এ.পি.জে. আবদুল কালাম। পুরো নাম আবুল পাকির জয়িনুল-আবেদিন আব্দুল কালাম। ভারতের একাদশতম এই রাষ্ট্রপতি ১৯৩১ সালের ১৫ই অক্টোবর ভারতের তামিলনাড়ু রাজ্যের রামেশ্বরমে জন্মগ্রহণ করেন।
এরোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে মাদ্রাজ ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজি (এম আই টি) থেকে পড়াশোনা শেষ করে প্রায় চার দশকেরও বেশি সময় কর্মরত ছিলেন মহাকাশ বিষয়ক বিভিন্ন সংস্থায়। ভারতের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ও মহাকাশযানবাহী রকেট উন্নয়নের কাজে তাঁর অবদানের জন্য তাঁকে ‘ভারতের ক্ষেপণাস্ত্র মানব’ বা ‘মিসাইল ম্যান অফ ইন্ডিয়া’ বলা হয়। ১৯৯৮ সালে পোখরান-২ পরমাণু বোমা পরীক্ষায় তিনি প্রধান সাংগঠনিক, প্রযুক্তিগত ও রাজনৈতিক ভূমিকা পালন করেন। এটি ছিল ১৯৭৪ সালে স্মাইলিং বুদ্ধ নামে পরিচিত প্রথম পরমাণু বোমা পরীক্ষার পর দ্বিতীয় পরমাণু বোমা পরীক্ষা।
নৌকামালিক বাবার দরিদ্র সংসারে অল্প বয়স থেকেই পরিবারের ভরণপোষণের জন্য তিনি সংবাদপত্রে লেখালিখি শুরু করেন। সাধারণ মানের ছাত্র হয়েও ঘন্টার পর ঘন্টা অধ্যাবসায়ের মাধ্যমে তিনি শিক্ষাজীবনে সফলতার চরম শিখরে পৌঁছে যান।
আজ অভিযাত্রীর পক্ষ থেকে থাকছে তার জীবনকাহিনী থেকে বলা অনুপ্রেরণার গল্পের বাংলা অনুবাদ।
এ.পি.জে. আবদুল কালামের অনুপ্রেরণামূলক বক্তব্য
যখন আমি অন্যের জন্যে কোন কিছু করতে পারি তখন আমি অনেক আনন্দ পাই। আপনিও এটা চেষ্টা করে দেখতে পারেন। এটা হতে পারে কোন জ্ঞান, কিংবা টাকা পয়সা। যাই-ই হোক, আপনি কাউকে দিয়ে খুশি করে আনন্দ পেতে পারেন। অন্যের সুখে এভাবে আপনি আনন্দ পেতে পারেন। একইসাথে এর মধ্যে দিয়ে সৃষ্টিকর্তা আপনাকে আত্মার পবিত্রতা দিবে। আত্মার পবিত্রতা হলো আমাদের চরিত্রের এক ধরণের সৌন্দর্য। চারিত্রিক এই সৌন্দর্য আপনার ঘরের ভেতর একটা মনোরম পরিবেশ তৈরী করবে। ঘরের মনোরম পরিবেশ আবার জাতিগত পরিবেশ নিশ্চিত করবে। এভাবে চলতে চলতে পুরো পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠা হবে।
তাহলে, পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠা কোথায় থেকে শুরু হচ্ছে? আমাদের আত্মার পবিত্রতা, পরিশুদ্ধতা থেকে।
লিডারশীপ নিয়ে এ.পি.জে. আবদুল কালাম যা বলেছেন
এবার দেশের উন্নতি আর লিডারশিপ নিয়ে একটি ঘটনা বলি।
১৯৭৯ সালের স্যাটেলাইট লঞ্চ নিয়ে একটি ঘটনা আমার মনে আছে। আমি প্রজেক্ট ডিরেক্টর ছিলাম। প্রজেক্ট ডিরেক্টর হিসেবে পুরো মিশন পরিচালনার দায়িত্ব আমার উপরে ছিলো। এই মিশনে আমার লক্ষ্য ছিলো, স্যাটেলাইটকে কক্ষপথে সফলভাবে প্রেরণ করা। এই প্রজেক্টে হাজার মানুষ দশ বছর ধরে কাজ করেছে।
আমি লঞ্চ প্যাডে পৌছালাম। কাউন্টডাউন শুরু হয়ে গেছে। ধীরে ধীরে সময় গড়াতে গড়াতে ৪০ সেকেন্ডে এসে হুট করে কম্পিউটারে একটি এরর মেসেজ দেখা দিলো। কম্পিউটার বলল, Don’t launch it. আমার পেছনে ছয়জন এক্সাপার্ট ছিলো। তারাও একই জিনিস দেখল। কম্পিউটার আমাদের বলল, স্যাটেলাইটের কন্ট্রোল সিস্টেমে একটি ছিদ্র রয়েছে। কিন্তু সাথে সাথে আমরা একটি হিসেব করে দেখলাম, আমাদের স্যাটেলাইটটিকে পাঠাতে পর্যাপ্ত জ্বালানী ও অক্সাইড রয়েছে। তাই আমরা সামনে এগিয়ে গেলাম। সবাই এ সিদ্ধান্তে আমার সাথে একমত হয়েছিলো। কিন্তু যেহেতু আমি নিজে প্রজেক্ট ডিরেক্টর তাই বাজে কিছু ঘটলে তার দোষ আমার উপরই বর্তাবে। আমি কম্পিউটারকে বাইপাস করে রকেট লঞ্চ করলাম।
এইটা ছিলো চার স্টেজের রকেট। দ্বিতীয় স্টেজে যেতেই এটি ঘোরা শুরু করল। ফলে অরবিটালে পৌছানো বাদ দিয়ে এটি বঙ্গোপসাগরে পড়ে গেল।
সফলতা ও ব্যর্থতা নিয়ে যা বলেছেন এ.পি.জে. আবদুল কালাম
এটা ছিলো ১৯৭৯ সালের কথা। আমি আমার জীবনে প্রথম ব্যর্থতাকে দেখলাম। সফলতাকে নেওয়া আমি শিখে গিয়েছিলাম। কিন্তু ব্যর্থতাকে প্রথম দেখলাম। সেই সময়ের প্রখ্যাত নেতা সতীশ ধাওয়ান আমার কাছে এলেন। তিনি বললেন তিনি একটি প্রেস কনফারেন্স করবেন এই বিষয়ে। আমি খুব ভয় পেলাম। কারণ আমি ছিলাম প্রজেক্ট ম্যানেজার। আর এত এত দেশি-বিদেশী মানুষের সামনে নিজের এমন ব্যর্থতা কিভাবে ঢাকবো- চিন্তায় পড়ে গেলাম।
কিন্তু প্রেস কনফারেন্সে এসে তিনি নিজেই বললেন, আমরা ব্যর্থ হয়েছি। কিন্তু এই ব্যর্থতাটাই আমাদের সকল টেকনিশিয়ান, সাইনটিস্টদের জন্যে সফলতা। কারণ তাঁরা পরের বছর আবার চেষ্টা করবে এবং সফল হবে।
ঠিক তখনই মিডিয়া তাকে পেয়ে বসল। মিডিয়া তাকে প্রশ্ন করলো, এত কোটি কোটি টাকার প্রজেক্ট বঙ্গোপসাগরে পড়ল আর তাঁরা কিছুই করবে না?? কিন্তু তবুও তিনি সব সহ্য করলেন। এমনকি আমাকেও কিছু বলতে দিলেন না।
ব্যর্থতা থেকে যা শিক্ষা- এ.পি.জে. আবদুল কালাম
আমাদের শুধু সফলতা হ্যান্ডেল করতে শিখলেই হবে না, ব্যর্থতাকেও হ্যান্ডেল করা শিখতে হবে। আপনি আসলে একটি ম্যানেজমেন্ট পরিবেশে আছেন। আমি এই কথাটি তরুণদের সবসময় বলি। কারণ আপনি পৃথিবীতে যে কাজই করতে যান না কেন, আপনাকে সমস্যার সম্মুখীন হতেই হবে। আর কোন প্রজেক্টের ক্যাপ্টেন মানে আপনি প্রবলেমেরও ক্যাপ্টেন। তাই প্রবলেমকে পরাজিত করেই আপনাকে সফল হতে হবে।
ব্যর্থতা থেকে সফলতা
পরের বছর জুলাই ১৮, ১৯৮০ সালে আমরা সফল হলাম। তখন মি. ধাওয়ান আমাকে বললেন, তুমি যাও এবং প্রেস কনফারেন্স পরিচালনা করো। এখান থেকে আমি বুঝলাম, ব্যর্থ হলে লিডারের সেই দায় নিতে হয় বা নেওয়া উচিৎ। কিন্তু সফলতার জন্যে প্রশংসা পুরো টিমকে দিতে হয়।
কীভাবে সফল হওয়া যায়?
এ.পি.জে. আবদুল কালাম বললেন, একবার একটি অনুষ্ঠানে ক্লাস ফোরের একটি মেয়ে আমাকে প্রশ্ন করে বসে, “আপনি কিভাবে মহৎ হয়েছেন?”
তারপর আমি তাকে প্রশ্ন করাতে জানতে পারি সে একটি সঙ্গীতশিল্পী হতে চায়। তখন আমি তাকে চারটি কথা বললাম,
এক, আমার একটি স্বপ্ন থাকতে হবে।
দুই, সেই স্বপ্ন পূরণের জন্যে জ্ঞান অর্জন করতে হবে। জ্ঞান অর্জনের পথ থামানো যাবে না।
তিন, আমাকে সমস্যা দেখে ভয় পাওয়া চলবে না।
আর সবশেষে আমাকে প্রচুর অধ্যাবসায় করতে হবে।
প্রতিভা এবং দক্ষতা কি?
আসলে এক্সিলেন্স ব্যাপারটা কোন এক্সিডেন্ট নয়। এটি একটি প্রক্রিয়া। নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়ার একটি ক্ষুধা দিয়ে এই প্রক্রিয়া শুরু হয়। প্রত্যেকের কাজের একটা স্ট্যান্ডার্ড থাকে। তাঁরা তাদের স্বপ্নকে ফোকাস রেখে কাজ করে, ঝুঁকি নেয়, তাদের সঙ্গীদের কথা আশাহত হয় না। এভাবে তাঁরা তাদের লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যায়। তাঁরা তাদের প্রতিভাকে কাজে লাগিয়ে তাদের পারফরমেন্সকে এক্সিলেন্ট করে। তাদের কোন প্রতিযোগী নেই। কিন্তু তাঁরা নিজেই তাদের প্রতিযোগী। আর এটা একটা লাইফ সাইকেল। এভাবে এক্সিলেন্সের লাইফ সাইকেল চলতে থাকে।
লেখাটা ভিডিও আকারে দেখতে চাইলে
আমি কেন একজন শিক্ষক হিসেবে পরিচয় দিতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি
একটি ইন্টারভিউতে আমাকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিলো, আমি প্রেসিডেন্ট-অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার-লেখক পরিচয় বাদ দিয়ে কেন একজন শিক্ষক হিসেবে পরিচয় দিতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি।
এ.পি.জে. আবদুল কালাম বলেন, আমি উত্তরে ইন্টারভিউয়ারকে বলেছিলাম, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আমি দশ বছরের বালক এবং আমি ক্লাস ফাইভে। আমার একজন শিক্ষক ছিলেন। তিনি একদিন ক্লাসে এসে জ্ঞানের বিচরণ ও জীবনের পবিত্রতা নিয়ে কথা বলছিলেন। তিনি যেভাবে বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলছিলেন, তা আমার সামনে জীবনের একটি শেপ, একটি স্বপ্নকে দাঁড় করিয়ে দেয়।
কেবল একজন শিক্ষকেরই এমন সুবর্ণ সুযোগ রয়েছে। তিনি তার ছাত্রছাত্রীদের মনের উৎকর্ষতা বাড়াতে পারেন, তিনি তাদের স্বপ্নের লালন পালন শেখাতে পারেন। এরফলে তাঁরা একজন সত্যিকারের মানুষ হতে পারবে, সফল হতে পারবে। এমনকি তাঁরা শিক্ষকের চেয়েও বড় হতে পারেন। শুধু একজন স্কুল নয়, আমার মত একজন প্রফেসরও এটা করতে পারেন। কারণ তিনি অনেক তরুণ গবেষকদের সাথে কাজ করার সুযোগ পান। আর তাঁরা যখন পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন এটা অনেক গর্বের।
কিন্তু কারো সফল হতে কি প্রয়োজন?
তাকে সব সীমাবদ্ধতাকে পেছনে ফেলতে হবে।
ইতিহাস বলছে, যারা অসম্ভবকে চিন্তা করতে পারে তাঁরা মানুষের সকল সীমাবদ্ধতাকে ভেঙে ফেলে। শিক্ষা, চিকিৎসা, আর্ট, টেকনোলজি সব বিষয়েই যারা পৃথিবীতে নিজেদের নাম স্মরণীয় করে গিয়েছেন তাঁরা সবাই অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন। তাঁরা তাদের সীমাবদ্ধতাকে ভেঙে পুরো পৃথিবীকে বদলে দিয়েছেন। যেমনঃ নিউটন, আইনস্টাইন, চন্দ্রশেখর। তাঁরা সবাই তাদের কল্পনাতে অবাস্তবকে বাস্তব করেছেন। আপনি যদি উদ্ভাবনের স্বাদ পেতে চান তাহলে আপনাকে উদ্ভাবকদের চরিত্রকে ধারণ করতে হবে। উদ্ভাবন আসে একটি সৃষ্টিশীল মানসিকতা থেকে যা প্রতিনিয়ত কাজ করে এবং উদ্ভাবনের ফলাফল নিয়ে ভাবেন। যেমনঃ একজন টেলিফোন নিয়ে ভাবলে তিনি টেলিফোনের আবিষ্কারের ফলাফল নিয়েও ভাবেন। তাদের এই শক্তিটার কারণে পৃথিবীর সব শক্তি তাদের হয়ে কাজ করে এবং তাঁরা উদ্ভাবন করেন নতুন কিছু।
কমেন্ট করে জানান কেমন লেগেছে-
এ.পি.জে. আবদুল কালামের অনুপ্রেরণামূলক বক্তব্য
আগামীতে আপনি কার সম্পর্কে ভিডিও অথবা লেখা পড়তে চান সেটাও এই কমেন্ট সেকশনে জানান।
আরও পড়ুন:
Leave a Reply