১০ ধরণের মানুষ থেকে দূরে থাকুন
আমি তখন সবেমাত্র ক্লাস টেনে উঠেছি। প্রথমের দিকে রেজাল্টের খারাপ হতে থাকলো। একদিন ক্লাস টিচার তার চেম্বারে ডাকলেন। পড়াশোনা মনোযোগ দেবার কথায় যাবার আগে, স্যার আমার সঙ্গ নিয়ে বলতে আরম্ভ করলেন।
তিনি আমার এক্সিস্টিং ফ্রেন্ড সার্কেল থেকে বেরিয়ে যেতে বললেন। কিন্তু শেষমেষ আমি স্যারের অবাধ্য হয়েছিলাম। ফলাফল পাই এসএসসি রেজাল্টে।
তখন বুঝতে পারি একটা মানুষের জীবনে খুব বেশি প্রভাব ফেলতে পারে তার চারপাশের মানুষ। আর তাই আমাদেরও সতর্ক হয়ে যাওয়া উচিৎ। কিন্তু বেশিরভাগ সময় এই জাজমেন্টে ভুল করে।
তবে কাজটা কিন্তু খুব কঠিন নয়। কেবল তাদের অ্যাপ্রোচের কিছু ব্যাপার খেয়াল করলে আমরা বুঝতে পারব, তাঁরা আমাদের জন্যে ক্ষতিকর নাকি সুখকর।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, ১০ ধরণের মানুষ থেকে দূরে থাকুন। কিন্তু কেনো?
জার্মানির ফেডরিক স্কিলার বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক ক্ষতিকর মানুষ এবং আমাদের জীবনে তাদের প্রভাব নিয়ে একটি গবেষণা করেছে। তাদের দীর্ঘ এই গবেষণায় দেখা গিয়েছে-
এসব মানুষ আমাদের আমাদের ব্রেইনে ম্যাসিভ স্ট্রেসের কারণ। আর এই স্ট্রেসের দীর্ঘ মেয়াদি একটা প্রভাব আছে। কখনো তা কয়েকমাস স্থায়ী, কখনো বছর, কিংবা কখনো সারাজীবনের জন্যে তা স্মৃতিশক্তিতে প্রভাব ফেলে।
এসব আপনার আমাদের ব্রেইনের হিপোক্যাম্পাসে প্রভাব ফেলে ব্রেইন সেল ড্যামেজ করে দেয়। হিপোক্যাম্পাস আমাদের বিচারক্ষমতা ও স্মৃতিতে ভূমিকা রাখে।
এ প্রভাবগুলো খুব কম সময়ের মধ্যে দেখা না গেলেও তা আপনার দৈনন্দিন পারফর্মেন্সে প্রভাব ফেলে। যেমনটা প্রভাব ফেলেছিলো, আমার এসএসসি রেজাল্টে।
এই গবেষণার পাশাপাশি, একটি কাউন্সিলিং ওয়েবসাইট প্রায় ১ মিলিয়ন মানুষের উপর গবেষণা চালায়। ৯০ শতাংশ ভালো পারফরমার তাদের স্ট্রেস কন্ট্রোল করতে পারে বলেই ভালো পারফরমেন্স করতে পারে।
আর তাদের সবার ক্ষতিকর মানুষগুলোকে দূরে রাখার একটি গিফটিং অ্যাবিলিটি ছিলো। এই জরিপে আরো বলা হয়, বেশিক্ষণ সময় ক্ষেপন করা পাঁচজন সঙ্গীর মধ্যে একজনও আপনার জন্যে ক্ষতিকর হতে পারে এবং সেই প্রভাব খুব ভালোভাবে আপনার উপর ভর করতে পারে।
এখন প্রশ্ন হলো, এমন মানুষকে চিহ্নিত করতে উপায় কি?
আবারো বলছি, কেবল তাদের অ্যাপ্রোচের কিছু ব্যাপার খেয়াল করলে আমরা বুঝতে পারব, তাঁরা আমাদের জন্যে ক্ষতিকর নাকি সুখকর, কেন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ১০ ধরণের মানুষ থেকে দূরে থাকুন।
আজ আমরা এমন ১০টি বিহ্যাভ অ্যাপ্রোচ নিয়ে কথা বলব যা আপনার সামনে সেই মানুষটি জাজমেন্ট দাঁড় করিয়ে দিবে।
আপনি কি গসিপিং করেন?
প্রথমেই আসি গসিপিংয়ের কথায়। বিখ্যাত আমেরিকান পলিটিক্যাল ফিগার এলেনর রোজভল্ট বলেন, “বিশাল মনের মানুষেরা চিন্তাভাবনা নিয়ে আলোচনা করেন। গড়পড়তা মানুষেরা ইভেন্ট নিয়ে কথা বলেন। আর ক্ষুদ্র মানসিকতার মানুষ অন্য মানুষকে নিয়ে গসিপ করেন”।
খোশগল্প প্রিয় মানুষেরা অন্যদের দুর্ভাগ্য নিয়ে আনন্দ পায়। হয়ত কিছু সময় কিছু ভুল আনন্দের হয়। কিন্তু সবসময় নয়। তাই একটা সময় পরে, এটি আপনাকে কাছে আরূচিপূর্ণ একটি বিষয় হিসেবে পরিণত হবে যা অন্যকে কষ্ট দিতে পারে।
অন্যদিকে, অন্যের সীমাবদ্ধতা নিয়ে সমালোচনা করে সময় নষ্ট না করে ভালো কিছু শিখে সময়টা আপনি কাজে লাগাতে পারেন।
বদমেজাজি মানুষ
এরপর আসি বদমেজাজি মানুষের কথায়। এসব মানুষদের নিজের ইমোশনের উপর কন্ট্রোল থাকে না। তাঁরা নিজের উপর কন্ট্রোল না রাখতে পেরে আপনার উপর নিজের সবটুকু রাগ ঝেড়ে দিবে।
তখন আপনার মনে হবে, আপনিই আসল দোষী। এসব মানুষ বদমেজাজী হবার কারণে নিজের জীবন নিয়ে অসন্তুষ্ট থাকেন। যার ফলে যার তার সাথে রাগের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে ফেলেন। তাই এদের থেকে ক্ষতির সম্ভাবনাই বেশি থাকে।
ভুক্তভোগী মানুষ
তৃতীয়ত, ভুক্তভোগী মানুষ আমাদের কাছে খুব সহজে সহানুভূতি পেয়ে যায়। ফলে আমরাও তাদের সমস্যাগুলো নিজেদের মত করে সমাধানের চেষ্টা করি।
কিন্তু এই সমস্যা যেন তাদের চিরন্তন। এর মূল কারণ তাদের দায়িত্ববোধ। একটা পুরাতন প্রবাদ আছে, “কষ্ট এড়ানো যায় না, কিন্তু কষ্ট ভোগ করা থেকে দূরে থাকা যায়”।
সুতরাং তাঁরা নিজেদের দায় এড়িয়ে আপনার কাছে আজীবন সহানুভূতি নিতে চাইবে। তাই সমস্যা সমাধানে যারা আপনাকে ব্যবহার করে তাদেরকে লিস্ট থেকে ঝেড়ে ফেলুন।
ভুক্তভোগী মানুষের সাথে খুব নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে আত্নমগ্ন মানুষের। আত্নমগ্ন মানুষেরা সবসময় নিজেদেরকে অন্যের কাছ থেকে আলাদা করে রাখে।
একাকিত্ব বা লোনলিনেস
আপনি যখন খুব একা ফিল করবেন তখনও তারা আপনাকে সঙ্গ দিবে না। এটার কারণ – তাদের সাথে অন্য কারো আদৌতে কোন সংযোগ নেই। একইসাথে আত্নসম্মানের বালাইও নেই তাদের। গবেষকরা তাই বলছেন এসব মানুষকেও দূরে রাখতে।
পরশ্রীকাতরতা
আত্নমগ্ন মানুষদের পরই এই লিস্টে এসেছেন পরশ্রীকাতর মানুষেরা। পরশ্রীকাতর মানুষের কাছে ঘাসের রঙকেও সবচেয়ে সবুজ লাগে। যার ফলে তাদের সাথে ভালো কিছু ঘটলেও তাঁরা তার মর্ম বুঝে না।
তাঁরা তাদের ভাগ্যকে পৃথিবীর বিপরীতে মনে করে। এমনকি নিজের কার্যবলে তাদের থেকে কেউ ভালো করলেও তাঁরা তা মেনে নিতে পারে না। ফলে তাদের সাথে বেশি সময়ক্ষেপণ করলে তাঁরা আপনাকে স্ব-প্রাপ্তি অস্বীকার করার ক্ষমতা ছাড়া কিছুই দিতে পারবে না।
যে ১০ টি সত্য নিজেকে জানতে সাহায্য করবে, পরিবর্তন নিয়ে আসবে আপনার চিন্তায়
ধান্দাবাজ মানুষ
ধান্দাবাজ মানুষও আপনার জন্যে ক্ষতির কারণ হতে পারে। তাঁরা বন্ধুত্বের আড়ালে আপনার সময়কে নষ্ট করবে। কারণ তাঁরা ফ্রেন্ডশিপের আড়ালে আপনার সাথে ধান্দা খুঁজে বেড়াবে।
এসব মানুষ আপনাকে খুব ভালো করে জানে। একইসাথে তাঁরা জানে আপনার পছন্দ-অপছন্দ এসব কাজে লাগিয়ে কিভাবে ফায়দা নিতে হয়।
তারা আপনাকে জয় করবে, তারপর আপনাকেই কাজে লাগাবে। তাদের সাথে সম্পর্কে শুধু দিয়ে যেতে হয়, কিন্তু প্রাপ্তির খাতা শূন্য থাকে।
নেতিবাচক ধারণা
আমরা যে গবেষণা নিয়ে কথা বলছি, এর পাশাপাশি একই বিষয় নিয়ে নটরডেম বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি গবেষণা করা হয়।
সেখানের ছাত্রদের উপর চালানো এক গবেষণায় দেখা যায়, যাদের রুমমেট নেতিবাচক ধারণার অধিকারী তাঁরা নিজেরাও একটা সময় নেতিবাচক হয়ে যায়।
অর্থাৎ কিছু মানুষ রয়েছে তাঁরা আপনাকে ভয় ব্যতীত কখনো সাহস দিতে পারবে না। জে. কে. রাউলিংয়ের হ্যারী পটার সিরিজে এদের ডেমেনটর হিসেবে বলা হয়। এসব ডেমেনটরধর্মী মানুষ অর্থাৎ যারা আপনাকে কেবল ভীত করে দেয় তাদের থেকেও দূরে থাকুন।
আত্নতৃপ্তি না অন্যকে ছোট করা
এগুলো ছাড়াও আরেক ধরণের মানুষ আছে যারা অন্যের দুঃখ দেখে নিজের ভেতর ভীষণ আত্নতৃপ্তি পায়। এরা আপনার দুঃখে হাসবে।
আপনার দুঃখকে দেখা কিংবা আপনার সুখকে বাধা দেওয়া ছাড়া তাঁরা কিছুই করতে পারে না। কিন্তু এদের ব্যাপারে একটি ভালো দিক হলো – এদের মুখোশ চিনতে সময় লাগে না। ফলে আপনি তাদের খুব কম সময়ের মধ্যেই আপনার জীবন থেকে ছেটে ফেলতে পারেন।
সবজান্তা টাইপ মানুষ
খোশগল্প প্রিয়, বদমেজাজি, ভুক্তভোগী, আত্নমগ্ন, পরশ্রীকাতর, ধান্দাবাজ, ডিমেন্টর, মুখোশধারী ছাড়াও হুট করে বিচার করা কিছু মানুষ রয়েছে। এরা অগ্রপশ্চাৎ না ভেবেই একটা কথা বলে।
তাদের ভেতরে বিচারের ক্ষমতা নেই। ফলে তারা বাছ-বিচার ছাড়াই এমন কিছু বলে ফেলে যা আপনাকে নিরুৎসাহিত করে তোলে। ফলে আপনি পিছিয়ে পড়েন।
এমনকি তাঁরা তাদের নিজের ধারণা থেকে বেরিয়েও আসতে চায় না, তাঁরা নিজেদের সঠিক মনে করে। ফলে তাদের বক্তব্য আপনাকে চরমভাবে আঘাত করতে পারে।
অহংকারী হওয়া
ক্ষতিকার এসব মানুষ আপনার ভেতরে স্ট্রেসের এক মহাসমুদ্র তৈরী করতে পারে। এই লিস্টের মানুষের আরেকটি বদ অভ্যাস হলো – অহংকারী হওয়া। অহংকারী মানুষ সবকিছুকেই পারসোনাল চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখে।
ফলে তাঁরা নিজেদের নিয়ে একটি মিথ্যা আত্নবিশ্বাসে ডুবে থাকে। ইউনিভার্সিটি অফ অ্যাকরনের একটি গবেষণায় দেখা গিয়েছে, অহংকারই কর্মক্ষেত্রে নানা সমস্যার সৃষ্টি করে।
এসব মানুষ আপনার সাথে একমত হবে না, নিজেদের ক্যারিয়ার ধ্বংস করবে এবং একজন সাধারণ মানুষের থেকেও এদের জ্ঞানের পরিসীমা কম। তাই এই ধরণের মানুষ আপনার চারপাশে বিষের মত ছড়িয়ে থাকবে।
সবশেষে বলা যায়, গবেষণার পাওয়া এসব ক্যাটাগরির মানুষ থেকে আমরা দূরে থাকলে নিজেদের ক্ষতি এড়িয়ে যেতে পারবো।
আচ্ছা, আপনি খোশগল্প প্রিয়, বদমেজাজি, ভুক্তভোগী, আত্নমগ্ন, পরশ্রীকাতর, ধান্দাবাজ, ডিমেন্টর, মুখোশধারী, অহংকারী মানুষগুলোর কখনো মুখোমুখি হয়েছেন? কমেন্ট বক্সে তা আমাদের জানিয়ে দিন।
অভিযাত্রীর পক্ষে হতে আপনার জন্য শুভ কামনা রইল।
Leave a Reply