রবার্তো কার্লোস “বুলেট ম্যান” | ব্রাজিলিয়ান ফুটবলের এক কিংবদন্তী ফুটবলার

Published:

Updated:

Author:

Disclaimer

As an affiliate, we may earn a commission from qualifying purchases. We get commissions for purchases made through links on this website from Amazon and other third parties.

পদার্থবিজ্ঞানের ভাষায় একটি কথা আছে, পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো গতি আর বল। কিছু ফুটবলার এই ফুটবল পায়ে গতি আর বল কাজে লাগিয়ে পৃথিবীর প্রত্যেক গোলরক্ষককে পরাস্থ করেছেন। বল রেখে টানা ৫-৬ হাত পিছিয়ে পড়া। তারপর দৌড়ে এসে শট।

গোলরক্ষকদের কোনো সুযোগ না দিয়েই চলে যেত সে বল—তাঁর ট্রেডমার্ক ফ্রি কিক। যার একটি ফ্রি-কিক গোল বিজ্ঞানীদের বাধ্য করেছিলো সেটি ব্যাখ্যা করার জন্য।

লেফট ব্যাক পজিশনে খেলে তিনি হয়ে যান ইতিহাসের অন্যতম সেরা একজন ফুটবলার। বলছিলাম ব্রাজিলিয়ান ফুটবলের এক কিংবদন্তী ফুটবলার রবার্তো কার্লোসের কথা। যাকে সবাই “বুলেট ম্যান” হিসেবেই চেনে। 

রবার্তো কার্লোসের জীবনী | কীভাবে তিনি ব্রাজিলিয়ান ফুটবলের বুলেট ম্যান হলেন?

প্রত্যেক ব্রাজিলিয়ান ফুটবলারের বেড়ে ওঠার গল্পগুলো এক রকমই। দারিদ্র্য, শূন্যতা, অভাব। তার বেলাতেও একই। কিন্তু এই দারিদ্রতা কি তার স্বপ্নের পথে বাধা হতে পেরেছিলো? চলুন জেনে নেই তার পুরো জীবনের গল্প। 

রোবের্তো কার্লোস, যার পুরো নাম রোবের্তো কার্লোস দা সিলভা। তিনি ১৯৭৩ সালের ১০ই এপ্রিল ব্রাজিলের সাও-পাওলোতে একটি দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহন করেন। অন্যান্য ব্রাজিলিয়াল ফুটবলারদের মতই তিনিও ছোট বেলাতেই ফুটবলের প্রেমে পরে যান। সারাদিন বাবা মায়ের সাথে ক্ষেতে কাজ করে বিকেলে যেতেন ফুটবল খেলতে।

এত কাজ করারও পরও ফুটবল খেলার আগ্রহ দেখে তার বাবা অবাকই হতেন। গায়ে শুধু একটি হাফপ্যান্ট পরেই নেমে যেতেন মাঠে। থাকতোনা কোন গেঞ্জি ও বুট জুতো। হঠাত এক বিকেলে ব্রাজিলের সাও পাওলো রাজ্যের গার্সা শহরের এক মাঠে ফুটবল খেলতে গেলেন। তার অসাধারণ ফুটবল দক্ষতা চোখে পরলো  সাও পাওলো রাজ্যের আঞ্চলিক এক ক্লাব ‘উনিয়াও সাও জোয়াও’ এর এক স্কাউটের।

খেলা শেষ হতেই স্কাউট তাকে কাছে ডেকে নিলেন এবং সাও জোয়াও এর অ্যাকাডেমিতে ট্রায়াল দেওয়ার পরামর্শ দিলেন। আশা দিলেন যে, অচিরেই সে একজন বড় মাপের ফুটবলারে পরিণত হবেন। কিন্তু ছেলেটির দুর্ভাগ্য, ক্লাবের অ্যাকাডেমি পর্যন্ত যাওয়ার মতো বাস ভাড়া ছিল না তার কাছে।

কিন্তু যার বুকে ফুটবলার হওয়ার আশা সেই ছোটবেলা থেকে তাকে কি আর শুধু বাস ভাড়া দমিয়ে রাখতে পারে? রবার্তো হেঁটে পাড়ি দিল সাও পাওলো রাজ্যের অন্য মাথায়!

ট্রায়েলে তার অসাধারণ দম, শক্তি, গতি, টেকনিকাল দক্ষতা আর পায়ের জোর দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলেন ক্লাব কোচ। মুহূর্তেই সাও জোয়াও ইয়ুথ অ্যাকাডেমিতে যোগ দেওয়ার জন্য প্রস্তাব করলেন। আর এই সুযোগটিই লুফে নেন তিনি।

পেশাদার ফুটবলে যাত্রা

১৯৯১ সালে যোগ দেন সাও জোয়াও সিনিয়র ক্লাবে। এখানে খেলেন দুটি মৌসুম। ১৯ বছর বয়সে তাঁকে চোখে পড়ে অ্যাথলেটিকো মিনেইরোর। মিনেইরো তাদের ‘বি’ দলের সঙ্গে তাঁকে কোপা কনমেবোল কাপে পাঠায়। এই সময়টাই তাঁর জীবনের সেরা সময় হিসেবে বিবেচিত। এই কনমেবোল কাপ দিয়েই ব্রাজিলের হলুদ জার্সিটাও গায়ে ওঠে তার। 

পরের বছর নতুন দল পালমেইরাসে পা দেন কার্লোস। পালমেইরাসে মাত্র দুই বছর সময় নিলেন ইউরোপিয়ানদের নজরে আসতে। ইন্টার মিলান দলে ভেড়ায় এই অ্যাটাকিং লেফট ব্যাককে।

অভিষেক ম্যাচেই ৩০ গজ দূর থেকে ফ্রি কিকে এক অসাধারণ দৃষ্টিনন্দন গোল করেন তিনি। কিন্তু এই গোলও তাঁর ইতালি ক্যারিয়ার দীর্ঘায়িত করতে পারেনি।

ইন্টার মিলানে অসাধারণ একটা মৌসুম কাটানোর পরেও দল হিসেবে ব্যর্থ হয় দল। কোচ রয় হজসন চাচ্ছিলেন তাঁকে পাকাপাকিভাবে লেফট উইঙ্গার হিসেবে খেলাতে।

কিন্তু পাকাপাকিভাবে লেফট উইংয়ে খেলার ইচ্ছে ছিল না তাঁর। ডিফেন্স থেকে দ্রুত উঠে যাওয়া, আবার ট্র্যাক ব্যাক করা তাঁর নিজ পছন্দ হলেও কোচ চাইতেন হয় ডিফেন্সে থাকবেন, নয়তো পাকাপাকি উইংয়ে। ইন্টারের প্রেসিডেন্ট মোরাত্তির সঙ্গে কথা বলেও কোনো ফল পাননি।  

ইন্টারের সঙ্গে যখন সম্পর্ক প্রায় ছিন্ন হওয়ার পথে, তখনই এক প্রীতি ম্যাচে চমক দেখালেন কার্লোস। ৩৫ মিটার দূর থেকে নেওয়া ফ্রি কিক, বিশ্বের প্রত্যেক ফুটবল দর্শককে হতভম্ব করে দিয়ে দুর্দান্ত গতির শটে সবাইকে বোকা বানান কার্লোস। গোল দেখে বোকা বনে যান রিয়াল মাদ্রিদ কোচ ফ্যাবিও ক্যাপেলোও।

যখন জানতে পারলেন, এই খেলোয়াড়কেই ইন্টার ছেড়ে দিচ্ছে নামমাত্র মূল্যে, দেরি করেননি। সঙ্গে সঙ্গে ব্রাজিলিয়ান লেফট ব্যাককে রিয়াল মাদ্রিদে টেনে আনেন ক্যাপেলো। বিশ্ব নতুন করে চিনতে শুরু করে ফুলব্যাকের সংজ্ঞা।

রিয়াল মাদ্রিদে আসার পর ফ্যাবিও ক্যাপেলো তাঁকে স্বাধীনতা দেন যেভাবে ইচ্ছে সেভাবে খেলার। শুধু ডিফেন্স ঠিক রাখলেই হবে। ৩ নম্বর জার্সি নিয়ে সারা পৃথিবী শাসন করার প্রস্তুতিও নেন ভালোভাবেই। প্রথম বছরেই ফ্যাবিও ক্যাপেলোর অধীনে ১৯৯৭ মৌসুমে লা লিগা জয় করে নেন। 

প্রথম মৌসুম খেলেই হলেন ফিফা কর্তৃক ঘোষিত বিশ্বের সেরা ২য় খেলোয়াড়। পরের বছরও ধরে রাখলেন পারফর্মেন্সের ধারাবাহিকতা। ইউরোপের সর্বোচ্চ শিরোপা উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ এবং ইন্টারকন্টিনেন্টাল কাপ জ্বলে উঠল তার হাতে। পরের বছরও আবারো তার হাতে দেখা গেল ব্রাজিলের হয়ে দুই বছর আগে জয় করা কোপা আমেরিকা।

একবিংশ শতাব্দীর প্রথম বছরেই হয়ে ২য় বারের মতো জিতলেন উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ। পাওলো মালদিনির সাথে তাকেও ইতিহাসের সেরা লেফট ব্যাক হিসেবে পরিগণিত করা হয়।

আক্রমণভাগেও তার দুর্দান্ত ফর্ম তাকে পরিচিত করে ফুটবলের সবচেয়ে আক্রমন্মুখো ডিফেন্ডার হিসেবে। একজন ডিফেন্ডার হয়েও ক্লাব ক্যারিয়ারে তার গোল সংখ্যা ১১৭। এছাড়াও তার বল কিক করার গতি অবিশ্বাস্য প্রতি ঘন্টায় ১৬৯ কি.মি.!

ক্যারিয়ারের সেরা সময়

২০০২ সাল তার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বর্ণিল বছর। এই বছর তিনি ছোঁয়া পেয়েছেন একই সাথে বিশ্বকাপ এবং উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগের। দুইটি শিরোপা জয়েই দলে তার ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়া সেই বছরেই ইন্টারকন্টিনেন্টাল কাপ ও উয়েফা সুপার কাপ জেতায় জায়গা পেয়েছিলেন উয়েফা টিম অফ দ্য ইয়ারে। উয়েফা ডিফেন্ডার অফ দ্য ইয়ার হিসেবেও নির্বাচিত হয়েছিলেন কার্লোস।

২০০৭ সালে যখন রিয়াল মাদ্রিদ ছাড়লেন ততদিনে লা লিগায় বিদেশি খেলোয়াড় হিসেবে আলফ্রেদো ডি স্টেফানোর সর্বোচ্চ ম্যাচ খেলার রেকর্ড ভেঙ্গে ফেলেছেন তিনি। জায়গা পেয়েছেন রিয়াল মাদ্রিদের ইতিহাসের সেরা বিদেশি দলে। জিতেছেন ৩টি উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ শিরোপা ও ৪টি লিগ শিরোপাসহ মোট ১৩টি ট্রফি। রিয়ালের হয়ে তিনি ৩৭০ ম্যাচে ৪৭টি গোল করেন।

এরপর তুরস্কের ক্লাব ফেনেরবাখে কিছুদিন কাটানোর পর ১৫ বছর পর ফিরে আসেন দেশের মাটিতে। ২০১০ সালে ব্রাজিলিয়ান ক্লাব করিন্থিয়ান্সে যোগ দেন তিনি। মাত্র ১ মৌসুম কাটিয়েই আবারো চলে যান ইউরোপে, রাশিয়ান ক্লাব আনঝি মাখাচকালার হয়ে খেলতে।

আনঝিতে খেলার সময় কোচ পদত্যাগ করায় তিনি কিছুদিন কেয়ারটেকারের দায়িত্ব পালন করেন। ঐ মৌসুমে ২৮ ম্যাচে ৫ গোল করে অবশেষে ২২ বছরের দীর্ঘ প্রোফেশনাল ক্যারিয়ারের সমাপ্তি ঘোষণা করেন রবার্তো ‘দ্য বুলেটম্যান’ কার্লোস

২০১৫ সালে অবসর ভেঙে ইন্ডিয়ান সুপার লিগে দিল্লী ডায়নামোস ক্লাবে একইসাথে হেড কোচ এবং খেলোয়াড় হিসেবে যোগ দেন তিনি । কিন্তু মাত্র দুইটি ম্যাচে মাঠে নামেন ৪২ বছর বয়সী এই ব্রাজিলিয়ান, বাকি ম্যাচগুলোতে ডাগআউটে থেকেই কোচের ভূমিকা পালন করেন।

ক্লাব ক্যারিয়ারের পাশাপাশি জাতীয় দলেও তিনি ছিলেন জলন্ত এক বিভীষিকা। জাতীয় দলের হয়েও তিনি ১২৫ ম্যাচে ১১টি গোল করেন। ২০০২ ফিফা বিশ্বকাপ, ১৯৯৭ সালে কোপা অ্যামেরিকা ও ফিফা কনফেডারেশন কাপ, ১৯৯৯ সালে আবারও কোপা আরেরিকা জয় করেন। 

রবার্তো কার্লোস কেবল ফুটবলার নন। তিনি হলেন অবিশ্বাস্য এক ফুটবলারের নাম। বুলেট ম্যান, সুপার হিউম্যান! যিনি গতি আর বল কাজে লাগিয়ে পৃথিবীর প্রত্যেক গোলকিপারকে পরাস্থ করেছেন। হতভম্ব বানিয়েছেন ফুটবল দর্শকদের, একবার নয়, দুবার নয়, বারবার, পুরো ক্যারিয়ার জুড়ে। 

About the author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Latest Posts

  • সর্দি থেকে মুক্তির উপায়, নাকের এলার্জি দূর করার উপায় | দ্রুত উপশম পেতে ঘরোয়া চিকিৎসা

    সর্দি থেকে মুক্তির উপায়, নাকের এলার্জি দূর করার উপায় | দ্রুত উপশম পেতে ঘরোয়া চিকিৎসা

    নাকের এলার্জি হচ্ছে নাকের ঝিল্লি প্রদাহের কারণে নাকের একটি সমস্যা। এটি সারা বিশ্বব্যাপী একটি স্বাস্থ্য সমস্যা। বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় ২০ থেকে ২৫ শতাংশ নাকের এই রোগে আক্রান্ত। নাকের এলার্জি কোন মারাত্মক ক্ষতিকর রোগ না হলেও এ রোগের কারণে দৈনন্দিন জীবন প্রবাহ ব্যাহত হয়। এলার্জিজনিত সর্দি এবং হাঁচি জীবনকে অতিষ্ট করে তোলে। এই রোগে হঠাৎ…

    Read more

  • কফ, কাশি দূর করার উপায় | সঠিক চিকিৎসাই হতে পারে কাশি দূরীকরণের মাধ্যম

    কফ, কাশি দূর করার উপায় | সঠিক চিকিৎসাই হতে পারে কাশি দূরীকরণের মাধ্যম

    গলায় বুকে কফ জমে থাকা বেশ বিরক্তিকর একটি সমস্যা। ঋতু পরিবর্তনের ফলে আবহাওয়া পরিবর্তন হয়। আর আবহাওয়ার এই দ্রুত পরিবর্তন আমাদের শরীর খাপ খাওয়াতে পারে না, যার কারণে সৃষ্টি হয় ঠান্ডা জ্বর ও সর্দি-কাশির। ঠান্ডা সর্দি কাশি এগুলো আমাদের কাছে খুব পরিচিত রোগ হলেও এই ঠান্ডা সর্দি কাশি থেকে আমাদের দেহে অনেক বড় বড় অসুখ…

    Read more

  • ওজন কমানোর উপায় ডায়েট চার্ট | সুস্থ স্বাভাবিক জীবন

    ওজন কমানোর উপায় ডায়েট চার্ট | সুস্থ স্বাভাবিক জীবন

    সুস্থ স্বাভাবিক এবং রোগমুক্ত জীবন আমরা কে না চাই। আর এই সুস্থ সুন্দর জীবন যাপন করার একমাত্র উপায় হচ্ছে শারীরিক ওজন ঠিক রাখা। কেননা ওজন বেড়ে গেলে যে কোন রোগের ঝুঁকি ও বেড়ে যায়। এজন্য বাড়তি ওজন অনেকের মানসিক অসুস্থির প্রধান কারণ। তাই রোগ প্রকোপ কমাতে এবং মানসিক শান্তির উদ্দেশ্যে আমাদের সকলের উচিত শারীরিক ওজন…

    Read more