চলচ্চিত্র মানুষের গল্প বলে, সমাজের কথা কথা বলে। মাঝে মাঝে তা প্রতিবাদের ভাষা হয়েও দাঁড়ায়। তাই বর্তমানে চলচ্চিত্র দুনিয়াজুড়ে বেশ বড় একটি প্লার্টফর্ম, শক্তিশালী একটি মাধ্যম। চলুন আজ জেনে আসি, সব সময়ের জন্য ইতিহাসের পাঁচটি সেরা ও নিষিদ্ধ চলচ্চিত্রের গল্প।
মানুষ কল্পনাপ্রবণ। কল্পনার সাগরে নৌকা ভাসায়নি এমন মানুষ পৃথিবীতে কমই আছে। সেই কল্পনার রঙ মানুষ লাগাতে চায় সিনেমাতেও। মাঝে মাঝে তা সমাজকে কিংবা আমাদের চালচলনকে কিছুটা পরিবর্তিত করেছে, আবার মাঝে মাঝে বির্তকের জন্ম দিয়েছে।
ব্যক্তি, সমাজ, দেশ কিংবা বিশ্বায়নের রাজনীতি থেকে ধর্মনীতি সব কিছু আজ চলচ্চিত্রে উঠে আসছে। কিন্তু সব সময় তা সব পক্ষকে খুশি করতে পারেনি। জন্ম হয়েছে নানান বির্তকের। ফলশ্রুতিতে, বিভিন্ন সময়ে নিষিদ্ধ হয়েছে অসংখ্য সিনেমা।
আজকে আমরা এমন কিছু সিনেমার কথা জানার চেষ্টা করবো, যা বিভিন্ন সময়ে বির্তকের জন্ম দিয়েছিল। অনেক দেশে হয়েছিল নিষিদ্ধ, কিন্তু সাধারণ দর্শক এসব সিনেমা সাগ্রহে দেখেছেন এবং তাদের জনপ্রিয়তার তালিকায় রেখেছেন।
চলুন জেনে নেওয়া যাক এরকম কিছু সিনেমার কথা
পৃথিবী সেরা কিন্তু নিষিদ্ধ চলচ্চিত্র
সিনেমা জগতে মানুষের বাস্তব জীবনকে ফুটিয়ে তোলা হয়। বাস্তব জীবনে এমন কিছু ঘটনা আছে, যা অনেকটাই সিনেমার সাথে মিলে যায়। এখান থেকে আমরা বেশ শিক্ষণীয় বিষয় জানতে পারি, যা জীবনে কাজে লাগানো যায়। তবে পৃথিবীর এমন কিছু চলচ্ছিত্র আছে, যা অনেক দেশেই নিষিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও সেরার তালিকায় স্থান পেয়েছে। এমন ৫টি নিষিদ্ধ মুভি নিয়ে আজকের পসরা;
১। প্রথমে আসি একটি এনিমেটেড সিনেমা নিয়ে। এনিমেটেড সিনেমা অনেকেরই প্রিয়। বর্তমানে প্রতিবাদ ও পৃথিবীর বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে সোচ্চার হওয়ার মাধ্যম হিসেবে এনিমেশন সিনেমা বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।
এই সিনেমাটির নাম দ্য সিম্পসন(২০০৭)। এই কার্টুন চলচ্চিত্রটি দুনিয়াজুড়ে দর্শকরা বেশ উপভোগ করেছেন। ছবিটি পরিচালনা করেন ডেভিড সিলভারম্যান। যখন দ্য সিম্পসন অনেক দেশে বেশ সাড়া ফেলছে, বক্স অফিস হিট করছে, ঠিক তখনই পরিচালকের জন্য একটা দুঃসংবাদ আসে।
দুঃসংবাদটি হলো, ছবিটি বার্মায় (বর্তমানে মিয়ানমার) নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু কেনো নিষিদ্ধ করা হল? কারণটি শুনলে যে কেউ হেসে উঠবেন। বার্মা সরকারের অভিযোগ, এই সিনেমায় হলুদ রঙকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। হলুদ রঙ বার্মা সংস্কৃতির কাছে অপমানকর। রঙ নিয়েও যে কারো কারো আঘাত লাগতে পারে এমন জাতি দুনিয়াতে বোধহয় একটাই।
২। এবার এমন একটি সিনেমার কথা বলব, যা সিনেমাপ্রেমীদের কাছে খুব পরিচিত। লুইস মাইলস্টোন পরিচালিত এই চলচ্চিত্রটি ১৯৩০ সালের ২১ এপ্রিল মুক্তি পায়। এটি নির্মিত হয় জার্মান উপন্যাসিক এরিক মারিয়া রেমার্কের প্রথম বিশ্বযুদ্ধের উপর লিখিত একটি উপন্যাস অবলম্বনে।
উপন্যাসটির মূল নাম Im Westen nichts Neues. আর সিনেমার নাম দেওয়া হয় অল কোয়াইট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট। এই চলচ্চিত্রটি মূলত হিটলার আর তার বাহিনীর অত্যচারের বিরুদ্ধে তৈরী।
সিনেমার কাহিনী শুরু হয় এভাবে, Paul Bäumer নামে একজন জার্মান ছাত্র তার শিক্ষকের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন। ছবিটিতে দেখানো হয় দুটি পার্ট। একটি হলো, পলের সেনাবাহিনীতে যোগদানের আগের অবস্থা এবং যুদ্ধ অবস্থা, অন্যটি যুদ্ধ ফেরত পলের মানসিক এবং দৈহিক অবস্থা।
সেনাবাহিনিতে যোগদানের পূর্বে পল ছিলেন সৃজনশীল, সংবেদনশীল, দয়াশীল। সবকিছুতে তার প্রচুর উৎসাহ আর উদ্দীপনা। কিন্তু যুদ্ধ তাকে বদলে দেয়। সে তার পরিবার সম্পর্কে উদাসীন হয়ে পড়ে। যুদ্ধে যাওয়ার আগে সে কবিতা লিখতো। কিন্তু পরে…না আর বলবো না! যারা দেখেননি তাদের আকর্ষণ নষ্ট করতে চাই না। শুধু বলব সিনেমাটি দেখুন। এটা নিশ্চিত আপনাকে হতাশ করবে না। এরকম সিনেমা খুব কমই তৈরী হয়েছে চলচ্চিত্রের ইতিহাসে।
অসাধারণ এই সিনেমাটি অস্কার জিতে নেয়। কিন্তু বিখ্যাত এই চলচ্চিত্রটি জার্মানি ও অস্ট্রিয়ায় দীর্ঘ ১২ বছর নিষিদ্ধ সিনেমা ছিলো। হিটলারের সময়ে এই ছবি কেউ দেখেছে্ন, এমন খবর যদি প্রশাসনের কানে যেত, তাহলে প্রচুর হেনস্তা করা হত। এমনকি এই সিনেমা দেখার জন্য জেলেও যেতে হয়েছে অনেককে। ভাবা যায়!
জানা যায়, হিটলার বাহিনী নাকি সে সময়ে রেমার্কের প্রায় সব বই পুড়িয়ে ফেলেছিলো। ইতিহাসে এ এক কালো অধ্যায় বলা যায়।
৩। এবার যে ছবির কথা বলব, তা ১৯৮৫ সালে নির্মিত একটি ব্যবসা সফল সিনেমা। এটি পরিচালনা করেছেন রবার্ট জেমেরিকস এবং প্রযোজনা স্টিভেন স্পিলবার্গ। এর IMDb রেটিং ৮.৫ ।
এই সিনেমার নাম ব্যাক টু দ্যা ফিউচার। এটি একটি কমেডিধর্মী বিজ্ঞান কল্পকাহিনীমূলক চলচ্চিত্র। মূল ব্যাক টু দ্য ফিউচার নির্মাণের পর আরও দুইটি সিকুয়েল নির্মিত হয় যাদের নাম যথাক্রমে ব্যাক টু দ্য ফিউচার ২ (১৯৮৯) ও ব্যাক টু দ্য ফিউচার ৩ (১৯৯০)। এটি একটি ত্রয়ি সিনেমা।
২০০২ সালের ১৭ ডিসেম্বর ইউনিভার্সাল স্টুডিওস ব্যাক টু দ্য ফিউচার ত্রয়ী নিয়ে প্রথম ডিভিডি এবং ভিএইচএস প্রকাশ করে। সেই সময়ে এই চলচ্চিত্রটি হলিউডের ইতিহাসে সর্বোচ্চ আয় করে। টাইম ট্রাভেলের উপরে নির্মিত চমৎকার এই সিনেমাটি নিষিদ্ধ করে চীন সরকার। বিশ্বের নিষিদ্ধ সিনেমাগুলোর মধ্যে এটি কেনো নিষিদ্ধ হলো? তাহলে শুনুন.. ।
এটাও বেশ হাস্যকর কারণে চীনা কতৃপক্ষ নিষিদ্ধ করে। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, সিনেমায় অনেকটা সিনে ভবিষ্যতে যাওয়া হয়েছে। যা নাকি চীনা সরকারের নিয়ম-বিরুদ্ধ। আবার এরকম অভিযোগও আনা হয় যে, সিনেমাটি নাকি কুসংস্কারের ইন্ধন দিয়েছে। তাছাড়া সিনেমার এক দৃশ্যে বলা হয়েছে, বেইজিংয়ের থেকেও ভালো থাকার জায়গা রয়েছে, যা সরকার বিরোধী। বুঝুন তাহলে অবস্থা!
৪। আপনি কি সাহসী ? যদি হয়ে থাকেন তাহলে এবার যে সিনেমাটির কথা বলব, তা দেখতে পারেন। কিন্তু যদি আপনার হার্ট দুর্বল হয়ে থাকে, রক্ত দেখলে আপনি যদি ভয় পান, তাহলে এটি আপনার না দেখাই ভালো।
একটি ক্যানিবালিজম সিনেমা। প্রচুর রক্তারক্তি এবং অনেক এডাল্ট চিত্রায়ণে ভরপুর এই চলচ্চিত্রটি। নাম ক্যানিবাল হলোকাস্ট। অনেকে হয়তো বুঝে গেছেন কেনো এই দীর্ঘ ভূমিকার অবতারণা। ১৯৮০ সালে ইতালীয় এই বিখ্যাত ছবিটি নির্মিত হয়।
ছবিটি পরিচালনা করেছেন রুজিরো দিওদাতো। এ ছবিটিতে আমেরিকান এবং ইতালিয়ান অভিনেতা, অভিনেত্রীদের সঙ্গে উপজাতিরাও অভিনয় করেছেন। কিন্তু আসল কথাটি এখনো বলা হয়নি। এই সিনেমাটি প্রায় ৪০টির অধিক দেশে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়।
কেন এত দেশে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয় তাই ভাবছেন তো? না ভেবে দেখতে শুরু করুন না! শরীর চাঙ্গা হয়ে উঠবে, এটুকু অন্তত বলতে পারি।
৫। সিনেমা পাগল অধিকাংশের প্রিয় পরিচালকের তালিকায় স্ট্যানলি কুবরিকের নামটি হরহামেশা পাওয়া যায়। ফিয়ার অ্যান্ড ডিজায়ার (১৯৫৩) দিয়ে যার যাত্রা শুরু। কিন্তু আজ আমি এই সিনেমাটি নিয়ে কথা বলছি না।
আমি যার কথা বলতে চাচ্ছি, তা দীর্ঘ ২৭ বছর ধরে গ্রেট ব্রিটেনে নিষিদ্ধ ছিলো! হ্যাঁ, আমি বলছি স্ট্যানলি কুবরিকের আ ক্লকওয়ার্ক অরেঞ্জ (ইংরেজি ভাষায়: A Clockwork Orange) সিনেমার কথা।
এটি ১৯৭১ সালে ডিসেম্বরে মুক্তি পায়। চলচ্চিত্রটি IMDb রেটিং ৮.৩। মূলত অ্যান্থনি বার্জেসের ব্যঙ্গরসাত্মক একটি উপন্যাসের চলচ্চিত্র সংস্করণ।
ছবির কাহিনী কিছুটা এরকম অ্যালেক্স ডিলার্জ (ম্যালকম ম্যাকডাওয়েল) ভবিষ্যৎ ইংল্যান্ডের এক শহরে একটি ছোট কিশোর গ্যাংয়ের প্রধান। গ্যাংয়ের সদস্য অ্যালেক্সসহ চার জন। তারা স্কুলে যায় না। সারাদিন ঘুমায়। বিকেল হলেই বেরিয়ে পরে।
স্থানীয় করোভা মিল্ক বার-এ একত্রিত হয়। সন্ধ্যা হলেই যতসব অপকর্ম শুরু করে। রাস্তাঘাটে লোকজনকে ধরে পিটানো, নির্মমভাবে ধর্ষণ, চুরি, ডাকাতি কিছুই বাদ যায় না। রগরগে এবং উত্তেজনায় ভরপুর এই ছবিটি আপনাকে হতাশ করবে না। আসলে মারামারি, কাটাকাটি, রগরগে ধর্ষণের দৃশ্য থাকায় এই সিনেমা ব্রিটেনে দীর্ঘদিন নিষিদ্ধ ছিলো। তবে আমেরিকায় এই সিনেমা ব্যাপক জয়প্রিয়তা পায় এবং ব্যবসা সফল হয়।
সিনেমা জগতটা থেকে কেউ যদি ভালো কিছু শিখে থাকে তবে জীবনের সাথে মিলিয়ে অনেক কিছুই শেখা সম্ভব। তবে, অবশ্যই ভালো দিকটা গ্রহণ করে খারাপ দিকগুলো বর্জন করতে হবে। তাহলে আর দেরী কেনো! বসে পড়ুন আর উপভোগ করুন সময়ের সেরা পাঁচ নিষিদ্ধ চলচ্চিত্র নিয়ে!
Leave a Reply