প্রতি এক মাস পর পর একটি নির্দিষ্ট সময়ে হরমোনের প্রভাবে পরিণত মেয়েদের জরায়ু চক্রাকারে যে পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যায় এবং রক্ত এবং জরায়ু নিঃসৃত অংশ যৌনি পথে বের হয়ে আসে তাকে ঋতুচক্র বলে। পিরিয়ড চলাকালীন সময়ে পেটে ব্যথা, বমি বমি ভাব, পিঠে ব্যথা ইত্যাদি হতে পারে। আর যাদের এই মাসিক নিয়মিত হয় না অথবা দুই মাস পর পর হয় আবার কখনো কখনো চার মাস পর পর হয় তখন তাকে অনিয়মিত মাসিক বলে। অনিয়মিত মাসিকে নারীদের বিভিন্ন সমস্যা হতে পারে। পিরিয়ড নারীদের জন্য একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। এই আর্টিক্যাল থেকে জানব, পিরিয়ডের ব্যথা কমানোর উপায় হিসেবে কি পন্থা অবলম্বন করা যায় সে সম্পর্কে।
প্রতিমাসে এই পিরিয়ড নারীদের গর্ভধারণের জন্য প্রস্তুত করে তোলে। তবে এই পিরিয়ডের সময় কোমর ব্যাথা, পেটে ব্যথা, মাথা ব্যথা, হাত জ্বালাপোড়া, বমি বমি ভাব সহ বিভিন্ন সমস্যা হতে পারে। অধিকাংশ নারীদেরই পিরিয়ডের সময় ব্যাথা হয়। অনেকের ব্যথা কম হয় আবার অনেকের অসহ্যনীয় পর্যায়ে চলে যায়। তবে তা খুব সহজেই ঘরোয়া উপায়ে দূর করা যায়। এখন আমরা জানব, ঘরোয়া উপায়ের পাশাপাশি পিরিয়ডের ব্যথা কমানোর ঔষধ গুলো কিভাবে কাজ করে:
পিরিয়ডের ব্যথা হওয়ার কারণ
প্রজননের সাথে সম্পর্কিত হরমোন গুলোর মাত্রা একটি নির্দিষ্ট সময়ে কমে যাওয়ার কারণে মাসিক শুরু হয়। এই হরমোন গুলোর প্রভাবে জরায়ুর ভেতরে আস্তরনটি খসে পিরিয়ডের রক্তের সাথে বের হয়ে যায়। আস্তরণটি ঠিক ভাবে বের দেওয়ার জন্য জরায়ুর দেয়াল জোরালো ভাবে সংকুচিত হয়ে থাকে।
এমন সংকোচনের ফলে জরায়ুর গায়ে থাকা রক্তনালীগুলোও সংকুচিত হয়। এর কারণে সাময়িকভাবে জড়ায়ুতে রক্ত অক্সিজেন সরবরাহ বন্ধ থাকে। আর অক্সিজেনের অভাবের কারণে যারাই থেকে রাসায়নিক পদার্থ নিঃসৃত হয়। এসব পদার্থের প্রভাবের কারণেই পিরিয়ডের ব্যাথা শুরু হয়। এসব রাসায়নিক পদার্থ মিশ্রিত হওয়ার পাশাপাশি মেয়েদের শরীর থেকেও প্রোস্টাগ্ল্যানডিন নামক এক ধরনের রাসায়নিক নিঃসৃত হয়। এই রাসায়নিক জরায়ুর দেয়ালের সংকোচন আরো জোরালো করে তোলে ব্যথার তীব্রতা আরও বেড়ে যায়।
পিরিয়ডের ব্যথা কোথায় হয়
পিরিয়ডের ব্যথা সাধারণত পেট কামড়ানোর মতো ব্যথা। এই ব্যথা কোমরে এবং উরুতে ছড়িয়ে যেতে পারে। কখনো কখনো পেটে ব্যথা কিছুক্ষণ পর পর প্রচন্ডভাবে কামড়ে ধরে, আবার চলে যায়। এইভাবে আসা-যাওয়া করে ও অন্যান্য সময়ে একটানা হালকা ব্যথা হয়।
এই রকম ব্যথা কোন কোন মাসে হয়, আবার কোন কোন মাসে একবারে হয় না। আবার দেখা যায় অন্য কোন মাসে অনেক ব্যথা হতে পারে। আবার কখনো মাসিক চলাকালীন সময় বাইরে ও তলপেটে ব্যথা হতে পারে।
মাসিকের সময় পেট ব্যথার কারণ ও মাসিক হলে পেটে ব্যথার সমাধান
বিভিন্ন রোগের কারণে পিরিয়ডের ব্যথা হতে পারে। তবে এসব কারণে পিরিয়ডের ব্যথা তুলনামূলকভাবে কম হয়। যেসব রোগের কারণে পিরিয়ডের ব্যথা হয় সেগুলো হচ্ছে:
১) এন্ডোমেট্টিয়োসিস: এই রোগের কারণে জরায়ুর বাইরে ও ভিতরে আস্তরনের মত টিস্যু তৈরি হয়। আর মাসিকের সময় জরায়ুর বাইরে প্রতিস্থাপিত হওয়া এসব টিস্যু খসে যায়। এর জন্যই এ সময়ে তীব্র ব্যথা হতে পারে। পাশাপাশি রক্তক্ষরণও হতে পারে।
২)ফাইব্রেয়েড: এটা হচ্ছে জরায়ুর পেশি স্তর থেকে বেড়ে ওঠা এক ধরনের টিউমার। এটি টিউমার গুলো জরায়ুর ভেতরে অথবা চারিদিকে সৃষ্টি হয়। এর কারণে মাসিকের সময় পেটে ব্যথা ও অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের সমস্যা হতে পারে। তবে এসব টিউমার ক্যান্সারের রূপ নেয় না।
৩) পেলভিক ইনফ্ল্যামেটরি ডিজিজ: এটি হচ্ছে স্ত্রী প্রজননতন্ত্রের একটি রোগ। এই রোগের কারণে ডিম্বোনালি, জরায়ু ও ডিম্বাশয় ব্যাকটেরিয়া দ্বারা ইনফেকশন হয়। যার কারণে এসব অঙ্গের জ্বালাপোড়া ও প্রদাহ সৃষ্টি হয়।
৪) এডনোমায়োসিস: এই রোগের কারণে জরায়ুর ভেতরে আস্তরনের মত টিস্যু বা কোষ জরায়ুর দেয়ালেও বেড়ে উঠতে থাকে। মাসিকের সময় এসব কোষ থেকে রক্তক্ষরণ হয়। আর এই রক্ত কোন ভাবেই বাইরে বের হতে পারে না। ফলে মাসিকের সময় প্রচন্ড পেটে ব্যথা হয়। পেটে ব্যথার পাশাপাশি রক্তক্ষরণও হতে পারে।
ঘরোয়াভাবে পিরিয়ডের ব্যথা কমানোর উপায়
অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পিরিয়ডের ব্যথা তেমন তীব্র বা জটিল রূপ ধারণ করে না। এর জন্য বাড়িতে চিকিৎসা করেই এর সমাধান করা যায়। ঔষধ না খেয়ে বাড়িতে চিকিৎসা করে এর সমাধান করা ভালো। তাহলে চলুন জেনে নিই পিরিয়ডের ব্যথা কমানোর উপায় গুলো, মেয়েদের তলপেটে ব্যথা কমানোর উপায়:
১) গরম সেঁক নিন: পিরিয়ডের ব্যথা কমানোর জন্য ঔষধ এর চেয়ে গরম সেঁক বেশি কার্যকর। এটি প্যারাসিটামল এর চেয়ে বেশি কার্যকর ও আইবোপ্রোফেনের সমান কার্যকর। সেই সাথে এর সবচেয়ে বড় সুবিধা হচ্ছে এতে কোন পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া নেই।
নিয়ম, হট ওয়াটার ব্যাগ যেকোনো মোটা কাপড় বা তোয়ালে দিয়ে মুড়িয়ে পেটের উপর রাখতে পারেন। হট ওয়াটার ব্যাগ ব্যবহারে সবসময় সাবধান থাকুন।
‘সহনীয় তাপমাত্রা পানি ব্যবহার করুন।
‘ভালোভাবে মুখ আটকিয়ে নিন।
‘নির্দিষ্ট সময় পরপর ব্যাগ উল্টেপাল্টে দিন।
২) আদা: আদা পিরিয়ডের ব্যথা কমানোর জন্য বেশ কার্যকর। যারা নিয়মিত পিরিয়ডের ব্যথায় ভুগছেন তারা পিরিয়ড শুরু হওয়ার আগে থেকেই আদা খাওয়া শুরু করে দিতে পারেন। আদা কুচি কুচি করে লবণ দিয়ে এমনি খেতে পারেন। অথবা চাইলে গরম পানি বা চায়ের সাথে খেতে পারেন। পিরিয়ডের প্রথম তিন থেকে চার দিন তিন বেলা এভাবে আদা কুচি খাবেন।
৩) ব্যায়াম করুন: নিয়মিত ব্যায়াম করলে অথবা শরীর সচল রাখলে পিরিয়ডের ব্যথা অনেক কমে যায়। এইজন্য সপ্তাহে ৩-৪দিন ৪০ মিনিট থেকে ১ ঘন্টা নিয়মিত শরীরচর্চা করুন। ভারী ব্যায়াম করা কষ্টকর হলে, হাটা, সাঁতার কাটা, সাইকেল চালানো বা ইয়োগার মতো হালকা ব্যায়াম বেছে নিতে পারেন। পিরিয়ডের সময় ব্যথার কারণে ব্যায়াম করতে ইচ্ছে না হলে হাঁটা চলার মত হালকা ব্যায়াম করুন।
৪) তলপেটে ম্যাসাজ করুন: তলপেটে এবং এর চারপাশে হালকা ম্যাসাজ করলে পিরিয়ডের ব্যথা কমতে থাকে।
৫) রিলাক্স করুন: সবসময় মানসিক ভাবে চাপমুক্ত থাকার চেষ্টা করুন। যোগ ব্যায়াম ও মেডিটেশন, মাথাব্যথা ও অস্থিরতার অনুভূতি থেকে মনোযোগ সরিয়ে নিতে পারে।
৬) কুসুম গরম পানি দিয়ে গোসল করুন: কুসুম গরম পানি দিয়ে গোসল করলে পিরিয়ডের ব্যথা কমে যায়। এটি আপনাকে রিলাক্স হতেও সাহায্য করবে।
৭) শ্বাস ব্যায়াম করুন: শ্বাসের ব্যায়াম পিরিয়ডের ব্যথা কমানোর একটি ভালো উপায়।
নিয়ম,
‘বুকের ওপরে ডান হাত আর পেটের ওপরে বাম হাত রাখুন।
‘নাক দিয়ে বড় শ্বাস নিন, এমন ভাবে শ্বাস নিন যাতে বাতাস বুকের গভীরে ঢুকে এবং পেট ফুলে ওঠে। এভাবে শ্বাস নেওয়ার ফলে পেটের উপরের হাতটি উপরে উঠে আসবে।
‘এরপর মুখ দিয়ে খুব আস্তে আস্তে নিশ্বাস ছাড়ুন।
৮)অ্যালোভেরার রস: অ্যালোভেরার রস ও মধু একসাথে মিশিয়ে একটি জুস তৈরি করুন। পিরিয়ডের ব্যথার সময় এটা পান করুন। দিনে দুই থেকে তিনবার পান করলে অনেকখানি ব্যথা কমিয়ে দিবে।
৯) পেঁপে: পেঁপে পিরিয়ডের ব্যথা দূর করার জন্য বেশ কার্যকর। পিরিয়ডের সময়ে কাঁচা পেঁপে খান। ব্যথা অনেক কমে যাবে।
১০) ল্যাভেন্ডার অয়েল: পিরিয়ডের ব্যথা হলে পেটে কয়েক ফোটা লেভেন্ডার অয়েল দিয়ে মালিশ করুন। দেখবেন ১০ থেকে ১৫ মিনিটের মধ্যে ব্যথা কমে যাবে।
পিরিয়ডের ব্যথা কমানোর ঔষধ
বাজারে পিরিয়ডের ব্যথা কমানোর জন্য বেশ কিছু ঔষুধ পাওয়া যায়। সাধারণত এসব ঔষুধ খেলে ব্যথা কমে যায়। তবে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত। চলুন ঔষুধগুলো সম্পর্কে জেনে নিই:
আইবুপ্রোফেন ও অ্যাসপিরিন: আইবুপ্রোফেন পিরিয়ডের ব্যথা কমাতে বেশি কার্যকর। প্রোস্টাগ্ল্যান্ডিন নামক যে কেমিক্যালের কারণে পিরিয়ডের ব্যথা হয় আইবুপ্রোফেন এই কেমিক্যাল কে থামিয়ে দেয়, যার কারণে ব্যথা কমে যায়। এই ঔষুধ সেবনের ২০ থেকে ৩০ মিনিটের মধ্যে ব্যথা কমে যায়।
আইবুপ্রোফেন ৪০০ মিলিগ্রাম দিনে ৩ থেকে ৪ টা খেতে হবে। সাধারণত ছয় ঘন্টা পরপর এই ঔষুধ খেতে হয়। বয়স ১২ বছরের বেশি হলেই এই ঔষুধ খেতে পারবে তাছাড়া নয়। আইবুপ্রোফেন ভরা পেটে সেবন করতে হবে, তা না হলে পেটে সমস্যা হতে পারে। সাধারণত পিরিয়ডের ব্যথার জন্য এই ঔষধ এক থেকে দুই দিনের বেশি খাওয়ার দরকার হয় না।
পিরিয়ডের ব্যথা কমানোর জন্য এটা বেশ কার্যকর। তবে কিছু ক্ষেত্রে এ ঔষুধ সেবন করা থেকে বিরত থাকতে হবে। যেমন,
- ‘অ্যাজমা হাঁপানি রোগী হলে।
- ‘লিভার, কিডনি, পাকস্থলী ও হার্টের সমস্যা থাকলে।
- ‘পেটে গ্যাসটিক অথবা আলসারের সমস্যা থাকলে।
আইবুপ্রোফেনের পরিবর্তে এনএসএআইডি গ্রুপের অন্য একটি ঔষধ অ্যাসপিরিনও সেবন করতে পারেন। এটাও ভরা পেটে সেবন করতে হবে। তবে এক্ষেত্রে খেয়াল রাখতে হবে বয়স ১৬ বছরের কম যাতে না হয়।
অনেক সময় এসব ঔষধ সেবনের পাশাপাশি গ্যাস্ট্রিকের ঔষধ সেবনের পরামর্শ দেওয়া হয়। এ ক্ষেত্রে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
প্যারাসিটামল: বয়স ১২ বছরের বেশি যাদের তারা ৫০০ থেকে ১০০০ মিলিগ্রাম প্যারাসিটামল খেতে পারবেন।
৫০০ মিলিগ্রাম ট্যাবলেট ৪ থেকে ৬ ঘন্টা পর পর একটা অথবা দুইটা সেবন করতে পারেন। তবে ২৪ ঘন্টায় ৮ টার বেশি সেবন করা উচিত নয়।
অনেক সময় শুধু প্যারাসিটামল কাজ করে না, সে ক্ষেত্রে আইবুপ্রোফেন ও প্যারাসিটামল দুইটা একসাথে খেতে পারেন।
সবশেষে, পিরিয়ড নারীদের গর্ভধারণের জন্য প্রস্তুত করে। প্রায় সব মেয়েদের এই পিরিয়ডের ব্যথা হয়, এটা স্বাভাবিক। এর জন্য ভীত না হয়ে ঘরোয়াভাবে পিরিয়ডের ব্যথা কমানোর উপায় গুলো ফলো করলেই খুব সহজেই এই ব্যথা থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে। মাসিকের ব্যথা কমানোর ঔষধ খাওয়ার আগে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ গ্রহণ করবেন এবং এই ব্যথা অস্বাভাবিক পর্যায়ে চলে গেলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। আর পিরিয়ডের সময় সঠিকভাবে হাইজেন মেইনটেইন করুন।
Leave a Reply