গৌতম বুদ্ধকে নিয়ে একটি গল্প প্রচলিত আছে। আপনিও হয়ত গল্পটি শুনে থাকবেন।
একজন ব্যক্তি প্রায় প্রতিদিনই বিভিন্ন কটূ কথা বলে গৌতম বুদ্ধকে অপমান করতেন। কিন্তু গৌতম বুদ্ধ কখনোই সেই ব্যক্তির কথায় বিব্রত হতেন না। তাকে এত অপমান করার পরও তিনি পাল্টা কোনো জবাব দিতেন না।
একদিন গৌতম বুদ্ধকে জিজ্ঞাসা করা হল, লোকটির অপমানের জবাবে তিনি কেন তাকে কিছু বলেন না?
তিনি সহজভাবেই উত্তর দিলেন, যদি কেউ আপনাকে একটি উপহার দেয় আর আপনি সেটি নিতে অস্বীকার করেন, তাহলে উপহারটি কার হবে? এভাবে কেউ অপমান করলে ঠাণ্ডা মাথায় এর সমাধান করতে হবে।
অপমান কি?
আসলে অপমান করা বলতে কি বোঝায়? কাউকে অপমান করার মানে হল তার সাথে অসম্মানজনকভাবে কথা বলা বা খারাপ ব্যবহার করা।
সাধারণত অপমান করার ধরণ দুই রকমের হতে পারে।
১. সবার সামনে কাউকে মেরে অপদস্থ করা,
২. মৌখিক অপমান।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, মৌখিক অপমান কি? সরাসরি বা কথার ছলে কাউকে অপমান করাকে মৌখিক অপমান বলে। যেমন, কারো শারীরিক বা অভ্যাসগত কোনো কিছু নিয়ে মন্তব্য করা, কারো কথার বা অঙ্গভঙ্গির নকল করা ইত্যাদি।
আপনিও কি কখনো এমন পরিস্থিতির শিকার হয়েছেন? তাহলে এ বিষয়ে আমাদের ভিডিওটি দেখুন নিচে।
জীবনের পথ চলায় আপনি কখনো একই সাথে সবাইকে ভালো রাখতে পারবেন না। এটাই স্বাভাবিক। কিছু মানুষ আপনাকে পছন্দ করবে এবং কিছু মানুষ আপনাকে অপছন্দ করবে।
আর আপনাকে অপছন্দ করা মানুষ হতে পারে আপনারই আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব বা কর্মক্ষেত্রের কেউ। তারাই আপনাকে ছোট করার জন্য বিভিন্নভাবে অপমান করার চেষ্টা করে থাকেন।
আর কেউ যদি কষ্ট দেওয়ার জন্য অপমান করে থাকে এবং সেটা কেবল মজা করার জন্য না হয়, তাহলে পরিস্থিতি সত্যিই কষ্টকর ও বিব্রতকর হয়ে পড়ে।
কিন্তু আপনাকে এভাবে অপমান করলে আপনি কি করবেন?
আপনি কি তার অপমানের বিপরীতে তাকেও পাল্টা অপমান করবেন? নাকি মন খারাপ করে বসে থাকবেন? নাকি স্বাভাবিকভাবে সেখান থেকে চলে যাবেন এবং তাকে উপেক্ষা করবেন?
কেউ অপমান করলে কি করতে হবে জানা থাকলে এরকম সামাজিক পরিস্থিতি আপনিও ভালোভাবে সামলে নিতে পারবেন। পরিস্থিতি নির্ধারণ, সঠিক প্রতিক্রিয়া দেখানো এবং প্রয়োজনে অন্যের সাহায্য নেওয়া ইত্যাদি আপনাকে সাহায্য করবে অপমানিত হওয়ার ভয়কে জয় করতে।
অপমান করার কারণ
কেউ যখন আপনাকে অপমান করার চেষ্টা করে, তখন প্রথমেই মনে প্রশ্ন আসে কেন সে আপনাকে অপমান করতে চাইছে? এক্ষেত্রে ৪টি কারণ হতে পারে-
১. ইনসিকিউরিটি
বিভিন্ন কটূ কথা বলে যারা অন্যদের ছোট করার চেষ্টা করে, তারা সাধারণত নেতিবাচক চিন্তাধারার অধিকারী হয়ে থাকেন। অনেকেই আছেন যারা নিজেদের নিয়ে সবসময় ইনসিকিউরিটি তে ভোগেন। নিজেদের সম্পর্কে তারা ভালো কিছু ভাবতে পারেন না। তাই তারা অন্যদের ছোট করে নিজেকে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করেন।
এক্ষেত্রে একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। ধরুন, আপনার বোন সবসময় এটা ভেবে চিন্তিত থাকে যে, তাকে দেখতে ভালো লাগছে কিনা বা তাকে নিয়ে সবাই কি ভাবছে।
তাই সে আপনার বাহ্যিক রূপ বা আপনি কেমন পোশাক পরেছেন বা স্কুলে আপনার মার্কস কেমন ইত্যাদি নিয়ে মন্তব্য করে আপনাকে ছোট করার চেষ্টা করে। কিন্তু আসলে সে নিজেকে সন্তুষ্ট করার জন্যই এমনটা করে থাকে।
২. ঈর্ষা
কাউকে অপমান করার ক্ষেত্রে ২য় কারণ হল ঈর্ষা। আপনার প্রতি ঈর্ষান্বিত ব্যক্তিরাই আপনাকে নিয়ে হাসি ঠাট্টা বা অপমান করে থাকে। কাউকে অপমান করার পেছনে ঈর্ষা খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি কারণ।
ঈর্ষান্বিত ব্যক্তিরা মনে করে তারা তাদের কাজের জন্য যথেষ্ট ক্রেডিট পাচ্ছেন না। তাই তারা সবসময় তাদের থেকে বেশি ক্রেডিট পাওয়া ব্যক্তিদের অপমান করার চেষ্টা করে থাকেন।
যেমন ধরুন, আপনার অফিসের বস আপনার সহকর্মীর থেকে আপনাকে বেশি পছন্দ করেন। ফলে আপনার সহকর্মী আপনার প্রতি ঈর্ষান্বিত হয়ে উঠতে পারেন।
ফলে তিনি আপনাকে ছোট করতে আপনার পোশাক বা কাজ নিয়ে বা আপনার তৈরি করা প্রেজেন্টেশন নিয়েও বিরূপ মন্তব্য করতে পারে।
৩. বুঝতে না পারা
একজন ব্যক্তির অক্ষমতা সম্পর্কে বুঝতে পারা সবার জন্য সহজ হয় না। ফলে অনেক সময় অপমানকারী না জেনেই ব্যক্তির অক্ষমতা নিয়ে মন্তব্য করে থাকে। তাই সে বুঝতে পারে না তার মন্তব্য ব্যক্তিটির উপর কেমন প্রভাব ফেলছে।
মনে করুন, স্কুলে একটি ছেলের কথা বলতে সমস্যা হয় বা সে তোতলামি সমস্যায় ভুগছে। আর তার সহপাঠিরা সমস্যাটি বুঝতে না পেরেই তাকে নিয়ে মজা করছে।
কিন্তু যদি তারা বুঝতে পারত ছেলেটির কথা বলতে সত্যিই সমস্যা হয়, তাহলে তারা আর ছেলেটিকে নিয়ে মজা করত না।
৪. মজা করা
শেষ কারণ হতে পারে, অন্যরা আপনাকে পছন্দ করে বলেই তারা আপনাকে নিয়ে মজা করে থাকে। অর্থাৎ কিছু মানুষ আছে যারা সত্যি আপনাকে খুব পছন্দ করেন এবং তারা মনে করে্ন যে আপনার সাথে যেকোনো বিষয় নিয়ে মজা করা যায়।
যেমন ধরুন, আপনার স্বাস্থ্য ভাল বলে আপনার কাজিন সবসময় আপনাকে মোটা বলে ডাকে। এক্ষেত্রে তার উদ্দেশ্য কিন্তু আপনাকে কষ্ট দেওয়া নয়। তার এধরনের মন্তব্যে আপনার খারাপ লাগলেও, আসলে তার উদ্দেশ্য হল কেবল মজা করা।
কেউ অপমান করলে কি করবেন
১. রাগ না করা
কেউ অপমান করলে সবচেয়ে দূর্বল প্রতিক্রিয়া হল রাগ দেখানো। এক্ষেত্রে রাগ করলে অপমানকারী ৩টি বিষয়ে নিশ্চিত হয়ে যায়-
১. আপনি অপমানকারীর মন্তব্য খুব গভীরভাবে মেনে নিয়েছেন,
২. তার কথায় সত্যতা আছে এবং
৩. আপনি অপমানকারীর মন্তব্যে হতাশ হয়ে পড়েছেন, কষ্ট পেয়েছেন।
ফলে অপমানকারী আবার আপনাকে অপমান করার জন্য উৎসাহ পায়। তাই কেউ অপমান করলে কখনোই রাগ করবেন না।
২. শান্ত থাকুন
যখন কেউ আপনাকে অপমান করে, তখন কোনো রেসপন্স না করাই সবচেয়ে ভালো পদ্ধতি। কারণ অপমানকারীর অপমান করার উদ্দেশ্যই হল আপনি যেন হতাশ হয়ে পড়েন বা রাগ করেন বা ভেঙ্গে পড়েন।
তাই সবসময় নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করুন। এমনকি যদি আপনার খুব রাগ হয় বা মন খারাপ হয়ে যায় তবুও কোনো রেসপন্স করবেন না। নাহলে অপমানকারীর অপমান করার উদ্দেশ্য সফল হয়ে যাবে এবং সে ভবিষ্যতে আবার আপনাকে অপমান করতে উৎসাহ পাবে।
তাই কোনো রেসপন্স করার আগে কয়েকবার গভীর নিঃশ্বাস নিন। মনকে শান্ত রাখুন। এতে অপমানকারীকে উচিত জবাব দেওয়ার জন্য নিজেকে যথেষ্ট শক্ত করতে পারবেন।
দৈনন্দিন জীবনের সমস্যাগুলো নিয়ে আপনি কি চিন্তিত? জেনে নিন মুক্তির উপায়
৩. উপেক্ষা করুন
কেউ অপমান করলে অপমানকারীকে উপেক্ষা করা আরেকটি কার্যকর উপায়। কারণ, অপমানকারীর উদ্দেশ্য হল আপনাকে তার কথায় প্রভাবিত করা।
কিন্তু আপনি যদি তার অপমানকে উপেক্ষা করেন, তাহলে সে বুঝতে পারবে, আপনি তার কথায় মোটেই প্রভাবিত হননি। ফলে অপমানকারী আবার আপনাকে অপমান করার উৎসাহ হারিয়ে ফেলবে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আপনি কিভাবে কারো অপমান করাকে উপেক্ষা করবেন? এক্ষেত্রে আপনি কথা বলার টপিক পরিবর্তন করতে পারেন বা সেখান থেকে চলে আসতে পারেন বা তাকে উপেক্ষা করে অন্য কারো সাথে কথা বলতে পারেন।
যেমন ধরুন, আপনি কাজে আছেন এবং আপনার সহকর্মী আপনার তৈরি করা প্রেজেন্টেশন নিয়ে মজা করছে । কিন্তু আপনি এটা উপেক্ষা করতে চাইছেন।
তাই তাকে উপেক্ষা করতে সেখান থেকে উঠে চলে যেতে পারেন বা অন্য কোনো প্রজেক্ট নিয়ে কথা বলা শুরু করতে পারেন যা আগের প্রজেক্টের সাথে সম্পর্কযুক্ত নয়।
আবার আপনি তার কথা একেবারেই শুনতে পাননি এমন ভান করে অন্য কিছু বলে সেই টপিকটি পরিবর্তন করে দিতে পারেন।
৪. আপনি যা অনুভব করেন তা প্রকাশ করুন
যে আপনাকে বারবার অপমান করছে তাকে পরিষ্কার করে বলুন, তার এরকম ব্যবহার আপনার উপর কেমন প্রভাব ফেলছে। দৃঢ় অথচ শান্ত কণ্ঠে বলুন এবং তাকে বোঝান কেন আপনি তাদের এমন ব্যবহার পছন্দ করছেন না।
উদাহরণস্বরূপ, যদি আপনার বন্ধু বারবার আপনাকে নিয়ে খারাপ মন্তব্য করে থাকে, তাহলে তাকে বলুন তারা যা করছে তাতে আপনি মোটেই খুশি নন। আর তার এই ব্যবহার আপনাদের সম্পর্কে খারাপ প্রভাব ফেলছে।
আবার আপনার সহকর্মী যদি বারবার আপনাকে অপমান করতে থাকে, তবে তাকে বলুন তার এই ব্যবহার আপনার কাজে ব্যাঘাত ঘটায়। আর সে যদি আবার এমন করে তবে আপনি কর্তৃপক্ষকে বিষয়টা জানাবেন।
৫. পরিস্থিতির জন্য তৈরি থাকুন
যদি প্রতিদিন আপনাকে এমন কারো সাথে সময় কাটাতে হয় যে বারবার আপনাকে অপমান করে, তবে এর পর থেকে তৈরি হয়ে আসুন।
আপনি কিভাবে পরিস্থিতি সামলাবেন তার একটি পরিকল্পনা করুন। ভাবুন এমন পরিস্থিতিতে আপনার প্রতিক্রিয়া কেমন হওয়া উচিত। এর ফলে আপনি সহজেই পরিস্থিতি সামাল দিতে পারবেন।
যেমন, আপনার কোনো বন্ধু হয়ত বারবার আপনাকে বলছে যে, আপনার চুল কাটিং তার একদম পছন্দ হয়নি। এবং আপনাকে আরো বাজে দেখাচ্ছে।
তখন আপনি তার কথায় সম্মতি জানিয়ে বলতে পারেন যে, হ্যা তুমি ঠিক ই বলেছো। কিন্তু এই কাটিং টা আমার পছন্দ। এবং আমার যেটা পছন্দ আমি সেটাই করব।
৬. হাস্যকৌতুক রস থেকে প্রতিক্রিয়া দিন
হাস্যরসের মাধ্যমে কারো অপমানের জবাব দেওয়া সম্ভবত সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি। তাই যখন কেউ আপনাকে নিয়ে মজা করে, আপনিও তার সাথে মজা করার চেষ্টা করুন।
আর এর মানে হল তার অপমান তার দিকেই ছুড়ে দেওয়া। কিন্তু অবশ্যই আপনাকে খুব নরম ও শান্তভাবে বলতে হবে যেন তাদের খারাপ না লাগে।
ব্যঙ্গকৌতুক একটি ভারি পরিস্থিতিকে সহজ করে তুলতে পারে। তাই কেউ আপনাকে অপমান করলে আপনিও সেটা নিয়ে মজা করার চেষ্টা করুন।
এখন নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, কেউ অপমান করলে আপনার কি করা উচিত এবং কি করা উচিত নয়। তাহলে এমন পরিস্থিতিতে আপনি কোন পদ্ধতিটি অবলম্বন করবেন? আপনার অভিজ্ঞতাটিও আমাদের সাথে শেয়ার করতে ভুলবেন না যেন।
Leave a Reply