দুর্বৃত্ত’দের গোলাগুলি চলছে । একজন ১৭ বছরের কিশোর আটকে পরলেন গোলাগুলির মাঝে। গল্প সিনেমা হলে হয়তো সে সবাইকে উড়িয়ে চলে আসতে পারতেন। কিন্তু না, তার গায়ে এসে লাগলো ৪টা গুলি। একটি দুটি নয় চার চারটি গুলি খেয়ে এখনো বেঁচে আছেন তিনি। মৃত্যু-দুয়ার থেকে ফিরে আসা কিশোরের যেন ভাবতেই কষ্ট হচ্ছিলো, সে বেঁচে আছে! সেদিনের ঘটনায় কিশোর’টি হারিয়ে গেলে আজ হয়তো বিশ্ব মঞ্চে আমাদের একজন যোগ্য প্রতিনিধি হারাতাম।
বাংলাদেশ ফুটবলের বড় বিজ্ঞাপণ এখন তিনি। যার কারনে বাংলাদেশ ফুটবল দল নতুন করে আশার আলো দেখতে শুরু করেছেন। তিনি হলেন বাংলাদেশ ফুটবল দলের অধিনায়ক জামাল ভূঁইয়া। আর আজ আমরা জানব জামালের জীবনীর আদ্যোপান্ত।
জামাল ভূঁইয়ার শৈশব
জামালের জন্ম ১৯৯০ সালের ১০ই এপ্রিল ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে। তাঁর পৈতৃক নিবাস বাংলাদেশের ময়মনসিংহে হলেও, ষাটের দশকে তাঁর বাবা স্থায়ীভাবে ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে বসবাস শুরু করেন। সেই সূত্রেই তাঁর জন্ম কোপেনহেগেনে। সেখানে কেটে গেছে শৈশব, কৈশোর। বাবা মায়ের স্বপ্ন ছিলো ছেলে আইনজীবি কিংবা ডাক্তার হবে। কিন্তু শৈশব মনেই স্থির করে নিয়েছিলেন ফুটবলার হবেন। প্রস্তুতিও নিচ্ছেন সেভাবে। একদিন সুযোগ আসে নিজেকে প্রমাণ করার।
সুযোগ হয় ডেনমার্কের সবচেয়ে বড় ফুটবল ক্লাব এফসি কোপেনহেগেনের জুনিয়র বিভাগে একটি ম্যাচ খেলার। সুযোগ লুফে নেন তিনি। পুরো ম্যাচে একটিমাত্র গোলে জয় পায় কোপেনহেগেন আর সেই গোলটিও এসেছিল বাংলাদেশের ছেলেটির পা থেকে। ভাগ্য খুলে যায় তাঁর। স্থায়ী ভাবে তাঁকে দলে টেনে নেয় এবং নিয়মিত জুনিয়র দলে খেলতে থাকেন।
হাই স্কুলের গন্ডি পেরোননি তিনি বয়স মাত্র ষোল পেরিয়ে সতেরতে পা রেখেছেন। একদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে, দুই জনের ঝগড়ার মাঝে পরে যান তিনি। সেখানে একটু থামতেই দুজনের একজন এলোপাতাড়ি গুলি ছুঁড়তে থাকে।
কিছু বুঝে ওঠার আগেই একের পর এক চারটি গুলি লাগে তার শরীরের বিভিন্ন অংশে। দ্রুত হাসপাতালে নেওয়া হয়। চারটি গুলি খেয়েও সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যান তিনি।
দীর্ঘ সাত মাস কোমায় থাকার পর কিছুটা সুস্থ হলেন বটে। তবে এ সময় হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে ফুটবলার হওয়ার স্বপ্নে সমাধি ঘটে। কারণ ডাক্তাররা জানিয়ে দেয় আর কখনো ফুটবল খেলতে পারবেন না।
সুস্থ হয়ে তিনি সিদ্ধান্ত নেন ফুটবল বাদ দিয়ে পড়াশোনায় মনোযোগ দেওয়ার। তবে একবার ভাবলেন তাঁর গুরুর থেকে একবার পরামর্শ নিলে কেমন হয়? তাঁর গুরু কিছুটা সাহস দেখান, এবং মন দিয়ে শেষ বার চেষ্টা করতে বললেন। তিনি নেমে যান চেষ্টায়। নিজের সর্বোচ্চ চেষ্টা দিয়ে পুনরায় ক্লাবে ফিরে আসেন, তবে ক্লাবে ফিরে পায়নি আগের অবস্থান।
ক্লাব ফুটবলে জামালের হাতেখড়ি ডেনমার্কের ক্লাব কোপেনহেগেন। খেলেছেন তাদের অনুর্ধ-১৯ দলে। সেখান থেকে আরেক ডেনিস ক্লাব হ্যালারাপ আইকে’তে। এখানে ৩ মৌসুম খেলে পাড়ি জমালেন নিজ দেশ বাংলাদেশে।
২০১২ সালের ১ জুলাই তাঁর সাথে চুক্তি পাকাপোক্ত করে আবাহনী ফুটবল লিমিটেড। তবে আবাহনী’তে তার যাত্রা বেশিদিন টিকলো না। ‘১৩/১৪ মৌসুমে আবারো ফিরে গেলেন ডেনমার্কে। এবার সাড়া দিলেন তৃতীয় সারির ক্লাব ‘বল্ডকোবেন আবার্থা’র ডাকে। পরের মৌসুমেই ফ্রি ট্রান্সফারে ‘এভেডোর আইএফ’ এর জার্সি গায়ে দিলেন জামাল।
পরের মৌসুমে তাকে আবারো বাংলাদেশের লীগে দেখা গেলো। তবে এবার ‘শেখ জামাল ধানমণ্ডি ক্লাব’ এর জার্সিতে৷ তখন শেখ জামালের জয়জয়কার অবস্থা। যদিও পরের মৌসুমে তাকে ছেড়ে দেয় ক্লাবটি। নাম লেখান ‘শেখ রাসেল কেসি’ ক্লাবে। অবশ্য এবারো তাকে বেশিদিন একই পোষাকে দেখা গেলোনা। পরের দলবদলে নাম লেখালেন নব্য পরাশক্তি হিসেবে আসা ‘সাইফ স্পোর্টিং ক্লাবে’। সর্বশেষ তিনি লোনে যোগ দিয়েছেন চিটাগং আবাহনী’তে। ২০২০-২১ মৌসুমে তিনি খেলে আসেন ভারতের জনপ্রিয় আই লীগ কলকাতা মোহামেডানের হয়ে। যেখানে তিনি ৯টি ম্যাচ খেলেন। এখানেও তিনি তার ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডারের প্রতিভা দিয়ে সবার মন জয় করেন। এমনকি শেষ ম্যাচে ক্যাপ্টেন্সির দ্বায়িত্বও পালন করেছেন তিনি।
জাতীয় দলে জামালের পদচারনা
ডেনমার্কে যখন থাকতেন, তখন থেকেই লাল সবুজ জার্সিটা গায়ে চড়ানোর ইচ্ছাটা অন্তরে লালন করতেন জামাল। ২০১১ সালে ট্রায়াল দিয়ে ফিরে গিয়েছিলেন তিনি।
কিন্তু দ্বিতীয় চেষ্টায় সফল হয়েছেন বাংলাদেশ ফুটবল দলের ক্যাপ্টেন হিসেবে। কিন্তু ডেনমার্ক শীতপ্রধান হওয়ায় বাংলাদেশের গরমে নাস্তানাবুদ হয়ে, ট্রায়ালের সময় বারবার পানি খেতে হয় তাকে। তা দেখে হাসির রোল পড়ে যায় ক্যাম্পে। কোচিং স্টাফ থেকে শুরু করে খেলোয়াড় সবাই তাঁকে নিয়ে হাসি ঠাট্টা করতে থাকেন। সেবার তাকে বিষণ্ণ মনে বাড়ী ফিরে যেতে হয়।
এরপর ২০১৩ সালে বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের তৎকালীন কোচ লোডভিক ডি ক্রুইফ তাঁর কিছু ভিডিও চিত্র দেখে পুনরায় তাঁকে ক্যাম্পে আসার আমন্ত্রণ জানান। এবার তাকে ফেরত যেতে হয়নি।
জাতীয় দলে খেলার সুযোগ পায়। সেই বছর বাংলাদেশের তৎকালীন ডাচ কোচ ডি ক্রুইফের হাত ধরেই জাতীয় দলে অভিষেক হয় তাঁর। ২০১৩ সালের ৩১ আগস্ট আসে তাঁর জীবনের সেই কাঙ্ক্ষিত মুহূর্ত। প্রথমবারে নেপালের বিপক্ষে বাংলাদেশের জার্সি গায়ে মাঠে নামেন জামাল। তিনিই প্রথম বিদেশে জন্ম নেওয়া ক্রীড়াবিদ, যিনি আন্তর্জাতিক মঞ্চে প্রতিনিধিত্ব করেছেন বাংলাদেশের।
নেপালে অনুষ্ঠিত সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে প্রথম টুর্নামেন্ট সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হন তিনি। এরপর ২০১৫ সালে আটটি দেশের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত হওয়া বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপ টুর্নামেন্টে সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হন তিনি। এভাবে একের পর এক সাফল্যের পর ২০১৮ সালে তাঁকে বাংলাদেশ ফুটবল দলের নেতৃত্ব দেওয়ার দায়িত্ব প্রদান করা হয়।
একদিন শুনেছিলেন, তাকে নিয়ে সমালোচনার কথা। এরপর থেকেই তিনি আরো দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। এবং দেখুন স্বপ্ন যখন অটুট, তখন সফলতা ঠিক আপনার হাতের মুঠোয়। প্রথমবারের মতো খেলতে নেমেই বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপ টুর্নামেন্টে হয়েছেন টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড়। জাতীয় দলে খেলেন ডিফেন্সিভ মিডফিল্ড পজিশনে। যে পজিশনের ফুটবলার’রা বরাবরেই আড়ালে থেকে যায়। তার কাঁধে থাকে বারবারেই প্রতিপক্ষের মধ্যমনি হয়ে থাকা খেলোয়াড়টিকে চুপ রাখার দায়িত্ব। আর এ দায়িত্বে ফুটবলার জামাল বরাবরের মতই সফল।
মাশচেরানোর মত স্লাইডিং ট্যাকেলে বারবার প্রতিপক্ষের আক্রমন রুখে দেয়া, আবার আলোনসোর মত লং পাসে ডিফেন্সের সাথে এটাকের যোগসূত্র তৈরি করা দুটোতেই সমান সফল। ডিফেন্সকে ছায়া প্রদান করাই মূলত তাঁর কাজ। দলের প্রতিটি আক্রমন শুরু হয় তাঁর পা থেকেই।
বাংলাদেশি ফুটবল ভক্তরা তাকে ‘বাংলার মাশচেরানো’ ডাকলেও জামাল ভুঁইয়া লুকা মদ্রিচ আর টনি ক্রুসের ভক্ত। আর রোল মডেল হিসেবে মানেন ডেনিশ ফুটবলার মাইকেল লাউড্রপকে।
শিক্ষা এবং শিক্ষকতা
এবার আসি তার শিক্ষা জীবনে। সবার মতো গতানুগতিক শিক্ষায় শিক্ষিত হতে চাননি জামাল। এখনো তো ইন্টারনেট ঘেঁটে নিজে নিজেই পড়াশোনা করেছেন আইটিতে! এ তো গেল ছাত্র জামালের কথা। এবার শুনুন ‘শিক্ষক’ জামালের কথা। ডেনমার্কের একটি হাইস্কুলে ছাত্রছাত্রীদের ইতিহাস ও ইংরেজি বিষয়ে পড়ান বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার জামাল ভুঁইয়া।
স্বদেশপ্রেমী জামাল
কিন্তু এসব মুদ্রার এপিঠ। ওপিঠে লেখা, একজন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ফুটবলার খেলেছেন ডেনমার্কের শীর্ষস্থানীয় লিগে! পারফরম্যান্সের গ্রাফ ওঠানামা করেছে প্রায়ই, তাই কখনো খেলেছেন কোপেনহেগেনে প্রথম বিভাগের দলে, কখনো বা দ্বিতীয় কিংবা চতুর্থ বিভাগের দলে। মাঝখানে ফিলিপাইনেও খেলেছেন। সেই জামাল এখন অসম্ভব রকম পরিণত, আরও বেশি পেশাদার।
হয়ত খেলতে পারতেন ডেনমার্কের মত একটা মোটামুটি বিশ্বমানের দলের হয়ে। খেলতে পারতেন ইউরোপের বড় কোনো ফুটবল টিমে। কোপেনহেগেনের মত দলে অনুর্ধ্ব ১৯ লেভেলে খেলেছিলেন। হতে পারতো আরো বড় কোন জায়ান্ট ক্লাবে খেলার সৌভাগ্য হয়ত। কিন্তু তাঁর শরীরে যে ছিলো বাঙালির রক্ত।
একমাত্র বাঙ্গালী হিসেবে লা-লীগার আমন্ত্রনে দুবাইয়ের স্টুডিওতে ম্যাচের ধারাভাষ্য দিয়ে এসেছেন স্বদেশপ্রেমী জামাল। দেশ’কে প্রতিনিধিত্ব করার এমন সুযোগ ক’জন-ই বা পায়!
দৃঢ় প্রতিজ্ঞ জামালের জীবনী থেকে আমরা তাঁর কঠিন পরিশ্রম, অধ্যাবসায় ও জীবনের লক্ষ্যতে কিভাবে অটুট থেকে সফলতা অর্জন করতে হয় সেটি শিক্ষা নিতে পারি। লক্ষ্য স্থির রেখে পরিশ্রম করে গেলে আপনি সফল হবেনই।
বাংলাদের গর্ব, জামাল ভূঁইয়ার জন্য অভিযাত্রীর পক্ষ থেকে থাকলো অনেক অনেক শুভকামনা।
কেমন লাগলো ডেনমার্ক বংশোদ্ভূত বাংলাদেশী জামালের জীবনের পথচলা? জানিয়ে দিন কমেন্ট বক্সে আর বেশি বেশি শেয়ার করুন আপনার বন্ধুদের সাথে। আপনার পছন্দের কোন ব্যক্তিত্বকে নিয়ে জানতে চাইলে জানিয়ে দিন অভিযাত্রীর টিম’কে। আমরা হাজির হয়ে যাবো আপনার কাঙ্খিত ব্যাক্তিকে নিয়ে।
Leave a Reply