একবিংশ শতাব্দীতে ব্রাজিলিয়ান ফুটবলে যে কয়জন কিংবদন্তি ফুটবলার এসেছেন তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন তিনি। ফুটবল ইতিহাসে কিছু খেলোয়াড়কে সর্বজনস্বীকৃত বিশ্বসেরা বলা না গেলেও, খেলার মাঠে তাদের সাফল্য ও দৃষ্টিনন্দন খেলা তাদেরকে ইতিহাসের পাতায় অমর করে রাখে একজন কিংবদন্তি হিসেবেই।
আজ আমরা কথা বলবো ব্রাজিলিয়ান ইতিহাসে এমনই একজন ফুটবলারকে নিয়ে যিনি একসময় মেসি-রোনালদোকে পেছনে ফেলে একমাত্র প্লেয়ার হিসেবে মাথায় পরেছিলেন বর্ষসেরার মুকুট। বলছি ব্রাজিলিয়ান ফুটবল ইতিহাসে একজন অন্যতম মিডফিল্ডার ‘কাকা’র কথা। ফুটবলার কাকার জীবনী সম্পর্কে জানতে শেষপর্যন্ত আমাদের সাথেই থাকুন।
ফুটবলার কাকার জীবনী
কাকা ১৯৮২ সালের ২২শে এপ্রিল ব্রাজিলের ফেডারাল জেলা ‘গামার’ একটি ধনী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পুরো নাম ‘রিকার্দু ইজেকসোঁ দুসাঁন্তুস লেইচি’। তার বাবা একজন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার ও মা শিক্ষিকা ছিলেন। তাঁর দু-ভাইয়ের মধ্যে তিনি ছিলেন বড়। তাঁর ছোট ভাইও একজন ফুটবলার ছিলেন। তাঁর ভাই রিকার্ডো উচ্চারণ করতে পারতো না, তাই তাকে শুধু কাকা বলে সম্বোধন করতো। সেখান থেকেই মূলত তার নাম হয়ে যায় কাকা।
৭ বছর বয়সে কাকা স্বপরিবারে সাও পাওলো তে বসবাস শুরু করেন। সেখানকার স্কুল প্রথম তার ফুটবল প্রতিভা আবিষ্কার করে। ‘আলফাভিল’ নামের একটি যুব ক্লাব তাকে ভর্তির অফার দেয়। তিনিও অফারটি লুফে নেন এবং সেখানে তিনি একটি টুর্নামেন্ট জিতেন। তার ফুটবল প্রতিভা দেখে তখন ‘সাও পাওলো’ ফুটবল ক্লাব তাদের যুব দলে তাকে খেলার সুযোগ করে দেয়। এখান থেকেই ব্রাজিলিয়ান ফুটবলার কাকার খেলার পথচলা শুরু।
খেলার যাত্রা শুরু
মাত্র আট বছর বয়সেই রিকার্ডো কাকা সাও পাওলোতে ক্যারিয়ার শুরু করেন। পনের বছর বয়সে তিনি ক্লাবের সাথে স্বায়ীভাবে চুক্তিবদ্ধ হন এবং সাও পাওলোর যুব দলের হয়ে কোপা ডি জুভেনিল জয়ে নেতৃত্ব দেন। ১ ফেব্রুয়ারি ২০০১ এ তাঁর সাও পাওলোর মূল দলে অভিষেক হয়। তবে এই ক্লাবের হয়ে খুব বেশি কিছু অর্জন নেই কাকার। সাও পাওলোর হয়ে Torneio Rio নামের একটি টুর্নামেন্ট জেতেন কাকা, তবে সেটিও পুরোপুরি নিজের কৃতিত্বেই।
সাও পাওলোতে প্রথম মৌসুমেই ২৭ ম্যাচে ১২ গোল এবং পরের মৌসুমে ২২ ম্যাচে ১০ গোল করেন। বোটাফোগোর বিপক্ষে ফাইনালে বদলি হিসেবে মাঠে নেমে দুই মিনিটের ব্যবধানে ২টি গোল করে সাও পাওলোকে ২-১ গোলে ম্যাচ জেতান। তখনই ইউরোপের দলগুলোর তাঁর প্রতি দৃষ্টি পড়ে।
২০০৩ মৌসুমে ৮.৫ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে তাকে দলে ভিড়িয়ে নেয় এসি মিলান। ঐ মৌসুমে ৩০ ম্যাচ খেলে ১০ টি গোল করেন এবং অনেক গুরুত্বপূর্ণ এসিস্টেও ভূমিকা রাখেন। ভালো খেলার সুবাদে প্রথম মৌসুমেই তিনি ২০০৪ সালে সিরিয়া প্লেয়ার অফ দ্যা সিজন হিসেবে ঘোষিত হন এবং বালোঁ দর ও ফিফা প্লেয়ার অফ দ্যা ইয়ার হিসেবে মনোনীত হয়েছিলেন।
পরের মৌসুমে গাটুসো, সিডর্ফ, মেসিমো, রুই কস্তার সাথে মিলে একটি শক্তিশালী মিডফিল্ড গঠিত হয় এসি মিলানের। ঐ মৌসুমে মিলান চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির রানার্স-আপ হয় লিভারপুলের কাছে পেনাল্টি হেরে। ফাইনালটিকে মিরাকল অফ ইস্তাম্বুল বলা হয়। ৩-০ গোলে এগিয়ে থেকেও ম্যাচটা হারতে হয় লিভারপুলের অবিস্মরণীয় কামব্যাকে। ম্যাচটিতে কাকা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ম্যাচের প্রথম গোলটা হয় কাকার ফ্রি কিক থেকে এবং একটি এসিস্টেও করেছেন তিনি।
ঐ টুর্নামেন্টে কাকা সর্বোচ্চ ৫ টি এসিস্ট ও ২টি গোল করেন। তার এমন পার্ফোমেন্সের ভিত্তিতে আবারো বালোঁ দর ও ফিফা বেস্ট প্লেয়ার এর জন্য মনোনীত হন। তবে ২০০৫ সালে উয়েফা সেরা ক্লাব ফুটবলার হিসেবে মনোনীত হন। ২০০৬ মৌসুমে প্রথমবারের মতো হ্যাট্রিক করেন তিনি। এবারে মনোনীত হলেও জিততে পারেন নি বালোঁ দর। উয়েফা টিম অফ দ্যা ইয়ারের জন্য নির্বাচিত হন।
২০০৬-০৭ চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি তে তিনি সবচেয়ে বেশি গোল এবং দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৫ টি এসিস্ট করেন এবং মিলান চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি শিরোপা জয় করে। একটি অনলাইন পোল দ্বারা তিনি ভোডাফোন ফ্যানস প্লেয়ার অফ সিজন হিসেবে নির্বাচিত হন সাথে উয়েফা প্লেয়ার অফ সিজন হিসেবেও ঘোষিত হন। একাধারে দ্বিতীয় বারের মত উয়েফা টিম অফ দ্যা সিজন এর একজন সদস্য হন।
তিনি ২০০৭ সালে ফিফা বেস্ট প্লেয়ার এওয়ার্ড জয় করেন। ২০০৮ সালে ফিফা ক্লাব বিশ্বকাপ জয় করেন মিলানের হয়ে। সেই ম্যাচে ৩য় গোলটি তাঁর পা থেকে আসে। টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড় হিসেবে গোল্ডেন বলটিও তিনি লাভ করেন।
২০০৩-২০০৯ সাল পর্যন্ত এসি মিলানের হয়ে তিনি ১৯৩ ম্যাচে সর্বমোট ৭০ টি গোল করেন। কাকাকে এসি মিলান ছাড়তে না চাইলেও ক্লাবের অর্থনৈতিক সংকটের কারনে ক্লাব তাকে ছাড়তে বাধ্য হয়। তারপর রিয়াল মাদ্রিদ ৬৭ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে কাকাকে কিনে নেয়।
রিয়াল মাদ্রিদের কাকার ক্যারিয়ারটা খুব ভালোভাবে কাটেনি। ইনজুরি তাকে বেশ ভুগিয়েছে। প্রায়ই তাকে লম্বা সময়ের জন্য মাঠের বাইরে কাটাতে হয়েছে। রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে ১২০টি ম্যাচে মাত্র ২৯টি গোল করেন তিনি। দলের হয়ে মাত্র ১টি লা লিগা, ১টি কোপা দেল রে আর ১টি স্প্যানিশ সুপার কাপ জিততে সমর্থ হন। মাদ্রিদের প্রত্যাশা অনুযায়ী সফলতা না পাওয়ার পরে ২০১৩ সালে আবার এসি মিলানে ফিরে আসেন কাকা। তবে এবারের প্রত্যবর্তনটা আগের মতো স্মরণীয় করতে পারেননি তিনি। মাত্র একটি মৌসুম খেলে ৩৭ ম্যাচে তিনি করেন ৭টি গোল।
এর পরেই ২০১৪-১৫ মৌসুমেই কাকা চলে যান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের Major league soccer এ অরল্যান্ডো সিটি দলে। সেখানে তিনি Major league soccer এর ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি বেতনভুক্ত খেলোয়াড়ে পরিণত হন। মাঝে ১টি মৌসুম সাও পাওলোতে লোনে খেললেও অরল্যান্ডো সিটিতেই তার ক্লাব ক্যারিয়ার শেষ করেন কাকা।
রিকার্ডোর ইন্টারন্যাশনাল ক্যারিয়ার
এবার নজর দেয়া যাক তাঁর ইন্টারন্যাশনাল ক্যারিয়ারের দিকে। ব্রাজিল দলে কাকার অভিষেক হয় ২০০২ সালে বলিভিয়ার বিপক্ষে একটি প্রীতি ম্যাচে। তিনি ২০০২ বিশ্বকাপের তারকাখচিত ব্রাজিল দলেও সুযোগ পান কিন্তু কোস্টারিকার বিপক্ষে মাত্র ২৫ মিনিট খেলতে পেরেছিলেন। ২০০৫ সালের কনফেডারেশন কাপে তিনি প্রতিটি ম্যাচেই খেলার সুযোগ পান এবং ফাইনালে আর্জেন্টিনাকে ৪-১ গোলে হারানো ম্যাচে ১টি গোলও করেন। ২০০৬ বিশ্বকাপে কাকা ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে ১টি গোল করেন এবং ম্যান অব দ্য ম্যাচ হন। তবে কোয়ার্টার ফাইনালে জিদান ম্যাজিকের কাছে তাঁর দল পরাজিত হয়।
২০০৯ সালের কনফেডারেশন কাপে কাকা ব্রাজিলের ১০ নম্বর জার্সি পান। সেই টুর্নামেন্টের ফাইনালে যুক্তরাষ্ট্রেকে ৩-২ গোলে হারানো ম্যাচের ম্যান অব দ্য ম্যাচ হন কাকা এবং টুর্নামেন্টের সেরাও হন তিনি।
২০১০ বিশ্বকাপে ফুটবল খেলোয়াড়দের নামের তালিকায় কাকা আসেন সবার নজরে থাকা সেরা তিন খেলোয়াড়ের একজন হিসেবে। কিন্তু টুর্নামেন্টে সবচেয়ে বেশি অ্যাসিস্ট করার পুরস্কার পেলেও কোয়ার্টার ফাইনালে নেদারল্যান্ডের কাছে হেরে টুর্নামেন্ট থেকে ছিটকে পড়ে ব্রাজিল। বিশ্বকাপের পর কয়েকবার কাকা দলে ফিরে আসলেও ইনজুরির জন্য স্থায়ী হতে পারেননি। ২০১৬ সালে তিনি জাতীয় ফুটবল দল থেকে এবং ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে সব ধরনের প্রফেশনাল ফুটবল থেকে অবসর নেন তিনি।
ব্যক্তিগত জীবন
ব্যক্তিগত জীবনে কাকা ২০০৫ সালে তাঁর শৈশবের পছন্দ ক্যরোলাইনকে বিয়ে করেন। এই দম্পতির ঘরে ১ ছেলে ও ১ মেয়ে রয়েছে। তবে ২০১৫ সালে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাঁরা নিজেদের বিবাহ বিচ্ছেদের সংবাদ প্রকাশ করেন। কাকা বর্তমানে ব্রাজিলিয়ান মডেল ক্যারোলিনা দিয়াস এর সঙ্গে প্রণয়ে আবদ্ধ আছেন।
ফুটবলার রিকার্ডোর সবচেয়ে বড় শত্রু কে ছিল তা চোখ বন্ধ করে বলা যাবে ইনজুরি। মাত্র ১৮ বছর বয়সেই সুইমিং পুলে এক দুর্ঘটনায় স্পাইনাল ফ্র্যাকচারে কাকার প্যারালাইসিস হওয়ার সম্ভাবনা হয়েছিল। পরবর্তীতে তিনি সেখান থেকে আশ্চর্যজনকভাবে সেরে উঠলেও পুরো ক্যারিয়ারে বারবার ইনজুরির জন্যই পিছিয়ে গিয়েছেন। হয়তো বার বার ইনজুরি তে না পরলে থাকতেন তিনি বিশ্বসেরাদের কাতারে।
কাকা নিরলসভাবে খেলে গিয়েছেন, যদিও ইনজুরি তাঁর বিশ্বসেরা হওয়ার পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল । ইনজুরি, ফুটবলার কাকার জীবনী থেকে না সরলেও তিনি বর্ষসেরা হয়েছেন বিভিন্ন দলে খেলে।
কাকার অদম্য ইচ্ছা শক্তির থাকার কারণেই ফুটবল খেলে তিনি সেরা হতে পেরেছিলেন। তিনি প্রমাণ করে দিয়েছেন, আত্মবিশ্বাস থাকলে সব কিছু করা সম্ভব। এরপর আপনি কোন ফুটবলারের জীবনী নিয়ে জানতে চান সেটিও কমেন্ট করে জানাতে পারেন আমাদেরকে।
Leave a Reply