বিরাট কোহলি : এক আশ্চর্য রান মেশিন
২৭৩৫ রান! এক পঞ্জিকাবর্ষে! সব ফরম্যাট মিলিয়ে। ওয়ানডেতে ১১০+ অ্যাভারেজ, টেস্টে ৫০ এর উপর। এক কথায় বলতে গেলে রান মেশিন। ১০০ এর নিচে রান যেন করতেই পারেন না, সেঞ্চুরি তাঁর কাছে শামীম চৌধুরীর ভাষ্যমতে ‘ডাল ভাত’।
বিরাট কোহলির কাছে কি এই মুহূর্তে অসম্ভব কিছু আছে? ১১টি জয় বাইরের কন্ডিশনে তাও মাত্র ২৪ টেস্টের মাথায়। পার করেছেন সৌরভের রেকর্ড। কাপ্তান হিসেবেও দারুণ সফল।
২০১৪ সালের ইংল্যান্ড সফর। পুরো সিরিজে ১৩৪ রান। এর মধ্যে সাতবার জেমস অ্যান্ডারসনের বলে আউট। অফ স্টাম্পের বাইরের বলটা যেন খেলতে পারছিলেন না তিনি। চতুর্থ স্টাম্পে দুর্বলতা থাকলে যে সেরা ব্যাটসম্যান হওয়া যায় না তা যেন চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিলন অ্যান্ডারসন।
২০১৮ সালের ইংল্যান্ড সফর। প্রথম টেস্ট। প্রথম ইনিংসে পার করলেন আগের সিরিজের সর্বমোট রানকে। খেললেন ১৪৯ রানের একটা ইনিংস। ওইদিন যেন ব্যাটিংয়ে এক অতিমানব ব্যাটিং করতে নেমেছিল।
কোনো ভুল শট নেই, চতুর্থ স্টাম্পের বল স্বভাববিরুদ্ধ লিভ। এদিনকার তাঁর এই ইনিংস যেকোনো উঠতি ক্রিকেটারের জন্য মাস্টার টিউটোরিয়াল।
বিরাট কোহলির শুরুর দিকের কথা
বিরাটের শুরুটা অনেকটা ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর মতো। ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই লাইমলাইটে, ব্যাটিং এপ্রোচ এবং মানসিকতা নিয়ে প্রচুর বিতর্ক।
শুরুর দিকে খুব ধারাবাহিক ছিলেন না তিনি। কিন্তু নিজের ক্লাস শো করতে শুরু করেন ২০১২ থেকে। পরীক্ষা বাকি ছিল।
২০১৪ সালের ইংল্যান্ড সফর ছিল বিরাট কোহলির জন্য একটি পরীক্ষা। ইংল্যান্ড কন্ডিশনে ব্যাটিং করা কতটা কঠিন এটা সবাই জানে। বিশেষ করে এশিয়ান ব্যাটসম্যানদের জন্য।
তাই কোন খেলোয়াড় কতটা ভালো, কতটা সলিড তা প্রমাণ করার জায়গা একটাই, ইংল্যান্ডে ভালো ব্যাটিং করা।
বিরাটের প্রথম ইংল্যান্ড সফর ছিলো। আশা ছিল তরুণ ব্যাটসম্যান হিসেবে নিজের ছাপ রেখে যাবেন। এরপর তো সবার জানা।
এই পরিবর্তনের রহস্য কি? কঠোর পরিশ্রম, ডেডিকেশন এবং প্রতিনিয়ত নিজেকে চ্যালেঞ্জ করা, নিজেকে নিজের চেয়ে ভালো প্রমাণ করার দৃঢ়প্রতিজ্ঞা।
তাই তো আজ সাউথ আফ্রিকার বাউন্সি কন্ডিশনে সেঞ্চুরি, ইংল্যান্ডের সুইং অনুকূল কন্ডিশনে সিরিজের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক কিংবা অস্ট্রেলিয়ার ভয়াবহ পেস আক্রমণের সামনে সেঞ্চুরি। বাকি আছে কি কোনো কিছু?
বিরাট কোহলির বেড়ে ওঠা
দিল্লির ছেলে বিরাট। বাবা প্রেম কোহলির স্বপ্ন ছিল তাঁর ছেলেকে ক্রিকেটার বানাবেন। বিরাটের মা এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, বিরাট তিন বছর বয়সেই ক্রিকেট ব্যাট তুলে নিয়েছিলেন হাতে। যেন এ ছেলের জন্মই ক্রিকেটের ‘কোহলি’ হওয়ার জন্য।
২০০৬ সালের ডিসেম্বর। রঞ্জি ট্রফির ম্যাচ কর্ণাটকের সাথে। ম্যাচের আগের দিন মৃত্যুবরণ করেন ভিরাটের বাবা। একজন ১৮ বছর বয়সী ছেলের কাছে আপনি কি আশা করবেন তখন? অবশ্যই সে দৌড়ে তাঁর পিতাকে শেষ দেখা দেখতে যাবে!
কিন্তু ভিরাট তা করেননি। সেই ১৮ বছর বয়সী ক্রিকেটার ওই ম্যাচটি খেলেন এবং ম্যাচ বাঁচানো ৯০ রান করেন। ম্যাচ শেষ হওয়ার পরপরই ভিরাট তাঁর পিতার শেষকৃত্য করতে চলে যান।
সেদিনের পর বিরাটের মধ্যে কিছুটা পরিবর্তন আসে যা তাঁর মা লক্ষ্য করেছিলেন। তিনি লক্ষ্য করেছিলেন, তাঁর ছেলে আর আগের মতো বেখেয়াল নেই, ছেলের চোখে দেখেছিলেন দায়িত্ববোধ। এক সাক্ষাৎকারে নিজের পিতার মৃত্যুকে তাঁর জীবনের মোড় ঘুরানো ঘটনা বলেছিলেন বিরাট।
বাংলাদেশে ক্রিকেটের একজন ডার্ক নাইটের গল্প – পড়তে ক্লিক করুন
তিনি বলেছিলেন, তাঁর পিতার স্বপ্ন ছিল তাঁর ছেলেকে ভারতের জার্সি পড়া অবস্থায় দেখে যাওয়া কিন্তু তাঁর পিতার হঠাৎ মৃত্যুর পর বিরাটের লক্ষ্য দাঁড়ায় যেকোনো মূল্যে ভারতীয় দলে সুযোগ পাওয়া এবং তাঁর বাবার স্বপ্ন পূরণ করা। এমন ছেলে যেন ঘরে ঘরে জন্মায়!
৯০ মিটারের বাউন্ডারিতে ছয় মারা স্যার ভিভ রিচারডস বিরাটের মধ্যে নিজেকে খুঁজে পান। ২৯ বছর বয়সেই ওয়ানডেতে ১০০০০ রানের গন্ডি পেরোনো বিরাট কোহলি তাঁর সমসাময়িকদের থেকে যোজন যোজন এগিয়ে।
একটু অন্যরকম বিরাট কোহলি
কোহলির মাঠে আচার-আচরণ নিয়ে সমস্যা আছে এমনটা শুধু অভিযোগ নয়, অনেক সত্যি। বিশেষ করে বিভিন্ন ধরনের অঙ্গভঙ্গি, কথা বার্তার কারণে তিনি সমালোচিত হয়েছেন বহুবার।
কিন্তু এ বিষয়ে তাঁকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, মাঝে মধ্যে খেলার ভেতরকার উত্তেজনা এবং জেতার আকাঙ্ক্ষার কারণে তিনি এমনটা করেন, যদিও তিনি এটা কমানোর চেষ্টা করছেন বলে দাবি করেন।
কিন্তু ভালো খেলোয়াড় যদি খানিকটা উগ্র হয় তাহলে সমস্যা কোথায়? সবাই শচীন, লারা, দ্রাবিড়দের মতো হবেন এটা কোথায় লেখা আছে?
কিছু খেলোয়াড় থাকুক না রিকি পন্টিং, বিরাট কোহলি কিংবা সাকিব আল হাসানের মতো। ক্রিকেট জেন্টেলম্যানস গেম হলেও দুই-একজন অভদ্রই তো খেলাটাকে আকর্ষণীয় করে।
সাউথ-আফ্রিকা সিরিজ হেরেছেন, ইংল্যান্ড সিরিজ হেরেছেন সেয়ানে সেয়ানে লড়াই করে কিন্তু চোখ করেছিলেন অস্ট্রেলিয়া সিরিজকে। সেঞ্চুরি মাত্র একটা পেলেও এই সিরিজে ক্যাপ্টেনসি করেছেন দারুণ যা নিয়ে সমস্যা ছিল অনেকের।
বিরাটের ক্যাপ্টেন্সিতে খুত আছে তা সাউথ আফ্রিকা, ইংল্যান্ড সিরিজের খেলাগুলো একটু লক্ষ্য করে দেখলেই বুঝতে পারবেন। দুই-একটা সেশনে চেপে ধরেননি প্রতিপক্ষকে যে কারণে সেই ম্যাচগুলো প্রতিপক্ষদের হাতে চলে গিয়েছে।
সেই তুলনায় এবারকার ভুল কম করেছেন। যদিও পার্থে চার পেসার নিয়ে নেমে ভুল করেছিলেন আবার। তবে সঠিক সময়ে সঠিক বোলার ব্যবহার করেছেন এবার।
৩০ বছর পর অস্ট্রেলিয়াকে অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে ফলো-অন করালো ভারত। অজিদের নাক এবার ভালোভাবেই কাটলেন সেনাপতি।
কতটা অসাধারণ বিরাট?
এখন হয়তো বুঝতে পারছি না! হয়তো অবসরের পর বুঝতে পারব কি খেলোয়াড়ের খেলা দেখছিলাম। টেকনিক্যালি খুতবিহীন, মানসিকভাবে ইস্পাত কঠিন, তাঁর প্রতিটা সেঞ্চুরি যেন একেকটা মাস্টারক্লাস ইনিংস!
একেকটা ফ্লিক যদি চোখের শান্তি হয়, একেক কাভার ড্রাইভের সময় ব্যাট বলের সাউন্ড যেনো মনে প্রশান্তি জুড়িয়ে দেয়। অ্যাডিলেড টেস্টের আগে এক ভিডিও ভাইরাল হয়।
বিরাটের নেট প্র্যাক্টিসের ভিডিও। প্রতিটা বল ব্যাটের সুইট স্পটে, প্রতিটা শট মেরে নিজেই বলছেন কত রান হবে ওইটা! পারফেকশন প্রতিটা শটে। এতটাও কি নিখুঁত হওয়া সম্ভব? হয়তো নামটা ভিরাট কোহলি বলেই সম্ভব।
Leave a Reply