জ্লাতান ইব্রাহিমোভিচ নামটি শুনলেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে রাগি এবং রগচটা এক ফুটবলারের কথা। যাকে সুইডিশ ফুটবলের দেবতা বলা হয়। একবার ছোট বেলায় স্কুলের এক ‘পাঁচ বছর পর আমি কি করবো’ বিষয়ক রচনায় তিনি লিখেছিলেন, “ আমি ইতালিতে পেশাদার ফুটবল খেলবো, আমার প্রচুর অর্থ থাকবে আর অনেক বিত্তশালী হবো, সাগর পাড়ে একটি বাড়ি কিনবো”। এর পাঁচ বছর পর তিনি ঠিকি পেশাদারি ফুটবলার হিসেবে খেলা শুরু করেন কিন্তু নেদারল্যান্ডের একটি ক্লাবের হয়ে।
তাঁর স্বপ্ন পূরণ হয় আরো তিন বছর পর। তিনি ইতালিতে পাড়ি জমান আর নাম লিখান জুভেন্টাস ক্লাবে। এর পর বিভিন্ন দেশের বড় বড় ক্লাবে খেলেছেন আর তাঁর প্রতিভা দিয়ে মুগ্ধ করেছেন দর্শকদের। জলাতানের জীবনটাও সোনার চামচ মুখে দিয়ে হয়নি। শৈশবে করতে হয়েছিলো অনেক স্ট্রাগেল। এই কষ্টটুকুই তাকে এনে দিয়েছিলে তাঁর সাফল্য। আজ অভিযাত্রীর পাতায় থাকবে তাঁর জীবনের গল্প।
ইব্রাহিমোভিচের পরিচয়
জ্লাতান ১৯৮১ সালে ৩ অক্টোবর সুইডেনের মালমোতে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর বাবা ছিলেন বসনিয়ান একজন মুসলিম এবং মা ক্রোয়েশিয়ান ক্যাথলিক বংশোদ্ভূত। জ্লাতানের বাবা এবং মায়ের সম্পর্ক খুব একটা ভালো ছিলো না। ফলে দুই বছর বয়সেই বাবা-মায়ের বিবাহ বিচ্ছেদের সাক্ষী হতে হয় তাঁকে। সেখান থেকেই কঠিন এক শৈশবের শুরু হয় তার।
প্রথমে ছোট্ট জ্লাতান মা আর সৎ বাবার সাথে ছিলেন। কিন্তু কিছুদিন পরেই তার বাবা তাকে নিজের কাছে নিয়ে যান। তার বাবা একটি গুদামঘরে চাকরি করতেন, সারাদিন কাজে ব্যস্ত থাকার কারণে তার বাবা তার কোন যত্ন নিতে পারতেন না। তাই নিজের প্রতি যত্নটুকু নিজেকেই নিতে হতো ইব্রাকে। এইসব প্রভাবেই ইব্রা একরোখা ও রগচটা চরিত্রের মানুষ হিসেবেই বেড়ে উঠেন।
যখন বাবার কাছে চলে আসেন তার বাবার নজর নজর এড়ায়নি সন্তানের ফুটবল প্রীতির বিষয়টি। মাত্র চার বছর বয়স থেকে ফুটবলের প্রতি তাঁর ভালেবাসা তৈরি হয় । যখন তার বয়স আট বছর তখন তার বাবা তাকে এক জোড়া বুট উপহার দেন। ফুটবলের প্রতি তার ভালোবাসা তখন আরো বেড়ে যায়। ছেলেকে নামকরা ফুটবলার বানাতে চেয়েছিলেন সে কারণে তার বাবা চেষ্টা করতেন ছেলেকে শৃঙ্খলার মধ্যে রেখে বড় করতে কিন্তু ছোটবেলা থেকে জ্লাতানের শৃঙ্খলাবদ্ধতা একদম ছিল না।
স্কুলের মধ্যে গুন্ডা টাইপের ছেলে ছিলেন তিনি। কিন্তু ছোট বেলা থেকেই তিনি বাজে সঙ্গ এবং নেশায় আশক্ত হয়ে পড়েছিলেন। যার ফলে নানা অপকর্মও জড়িয়ে পড়েছিলেন। তাঁর সম্পর্কে স্কুলের প্রধান শিক্ষক একবার বলেন,” আমার স্কুলের পাঁচ জন গাধা ছাত্রের মধ্যে জ্লাতান ছিলেন একজন।” কিন্তু ছাত্র হিসেবে গাধা হলেও তাঁর ফুটবল প্রতিভা ছিল অসামান্য যে কারণে তিনি তার ফুটবলের প্রতিভা দিয়ে বিশ্ব জয় করেছেন।
জ্লাতান এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “একটা সময় মদ আর নেশা ছিলো আমার জীবন। আমি সেটা থেকে মুক্ত হতে পেরে আনন্দিত। আর যাদের বাবা নেই তাদের জন্য তিনি উপদেশ দিয়ে বলেছেন, “নিজের উপর বিশ্বাস রাখো তবে একদিন সফল হবেই। সুযোগ সবসময়ই আছে, সবকিছু তোমার উপরেই নির্ভর করবে।“
জ্লাতানের ফুটবল খেলার যাত্রা
তাঁর ক্লাব ফুটবল শুরু করেন নিজের শহরের মালমো ক্লাবে। ১৯৯৬ সালে তিনি মালমো ক্লাবের জুনিয়র দলের হয়ে খেলা শুরু করেন এবং ১৯৯৯ সালে তিনি একই ক্লাবের সিনিয়র দলের হয়ে সুইডেনের পেশাদার ফুটবল লীগে খেলেন। সেই মৌসুমে তাঁর দল লীগে রেলিগেশনের শিকার হয় এবং দ্বিতীয় বিভাগে নেমে যায়। কিন্তু পরের বছর তাঁর অসাধারণ ফুটবল নৈপুণ্যের কারনে দ্বিতীয় বিভাগ থেকে প্রথম বিভাগে উঠে আসে। তখনই তার উপর নজর পড়ে ইংলিশ ক্লাব আর্সেনাল দলের।
জ্লাতানও আর্সেনালে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিলেন কিন্তু যখন কোচ তাকে ট্রায়াল দিতে বলেন তখন তিনি আর্সেনালে যোগ দিতে অস্বীকৃতি জানান। তিনি একবার এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “আমার বয়স যখন ১৭, আর্সেন ওয়েঙ্গার তখন আমাকে আর্সেনালের সাথে ট্রায়াল দিতে বলেন। আমি না করে দেই কারণ ইব্রাহিমোভিচ কখনো অডিশন দেন না।”
কিন্তু ডাচ ক্লাব আজাক্সের নজর এড়াননি তিনি। ২০০১ সালে ৮.৭ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে তিনি ডাচ ক্লাব আজাক্স আমস্টারডামের হয়ে খেলা শুরু করেন। সেই মৌসুমে আজাক্স লীগ শিরোপা জয় করে। তার দল চ্যাম্পিয়নস লীগ খেলার সুযোগ পায়। তার দল কোয়ার্টার ফাইনালে মিলানের কাছে হেরে যাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত তিনি মোট পাঁচ গোল করেন। তিনি আজাক্সের হয়ে মোট ৭৪ ম্যাচে ৩৫টি গোল করেন।
২০০৪ সালে জ্লাতান ১৬ মিলিয়ন ইউরো ট্রান্সফার ফি তে আজাক্স থেকে জুভেন্টাসে যোগ দেন। জুভেন্টাসে তার সময়টি একদমই ভালো যায় নি, কারন তাকে বেশি সাইড ব্যাঞ্চেই থাকতে হত। পরের মৌসুমের চ্যাম্পিয়ন্স লীগে আর্সেনালের বিপক্ষে হারার পর জুভেন্টাসের ভক্তরা তাঁর উপর হতাশ হন। এরপরের দুই মৌসুমে জুভেন্টাস ক্লাব কালসিওপলি স্ক্যান্ডালের কারণে নিষিদ্ধ হয় এবং জুভেন্টাস কে দ্বিতীয় বিভাগে নামিয়ে দেওয়া হয়। পরবর্তীতে জ্লাতান জুভেন্টাস ছেড়ে ইন্টার মিলানে যোগ দেন।
২০০৬ সালে তিনি ইন্টার মিলানের সাথে ২৪.৮ মিলিয়ন ট্রান্সফার ফি তে চার বছরের জন্য চুক্তি করেন। প্রথম মৌসুমেই তিনি দলের হয়ে সর্বোচ্চ গোল করেন এবং ইন্টার মিলান সিরি’আ লীগ শিরোপা জিতে নেয়। পরের বছর তাঁর অসাধারণ ক্রীড়া নৈপুণ্যে ইন্টার টানা দ্বিতীয় বারের মত সিরি’আ চ্যাম্পিয়ন হয় এবং তিনি দলের হয়ে সর্বোচ্চ ১৭ গোল করেন।
২০০৭ সালে, ‘ইন্টারের সাথে’ ২০১৩ সাল পর্যন্ত থাকার চুক্তি করেন এবং চুক্তি অনুযায়ী তিনি বিশ্বের সবচেয়ে দামী খেলোয়ার হন। ২০০৭ সালে তিনি “সিরি’আ প্লেয়ার অব দ্য ইয়ার” এবং সিরি’আর সেরা বিদেশী খেলোয়ার হিসেবে নির্বাচিত হন। ২০০৮-০৯ মৌসুমে তিনি তাঁর অসাধারণ ক্রীড়া দক্ষতা দেখিয়ে লীগে সর্বোচ্চ গোলদাতা হন এবং ইন্টার মিলান হ্যাটট্রিক শিরোপা জয় করে।
ইন্টারমিলান থেকে তাঁকে বার্সোলোনা কিনে আনে ৪৬ মিলিয়ন ইউরো এবং স্যামুয়েল ইতো’র বিনিময়ে। জ্লাতানকে ক্যাম্প ন্যূতে রাজকীয়ভাবে স্বাগতম জানায় প্রায় ৬০ হাজার দর্শক। বার্সার সাথে তাঁর চুক্তি ছিল পাঁচ বছরের কিন্তু বার্সার সাথে পাঁচ বছরের স্থায়ীত্ব হয় নি ইব্রাহির সম্পর্ক। বার্সাতে তিনি মাত্র ১ মৌসুম কাটান। বার্সার হয়ে মোট ৪৬ ম্যাচে ২২ টি গোল করেছেন এবং আরও ১৩ টি গোলে এসিস্ট করেছিলেন। কিন্তু বার্সোলোনা কোচ পেপ গার্দিওলার সাথে সম্পর্ক খারাপ হওয়ার কারনে তিনি বার্সা ছেড়ে চলে যান।
বার্সা থেকে এসি মিলান তাকে এক বছরের জন্য ধার নেয়। ২০১০-১১ মৌসুমে ইব্রাহি এসি মিলানে তাঁর খেলা শুরু করেন। এসি মিলানের হয়ে তিনি মোট ৮৫ টি ম্যাচ খেলে ৫৬ টি গোল করেন। তিনি এসি মিলানের হয়ে একবার সিরি’আ ও ইতালিয়ান সুপার কাপের শিরোপা জিতেছেন।
২০১২ সালের ১৭ জুলাই জ্লাতান -কে ২০ মিলিয়ন ইউরো ট্রান্সফার ফি তে প্যারিস সেইন্ট জার্মেইন কিনে নেয়। তাঁর সাথে বোনাস সহ বার্ষিক ১৪ মিলিয়ন ইউরো বেতন দেওয়ার ভিত্তিতে তিন বছরের চুক্তি করে প্যারিসের ক্লাবে। এই চুক্তির ফলে মোভিচ বিশ্বের দ্বিতীয় দামী খেলোয়ার হন। তিনি প্যারিসের এই ক্লাবের হয়ে ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা সময় কাটিয়েছেন। প্যারিস সেইন্ট জার্মেইন এর হয়ে চার মৌসুমে মোট ১৮০ টি ম্যাচ খেলে ১৫৬ টি গোল করেছেন। পিএসজির হয়ে তিনি চারবার লীগ ওয়ান, তিন বার কাপ দে লা লীগ এবং দুইবার ফ্রেঞ্চ কাপ জিতেছেন।
ইব্রাহি ২০১৬-১৭ মৌসুমে পিএসজি থেকে ফ্রি ট্রানফারে নিজস্ব স্বাধীনতায় ইউনাইটেডের সাথে সাপ্তাহিক ২ লাখ ইউরো বেতনে এক বছরের জন্য চুক্তিবদ্ধ হন। তিনি যদি ভালো পারফর্ম করেন তাহলে চুক্তি বাড়ানো হবে ক্লাবের পক্ষ থেকে জানানো হয়। কিন্তু ম্যানইউ এর খুব বেশী ম্যাচ খেলা হয় নি ইনজুরির কারনে।
অধিকাংশ সময় তাকে মাঠের বাইরে থাকতে হয়েছে। ২০১৬-১৭ মৌসুমে মাত্র ২৮ ম্যাচ খেলে তিনি ১৭ গোল করেন। ২০১৭-১৮ মৌসুমে ইউনাইটেডের সাথে চুক্তির মেয়াদ এক বছর বৃদ্ধি করলেও সময় ভালো কাটেনি তার। মাত্র পাঁচ ম্যাচ খেলে কোন গোল করতে পারেন নি। মৌসুম শেষ হওয়ার আগে ইউনাইটেড ছেড়ে পাড়ি জমান যুক্তরাষ্ট্রে। ২০১৮ সালে জ্লাতান ম্যানইউ ছেড়ে মার্কিন মেজর লীগ সকারের ক্লাব লস এ্যাঞ্জেলস গ্যালাক্সির সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়েছিলেন। সেখানে তিনি ২ মৌসুম খেলে আবারও পারি জমান এসি মিলানে। তিনি ২০২০ সালে এসি মিলানের সাথে আবারও যুক্ত হন। বর্তমানে তিনি এই ক্লাবের হয়েই খেলে যাচ্ছেন।
জাতীয় দলের পারফরমেন্স
ফুটবল খেলার জন্য তিনটি দেশ কে বেছে নেওয়ার সুযোগ ছিল জ্লাতানের সামনে। কিন্তু তিনি বসনিয়া, সুইডেন ও ক্রোয়েশিয়ার মধ্যে সুইডেন-কে বেছে নেন। ২০০০-২০০১ সালের নরডিক ফুটবল চ্যাম্পিয়নশীপে আইল্যান্ডের বিপক্ষে একটি ফ্রেন্ডলি ম্যাচে সুইডেনের হয়ে তাঁর অভিষেক হয়। ২০০২ সালের বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ করেন। তিনি দুই ম্যাচ খেলার সুযোগ পান, তাও অতিরিক্ত খেলোয়াড় হিসেবে। এই টুর্নামেন্টে তিনি একটি গোল করেন।
২০০৪ – এ ইউরেতে তিনি অংশগ্রহন করেন। এই আসরে তার ইতালির বিপক্ষে একটি গোল টুর্নামেন্টের সেরা গোল হিসেবে নির্বাচিত হয়। সুইডেন কোয়ার্টার ফাইনালে নেদাল্যান্ডের বইপক্ষে হেরে বিদায় নেয়।
২০০৬ সালে নিজের অনবদ্ধ পার্ফমেন্সে দলকে বিশ্বকাপে তোলেন কিন্তু তার দল রাউন্ড অফ ১৬ এ বাদ পরে যায় নেদারল্যান্ডের কাছে।
২০০৮ সালের ইউরোতে তার দল গ্রুপ পর্ব থেকে বিদায় নেয়। ২০১০ বিশ্বকাপে তার দল সুইডেন বিশ্বকাপে কোয়ালিফাই করতে ব্যর্থ হয়।
২০১২ সালে ইউরোতে তাকে দলের অধিনায়ক করা হয়। এই আসরেও তার দল গ্রুপ পর্ব থেকে বিদায় নেয়।
২০১৪ সালেও তার দল টানা ২য় বারের মত বিশ্বকাপে কোয়ালিফাই করতে ব্যর্থ হয়। ২০১৬ তে সুইডেন মূলপর্বে উঠলেও গ্রুপের সর্বশেষ দল হসেবে বিদায় নেয়। তাই তিনি জাতীয় দল থেকে অবসরের ঘোষনা দেন। ২০২১ সালে ৫ বছর পর ৩৯ বছর বয়সে তিনি অবসর ভেঙ্গে ২০২২ বিশ্বকাপ কোয়ালিফাইয়ার স্কোয়াডে জাতীয় দলে আবারও ডাক পান। তাহলে বোঝাই যাচ্ছে তিনি খেলতে চলেছেন ২০২২ ফিফা বিশ্বকাপ।
তিনি হচ্ছেন সুইডিশ একটি ব্র্যান্ড। ২০০৩ সালে তার নিজের নাম কে ট্রেড মার্ক হিসেবে রেজিস্ট্রি করেন যার ফলে তার নাম অন্য খেলার সামগ্রী,পোষাক ও জুতায় তার অনুমতি ব্যতীত ব্যবহার করতে পারবেন না। ২০১৫ সালে তাঁর জীবনের কাহিনী নিয়ে “Becoming Zlatan” নামের একটি মুভি তৈরি করা হয়েছে। মুভিটি বিশ্বের বিভিন্ন ফিল্ম ফেস্টিভালে প্রদর্শিত হয়েছে।
আলোচনায় আমরা জেনে নিয়েছি একজন কিংবদন্তী ফুটবলারের কথা। তিনি হলেন ইব্রাহিমোভিচ, একজন সুইডিশ খেলোয়াড় এবং ইতালির স্ট্রাইকার হিসেবে শীর্ষ স্তর সেরিয়ে আ ক্লাব এসি মিলান দলের পক্ষে খেলেন।
এর পর আপনি কার জীবনী নিয়ে লেখনী পড়তে চান কমেন্ট করে জানিয়ে দিন আমাদেরকে। অভিযাত্রীর সাথেই থাকুন।
Leave a Reply