সময়টা ঈদুল আযহার ২দিন পর মানে ২৫ শে আগষ্ট ২০১৮। ভোর ৫ঃ৫২ মিনিট। তুর্যের ফোন পেয়ে ঘুমটা ভেঙ্গে গেলো। ইদের ছুটিতে বাড়িতে আসার পর থেকে সকালে দেরি করে ঘুম থেকে ওঠা অভ্যেস হয়ে দাড়িয়েছে। ক্যাম্পাসে থাকলে সকালে ক্লাশ, ল্যাব সব মিলিয়ে জীবনটা অতিষ্ঠ একাবারে। ঈদের আগের দিন চা খেতে প্লান হলো ঘুরতে যাবো। কিন্তু কোথায় যাওয়া যায়। তুর্য জানালো বিরিশিরি সুসং দূর্গাপুর। আগে অনেকবার জায়গাটার নাম শুনেছি কিন্তু যাওয়া হয়নি অথচ আমাদের ময়মনসিংহ থেকে বিরিশিরি খুব একটা দূরেও নয়।
ফোন ধরতেই তুর্যের ঝারি, তুই এখনো ঘুমাচ্ছিস, যাবি না?
ঘুম চোখে বললাম, বৃষ্টি হচ্ছে মনে হয়। প্রতিদিন সকালে তো বৃষ্টি নামছে এই সময়!
তুর্য আবার ঝারি দিয়ে বললো, আজ বৃষ্টি হচ্ছে না। তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে আয়। আজ বৃষ্টি হলেও যাবো।
তুর্য এরকমই, যখন একবার বলছে যাবো, তো যাবো। এর আর নড়চড় হবে না। ট্রেন ৬.৩০ মিনিটে। আর ১ মিনিট লেট করলে ট্রেন মিস। সবাই তাড়াহুড়ো করে রেডি হয়ে নাস্তা না খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম। হালকা ঝিরিঝিরি বৃষ্টি নামলো।
সকালে বেলা তার উপরে বৃষ্টি। রিক্সা পাওয়া দুষ্কর। এদিকে ট্রেনের সময় হয়ে যাচ্ছে। তাই রিকসার জন্য দাঁড়িয়ে না থেকে ৫ জন বন্ধু মিলে হেটে রওনা দিলাম স্টেশনের দিকে। আমার বাসা থেকে ময়মনসিংহ স্টেশন প্রায় ৩ কি.মি দূরে।
স্টেশনে ঢুকতে দেখি ট্রেনের হুইসেল, ট্রেন ছেড়ে দিচ্ছে। এক দৌড়ে গিয়ে ট্রেনে উঠলাম। ময়মনসিংহ টু জারিয়া (নেত্রকোনা) ট্রেনের সিস্টেম হচ্ছে জোড় যার মুলুক তার টাইপের। তাই টিকেট কাটার পরও সিট পাওয়া গেলো না। সিট দখল করে কয়েকজন মেয়ে বসে আছে। কোনো মতেই তাঁরা সিট ছাড়বে না। মেয়েদের সাথে তর্ক করাও ঝামেলা। সিটের আশা বাদ দিলাম আমরা। যাই হোক ট্রেন তো ধরতে পেরেছি!
ট্রেনে উঠতে আবার সেই বৃষ্টির হানা। পুরো ট্রেন জুড়ে যেনো বৃষ্টি। সবাই চিন্তা করছিলাম স্টেশনে নেমে আবার পরের ট্রেনে ব্যাক করবো। কারণ এরকম বৃষ্টি যদি হতে থাকে তাহলে ঘুরবো কিভাবে! তবে এরকম বৃষ্টির দিনে ট্রেন জার্নি করতে ভালোই লাগে। কেমন যেন অদ্ভুত মন্থর একটা সময়, একেবারে শৈশবে টেনে নিয়ে যায়।
আনমনা হয়ে ট্রেনের এক কোনায় হেলান দিয়ে কানে হেড ফোন লাগিয়ে প্রায় পুরো রাস্তা শেষ করলাম। ৮:১৫ তে আমাদের ট্রেন পৌঁছালো জারিয়া স্টেশনে। স্টেশনের নামটা অদ্ভুত না, জারিয়া।
সকালে নাস্তা করে বের না হওয়ায় সবার পেট চো চো করছিলো। বৃষ্টির বেগ আর আগের মতো নেই, তবে ঝিরিঝিরি বৃষ্টিটা আবার শুরু হলো। সবাই নাস্তা করে নিলাম স্টেশনের পাশে একটা হোটেল থেকে।
নাস্তা শেষ করে দেখি আবার মুষলধারে বৃষ্টি। ফিরে যাবো কিনা এই নিয়ে আলোচনা চলতে চলতে প্রায় ৩০ মিনিট পর বৃষ্টি থেমে গেলো। যাক বাঁচা গেলো। আমাদের গন্তব্য দূর্গাপুরের উদ্দেশ্য রওনা হলাম। একটি মাহেন্দ্রা গাড়ি ভাড়া করলাম আমরা। এর থেকে ভালো পরিবহন এই রোডে পাওয়া যায় না।
বিরিশিরি সুসং দূর্গাপুর
রাস্তার কথা কি বলবো! জারিয়া থেকে দুর্গাপু্রের রাস্তা এত খারাপ, আমাদের প্রায় আলু ভর্তা হবার মত অবস্থা। আমার পেট ব্যথা শুরু হয়ে গিয়েছিলো ঝাঁকি খেতে খেতে। এই খারাপ অবস্থার কারণে কোন সিএনজিও যায় না এই রাস্তায়। যাওয়ার সময় চোখে পড়বে কংশ নদী। রাস্তার দুধারের দৃশ্যগুলো আপনাকে মুগ্ধ করবে। প্রায় ঘন্টা খানিক পর আমরা পৌছলাম সুসং দূর্গাপুর।
আমাদের নামিয়ে দেওয়া হলো সোমেশ্বরী নদীর তীরে। ২ টা স্ট্রিমার পার করছে যাত্রীদের। এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যেতে ভিড় জমে যায় স্ট্রিমারে। এত মানুষ ভ্রমন করতে যাবে আগে চিন্তা করতে পারিনি। অবশ্য তখন ঈদের সময় থাকায় হয়তো ভিড় বেশি ছিলো। নদী পার হয়ে একটু সামনে এগিয়ে গেলেই একটা বাজার। নামটা ঠিক মনে করতে পারছি না।
সেখানে গিয়ে আমরা গরুর দুধের চা খাই। খুব মজার ছিলো সেই চা। এক কাপ চা আর ঐ দূরে ভারতের মেঘালয়ের উঁচু উঁচু পাহাড় দেখতে কার না ভালো লাগে বলুন! স্বর্গীয় সৌন্দর্য। ভাঙ্গা রাস্তার ক্লান্তি আর বিরক্তি নিমিষেই দূর হয়ে গেলো।
চা খেয়ে আমরা বিজয়পুরের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলাম। অটো, সিএনজি, রিক্সা, ভ্যান সবই পাওয়া যায় এই বাজার থেকে। আকাশ মেঘলা থাকায় আমরা একটি ভ্যান ভাড়া করি ৩ ঘন্টার জন্য। ১১:১৫ থেকে ২:১৫ পর্যন্ত ঠিক হলো। তারপর শুরু হলো আমাদের লক্ষ্য স্থানে যাত্রা, বিরিশিরি ঘুরে দেখা।
আমাদের প্রথম টার্গেট ছিলো বিজিপি ক্যাম্প ভ্রমন। প্রায় ঘন্টাখানিক রাস্তার পাশের প্রাকৃতিক পরিবেশ, বৃষ্টিতে ভেজা সবুজ গাছপালা সত্যিই মুগ্ধ করার মত। রাস্তা একদম পরিষ্কার এবং সরু। রাস্তার মাঝে মাঝে লম্বা ব্রিজ গ্রাম্য পরিবেশ, এ এক অন্য জগত।
প্রায় ৪০ মিনিট পর আমরা পৌঁছলাম বিজিবি ক্যাম্পে। সেখানে দর্শনার্থীদের জন্য উঁচু পাহাড়ে উঠার বিশেষ ব্যবস্থা আছে। যেখান থেকে ভারতের মেঘালয় পাহাড় খুব ভালো করে দেখা যায়। এক পাশে বাংলাদেশের বিজিবি ক্যাম্প, অন্যপাশে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের উঁচু পাহাড় এবং মাঝখানে মেঘালয় থেকে বয়ে আসা সোমেশ্বর নদী।
বেশ কিছুক্ষন উপভোগ করলাম সেই অপরুপ সৌন্দর্য। এত কাছ থেকে দেখা ভারতের মেঘালয় রাজ্য ভাবতেই খুব ভালো লাগে। যেনো হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যায় কিন্তু হাত বাড়ানো মানা। যদি কাটাতারের বেড়া না থাকতো, কতই না ভালো হত।
তারপর রওনা হলাম বাংলাদেশ–ভারত সীমান্তের দিকে। এখানে যাওয়ার সুযোগ সারা বছর থাকে না। শুধু ঈদ-পূজার মৌসুমে খুলে দেওয়া হয় পর্যটকদের জন্য। যাই হোক, সেখান থেকে ৩ কিলোমিটার গেলে বর্ডার। রাস্তার দুপাশে ভারত আর মাঝের রাস্তাটি শুধু বাংলাদেশের।
এমন পরিবেশ দেখতে দেখতে যখন “বাংলাদেশের সীমান্ত এখানেই শেষ” এই লেখাটি দেখলাম, বুঝলাম চলে এসেছি গন্তব্যে। কিছু দূরে দেখা যাচ্ছে মেঘালয়ের একটি বাজার, SBI ব্যাংক ইত্যাদি।
সেখানে ১৫–২০ মিনিট থাকার পর আবার রওনা হলাম রানী কং দেখার উদ্দেশ্যে। এটা একটি খ্রিষ্টানদের চার্চ। এখানে ভেতরে প্রবেশ করতে দেয়া হয় না বাইরের কাউকে। তাই মন খারাপ করে গেইট থেকে ঘুরে আসতে হলো।
এবার আমরা চিনা মাটির পাহাড় যেটা সিরামিক পাহাড় নামেও পরিচিত সেখানে যাওয়ার উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। যেতে আরো ৩০ মিনিটের মত লাগলো। মাথার উপর তখন রোদ উঠে গেছে পুরোপুরি। অন্যরকম এক প্রকৃতির সমারোহ দেখতে পেলাম সেখানে।
উঁচু উঁচু পাহাড়ের পাশাপাশি আছে একটি নীল পানির লেক। একটি অদ্ভুত ব্যাপার ঘটে এখানে, বৃষ্টি হলে এখানকার লেকের পানির রঙ আর পাহাড়ে লেগে থাকা পাথরের রঙ বদলে যায়। কি মনে হচ্ছে আপনাদের? বিশ্বাস হচ্ছে না তো ! আমারও প্রথমে বিশ্বাস হয়নি।
কি ভাবছেন, নিশ্চয় এমন একটি স্থানে যেতে ইচ্ছে করছে? প্রকৃতি আবার রং বদলায় এত তাড়াতাড়ি! কিভাবে সম্ভব!
দুপুর হয়ে গেলো। লেকের পাড়ে আমরা ছবি তুলে নিলাম। তারপর পাহাড়ে উঠতে শুরু করলাম। এ এক অন্যরকম এডভেঞ্চার। কিন্তু সকালের নাস্তার পর আর কোন খাওয়া-দাওয়া হয়নি। তাই সবাই প্রচণ্ড ক্ষুধার্ত। জায়গায় জায়গায় বিশ্রাম নিয়ে উঠা শুরু করলাম পাহাড়ের চূড়ায়। ১০ তলার সমান তো হবেই। চূড়ায় উঠার পর যা দেখলাম তা আপনাদের বোঝাতে পারবো না। এত সুন্দর, এমন অপরূপ রূপ একমাত্র প্রকৃতিই সাজাতে পারে।
দেখতে পেলাম মেঘালয়ের সবচেয়ে উঁচু পাহাড়, মেঘের ভেতর হারিয়ে গেছে এতটাই এর উচ্চতা! এত ভরপুর গরম থাকার পরও চূড়ায় কিছুটা ঠান্ডা হাওয়া। কিছু দূরে মেঘালয়, মনে হচ্ছে ওখান থেকেই মিষ্টি ঠান্ডা বাতাস ভেসে আসছে আমাদের গায়ে। পর্যটকসহ সবাই সেখানে ছবি তুলছে মেঘালয়ের পাহাড়ের। আমরাও তুলে নিলাম।
আরো বেশ কিছুক্ষণ থাকার ইচ্ছে ছিলো কিন্তু পেট এদিকে ক্ষুধায় জ্বলছে। শেষে ক্ষুধা আর সময়ের তাড়নায় চলে আসতে হলো সেখান থেকে।
সুসং দুর্গাপুর ভ্রমণ
এবার আসি আপনারা কিভাবে যাবেন? আমরা যেভাবে গিয়েছি এবং জনপ্রতি কত খরচ হয়েছে এরকম একটা তালিকা দেওয়ার চেষ্টা করলাম নিচে।
আমরা যাত্রা শুরু করেছিলাম ময়মনসিংহ শহর থেকে। তাই আপনাদের প্রথমেই ময়মনসিংহ শহরে আসতে হবে। আপনি যদি ঢাকা থেকে আসতে চান তাহলে ঢাকার শ্যামলি, কল্যাণপুর, গাবতলী থেকে অসংখ্য বাস পাবেন ময়মনসিংহে আসার জন্য। চাইলে আপনারা ট্রেনেও আসতে পারেন।
আমি ময়মনসিংহ শহর থেকে খরচের হিসেবটা (জনপ্রতি) দিলাম।
> ময়মনসিংহ রেলওয়ে স্টেশন থেকে জারিয়া ট্রেন স্টেশন ভাড়া ২০+২০=৪০ টাকা (যাওয়া–আসা)।
> জারিয়া থেকে দূর্গাপুর, মাহেন্দ্রাতে ভাড়া জন প্রতি ৬০+৬০=১২০ টাকা (যাওয়া–আসা)।
> সোমেশ্বরী নদী পারাপার ১০+১০= ২০ টাকা জন প্রতি(যাওয়া-আসা)।
> সেখান থেকে ভ্যান রিজার্ভ ৩ ঘন্টার জন্য ৪৫০ টাকা, জন প্রতি ৯০ টাকা।
এছাড়া সকালের নাস্তা এবং দুপুরের লাঞ্চ খরচ আপনাদের উপর নির্ভর করছে। আমাদের জনপ্রতি যাতায়াত খরচ হয়েছে মোটের উপর ২৭০ টাকা এবং খাওয়া দাওয়াসহ খরচ হয়েছে ৪০৬ টাকা মাত্র। ইদ মৌসুম থাকায় গাড়ি ভাড়া সব জায়গায় একটু বেশি তাই একটু বেশি খরচ হয়েছে যাতায়াতে।
তবে ভাড়া দরদাম করে মিটিয়ে নিবেন আগেই। কারন ৩০০ টাকার ভাড়া ১০০০ টাকা হয়ে যায় এই সময়ে। ঢাকার পাশে একদিনের ট্যুর দেওয়ার জন্য পারফেক্ট একটি জায়গা। মনে রাখার মতো।
ঢাকার আশেপাশে ঘুরে আসতে চাইলে বিরিশিরি সুসং দূর্গাপুর ঘুরে আসাটা একটা ভালো সিদ্ধান্ত হতে পারে। একদিনের জন্য অনেকে মিলে ঘুরে আসতে পারেন এই সুসং দুর্গাপুর। অপরূপ সৌন্দর্যে ভরে যাবে মন।
দেশ আমার, তাই রক্ষা করার দ্বায়িত্বও আমার। সবার প্রতি অনুরোধ, ঘুরতে গিয়ে যেখানে সেখানে ময়লা বিশেষ করে প্লাস্টিকের কিছু ফেলবেন না।
Leave a Reply