খুম সাম্রাজ্যের রানি বলা বলা হয় আমিয়াখুমকে! আমার চোখে তা অপরুপা! একটি অনলাইন পেজে যেদিন প্রথম এর ছবি দেখলাম সেদিনই পাগল হয়ে গিয়েছিলাম তাকে দেখার জন্য! তবে সময় আর সুযোগ হয়ে উঠছিলো না।
২৭শে সেপ্টম্বর ২০১৮ তারিখে হুট করে একদিনের সিদ্ধান্তে নিজেকে গুছিয়ে নিলাম বান্দরবান ভ্রমণের জন্য! মোহের জায়গা বান্দরবান!পরদিন সকালে আঁকাবাঁকা রাস্তায় চলছে চান্দের গাড়ি আর আমি অবাক হয়ে পাহাড়ের রুপ দেখছি! পুরো পাহাড়ি জনপথের সৌন্দর্যে নতুন রুপ এসেছে আজ, নতুন করে প্রকৃতি মেলে ধরেছে নিজেকে। বর্ষাকালে এই পাহাড়ি জনপথের রূপ-মাধুর্য্য অন্যরকম হয়ে যায়।
তার সাথে পাহাড়ে পাহাড়ে মেঘেদের খেলা নিজেকে হারিয়ে ফেলার নেশাটাকে আরও বাড়িয়ে দেয়! যখন থানচি গিয়ে পৌছলাম তখন বাজে সকাল ১০:৩০। পুরো ৩ ঘণ্টা লেগেছে বান্দরবান থেকে থানচি আসতে! সকল নিয়ম নির্দেশনা মেনে নৌকা করে চলে এলাম পদ্মঝিরি। ততক্ষণে দুপুর ১২:১৫, প্রচণ্ড খিদায় সবার বেহাল অবস্থা!
তাই ট্রেকিং শুরুর কিছু দূর গিয়ে ঝিরির পাশে সবাই খাবার নিয়ে বসে পরলাম। পাশে বয়ে চলছে মৃদু পানির শব্দে পদ্মঝিরি! এরকমবন্য পরিবেশে খাওয়ার অনুভুতিই আলাদা। কেমন যেন আদিম আদিম একটা অনুভূতি,যার কাছে ৫তারার হোটেলও হার মেনে যাবে!
সময় নষ্ট না করে একটা ছোট পাথরের উপর হাটু পর্যন্ত পা চুবিয়ে বেশ মজা করে দুপুরের খাবার সেরে আমরা থুইসা পাড়ার দিকে যাত্রা শুরু করলাম।
বান্দরবান ভ্রমণের যাত্রা হলো শুরু
ঝিরিপথের শেষ পাহাড়ি পথ শুরু! পাহাড়ের আতংক জোঁক, তবে তারাই পথের সঙ্গি। এর মাঝে এগিয়ে চলছি আমরা ১২জন। দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমে এলে যে যার মত টর্চ বের করে নিলাম!
পাহাড়ের পথে সন্ধ্যা একটু ভয়ঙ্কর, পা পিছলে গেলে একদম খাদে আবার দ্রুত না এগোলে পৌছাতে পৌছাতে রাত হয়ে যাবে। সঙ্গ ছাড়া হলে আছে হারিয়ে যাবার ভয়!
তবু পাহাড়ের সৌন্দর্য আর মায়া ভয়গুলো কাটিয়ে তুলতে সাহায্য করে! ঝিঝিপোকাসহ নাম না জানা আরও কত পোকার ডাক যে শোনা যায়!পাহাড়ি স্তব্ধতার মাঝে হাঁটছি! থুইসা পাড়ার প্রায় কাছাকাছি এলে আমরা আর একটি ঝিরি পাই, সেখানে বেশ বড় কাঁকড়া ও চিংড়ি পাওয়া যায়!
হাটার মাঝেই ব্যাগে করে কিছু চিংড়ি আর কাঁকড়া নিয়ে নিলাম আমরা! যখন থুইসা পাড়া এসে পৌছলাম তখন রাত ৮:৩০ বেজে গেছে! পাহাড়ের পাড়াগুলো দারুন হয়! পাহাড়ি মানুষগুলো অনেক সহজ সরল! ছোট বাচ্চাগুলো পুতুলের মত দেখতে! তাদের প্রতি অন্যরকম সম্মান আর ভালবাসা কাজ করে মনে!
বান্দরবানের পাহাড়ি জীবন
তবে পাহাড়ি পরিবেশে নিজেকে খাপ খাওয়ানোটাএকটু কঠিন! এখানকার জীবন দেখতে যতটা সহজ মনে হয় আসলে ততটা সহজ নয়। কঠোর সংগ্রামের জীবন পাহাড়ি জনপথের জীবন।
পানির অভাব এখানে প্রচণ্ড। পাহাড়ি জনগোষ্ঠী সাধারণত ঝিরি আর ঝর্ণা থেকে পানি সংগ্রহ করে এবং আমাদের ব্যবহারের জন্য তা জমিয়ে রাখে।
ফ্রেশ হয়ে খাওয়া শেষে আমরা সবাই একটা ঘরে আড্ডা দিতে বসলাম। আমরা বিভিন্নজন “ট্যুর গ্রুপ বিডি” এর আয়োজনে এসেছি। প্রায় সবার সবারই অপরিচিত। যদিও পুরো রাস্তায় অনেক কথা হয়ে গেছে তারপরেও ঘটা করে এবার পরিচয় পর্ব চলতে থাকে।
তিনাপ সাইতার ঝর্ণা, বান্দরবানের এক অপার্থিব সৌন্দর্য | পড়তে ক্লিক করুন
নিজের সম্পর্কে এবং যতটুকু এসেছি তা নিয়ে গল্প চলছে, তাঁর সাথে হালকা গানের আসর। আহা, জীবন সুন্দর। সবাই ক্লান্ত তাই গানের আসর ভাঙ্গতে সময় লাগলো না। যে যার মত নিজের ঘরে চলে গেলাম। রূপসী খুম সম্রাজ্যকে দেখার স্বপ্ন চোখে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম!
সকালের থুইসা পাড়া
পাড়া গুলোর রাতে এক রুপ আবার সকালে আর এক রুপ! বেশ শান্ত, ঠান্ডা পরিবেশ এবং সবুজে ঘেরা। একটু হেঁটে চোখ জুড়িয়ে নেওয়া যেন নৈতিক দায়িত্ব! যদিও গত দিনের সাড়ে আট ঘণ্টার ট্রেকিং এ শরীরের বিভিন্ন স্থানে ব্যথা শুরু হয়ে গেছে তবুও প্রকৃতির মায়া বড়ই অদ্ভূত!
আমাদের মত আরও অনেক গ্রুপ এসেছে আমিয়াখুমের উদ্দেশ্যে থুইসা পাড়ায়! আমরা সকালের নাস্তা শেষ করে আমিয়াখুমের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম সকাল ৭:৫০ এর দিকে!
এ পথের আতঙ্কের নাম দেবতা পাহাড়। কিছুদিন আগে ধসে পড়া এ পাহাড় আজ পিচ্ছিল। আজ আকাশ মেঘলা, ঝিরঝির বৃষ্টি হচ্ছে কিছুক্ষণ পরপর!
দেবতা পাহাড়টি বেশ খাড়া একটি পাহাড়। জানতে পারলাম অনেক আগে এখানে পাহাড়িরা দেবতা দেখতে পেত বলে তারা এর নাম দিয়েছেন দেবতা পাহাড়! আসল বর্ণনা ঐ কম সময়ে হয়ত জানা হয়নি। তবে নামটা বেশ অদ্ভুত,”দেবতা পাহাড়!”
অবশ্য প্রাচীন কালে মানুষ পাহাড় পর্বতকে পূজা করতো, দেবতা মানতো। কি জানি সেখান থেকেও নামটা হতে পারে।
প্রথমে আমাদের নামতে হবে এই পাহাড় থেকে। খুব সাবধানে, একটু পা ফসকালেই একেবারে নিচে খাদে চলে যেতে হবে। গাইড দাদা দড়ি বেধে দিয়েছেন।
সেটা ধরেই নেমে গেলাম তবে জোঁক থেকে রেহাই নেই। যদিও জোঁক থেকে বাচার জন্য আমি সাথে লবণ রেখেছি! প্রায় ২ ঘণ্টা শেষে আমরা ভেলাখুমে পোঁছালাম!
ভেলাখুম না আমিয়াখুম জলপ্রপাত
একটু সামনে গেলেই খুমের রানি আমিয়াখুম তাই লোভ সামলাতে না পেরে ভেলাখুমে আগে না গিয়ে এগিয়ে গেলাম আমিয়াখুমের দিকে! পাহাড়িদের ভাষায় খুম হল বড় খাল, যেখানে পানি এসে জমে থাকে।
প্রথম দেখা ও কাছে আসা! অপরুপ তার রুপ! দেখেই চোখ জুড়ে গেল! সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টি এত সুন্দর হয় তা কাছে না গেলে বোঝা যেত না! স্বর্গীয় রুপ তার! চারদিকে উচু উচু পাহাড়, সবুজে ঘেরা, মিষ্টি গন্ধে মাখা আমিয়াখুম জলপ্রপাত!
মনে চায় এই অপরুপার কান জুড়ানো শব্দ জীবনভর শুনি! খুম রাজ্যের রানী এই আমিয়াখুম! এ সাম্রাজ্য যেন পুরোটাই তার দখলে।
অনেক দিনের ইচ্ছে থাকায় সাথে শাড়ি নিয়ে এসেছি! জিন্স টিশার্টের উপর পেঁচিয়ে কিছু ছবি তুলে নিলাম সময়টাকে স্মৃতিময় করে রাখার জন্য!
আজ খুম রানী বেশ উত্তাল। আকাশে বৃষ্টি হচ্ছে! তবে তার দানবিক রুপ দেখতে পাওয়াই আসল দেখা! সব মিলিয়ে আমার স্বপ্ন পূরণ হলো। মনে একটাই আনন্দ “দেখেছি আমি দেখেছি তারে, অপরুপ তার রুপের রাজ্য”।
এদিকে গাইড দাদারা প্রাকৃতিক চুলোয় খিচুড়ি রান্না বসিয়েছেন। এই সময়ে লাইফ জ্যাকেট পড়ে আমরা কয়েকজন আমিয়াখুমের পানিতে ভিজে নিলাম! এরপর খাওয়াদাওয়া শেষ করে ফেরার পালা!
পাহাড়ি এলাকার একটা অন্যরকম আকর্ষণ আছে, মনে হয় সারাটা জীবন এখানে থেকে যাই। মিশে যাই প্রকৃতির এই জনশূন্য অরণ্যে। কিন্তু উপায় নেই, ফিরতে হবে!
আবার থুইসা পাড়ায়
ভেলাখুমে ঘুরে আবার দেবতা পাহাড়ে যখন উঠে আসছি তখন রাস্তার অবস্থা আরও খারাপ হয়ে গেছে। পাহাড় বেয়ে উপরে উঠা মোটেও সুখকর নয়।
বৃষ্টি পড়ছে সমান তালে। পুরো রাস্তা পিচ্ছিল তাঁর উপরে আগের মানুষ হেঁটে যাওয়ায় পা বেশি স্লিপ করছে! তবে কষ্টের মাঝেও মজা করাই পাহাড়ের বোনাস ভালোবাসা! ফেরার পথে কিছু জায়গা যেখানে হাটা যাচ্ছিল না সেখানে স্লাইড করেছি আমরা! এসব অদ্ভূত ভাললাগা আর ভালবাসার নামই পাহাড়!
যখন থুইসা পাড়ায় ফিরে এসেছি তখন বিকেল ৫:৩০।
ঝিরির পানিতে ফ্রেশ হয়ে একটু বিশ্রাম সেরে আবার আমাদের গল্পের আসর বসলো এবং সূর্য আস্তে আস্তে তার আভা ছড়ানো বন্ধ করে সন্ধ্যা থেকে রাত নেমে এল জোছনাময় থুইসা পাড়ায়!
বিরিশিরি সুসং দূর্গাপুর, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক অনন্য নিদর্শন | পড়তে ক্লিক করুন
এবার ফেরার পালা আমাদের!
একটু সকালে রওনা দিতে হবে আজ। কারন পথে আরেক খুম দর্শন করব আমরা! তাই ব্যাগ গুছিয়ে নাস্তা করে রওনা দিতে দিতে সকাল ৬:৩০ । থুইসা পাড়ার পাশে বেশ বড় পেয়ারা বাগান, অনুমতি নিয়ে কিছু পেয়ারা নিয়ে নিলাম! পাহাড়ের ফল তুলনামূলকভাবে সমতলের চেয়ে সুস্বাদু হয়।
এবার ভিন্ন রাস্তা আমাদের! পথে পড়ল জিন্না পাড়া! বেশ গোছালো এবং ছিমছাম পাড়া। এদিকটায় পাহাড় অল্প এবং সাঙ্গু নদীর পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া যায় তাই এবার কষ্ট তুলনামূলক কম!
তবে এদিকের রুপ অসম্ভব সুন্দর। উচু পাহাড়, পাশে নদী, সচ্ছ পানি, সবুজ ঘাস কি যে অপরুপ ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব না! পৃথিবীর বুকে বেঁচে থাকার আশা বাড়িয়ে দেয় এ রুপ! মন বলে এইতো জীবন।
নাফাখুম জলপ্রপাত
৬ ঘণ্টার হাঁটাপথ শেষ করে অবশেষে নাফাখুম! শুনেছি এখানে আগে এক প্রকার মাছ প্রচুর পাওয়া যেত যা নাফা নামে পরিচিত। তাই এর নাম নাফাখুম বলা হয়ে থাকে। আমিয়াখুমের মতই অনেকটা দেখতে এই জলপ্রপাতটি!
যেহেতু পানির গভীরতা অনেক তাই লাইফ জ্যাকেট পরে লাফ দিয়েছি নাফখুমের পানিতে! এখানে এসে ঐ লাফ না দিলে অসমাপ্তই থেকে যেত আমার খুমরাজ্যের ভ্রমনটি! সবাই যে যার মত ইচ্ছে পূরণ করে আবার হাঁটা শুরু আমাদের!
হাঁটাপথের শেষ। চলে এসেছি রেমাক্রি ফলসে। প্রায় ৩ ঘণ্টা সময় লেগেছে আমাদের! ঢেউয়ে ঢেউয়ে বয়ে যাওয়া রেমাক্রি ফলস! অনেক পিচ্ছিল হলেও হেটে ভেতরের দিকটায় যাওয়া যায়! শরীর এলিয়ে শুয়ে/বসে থাকতে বেশ লাগে!
রেমাক্রি থেকে আসতে হবে নৌকায়। গাইডের নির্দেশনায় সবাই লাইফ জ্যাকেট পরে নিয়ে নৌকায় বসলাম। এ এক অন্যরকম আমেজ।
নিচে পাথর অনেক তাই মাঝির দক্ষতায় সাবধানে নৌকা এগোচ্ছে থানচির পথে। হঠাৎজোরেসরে বৃষ্টি নামলো।পথে পড়ল বড় পাথর জায়গাটি,বেশ বড় বড় পাথর আছে সেখানে!এবং অবশেষে বিকেল ৪ টায় চলে এলাম থানচিতে। ফিরে এলাম নেটওয়ার্কের দুনিয়ায়।
আবার যান্ত্রিক শহরে ফিরে আসা
বান্দরবান এসে যখন পৌছলাম আমরা তখন রাত। খাওয়া দাওয়া সেরে রাতের বাসে করে ফিরছি পাহাড় থেকে শহরে, চোখে নতুন কোনও পাহাড় দেখার স্বপ্ন নিয়ে।
বি.দ্র: সকলের প্রতি অনুরোধ, ঘুরতে গিয়ে অপচনশীল দ্রব্য, বিশেষ করে চকলেট-চিপস্-বিস্কুটের প্যাকেট বা পানির বোতল যেখানে সেখানে ফেলবেন না এবং পাহাড়িদের সাথে খারাপ আচরণ করবেন না।
আপনার ভ্রমণ সুন্দর হোক।
Leave a Reply