শৈল্পিক ফুটবলারের কারিগর রোনালদিনহো
ফুটবলকে বলা হয় “গেম অফ অ্যাকশন”। পুরো ৯০ মিনিট আপনাকে একটি সক্রিয়তায় ধরে রাখবে ফুটবল। কিন্তু কেন? কখনো ভেবে দেখেছেন?
মূলত একজন ফুটবলার শুধু গোল নয়, তার শারীরিক কসরত দেখিয়ে আপনাকে প্রতিটা মিনিটে একেকটি জাদু দেখাতে সক্ষম।
সেরা ফুটবলার তর্কে আমরা অনেক পরিসংখ্যান নিয়ে আসি, তাদের নিট মূল্য নিয়ে পড়ে থাকি। কিন্তু ফুটবলটাকে শিল্প তৈরী করার যাত্রায় যারা ছিলেন তাদেরকে আমরা হয়ত কালের গহ্বরে হারিয়ে ফেলি।
আজকে আমরা জানার চেষ্টা করবো এমনি এক নিভে যাওয়া তারার গল্প। এই প্রজন্মের শুরু থেকেই শৈল্পিক ফুটবলারের কারিগর তিনি।
তার নাম “রোনালদিনহো”। অনেকেই তাকে “রোনালদিনহো গাউচো” নামে চিনে থাকবেন। তবে তার পুরো নাম “রোনাল্ড ডি আসিস মোরেইরা”। জন্মগ্রহণ করেন ২১ মার্চ, ১৯৮০ সালে, ব্রাজিলের পোর্তো আলেগ্রে শহরে, রিও গ্র্যান্ডে রাজ্যের রাজধানী রিও গ্র্যান্ডে দো সুল-এ।
তার ডাক নাম রোনালদিনহো রাখা হয় কারণ যুবকেন্দ্রের ম্যাচে তিনি ছিলেন সবচেয়ে কনিষ্ঠ ফুটবলার। তখন তার বয়সটা আন্দাজ করতে পারছেন? সে সময় তিনি মাত্র ৮ বছরের একজন বালক।
৮ বছরে ফুটবল প্রতিভার প্রধান কারণ ছিলো তার পরিবার। বাবা জোয়াও ডে এসিস মরেইরা ছিলেন একজন পেশাদার ফুটবলার। স্থানীয় ক্লাব এস্পোরটে ক্লাব ক্রুজেয়রোর হয়ে তিনি খেলতেন। যদিও পরে খেলার ঝোঁক ধরে রাখতে পারেন নি।
অন্যদিকে, বড় ভাই রবার্তো ছিলেন পুরোদস্তু একজন ফুটবলার। অর্থ্যাৎ অন্যান্য ব্রাজিলিয়ান পরিবারের মত তিনিও একটি ফুটবল পরিমন্ডলেই বড় হয়েছিলেন।
বাঁধা এবং ফুটবল
রোনালদিনহোর জীবনের পরিবর্তন আসতে থাকে ঐ ৮ বছর বয়সেই। একইসাথে এসময় ঘটে তার জীবনের সবচেয়ে দুঃখজনক ঘটনা।
তার বাবা সুইমিং পুলে একটি মারাত্মক হার্ট অ্যাটাক করেন এবং মারা যান। অন্যদিকে, একই সময়ে রবার্তো গ্রেমির সাথে চুক্তিবদ্ধ হন। কিন্তু ইনজুরির কারণে তার ক্যারিয়ার থমকে যায়।
অন্যদিকে, রোনালদিনহো সর্বপ্রথম মিডিয়ার নজরের আসেন তার ১৩ বছরে বয়সে। কারণ একটি স্থানীয় দল ২৩-০ ব্যবধানে জিতে যায়। আর সেই দলের পক্ষে সবগুলো গোল করেন রোনালদিনহো নিজেই।
তবে তার ক্যারিয়ারের প্রথম ব্রেকথ্রু আসে ১৯৯৭ সালে। সে বছরই ডাক পেলেন ব্রাজিলের অনূর্ধ্ব-১৭ এর যুব বিশ্বকাপের দলে। ব্রাজিল চ্যাম্পিয়ন হল। রোনালদিনহো হলেন টুর্নামেন্টের ৩য় সেরা এবং সাথে পেলেন ব্রোঞ্জ বল। এই বিশ্বকাপে দিনহো মোট দুটি গোল করেছিলেন।
রোনালদিনহো’কে নিয়ে তোলপাড়
এরপর থেকেই ব্রাজিলিয়ান ক্লাবগুলো তাকে দলে ভিড়াতে উঠে-পড়ে লাগল।
অবশেষে ভাগ্যের চাকা থামে গ্রোমিতে। ১৯৯৮ সালে তিনি কোপা লিবারটাডোরেস এ গ্রেমিওর সিনিওর দলে চান্স পান। মোট ৩ সিজনে ১৪৫ ম্যাচে ৭২ গোল এবং ২টি এসিস্ট।
শুধু ১৯৯৯ সালেই গ্রেমিয়ের হয়ে তিনি ৪৮ ম্যাচেই করে বসেন ২৩ টি গোল মাত্র ১৯ বছর বয়সে।
একই বছর দিনহো সাউথ আমেরিকান যুব চ্যাম্পিয়ানশিপে ব্রাজিলের প্রতিনিধিত্ব করেন। এই প্রতিযোগীতায় তিনি মোট ৩ টি গোল করেছিলেন।
এর ফলে ব্রাজিল ফিফা যুব বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ পায়। নাইজেরিয়ায় অনুষ্ঠিত ফিফা যুব বিশ্বকাপেও দিনহো মোট ৩ টি গোল করেছিলেন। এ টুর্নামেন্টে ব্রাজিল কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে বিদায় নিয়েছিলো।
জাতীয় দলে রোনালদিনহো
ব্রাজিলের তিন ফরম্যাটে অংশ নেবার পর, জাতীয় দলে খেলাটা তার জন্যে শুধু যেন নিছক অপেক্ষা ছিলো। সেই অপেক্ষার অবসান ঘটল ১৯৯৯ সালে ২৬ জুন। মাত্র ১৯ বছর বয়সী দিনহো যেন স্বমহিমায় জ্বলে উঠলেন।
লাটভিয়াকে ৩-০ হারালো ব্রাজিল। যার মধ্যে দুইটি গোলই তার। অসাধারণ সব নৈপুণ্যের সংমিশ্রণ ঘটিয়ে বড় আসরের ফাইনাল স্কোয়াডে জায়গা নেওয়ার পথ সুগম করলেন।
ফলও মিলল হাতেনাতে। সেবছরই অনুষ্ঠেয় কোপায় জায়গা করে নিলেন। শুরু হলো ব্রাজিলের সিনিয়র টিমে তার যাত্রা।
কোপায় তিনি গোল করলেন মাত্র ১টি। কিন্তু ব্রাজিল হলো চ্যাম্পিয়ন। তাই ১৯ বছর বয়সেই ছুঁয়ে দেখা হলো কোপা শিরোপা। সে বছরই আরেকটি বড় আসরে অংশ নেন রোনালদিনহো। আর সেটা হলো কনফেডারেশন কাপ।
নিজের পায়ে বল নিয়ে একের পর এক গোল ভেদ করলেন প্রতিপক্ষের জালে। তার এই আসরে সবচেয়ে সফল ম্যাচ ছিলো সৌদি আরবের বিপক্ষে। ৮-০ জয়ের এই ম্যাচে ব্রাজিলের হয়ে হ্যাট্রিক করলেন।
যদিও দল কাপ জিতেনি। কিন্তু নিজের কৃতিত্বের প্রমাণ দিয়ে গোল্ডেন বল ও গোল্ডেন বুট। এরপর ২০০০ সালে রোনালদিনহো ব্রাজিলের অনূর্ধ্ব-২৩ দলের হয়ে প্রি-অলিম্পিক টুর্নামেন্টে অংশ নেন। এ প্রতিযোগীতার ৭ ম্যাচে ৯ গোল করে দলকে চ্যাম্পিয়ন করেন।
রোনালদিনহোর ঐশ্বরিক কারিশমা
পরপর সাফল্যের মাধ্যমে নিজের অস্তিত্ব জানান দেন খুব ভালো করে। যার ফলাফলে ২০০১ সালে ৫ মিলিয়ন ইউরো ট্রান্সফারে খেলা শুরু করেন ফরাসি জায়ান্ট পিএসজিতে। গ্রোমির মত এখানেও সফল তিনি। ২ সিজনের মোট ৮৬ ম্যাচে ২৫ গোল এবং ১৮টি এসিস্ট করেন।
দেখতে দেখতে চলে আসে ২০০২ বিশ্বকাপের সময়। কিন্তু সময়টা ভালো যাচ্ছিলো না ব্রাজিলের। কোয়ালিফাই করতে অনেক কাঠ কয়লা পোড়াতে হয় সেলেসাওদের। তাই হট ফেবারিট তকমাটা যেন ফিকে হয়ে গিয়েছিলো।
এসময় স্কোয়াডে সুযোগ পান রোনালদিনহো। সাথে রোনাল্ডো-রিভাল্ডো। এই ত্রয়ী মিলে টুর্নামেন্ট শুরুতেই ব্রাজিল সমর্থকদের উপহার দিলেন হট ফেবারিট তকমা।
অন্যদিকে, আর্জেন্টিনা-ফ্রান্সের মত হট ফেভারেট দলগুলা বাদ পরে গেল প্রথম রাউন্ডেই। আর ব্রাজিল এই ত্রয়ীর উপর ভর দিয়ে একের পর এক বাঁধা পেরিয়ে গেল।
কিন্তু রোনালদিনহোর কারিশমার দেখা মিলল কোয়ার্টার ফাইনালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে। ফার্স্ট হাফে স্কোর ছিলো ১-১! সেকেন্ড হাফে রোনালদিনহো ৪০ ইয়ার্ড দূর থেকে একটা ফ্রি-কিক নিলেন।
বলটা হাল্কা টার্ন নিয়ে আস্তে করে টপ কর্নারে আকস্মিকভাবে ঢুকে গেল। ইংল্যান্ডের গোলকিপার ড্যাভিড সিম্যান শুধু হতভম্ভ হয়ে তাকিয়েই থাকলেন আর ব্রাজিল সমর্থকদের জন্যে নতুন আস্থার জানান দিলেন এই মিডফিল্ডার।
বিশ্বকাপের সব সমীকরণ ভুল প্রমাণ করে ব্রাজিল চ্যাম্পিয়ন।
ক্যারিয়ারে আবার আরেকটি মোড় রোনালদিনহের। পিএসজি থেকে চলে গেলেন আরেক স্প্যানিশ জায়েন্ট বার্সাতে। বার্সার সময়টা তখন যাচ্ছে তাই। রোনালদিনহো সেই বার্সাকে খাদের কিনারা থেকে টেনে তুললেন।
ঠিক এই সময়টাতেই নান্দনিক ফুটবলার হিসেবে দিনহো নিজের জানান দিতে শুরু করেন। ৯০ মিনিটে পায়ের জাদু দিয়ে মাতিয়ে রাখলেন পুরো গ্যালারীসুদ্ধ মানুষকে। ফ্লিপ ফ্ল্যাপ, র্যাবোনা, রেইনবো, ইলাস্টিকো, থ্রি সিক্সটি – ভ্যারিয়েশনের একেকটি ঝলক নিয়ে হাজির হতেন প্রতি ম্যাচে।
দিনহো তখন হয়ে উঠেছেন একটি কমপ্লিট প্যাকেজ। ২০০৫ এর এল ক্লাসিকোতে সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ে এটি।
রোনালদিনহো সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে শক্তিশালী মাদ্রিদের বিপক্ষে দুইটি অমুল্য গোল করে মাদ্রিদ ফ্যানদের থেকে স্ট্যান্ডিং অভেশন পান। ইতিহাসে শুধুমাত্র ৩ জন স্ট্যান্ডিং অভেশন পান বার্নাব্যুতে। তারা হলেন ম্যারাডনা, রোনালদিনহো, ইনিয়েস্তা।
বার্সা এবং রোনালদিনহো
বার্সার হয়ে ৫ সিজনে ২০৭ ম্যাচে ৯৪ গোল এবং ৬৯টি এসিস্ট। স্বীকৃতিসরূপ ২০০৪ এ ফিফা বর্ষসেরা ফুটবলার এবং ২০০৫ এর ব্যালন ডি ওর লুফে নেন রোনালদিনহো।
শুধু ক্লাব ক্যারিয়ার নয়, নিজের দলে একের পর এক সাফল্য উপহার দিচ্ছিলেন তিনি। ২০০৫ এর কনফেডারেশন কাপ যার একটি প্রমাণ।
ক্লাব ইতিহাসে ২০০৫ ছিলো রোনালদিনহোময়। ২০০৫-০৬ সিজনে মেসি-ডেকো-এটো-বেলেত্তিদের সাথে জিতে নিলেন লা লিগা এবং চ্যাম্পিওন্স লিগ। ১৪ বছরের খড়া ভেঙ্গে বার্সাকে চ্যাম্পিয়ন বানাতে বেশ ভালো ভূমিকা রাখেন রোনালদিনহো।
এরপর আসে ২০০৬ বিশ্বকাপ। দিনহোকে নিয়ে সবাই আকাশচুম্বী আশায় বুক বাধলেন। কিন্তু গুড়ে বালি। হুট করেই ফর্ম পড়তে থাকলো তার। ফলশ্রুতিতে ফ্রান্সের কাছে হেরে ছিটকে পড়ে ব্রাজিল।
ফুটবল জাদুকরের পতন
এরপরেও ইতিহাসটা দিনহো ভক্তদের জন্যে মোটেও সুখকর নয়। একের পর এক, অভিযোগে অভিযুক্ত হতে থাকলেন এই নান্দনিক ফুটবলের জাদুকর। আর মাঠের পারফর্মমেন্স বাজে হওয়াতে গুঞ্জন আরো জোরালো হলো।
২০০৫ এর কনফেডেরেশান কাপের পর থেকে প্রায় ২ বছর ধরে ব্রাজিলের জার্সি গায়ে গোলবিহীন ছিলেন এই জাদুকর। ২০০৮ সালের বেইজিং অলিম্পিকে সিনিয়র খেলোয়াড় হিসেবে ব্রাজিল অলিম্পিক টিমে যোগ দেন রোনালদিনহো।
তাকে ব্রাজিল অলিম্পিক টিমের ক্যাপ্টেন করা হয়। কোয়ার্টার ফাইনালে ২ গোল করে দলকে সেমি ফাইনালে তুললেন রোনি। সেমি ফাইনালে রোনালদিনহোর ব্রাজিলের প্রতিপক্ষ মেসির আর্জেন্টিনা।
এই টুর্নামেন্টের চ্যাম্পিয়ান আর্জেন্টিনার কাছে হেরে যায় ব্রাজিল। ব্রাজিল এই অলিম্পিকে ব্রোঞ্জ মেডেল জেতে।
অবশেষে, ২০০৮ বার্সা ছেড়ে দিলেন। এবার গেলেন এসি মিলানে। কিন্তু তখন সেই রোনালদিনহোকে আর খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। তবে ২০১০-১১ মৌসুমে এসি মিলানের হয়ে লীগ শিরোপা জিতে বার্তা দিয়েছিলেন ফুটবলকে আরও অনেক কিছু দেওয়ার বাকি আছে তার। কিন্তু তবুও এর পরের গল্পটা পিছিয়ে যাবার।
রোনালদিনহোর বেদনা
২০১০ বিশ্বকাপে রোনালদিনহোর ফর্ম থাকার পরও কোচ দুঙ্গা তাকে দলে জায়গা দেন না। তারপরও ২০১৩ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সময় থেমে থেমে দলে ডাক পেয়েছেন তিনি।
কিন্তু ২০১৩ সালের কনফেডেরেশান কাপে দলে ছিলেন না। এমনকি ২০১৪ সালে স্কোলারির বিশ্বকাপ দলেও আর জায়গা পাননি তিনি।
অন্যদিকে কয়েক সিজন পরেই আবার ক্লাব পরিবর্তন করলেন। ২০১১ সালে ফ্যামেঙ্গোতে ফেরেন রোনালদিনহো। তারপর গেলেন ব্রাজিলীয় ক্লাব এটলেটিকো মিনেইরোতে। ২০১৩ তে কোপা লিবারটাডোরেস জিততে যথেষ্ট ভালো ভূমিকা রাখেন এটলেটিকো মিনেইরোর হয়ে।
এরপর মেক্সিকোর কেরেতারা এবং সর্বশেষ খেলেন ব্রাজিলিয়ান ক্লাব ফ্লুমিনেনসে। সবশেষ তাকে ২০১৫ সালে ব্রাজিলিয়ান ক্লাব ফ্লুমিনেনসের হয়ে ম্যাচ খেলতে দেখা যায়।
এরপর বেশ কয়েকবার অবসর নিয়ে কথা বলেছেন এই জাদুকর। অবশেষে ২০১৮ সালের ৩১ মে অফিশিয়ালি অবসরের কথা জানিয়ে দেন এই কিংবদন্তী ফুটবলার।ও
ঐশ্বরিক ছন্দের অধিকারী রোনালদিনহোর অর্জন
রোনালদিনহো ব্যক্তিগত পুরস্কার হিসেবে ফিফা কনফেডেরেশান কাপ গোল্ডেন বল, ব্রোঞ্জ বল, গোল্ডেন বুট, কনমেবল মেন প্রি অলিম্পিক টপ স্কোরারের পুরস্কার জিতেছেন।
এছাড়াও ২ বার ওয়ার্ল্ড সুকার ম্যাগাজিনের বর্ষসেরা খেলোয়াড়, ২ বার ফিফা ওয়ার্ল্ড প্লেয়ার অভ দ্যা ইয়ার হয়েছেন। ব্যালন ডি অরও জিতেছেন এ প্রতিভাধর ফুটবলার। ফিফা বিশ্বকাপের একাদশে ১বার এবং ফিফপ্রো ওয়ার্ল্ড একাদশে ৩ বার জায়গা করে নিয়েছেন।
অভিযাত্রীর পক্ষ থেকে এই ফুটবল জাদুকরের জন্যে শুভকামনা রইল।
Leave a Reply