘সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় মনে করে, ইংরেজ শাসকেরা ভারত থেকে কোহিনুর চুরি যেমন করেনি, তেমনি লুট করেও নিয়ে যায়নি। পাঞ্জাবের মহারাজা রণজিৎ সিং ১৮৪৯ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে নিজেই এই অমূল্য সম্পদ উপহার দিয়েছিলেন।’
এমন বক্তব্যের পর পুরো ভারতজুড়ে তীব্র আলোচনার সৃষ্টি হয়। মহারাজা রণজিৎ সিং ১৮৪৯ সালে বালক ছিলেন। তিনি অল্পবয়সেই রাজা হয়। তাই মনে করা হয়, বিট্রিশরা তাঁকে চাপ প্রয়োগ কিংবা ভয়ভীতি দেখিয়ে কোহিনুরকে উপহার দিতে বাধ্য করেন।
ভারতের বরেণ্য ব্যক্তিত্ব কুলদীপ নায়ারও কোহিনুরকে যুক্তরাজ্য থেকে ভারতে ফিরিয়ে আনার নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। ভারত ছাড়াও পাকিস্তান, ইরান ও আফগানিস্তান এখনো কোহিনুরকে তাদের সম্পত্তি দাবি করেন।
পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো যুক্তরাজ্যকে কোহিনুর ফেরত দেয়ার জন্যে চিঠি লিখেছিলেন। সেসময় বিট্রিশ প্রধানমন্ত্রী ছিলেন জেমস কালাহান। তিনি দীর্ঘ একমাস পর ভুট্টোর চিঠির জবাব দিয়েছিলেন। তিনি চিঠিতে লিখেছেন, ‘কোহিনুর হীরার বিভ্রান্তিকর অতীতের বিপরীতে এর ওপর ব্রিটিশ মালিকানা একেবারে পরিষ্কার। অন্যদিকে এর মালিকানা নিয়ে অনেকের দাবি আছে। এমন পরিস্থিতিতে আমি মহামান্য রানীকে কোনোভাবেই কোহিনুরকে অন্য কোনো দেশের কাছে সমর্পণের পরামর্শ দিতে পারি না।’
আফগানিস্তানের তালেবানরাও কোহিনুর ফিরিয়ে দেয়ার জোর দাবি জানিয়েছিল। তাদের বিদেশনীতি-বিষয়ক মুখপাত্র ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ বলেছেন, ‘কোহিনুরের ইতিহাস বলে এটা আমাদের কাছ থেকে ভারতে নেয়া হয়েছে এবং সেখান থেকে ব্রিটেনে গেছে। তাই ভারতের চেয়ে কোহিনুরের ওপর আমাদের দাবি বেশি।’
বিগত দিনে যারাই কোহিনুরের দাবি করেছে তাদের কারো দাবিই যুক্তরাজ্য গ্রাহ্য করেনি। বর্তমানে হীরা লন্ডন টাওয়ারে ব্রিটিশ রানীর মুকুটের অংশ হিসেবে প্রদর্শিত হচ্ছে। সেখানে কোহিনুরের সামনে একটি বিজ্ঞপ্তি সাঁটানো রয়েছে। তাতে লেখা আছে : এই বিশেষ হীরে ইংল্যান্ডের মহারানীকে পাঞ্জাব শাসক উপহার দেন ১৮৪৯ সালে। কোহিনুর এখন মহারানীর গৌরবের অংশীদার।
কোহিনুর বর্তমান পৃথিবীর সবচেয়ে বড় হীরা নয়। এটি ওজনের দিক দিয়ে পৃথিবীর ৯০তম বৃহৎ হীরা। কিন্তু এ হীরাটির পৃথিবীব্যাপী যে ঐতিহাসিক মূল্য, আলোচনা, মিথ রয়েছে তা অন্য কোনো হীরার নেই। সেজন্যই পৃথিবীবাসীর আগ্রহ এখনো কোহিনুরের দিকে রয়েছে। যার কারণে বলা যায়, আরো শত শত বছর কোহিনুর হীরা তার মিথ ও রহস্যের দ্যুতি ছড়াবে পৃথিবী ভরে।
Leave a Reply