ফুটবল যাদুকর পেলের পরেই তাঁর স্থান। ২০০০ সালে ফিফার করা “প্লেয়ার অফ দ্যা সেঞ্চুরি”তে ছিলো তার নাম। সে হিসেবে তার ফুটবল ক্যারিয়ার আরো বেশি উজ্জ্বল হতে পারত। কিন্তু ড্রাগ আর বিশৃঙ্খল জীবন তাকে অতটা প্রজ্বলিত হতে দেয়নি।
ক্লাব ক্যারিয়ারের মাঝামাঝিতে ড্রাগের জন্যে তাকে ৭০,০০০ ডলার জরিমানা করে। এই ফুটবলারের ক্যারিয়ার বাঁচাতে ঐ অঞ্চলের লোকজন চাঁদা তুলে সে জরিমানা পরিশোধের চেষ্টা করেন।
তিনি মানুষের আবেগের সাথে এতটা মিশে গিয়েছিলেন যে, তাঁর নিষিদ্ধ হবার ঘটনায় বাংলাদেশে একজন আত্মহত্যা করেন। কার কথা বলছি তা হয়ত আর্জেন্টাইন ফ্যানরা ইতোমধ্যে বুঝে গিয়েছেন।
বলছি আর্জেন্টাইন ফুটবল ঈশ্বর দিয়েগো ম্যারাডোনা কথা। আপনাদের জানাবো তাঁর ফুটবল ক্যারিয়ার, ব্যক্তিগত জীবনসহ উত্থান-পতনের গল্প। বিস্তারিত জানতে শেষ পর্যন্ত সাথেই থাকুন।
দিয়েগো ম্যারাডোনার জীবনী
‘চিতরো’ দিয়েগো মারাদোনা এবং ‘দোনা তোতা’ দালমা সালভাদ দম্পতির ঘর আলো করে ১৯৬৯ সালের ৩০শে অক্টোবর কোলে আসেন তাদের চতুর্থ সন্তান দিয়েগো আরমান্ডো ম্যারাদোনা বা দিয়েগো মারাদোনা ।
তাঁর জন্ম হয়েছিলো বুয়েনোস আইরেস প্রদেশের লানুস শহরের পলিক্লিনিকো এভিতা হাসপাতালে। তবে তাঁর বেড়ে ওঠা ভিয়া ফিওরিতোতে। ছয় সন্তানসহ আটজনের পুরো পরিবার চালাতে প্রায় হিমশিম খেতে হতো তাঁর বাবাকে।
অন্যদিকে ফুটবলের পরিবেশ ছোটবেলা থেকে পরিবারের মধ্যেই ছিলো। তাঁর ছোট দুই ভাই ছিলেন পেশাদার ফুটবল খেলোয়াড়।
আর ঠিক এ কারণেই একদম ছোট বয়স থেকে তাঁর ফুটবল খেলা শুরু। এর ধারাবাহিকতায় ১০ বছর বয়সে এস্ত্রেয়া রোজার হয়ে খেলার সময় চোখে পড়েন ফ্রান্সেসকো কোরনেহো নামের একজন স্কাউটের।
তারপর খেলা শুরু করেন বুয়েন্স আয়ার্সের জুনিয়র টিম “লস সেবোলিটিয়াস”-এর হয়ে। এই দলের হয়ে টানা ১৩৬ ম্যাচ খেলেন এবং নিজের প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে মাত্র ১২ বছর বয়সে “বল-বয়” খেতাব নেন।
পেশাদার ফুটবলে ম্যারাডনা
১৯৭৬ সালে তাঁর ১৬তম জন্মদিনের ১০ দিন আগে আর্জেন্টিনোস জুনিয়রসের হয়ে তাঁর পেশাদার ফুটবলে অভিষেক হয়। এই ক্লাবে তিনি তিনি ১৯৮১ সাল পর্যন্ত ছিলেন এবং ১৬৭ খেলায় ১১৫টি গোল করেন।
বছর না ঘুরতেই, তাঁর প্রথম আন্তর্জাতিক অভিষেক হয়। ১৯৭৭ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি, ১৬ বছর বয়সে হাঙ্গেরির বিপক্ষে মারাদোনার অভিষেক হয়। ঠিক পরের বছর, ১৯৭৮ সালে ঘরের মাঠেই বিশ্বকাপ আসর ছিলো আর্জেন্টাইনদের।
অন্যদিকে, সেসময় মারাদোনার ফর্ম তুঙ্গে। কিন্তু বিশ্বকাপ দলে তাঁর জায়গা হয় নি। ফলশ্রুতিতে তৎকালীন কোচ সুইজার লুই মেনট্টি চরমভাবে সমালোচিত হন।
মূল জাতীয় টিমের হয়ে খেলতে না পারলেও, ১৯৭৯ সালে ১৮ বছর বয়সে তিনি আর্জেন্টিনার হয়ে “ফিফা অনুর্ধ-২০ বিশ্বকাপে” অংশগ্রহণ করেন। সেসময়ে তিনি ইতোমধ্যে স্টার প্লেয়ারদের কাতারে চলে গিয়েছেন।
প্রতিযোগিতার ফাইনালে সোভিয়েত ইউনিয়নকে ৩–১ গোলে পরাজিত করে চ্যাম্পিয়ন হয় আর্জেন্টিনা। ১৯৭৯ সালের ২ জুন, স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে সিনিয়র দলের হয়ে প্রথম গোল করেন মারাদোনা। তারপর পুরো বিশ্বকাপে অসাধারণ খেলা প্রদর্শন করে সেরা খেলোয়াড় হিসেবে “গোল্ডেন বল” পান।
এক মিলিয়ন ইউরোর ম্যারাডোনা
অনুর্ধ-২০ বিশ্বকাপ শেষ হতেই, ক্লাব পরিবর্তন করেন। এক মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে পাড়ি জমান আরেক আর্জেন্টাইন ক্লাব “বোকা জুনিয়রস”-এ। ১৯৮১ সালের সিজনের মাঝামাঝি যোগ দিয়ে ১৯৮২ সালে প্রথম লীগ চ্যাম্পিয়নশিপ জিতেন।
সময় গুনতে গুনতে চলে আসে বিশ্ব ফুটবলের সবচেয়ে বড় আসর “ফুটবল বিশ্বকাপ”। ১৯৮২ সালে তাঁর বিশ্বকাপ অভিষেক হয়।
আর্জেন্টিনা হট ফেভারিট এবং ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন হওয়া সত্ত্বেও প্রথম রাউন্ড থেকেই আর্জেন্টিনা পিছিয়ে পড়তে থাকে। দ্বিতীয় পর্বে গিয়ে ব্রাজিলের কাছে পরাজিত হয়ে বিশ্বকাপ স্বপ্ন শেষ হয়ে যায় আলবাসিলেস্তদের।
বিশ্বকাপ শেষ করে, আরেক দফা ক্লাব পরিবর্তন করেন মারাদোনা। ১৯৮২ সালে রেকর্ড ৫ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে বার্সেলোনায় যোগ দেন এই তারকা। বার্সায় আসার পরই, জ্বলে উঠেন তিনি।
দুই সিজনে ৫৮ ম্যাচে ৩৮ গোল করেন। ১৯৮৩ সালে বার্সার হয়ে কোপা দেল রে এবং স্প্যানিশ সুপার কাপ ছিল বার্সার হয়ে তাঁর অর্জন। কিন্তু তারপরেও সময়টা যেন ভালো যাচ্ছিলো না।
মেসুত ওজিল, একজন ছান্দিক ফুটবলার এবং আড়ালের নায়ক- পড়তে ক্লিক করুন
বার্সা ছেড়ে নেপোলিতে ফুটবল ঈশ্বর
একদিকে, অসুস্থতা আর ইনজুরি অন্যদিকে, বার্সার প্রেসিডেন্ট ইয়োসেপ লুইস নুনেজের সাথে ঘনঘন বিতর্ক। অবশেষে, বার্সা ছাড়েন মারাদোনা।
১৯৮৪ সালে ৬.৯ মিলিয়ন ইউরোর রেকর্ড ট্রান্সফার অ্যামাউন্ট নিয়ে যোগ দেন ইটালিয়ান ক্লাব নেপোলিতে। নেপোলিতে যোগদানের পর তাঁর ক্যারিয়ারের মোড় ঘুরে যায়। নেপোলির ১০ নম্বর জার্সি মানেই তখন সমর্থকদের জন্যে এক উন্মাদনা।
এখন পর্যন্ত নেপোলির ইতিহাসে সবচেয়ে সফলতম সময় ছিলো এটি। তাঁর দারুণ ফর্মের কারনে নেপোলি ১৯৮৬-৮৭ ও ১৯৮৯-৯০ মৌসুমে সিরি এ চ্যাম্পিয়নশিপ জিতে নেয়। ১৯৮৬-৮৭ মৌসুমে মারাদোনা টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ গোলদাতা হন।
একই সময়ে এই ক্লাবটি ১৯৮৭ সালে কোপা ইতালিয়া জিতে এবং ১৯৮৯ সালে রানার-আপ হয়। এছাড়াও ১৯৮৯ তে উয়েফা কাপ, ১৯৯০ সালে ইতালীয় সুপার কাপ জিতে, ১৯৮৯–৮৮ ও ১৯৮৮–৮৯ মৌসুমে সিরি-এ চ্যাম্পিয়নশিপে তারা রানার-আপ হয়।
১৯৮৬ বিশ্বকাপের কিছু পূর্বে মারাদোনা টটেনহাম হটস্পারের হয়েও মাঠে নামেন ইন্টারন্যাজিওনালের বিপক্ষে। খেলায় টটেনহাম ২–১ গোলে জয় লাভ করে।
তিনি গ্লেন হোডেলের সাথে খেলেন, যিনি মারাদোনার জন্য তার ১০ নম্বর জার্সিটি ছেড়ে দিয়েছিলেন।
বিশ্বকাপ এবং দেশের হয়ে খেলা
তাঁর ছন্দ অব্যাহত থাকে ১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপেও। এই বিশ্বকাপে তিনি আর্জেন্টিনা দলের অধিনায়কত্ব পান। আসরের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তিনি এবং তাঁর দল নিজেদের আধিপত্য ধরে রেখেছিলেন।
এই বিশ্বকাপের সবচেয়ে স্মরণীয় ম্যাচ ছিলো ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে কোয়ার্টার ফাইনালে। গোলশূন্য প্রথমার্ধের পর খেলার ৫১তম মিনিটে মারাদোনা একটি গোল করেন। রিপ্লেতে দেখা যায় গোলটি করার সময় তিনি হাত দিয়ে বলে আঘাত করেছেন।
দ্য হ্যান্ড অফ গড
এই গোলের নাম দেওয়া হয় “দ্য হ্যান্ড অফ গড”। এর চার মিনিট পরেই মারাদোনা দ্বিতীয় গোল করেন। মাঠে নিজেদের অর্ধে তিনি বল গ্রহণ করে মাঠের অর্ধেকেরও বেশি অংশ দৌড়িয়ে, পাঁচ জন ইংরেজ ডিফেন্ডার এবং গোলরক্ষক পিটার শিলটনকে কাটিয়ে গোল করেন।
২০০২ সালে ফিফা অনলাইনে ভোটের আয়োজন করলে এই গোলটি “শতাব্দীর সেরা গোল” হিসেবে নির্বাচিত হয়। এছাড়াও ২০০৫ সালের ২২ আগস্ট একটি টেলিভিশন শোতে মারাদোনা “দ্য হ্যান্ড অফ গড” সম্পর্কে বলেন, তার মাথা বল স্পর্শ করেনি এবং সে মূহুর্তে তিনি জানতেন গোলটি অবৈধ।
এরপর একে একে সবদলকে হারিয়ে ফাইনালে জার্মানির সাথে জিতে শিরোপা নিজেদের করে নেয় তারা। মারাদোনা এই বিশ্বকাপে ৫টি গোল ও ৫টি এসিস্ট করে সেরা খেলোয়াড় হিসেবে গোল্ডেন বল পান।
তার প্রতি সম্মান জানিয়ে স্তাদিও অ্যাজতেকা কর্তৃপক্ষ স্টেডিয়ামটির সামনে মারাদোনার গোল অফ দ্য সেঞ্চুরীর একটি প্রতিমূর্তি নির্মাণ করেছে। প্রতিমূর্তিটি স্টেডিয়ামের প্রবেশ পথের সামনে স্থাপিত।
বিশ্বকাপের রেশ তাঁর নেপোলির ক্লাব ক্যারিয়ারেও ছিলো। একের পর এক শিরোপা উপহার দিচ্ছিলেন নেপোলিকে। জয়ের আর জাদুর এই রেশটা ছিলো ১৯৯০ এর বিশ্বকাপেও।
কিন্তু গোড়ালির ইনজুরির কারণে অনেকটাই নিষ্প্রভ ছিলেন তিনি। এই বিশ্বকাপে তিনি কোন আসরের রেকর্ড পরিমাণ ৫০টা ফাউলের শিকার হন। এছাড়াও এক ম্যাচে ২৩টি ফাউলের শিকার হওয়ার রেকর্ডও তাঁর।
ফুটবলের জাদুকর রোনালদিনহো, শৈল্পিক ছন্দ ছিলো যার পায়ে- পড়তে ক্লিক করুন
তবে সেটি ছিলো ’৮২ বিশ্বকাপে, ইতালির বিপক্ষে ম্যাচে। নিষ্প্রভ মারাদোনা নিয়ে দল তাদের পারফর্মেন্সের জোরে ফাইনাল পর্যন্ত যায়।
কিন্তু ফাইনালে রুডি ফোলারকে ফাউল করার কারণে দেওয়া বিতর্কিত পেনাল্টিতে আনড্রেয়াস ব্রেহমার করা একমাত্র গোলে জয় পায় জার্মানি। টানা দুই বিশ্বকাপ জেতা হয় না আর্জেন্টিনার।
ছন্দপতন শুরু
সবকিছু ঠিকঠাক চলছিলো। কিন্তু হুট করেই যেন ছন্দপতন হতে থাকে মারাদোনার। তিনি কোকেইনের প্রতি তীব্রভাবে আসক্ত হয়ে পড়েন। শৃঙ্খলা ভঙ্গ ও অনুশীলনে অনুপস্থিত থাকার কারণে ক্লাবের পক্ষ থেকে তাকে ৭০০০০ ডলার জরিমানা করা হয়।
নাপোলির জনগন নিজেরাই এত অর্থ জোগাড় করে দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছিল,কিন্তু মারাদোনা আর ওই ক্লাবে থাকেননি।
মাদকে আসক্ত ম্যারাডোনা
ড্রাগ টেস্টে ধরা পড়ে ১৫ মাসের নিষেধাজ্ঞা থেকে ফিরে ১৯৯২ সালে মারাদোনা নাপোলি ছেড়ে দেন। নাপোলি তাঁর প্রতি সন্মান রেখে ১০ নম্বর জার্সিটি দাপ্তরিকভাবে তুলে রাখে।
নেপোলি ছাড়ার পর স্পেনীয় ক্লাব রিয়াল মাদ্রিদ এবং ফরাসি ক্লাব অলিম্পিকে মার্শেই তার প্রতি আগ্রহী হলেও তিনি স্পেনীয় ক্লাব সেভিয়াতে যোগ দেন। সেখানে তিনি এক বছর ছিলেন। ১৯৯৩ সালে তিনি লিওয়েলস ওল্ড বয়েজের হয়ে খেলেন।
এর মধ্যে চলে আসে ’৯৪ বিশ্বকাপ। ড্রাগ টেস্টে ধরা পড়ে দুই ম্যাচ পড়েই বিশ্বকাপে খেলার নিষেধাজ্ঞা পান।
১৯৯৪ বিশ্বকাপের পর মারাদোনার ১৭ বছরের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের ইতি ঘটে। পুরো ক্যারিয়ারে তিনি ৯১ খেলায় ৩৪টি গোল করেন।
১৯৯৫ সালে তিনি বোকা জুনিয়র্সে ফিরে আসেন এবং সেখানে দুই বছর খেলেন। তারপর ১৯৯৭ সালে তাঁর জন্মদিনের সন্ধ্যায় তিনি সকল প্রকার ফুটবল থেকে অবসর নেন।
কোচ হিশেবে ক্যারিয়ার শুরু
পরবর্তীতে তিনি তাঁর কোচিং ক্যারিয়ার শুরু করেন। তিনি ২০১০ বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার হেড কোচ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এবছরই তিনি টাইমস ম্যাগাজিনের সর্বকালের সেরা ১০ বিশ্বকাপ স্কোয়াডে জায়গা করে নেন।
জাতীয় দলের কোচ থেকে ইস্তফা দেওয়ার পর ২০১৩ তে আর্জেন্টিনার একটি স্থানীয় ক্লাবে কোচের দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৮৪ সালের ৭ নভেম্বর, বুয়েনোস আইরেসে ফিয়ান্সি ক্লদিয়া ভিয়াফানিয়ের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন মারাদোনা। তাদের দুইটি কন্যা সন্তান রয়েছে। মারাদোনা এবং ভিয়াফানিয়ের বিচ্ছেদ হয় ২০০৪ সালে। ২০১৩ সালে মারাদোনার পুত্র দিয়েগো ফেরন্যান্দো তার প্রাক্তন সঙ্গিনী ভেরনিকা ওজেদার গর্ভে জন্মগ্রহন করে।
দিয়েগো মারাদোনার পুরো জীবনীটি ভিডিও আকারে দেখুন নিচে
Leave a Reply