“একজন ডার্ক নাইটের গল্প”
মনে আছে, ব্যাটম্যানের “The Dark Knight” চলচ্চিত্রের এর সেই বিখ্যাত সংলাপটি? মনে না থাকলে আরেকবার মনে করিয়ে দেই, সংলাপটি ছিলো এরকম,”Because he’s the hero Gotham deserves, but not the one it needs right now, so we’ll hunt him. Because he can take it, because he’s not a hero. He’s a silent guardian, a watchful protector, a Dark Knight.”
বাংলাদেশের কোনো খেলোয়াড়ের সাথে কি এই সংলাপটির মিল খুজে পান? না পেলে আমি বলে দিচ্ছি। আমরা মানে বাংলাদেশের দর্শকেরা মাঝেমধ্যে খুব অধৈর্য হয়ে যাই। সব খেলোয়াড় এর কাছ থেকেই সেঞ্চুরি, পাঁচ উইকেট আশা করি।
যারা প্রতিবার দলের জয়ে অবদান বেশি রাখেন শুধু তাদেরই মনে রাখি। সাকিব-তামিম কিংবা মাশরাফি, মুশফিককে নিয়ে লেখা হয় বিস্তর কিন্তু এই খেলোয়াড়টিকে নিয়ে কখনোই বিস্তর ভাবে লেখালেখি হয় না।
কিন্তু দলের বিপদের সময় বাংলাদেশের এই খেলোয়াড়টি সবসময়ই মাথা উচু করে দাঁড়ান স্রোতের বিপরীতে। সেই ব্যাটসম্যানটিকে জয়ের সময় কখনোই মনে রাখা হয় না কিন্তু এই ব্যাটসম্যান দলকে খাদের কিনারা থেকে তুলে ধরেছেন বহুবার। সেই ব্যাটসম্যানটির নাম মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ।
মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ
৪ ফ্রেবুয়ারি,১৯৮৬ সালে ময়মনসিংহের এক সাধারণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ। ২০০৪ সালে অনুষ্ঠিত হওয়া অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে বাংলাদেশ দলের সদস্য ছিলেন তিনি। তবে তিনি জাতীয় দলের হয়ে খেলতে শুরু করেন ২০০৮ সাল থেকে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে।
মাহমুদউল্লাহকে কেনো “ডার্ক নাইট” এর সাথে তুলনা করেছি,জানেন?
একটু পেছনে নিয়ে যাই আপনাদের। গত বছর ত্রিদেশীয় সিরিজের ফাইনালের কথা মনে আছে? টার্গেটটা খুব বেশি ছিল না। কিন্তু সবাই ব্যর্থ হলেন সেদিন কিন্তু একাই লড়ে গেলেন রিয়াদ। ৯২ বলে করেছিলেন ৭৬ রান।
আউট হয়ে যখন প্যাভিলিয়নে ফিরছিলেন তখন কেউ যেনো তাঁর চোখের কান্না না দেখতে পারে, এজন্য হাত দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলেছিলেন হয়তো। হয়তো তাঁর চোখে ভেসে আসছিল ২০১২ সালের সন্ধ্যা। সেবার তিনি ছিলেন নন-স্ট্রাইক এন্ডে।
শাহাদাত ব্যাটে লাগাতে পারেননি শেষ বলটা। চোখের সামনে দেখেছেন পাকিস্তানিদের উল্লাস। কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছিলেন সাকিব, মুশফিক, নাসিররা কিন্তু তিনি শান্ত ছিলেন। হয়তো ভেবেছিলেন, যদি স্ট্রাইকে আমি থাকতাম তাহলে গল্পটা হয়তো অন্যরকম হতো।
চার বলে ১২ লাগে। ওভারে একবারের বেশি বাউন্সার দিলে তা নো বল ধরা হয়। উদানা সে ওভারে এর আগেই একটি বাউন্সার দিয়ে ফেলেছিলেন। দ্বিতীয় বাউন্সারটি যখন দিলেন তখন নো দিলেন না আম্পায়ার।
মাহমুদউল্লাহ জানতে চাইলেন, কেনো নো হল না যেখানে টিভি রিপ্লেতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, মাথার উপর দিয়ে গিয়েছে বল। সাকিব তাঁর মাথা গরম করে ফেললেন। বেরিয়ে আসতে বললেন টিমকে। কিন্তু মাহমুদউল্লাহ শান্ত রইলেন। তিনি মাথা গরম করলেন না। আবারো স্ট্রাইকিং এন্ডে ফিরলেন এবং লেগে বিশাল ছক্কা মেরে শেষ করেছিলেন সেই ম্যাচ।
পড়ুন- বিপিএল তামাশা এবং দর্শকদের হতাশা !
এক নিঃসঙ্গ যোদ্ধা
রিয়াদ এক নিঃসঙ্গ যোদ্ধার নাম। দলের ভালো খেলার দিনে চোখে পড়ে না তাঁর ফিফটি কিংবা ত্রিশের উপর করা রান। কিন্তু যেদিন সবাই ব্যর্থ হোন, তখন দাঁড়িয়ে যান তিনি “Captain America”-র ঢালের মতো। একা লড়াই করেন গ্ল্যাডিয়েটরের মতো।
ক্যারিয়ারে অনেক উত্থান-পতন হয়েছে। বহুবার দল থেকে কারণে-অকারণে বাদ পড়েছেন দল থেকে।নোংরা ট্রলের শিকার হয়েছেন। মুশফিকের সাথে আত্মীয়তার কারণে অনেক মানুষই বলতেন, “ভায়রা-ভাই” কোটায় খেলে রিয়াদ। জবাবটাও দিয়েছেন রিয়াদ।
তিন হোক কিংবা ছয়, যেই পজিশনেই কোচ তাঁকে নামিয়েছেন তাঁর প্রতিদান দিয়েছেন। তাঁকে নিয়ে ধারণা ছিল, তিনি পেস বল খেলতে পারেন না। তাঁর জবাব দিয়েছেন অস্ট্রেলিয়া বিশ্বকাপে। তিনে নেমে টানা দুই ম্যাচে করেছিলেন সেঞ্চুরি। ২০১১ সালের বিশ্বকাপে ইংল্যান্ড এর বিপক্ষে শফিউলকে নিয়ে ম্যাচ জেতান বাংলাদেশকে।
৩৩ রানে ৪ উইকেট নাই। মহাকাব্যিক একটা পার্টনারশিপ করে দলকে ম্যাচ জেতান রিয়াদ-সাকিব। নিউজিল্যান্ড এর পেস বোলিং অ্যাটাকের সামনে সবুজ পিচে সেই ইনিংস কতটা কঠিন ছিল তা ক্রিকেট বিশ্লেষকরাই ভালো বলতে পারবেন। অপরাজিত থেকে ম্যাচ ফিনিশ করে বের হয়েছিলেন সেদিন মাঠ থেকে।
কাপ্তান হিসেবেও তিনি অনন্য। প্রতিবার একটি তরুণ দল নিয়ে বাঘা বাঘা প্লেয়ারদের সাথে লড়াই করেন তিনি। বিপিএল এ রিয়াদের নেতৃত্বগুন অনেক ট্যাকটিক্যাল কাপ্তানদেরও হার মানাবে।
নিদাহাস ট্রফিতে মাহমুদউল্লাহ-ই গিয়েছিলেন ক্যাপ্টেন হিসেবে। কিন্তু সাকিব মাঝে যোগ দিয়ে হয়ে যান ক্যাপ্টেন। ব্যক্তিত্বের সংঘাত কিন্তু লাগতে পারত এখানে। লাগে নাই, কারণ রিয়াদ আপাদমস্তক একজন বিনয়ী মানুষ।
সাকিব যখন বেরিয়ে আসতে বলছিলেন মাঠ থেকে,বেরিয়ে আসেননি তিনি। খেলার সিদ্ধান্তে ছিলেন অটল এবং জিতিয়েই ফিরেছিলেন ড্রেসিংরুমে।
বাংলাদেশ ক্রিকেটের একজন “সাইলেন্ট গার্ডিয়ান”
আপনি হয়তো তামিমের রিপ্লেসমেন্ট পাবেন, হয়তো মুশফিকেরও রিপ্লেসমেন্ট পাবেন। হয়তো খুজে পাবেন মাশরাফির মতো একজন উইকেট-টেকিং বোলার। কিন্তু একজন রিয়াদ কি কখনো পাবো? দলের সবার ব্যর্থতায় ঢাল হয়ে দাঁড়ানো একজন গ্ল্যাডিয়েটরের রিপ্লেসমেন্ট কখনো পাবো? আমার মনে হয় না, আমরা একজন রিয়াদ কখনো পাবো।
ক্যারিয়ারে যে পরিমাণ সমালোচনার শিকার হয়েছেন, অন্য কেউ যদি এরকম সমালোচনার শিকার হতো তাহলে তাঁর ক্যারিয়ারে অবশ্যই এর বাজে প্রভাব পড়ত কিন্তু রিয়াদ তোয়াক্কাই করেন নাই। একমনে পরিশ্রম করে গিয়েছেন। দলে জায়গা ধরে রেখেছেন।
রিয়াদ সাকিব-তামিম, মুশফিকদের মতো হিরো না। মাশরাফির মতো ক্যারিশমাটিক না। মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ বাংলাদেশ ক্রিকেটের একজন “সাইলেন্ট গার্ডিয়ান”। তিনি বাংলাদেশ ক্রিকেটের “Dark Knight”.
Leave a Reply