আর্নল্ড শোয়ার্জনেগার
আর্নল্ড শোয়ার্জনেগার। ১৯৪৭ সালে জন্ম নেওয়া একজন অস্ট্রিয়ান-আমেরিকান বডিবিল্ডার, অভিনেতা, মডেল, ব্যবসায়ী এবং রাজনীতিবিদ। মাত্র ২২ বছরের তিনি মিস্টার ইউনিভার্স হন।
তবে মিস্টার ইউনিভার্স হবার সাধনা শুরু করেছিলেন ১৫ বছর বয়সে। এ ছাড়াও সাত বার জিতেছেন মিস্টার অলিম্পিয়া প্রতিযোগিতায়। স্পোর্টসম্যান থেকে “কোনান”, টার্মিনেটরের মত মুভিতে লিড রোল প্লে করেছেন।
সফল এই মানুষটি রাজনীতিতেও সফল। বর্তমানে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যের ৩৮তম গভর্নর। সফল এই মানুষটির কাছে সফলতার গোপন রহস্য কি? কি কি কাঁটা নিজের গায়ে বিদ্ধ করে আজকে নিজেকে এই পর্যায়ে নিয়ে এসেছেন?
আজ অভিযাত্রীর পক্ষ হতে থাকছে এই সফল মানুষটিকে নিয়ে আলোচনা।
সফলতার মানে কি, জীবনে সফল হওয়া বলতে কি বোঝায়? চলুন তা জানা যাক আর্নল্ড শোয়ার্জনেগারের নিজের মুখ থেকে-
“মানুষ আমাকে প্রতিবার জিজ্ঞাসা করে, সফলতার গোপন রহস্য কি?
আমি তাদের মজা করে বলি, সাকসেসের শর্ট ভার্সন হলো – আপনার ২২ ইঞ্চি বাইসেপ থাকতে হবে এবং খালি হাতে প্রাণীদের হত্যা করার ক্ষমতা থাকতে হবে।
হয়ত আমার কথা আপনার কাছে অস্ট্রিয়ান অ্যাকসেন্টের মত কঠিন লাগছে। তাহলে একটু সোজা করে বলা যাক। সাকসেসের লং ভার্সন ডেফিনেশনে ৫টি নিয়ম আছে।
বডিবিল্ডিং চ্যাম্পিয়ন কিংবা অ্যাকশন হিরো হতে চাইলে এগুলোর দরকার নেই। যদি আপনি আপনার লাইফের শ্রেষ্ঠতম আসনে আসীন হতে চান তাহলেই কেবল এগুলোর দরকার হবে।
আমার প্রথম নিয়ম
আপনার ভিশন খুঁজে বের করুন এবং তাকে অনুসরণ করুন। যদি আপনার লক্ষ্য না থাকে, ভিশন না থাকে আপনি স্রোতের মধ্যে পড়ে যাবেন এবং সুখী হতে পারবেন না।
আমি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে বেড়ে উঠেছিলাম। তখন অস্ট্রিয়া জার্মানির সাথে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হেরে যায়। যার কারণে, তখন প্রচুর হতাশা আর আর্থিক সংকট আমাকে ঘিরে ধরেছিলো। আমি এগুলো থেকে বের হতে চাইতাম, পালিয়ে যেতে চাইতাম।
ভাগ্যক্রমে, একদিন স্কুলে আমি আমেরিকা নিয়ে একটি ডকুমেন্টারি দেখি। আমি তখন বুঝতে পেরেছিলাম, সেখানেই আমি বাকী জীবন কাটাতে পারব। কিন্তু প্রশ্ন হলো – আমি সেখানে কিভাবে যাবো? কিভাবে আমেরিকার দেখা পাবো?
কারণ কারো কাছে ভ্রমণের মত টাকা কিংবা অন্যকিছু ছিলো না। তখন একদিন আমি ভাগ্যবশত একটি বডিবিল্ডিং ম্যাগাজিন দেখলাম। সেটার কভারে একজন বডিবিল্ডারকে দেখলাম। সেখানে লেখা ছিলো – Mr. Universe become hercules star.
তার নাম ছিলো– রিজ পার্ক। আমি আর্টিকেলটি যত দ্রুত পারা যায় পড়ে ফেললাম এবং জানতে পারলাম তিনি ইংল্যান্ডের লিডসে কিভাবে দারিদ্রতায় বেড়ে উঠেছিলেন। আরো জানতে পারলাম, সে প্রতিদিন কিভাবে ৫ ঘন্টা খরচ করে নিজেকে প্রস্তুত করে।
এভাবে প্রস্তুত হতে হতে অবশেষে তিনি মি. ব্রিটেন হয়ে গেলেন এবং তারপর মি. ইউনিভার্স। একবার, দুইবার করে করে তিনি তিনবার এই সম্মান পেলেন। তারপর তিনি রোমে গেলেন “হারকিউলিস” মুভিতে কাজ করতে।
পড়তে পড়তে আমার ভিশন আমার কাছে ক্লিয়ার হয়ে গেল। আমি তার মত স্টেজে চ্যাম্পিয়ন হয়ে আমেরিকা গেলাম। এবং তারপর মুভিতে কাজ করতে আরম্ভ করলাম।
সেই মুহূর্তে এটি করতে আমি যতটা কঠোর পরিশ্রম কিংবা সংগ্রাম করি না কেন তা আমার কাছে কোন বিষয় ছিলো না। কারণ আমি সেসবের কারণ এবং আমার প্যাশন পেয়ে গিয়েছিলাম। তাই সবসময় আপনার ভিশনকে আবিষ্কার করুন এবং তার পরবর্তী সময়ে তা অনুসরণ করুন।
আমার দ্বিতীয় নিয়মটি হলো
কখনো ছোটখাটো কিছু চিন্তা করবেন না। আমি ভাবতাম, আমাকে তারকাদের সাথে কাজ করতে হবে। আমি শুধু মুভিতে থাকতে চাইতাম না, আমি মুভি স্টার হতে চাইতাম। আমি সব জায়গার শিরোনামে থাকতে চাইতাম।
আমি হতে চাইতাম, সবচেয়ে বেশি পারিশ্রমিকের এন্টারটেইনার। আমি আরেকজন জন ওয়েন হতে চাইতাম। তাতে কি কিছু ভুল ছিলো? তাই বড় করে ভাবুন, ক্ষুদ্র পরিসরে ভাববেন না।
তৃতীয় নিয়মটি হলো
নিন্দুকদের এড়িয়ে চলুন। আপনার যখন বড় স্বপ্ন থাকবে, ভিশন থাকবে, লক্ষ্য থাকবে তখন সাধারণভাবেই শুনবেন, “আমার মনে হয় না এটা হবে। এটা অসম্ভব”।
আমি বলছি আমার ১৫ বছর বয়সের কথা, যখন আমি বডিবিল্ডার হয়ে গিয়েছি। তখন আমি একজনকে বললাম, “আমি বডিবিল্ডিংয়ে ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়ন হতে চাই, আমি মি. ইউনিভার্স হতে চাই”।
তখন তিনি সরাসরি বললেন, “তুমি কি পাগল হয়ে গিয়েছো? বডিবিল্ডিং একটি আমেরিকান খেলা, সেটা কি ভুলে গেছো?”
তারপর আমাকে শো করে বিজনেস শুরু হলো, আমি ১৩টি বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন টাইটেল পেলাম। তারপর আমি বললাম, “আমি রিজ পার্কের মত হতে চাই, আমি হারকিউলিস হতে চাই, মুভিতে কাজ করতে চাই”।
এটা যখন আমি এজেন্ট এবং ম্যানেজারদের বলতাম, তারা হেসেই উড়িয়ে দিয়ে বলত,
“আর্নোড, এটা খুব হাস্যকর। তুমি লিডিং ম্যান হতে চাও? আচ্ছা, প্রথমে তোমার শরীর নিয়ে বলা যাক। তোমার দেহ রাক্ষস বা দৈত্যদের মত। আর তোমার উচ্চারণ, জার্মানদের মত। যার কিছুই বোঝা যায় না।
তুমি কি দেখেছো, কখনো কোন ইন্টারন্যাশনাল মুভি স্টার জার্মান ভাষায় কথা বলে? এটা হয় না। তাই ভুলে যাও। আর তোমার নামও তো কেউ উচ্চারণ করতে পারবে না”।
বয়স অনুযায়ি আপনার এখনই কি করা উচিত? জানতে ক্লিক করুন
হ্যাঁ, আমার নাম নিয়েও কটাক্ষ শুনতে হয়েছিলো আমাকে। আর এখন, শোয়ার্জনেগারের নাম উচ্চারণ দূরে থাক, এই নাম শুনলে মানুষ বাসা কিংবা সিনেমা হলে সমুদ্রের মত উপচে পড়ে। এ
খন চিন্তা করুন- যখনই আমি কোন সিদ্ধান্ত নিতে গিয়েছি সবাই বলেছে, “এটা হবে না, হতে পারেনা, এটা অসম্ভব। এর কথা ভুলে যাও”। ভাগ্যক্রমে আমি তাদের কথা শুনিনি। আমি অ্যাক্টিং ক্লাস, ইংলিশ ক্লাস, অ্যাকসেন্ট রিমুভ ক্লাস শুরু করলাম।
“কষ্ট করলে কেষ্ট মেলে”, আমি সারাদিন এই কথাটাই আওড়াতে থাকতাম। হঠাৎ করে আমি ব্রেকথ্রু পেয়ে গেলাম। টিভি শোতে ছোট ছোট পার্ট করা শুরু করলাম। তারপর পাম্পিং আয়রন, স্টে হাঙরি এবং তারপর কোনান দ্যা বাবেরিয়ানে আমি বড় একটা রোল পেলাম।
কোনানের মাধ্যমে আমি বড় একটা ব্রেকথ্রু পেলাম। এখানে একটি চমৎকার বিষয় হলো– কোনানের ডিরেক্টর প্রেস কনফারেন্সে বললেন, “আমাদের যদি শোয়ার্জনেগারের মত একজন না থাকত, তার মত বডিবিল্ডার না থাকত, তাহলে আমরা কখনোই এটা বানাতে পারতাম না”।
এরপর যখন আমি টার্মিনেটর করলাম, জেমস ক্যামেরুন বললেন, “I Will be back তার বানানো মুভির ডায়লগগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত লাইন। কারণ আর্নোল্ডের অ্যাকসেন্টের কারণে এটা মেশিনের কন্ঠস্বরের মত লাগছিলো”। সুতরাং দেখতেই পাচ্ছেন নিন্দুকেরা যা বলেছিলো, তা শুধুমাত্র দায় সাড়া ছাড়া কিছু নয়। তাই সমালোচকদের ইগনোর করুন।
চতুর্থ নিয়মটি হলো
কঠোর পরিশ্রম করুন। আপনি কখনো হেরে যেত চান না। কারণ আপনি কঠোর পরিশ্রম করতে চান না। আপনি কোথায় কাজ করছেন এটা কোন ব্যাপার না। নো পেইন, নো গেইন।
একটা উদাহরণ দেই। আমি যখন আমেরিকায় আসি তখন আমি প্রতিদিন চার ঘন্টা অনুশীলন করতাম, একটি কনস্ট্রাকশন বিজনেস দেখাশোনা করতাম, আমি একজন রাজমিস্ত্রি ছিলাম এবং আমি কলেজেও যেতাম।
এর সাথে ছিলো প্রতিদিন রাত ৮টা থেকে ১২টা পর্যন্ত অ্যাক্টিং ক্লাস। এটা আমার প্রতিদিনের রুটিন ছিলো। তাই কাজ করুন। কোথায় আছেন সেটা ব্যাপার না। কাজে থাকুন।
আমার পঞ্চম ও শেষ নিয়ম হলো
শুধু নিয়ে যাবেন না, কিছু দিয়ে যান। যে আয়নাতে কেবল আপনি নিজেকে দেখতে পান সেই আয়না ভেঙে ফেলুন। কারণ সেই আয়নার বাইরে গিয়ে আপনি লক্ষ লক্ষ মানুষকে দেখতে পাবেন যাদের আপনার সাহায্য প্রয়োজন।
যার ফলে, আমি অন্যকে কিছু দেওয়ার প্রতিটা সুযোগ কাজে লাগাতে চেষ্টা করি। আমি স্পেশাল অলিম্পিয়ান ট্রেনিং চালু করেছি, সুবিধাবঞ্চিত ও মফস্বলের শিশুদের জন্যে আফটার-স্কুল প্রোগ্রাম চালু করেছি।
তাদেরকে মাদকসহ নানান সন্ত্রাসী কর্মকান্ডকে না বলতে শিখিয়েছি। আমার প্রতিবেশী কিংবা স্থানীয় স্কুল যেকোন কিছুকেই পরিবর্তন করতে পারি। কারণ এটা পুরোপুরি আমাদের উপর।
তাই ভিশন নিন, বড় চিন্তা করুন,
নিন্দুককে এড়িয়ে যান, কঠোর পরিশ্রম করুন,
এবং পৃথিবীকে পরিবর্তন উপহার দিন। কারণ এটা আমরা ছাড়া আর কে করবে?
Leave a Reply