যখন ফুটবল নিয়ে কথা হয় তখন “গোল্ডেন বুট” প্রসঙ্গ আসা খুব স্বাভাবিক। আচ্ছা, এবারের গোল্ডেন বুটের মালিক হতে পারেন কে? আপনার প্রেডিকশন জানিয়ে দিন কমেন্টে আমাদেরকে।
এবার প্রেডিকশন থেকে একটু পরিসংখ্যানের দিকে তাকানো যাক। গত ১০ বছরে চারবার করে গোল্ডেন বুট জিতেছেন ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো ও লিওনেল মেসি। প্রতিবার আলোচনা মূলত এই দুই ব্যক্তির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে।
কিন্তু এবার আপনাকে একটু নতুন করে ভাবার সুযোগ করে দিচ্ছেন মিসরীয় ফরওয়ার্ড মোহাম্মদ সালাহ। লিভারপুলের হয়ে খেলা এই নতুন বিস্ময় এই সিজনে ইতোমধ্যে ৪৪টি গোলের মালিক। মোহাম্মদ সালাহর ব্যাপারে সবচেয়ে মজার বিষয় হলো – শুধু ভক্ত নয়, প্রতিপক্ষের কাছেও তিনি একজন প্রিয় ব্যক্তি।
এর প্রধান কারণ – তার ব্যক্তিগত গুণাবলি। মিসরের মানুষেরা তাকে “ফারাও” বলে ডাকেন। ফারাও মিসরের প্রাচীন রাজাদের নাম। আজ অভিযাত্রীর পক্ষ হতে থাকছে এই উদীয়মান তারকার সংক্ষিপ্ত জীবন কাহিনী।
মোহাম্মদ সালাহর জন্ম, বেড়ে উঠা
১৯৯২ সালের ১৫ই জুন মিসরের ঘারবিয়ার অন্তর্গত নাগিরিগ শহরে একটি মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম তার। অন্যান্য ফুটবলারের মত তার জন্ম কোন নিম্নবিত্ত পরিবারে হয়নি।
আর ঠিক এর জন্যে ছেলেকে ফুটবলার তৈরীর থেকে একাডেমিক ক্যারিয়ারের দিকে বেশি মনোযোগের জন্যে তাগাদা দিতেন তার বাবা-মা। আর সালাহ একাডেমিক ও ফুটবল দুটোকে সমান তালে চালাতে চাইতেন।
কিন্তু সেটা বেশিরভাগ সময়ে হয়ে উঠত না। যখন ফুটবল খেলতে পারতেন না তখন ফুটবল খেলা দেখতেন। বড় হয়ে ওঠার সাথে সাথে ফুটবলের উপর নিষেধাজ্ঞা বাড়তে থাকে পরিবার থেকে। কিন্তু সালাহ নাছোড় বান্দা।
তিনি ফুটবল খেলা চালিয়ে গেলেন। মজা করে ফুটবল খেলতে খেলতে একটি বড় সুযোগ পেয়ে গেলেন। আর তা হল – কায়রোতে এল মাকাউলুনের হয়ে খেলার সুযোগ।
ফুটবলে ক্যারিয়ার শুরু মিশরীয় তারকার
২০০৬ সালে এল মাকাউলুনের যুব টিমে খেলার মধ্যে দিয়ে তিনি ক্লাব ক্যারিয়ার শুরু করেন। তারপর ২০১০ সালে এল মাকাউলুনের সিনিয়র ক্লাবে জায়গা পান।
এভাবে তার ক্লাব ক্যারিয়ার শুরু হয় ইজিপ্টিয়ান প্রিমিয়ার লিগে খেলার মধ্যে দিয়ে। তবে প্রথমদিকে তার স্থান হতো সাইডলাইনের ব্রেঞ্চে। ধীরে ধীরে মাঠে অংশগ্রহণের সময় বাড়তে থাকে। ভিশন আর ইঞ্চ দিয়ে নিজের ক্ষমতার ঝলকানি দিয়ে পুরো মাঠ কাঁপিয়ে রাখতেন।
এর মাঝে মিসর অনুর্ধ-২০ ও অনুর্ধ-২৩ দলে খেলার অধ্যায় শুরু করে ফেলেন। ক্লাবের সাফল্যতার পর জাতীয় দলে খেলার সুযোগের জন্যে মুখিয়ে ছিলেন। ২০১১ সালের ৩ সেপ্টেম্বর সেই অপেক্ষার অবসান ঘটল। সিরিয়া লিয়নের সাথে মিসরের খেলার মধ্যে দিয়ে তার অভিষেক হয়।
তবে সেই ম্যাচে জাতীয় দলের হয়ে প্রথম গোলটি করতে পারেন নি। গোল করেছিলেন আরো একমাস পরে নাইজেরিয়ার সাথে খেলায়। জাতীয় দলে খেললেও অনুর্ধ টিমগুলোতে তার সরব উপস্থিতি ছিলো।
একই বছর ফিফা অনূর্ধ্ব-২০ বিশ্বকাপে খেলেন এবং পরের বছর সামার অলিম্পিকে দলের হয়ে খেলেন। সামার অলিম্পিকে দলের হয়ে অসাধারণ খেলা প্রদর্শন করে দলকে কোয়ার্টার ফাইনালে নিয়ে যান।
সবকিছু ভালোর মধ্যে যখন অঘটন ঘটেই যায়
সবকিছু ঠিকঠাকই চলছিলো। কিন্তু সে বছরই একটি অঘটন ঘটে গেল। পোর্ট সেইড স্টেডিয়ামের ডিজাস্টারের জন্যে ইজিপ্টিয়ান প্রিমিয়ার লিগ বন্ধ হয়ে যায় আর একই সাথে সিজনের সবগুলো ম্যাচ বাতিল করা হয়।
কিন্তু এতে করে সুইস ক্লাব ব্রাসেল কর্তৃপক্ষের মুখে হাসি ফুটল। কারণ সালাহর উপর তাদের নজর ছিলো অনেক আগে থেকেই। আর ইজিপ্টিয়ান প্রিমিয়ার লিগ বন্ধ হওয়াতে তা তাদের যেন সুবিধা হলো।
ঘটনার অল্প সময়ের মধ্যে মিসর অনুর্ধ-২০ দলের সাথে তারা একটি প্রীতি ম্যাচ আয়োজন করেন। ম্যাচটি অনুষ্ঠিত হয়েছিলো বাসেলের স্ট্যাডিয়ান র্যানকনে। প্রথমার্ধে মাঠে নামেন নি। কিন্তু কথায় আসে – “ওস্তাদের মার শেষ রাতে”।
তাই দ্বিতীয়ার্ধে নেমে দুই গোল করে দলকে ৪-৩ জিতিয়ে দেন তিনি। ম্যাচ হারলেও বাসেলের কোচ খুশি হবার একটা বড় কারণ ছিলো। কারণ তিনি তার ক্লাবের জন্যে রত্ন পেয়ে গিয়েছেন।
সেখান থেকেই সিদ্ধান্ত। এরপর সালাহকে ট্রেনিংয়ের জন্যে এক সপ্তাহ বাসেলের আসতে বলেন। তারপর সব ফরমালিটি চুকিয়ে সে বছর এপ্রিলে চার বছরের জন্যে সালাহকে চুক্তি বদ্ধ করান।
নতুন করে শুরু
বাসেলে খেলা শুরুর প্রথম সিজনে উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগ এবং ইউরোপা লিগে অভিষেক হয় তার। ইউরোপা লিগে নিজের প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে দলকে সেমিফাইনালে নিয়ে যেতে পারলেও শেষমেষ জেতাতে পারেননি।
তবে ২০১২-১৩ সিজনে সুইস সুপার লিগে চ্যাম্পিয়নশিপ টাইটেল আর সুইস কাপে রানার্সআপ হয় বাসেল। আর সেখানে বাসেলের এই রেগুলার স্টার্টারের অবদান একদমই কম নয়। পরের সিজনে বাসেলের জেতা “হেরেন কাপ” স্কোয়াডের সদস্যও ছিলেন।
এভাবে নিজের পারফরমেন্স দিয়ে ইউরোপিয়ান ক্লাবগুলো নজরবন্দী হন। বাসেল আর চেলসির মধ্যকার হোম ও অ্যাওয়ে দুই ম্যাচে তার নৈপুণ্যে চেলসি পরাজিত হয়। তার বিস্ময় সৃষ্টিকরা প্রতিভায় মুদ্ধ হন চেলসি কোচ হোসে মরিনহো।
২০১৪-র ব্রাজিল বিশ্বকাপে নিজের দেশকে কোয়ালিফাই করতে তিনি বিশেষ ভুমিকা রাখেন। আর ২০১৪ সিজনে সামার ট্রান্সফার উইনডোতে মোহাম্মদ সালাহকে দলে ভেড়ায় চেলসি। কিন্তু তারকাসমৃদ্ধ ক্লাবে তার ঠিকানা হয় সাইডলাইন। তবে সুযোগের সাথে সাথে জ্বলে উঠতেন।
বাধ্যতামূলক মিলিটারী ট্রেনিং
২০১৪-১৫ সিজনের একদম শুরুতে তিনি মিসরে যান বাধ্যতামূলক মিলিটারী ট্রেনিংয়ের জন্যে। এখানে গিয়ে তিনি মিসরের প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করেন।
চেলসির সাথে দ্বিতীয় সিজনে এসে লোনে ফিওরেন্তিনা ২০১৫-১৬ সিজনে এক বছরের জন্যে যান। সালাহর পায়ের জাদুতে ফিওরেন্তিনা তাদের পুরোনো ফর্মে ফিরে আসে। আর তাই ফিওরেন্তিনা তাকে দলে রাখতে চায়। কিন্তু তিনি ইটালিয়ান ক্লাব “এ.এস. রোমা”তে যোগ দেন।
২০১৫ সালে আগস্টে রোমার হয়ে তার যাত্রা শুরু হয়। ঠিক পরের মাসে ফিওরেন্তিনা চেলসির বিরুদ্ধে “চুক্তি ভঙ্গের অপরাধে” আদালতে যায়।
কিন্তু মামলায় ফিওরেন্তিনা হেরে যায় এবং সালাহ রোমাতেই থাকেন। রোমাতে থাকাকালীন এক সিজন পরে ১৫টি গোল নিয়ে টপ স্কোরার এবং প্লেয়ার অফ দ্যা সিজন হন।
ইংলিশ ক্লাব লিভারপুলে মিশরীয় ফারাও
২০১৬ তে রোমা সালাহর সাথে স্থায়ী চুক্তি করতে চায়। তিনি রাজি হন। কিন্তু ২০১৭তে এসে ইংলিশ ক্লাব লিভারপুলে “ক্লাব রেকর্ড” করা ৫০ মিলিয়ন পাউন্ড ডলারের প্রস্তাব ফেরাতে পারেননি। তিনিই সর্বপ্রথম মিসরীয় খেলোয়াড় যিনি লিভারপুলের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়েছিলেন।
ওয়াটফোর্ডের সাথে অভিষেক ম্যাচে থেকে তার গোলের যাত্রা শুরু হয়। এই ওয়াটফোর্ডের সাথে লিভারপুলের আরেকটি ম্যাচে তিনি নিজে ৪টি গোল করে ৫-০তে দলের জয় নিশ্চিত করেন।
এটি ছিলো লিভারপুলের হয়ে তার প্রথম হ্যাট্রিক। এর ধারাবাহিকতায় পুরো সিজন শেষে তার গোল সংখ্যা দাঁড়ায় ৩৬ এ।
এছাড়াও ২০১৭ সালের আগস্ট মাসে তিনি লিভারপুল ভক্তদের ভোট অনুসারে “প্লেয়ার অফ দ্যা মান্থ”, “প্রিমিয়ার প্লেয়ার অফ দ্যা মান্থ” নির্বাচিত হন।
এছাড়াও ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে এক সিজনে সর্বোচ্চ চার বার “প্লেয়ার অফ দ্যা মান্থ” নির্বাচিত হয়ে রেকর্ড করেন। এর সাথে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে এক সিজনে সর্বোচ্চ গোলের রেকর্ডটিও তার।
দেশের হয়ে মোহাম্মদ সালাহ
২০১৭তে নিজের দেশের ক্যারিয়ারেও ছিলো আলোর ছটা। এ বছর আফ্রিকান ন্যাশনস কাপে তিনি নিজে সর্বোচ্চ গোলদাতার খেতাব অর্জন করেন।
পাশাপাশি দলকে ফাইনালে নিয়ে যেতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। এছাড়াও তার দল “CAF Team of the Tournament” খেতাব জিতে। ২০১৮ বিশ্বকাপের কোয়ালিফাই রাউন্ডে তিনি তার দলের হয়ে সর্বোচ্চ পাঁচটি গোল করেন।
ব্যক্তি জীবনে সালাহ কেমন?
এ তো গেল খেলোয়াড় সালাহর কথা। ব্যক্তি জীবনে সালাহ খুব সচেতনভাবে ইসলামী জীবনবিধান মেনে চলেন। এর প্রকাশ পাওয়া যায় তিনি মাঠে গোল করার পর। প্রতিটি গোলের পরে তিনি কিবলামূখী হয়ে সিজদাহ দেন।
২০১২ ইসলামী রীতি অনুসারে বিয়ে করেন ম্যাগি নামের একজন ইসলামী নারীকে। এই দম্পতির ঘরে “মক্কা” নামে একজন কন্যা সন্তানও রয়েছে। তার উদারতার প্রকাশ পাওয়া যায় বিয়ের অনুষ্ঠানে।
তার বিয়েতে কোন নির্দিষ্ট আমন্ত্রিত অতিথি ছিলো না। পুরো গ্রামের মানুষকে তিনি দাওয়াত করেন। এছাড়া বিভিন্ন মিডিয়া অনুষ্ঠানেও তিনি অন্য সবার থেকে অনেকটাই আলাদা।
একটা খুব মজার তথ্য দিয়ে আজকের আলোচনা শেষ করবো। তা হলো– মোহাম্মদ সালাহর গড় স্পিড হলো ২০.৭ কিলোমিটার/Hour.. আর তিনি ২০১৩-১৪ সিজনে ছিলেন সবচেয়ে দ্রুতগতির খেলোয়াড়।
Leave a Reply