বিশ্বের সবথেকে বেশি মানুষ আক্রান্ত যে রোগে
হার্ট এট্যাক শব্দটির সাথে কম বেশি সবাই পরিচিত হলেও, এ সম্পর্কে অনেকের ধারণাই স্পষ্ট নয়। একটা সময় মনে করা হত, কেবল বয়স্ক মানুষই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়। কিন্তু আজকাল প্রায় সব বয়সের মানুষ হৃদরোগ বা হার্ট এটাকে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে।
তাই প্রত্যেকের হার্ট এট্যাক বা হৃদরোগ সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা থাকা উচিত।
একজন ব্যক্তি যেকোনো সময় হার্ট এট্যাকে আক্রান্ত হতে পারে। হতে পারে সেটা ঘুমের সময় বা বিশ্রামের সময় বা হঠাত ভারী কাজ করার পর কিংবা ইমোশনাল স্ট্রেসের জন্য। তবে শতকরা ৬০ ভাগ মানুষই ঘুমের মধ্যে হার্ট এট্যাকে আক্রান্ত হন।
ধরুন, আপনার সামনে বসা মানুষটি বা আপনার খুব কাছের মানুষটি হঠাত হার্ট এট্যাক বা হৃদরোগে আক্রান্ত হল, তখন আপনি কি করবেন?
হার্ট এটাকের চিকিৎসা পুরোটা ডাক্তার এবং হাসপাতাল নির্ভর হলেও, প্রাথমিক চিকিৎসার মাধ্যমে এর ঝুঁকি অনেকটা কমানো সম্ভব। কিন্তু কেউ হার্ট এট্যাকে আক্রান্ত হলে দেখা যায়, জ্ঞানের স্বল্পতার কারণে পরিস্থিতি প্রায় নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় এবং মৃত্যুর ঝুঁকি বেড়ে যায়।
তাই হঠাৎ কেউ হার্ট এট্যাকে আক্রান্ত হলে কি ধরণের সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে তা নিয়েই আমাদের আজকের এই আয়োজন। আশা করি, এ ব্যাপারে আমরা সবাই সচেতন হব।
হার্ট এট্যাক বা হৃদরোগ
কোনো রোগের চিকিৎসা করতে হলে, সে রোগ সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞান থাকা প্রয়োজন। তাই প্রথমেই মনে প্রশ্ন জাগে, আসলে হার্ট এট্যাক বা হৃদরোগ কি?
হৃৎপিণ্ডের করোনারী আর্টারিতে কোলেস্টেরল জমে ব্লক সৃষ্টি হলে ধমনীর রক্ত প্রবাহে বাঁধা সৃষ্টি হয়। অর্থাৎ ধমনী প্রাচীর মোটা হয়ে সহজে রক্ত প্রবাহিত হতে পারে না এবং রক্ত জমাট বেঁধে যায়।
রক্ত জমাট বাঁধার কারণে করোনারি ধমনির লুমেন সম্পূর্ণ রূপে বন্ধ হয়ে যাওয়ায় হৃদপেশিতে পুষ্টি ও অক্সিজেন সমৃদ্ধ রক্তের সরবরাহও বন্ধ হয়ে যায়। ফলে হার্ট এটাকের মত মারাত্মক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। যার অপর নাম মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশন।
হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার কারণ
গবেষণায় দেখা গেছে, জেনেটিক বৈশিষ্ট্য হৃদরোগের ক্ষেত্রে একটি অন্যতম কারণ। তবে বেশিরভাগ মানুষ নিয়ন্ত্রণ যোগ্য কারণে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়। এসব কারণের মধ্যে রয়েছে- উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, ধূমপান, অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভাস, মানসিক চাপ, অতিরিক্ত ওজন ইত্যাদি। বর্তমানে মানুষের জীবনযাত্রার ধরণও হৃদরোগের অন্যতম বড় ঝুকিপূর্ণ কারণ।
হৃদরোগে লক্ষণ বা উপসর্গসমূহ
অন্যান্য রোগের মত হার্ট এট্যাক বা হৃদরোগেরও কিছু লক্ষণ বা উপসর্গ আছে।
১. ব্যক্তির বুকের ঠিক মাঝখানে অস্বস্তিকর চাপ অনুভূত হয়। আবার বুকে ব্যাথাও হয়, যা ১৫ মিনিট অবধি থাকতে পারে। ব্যাথা চলে যায় আবার ফিরে আসে।
২. বুকের এই ব্যাথা ক্রমেই শরীরের নানা অংশ যেমন এক বা উভয় বাহু, পিঠ, গলা, চোয়াল বা পাকস্থলির উপরের অংশে ছড়িয়ে পড়ে।
৩. পেটের উপরের দিকে তুলনামূলক লম্বা সময় ধরে ব্যাথা অনুভব হতে পারে।
৪. বমি বমি ভাব বা বমি হতে পারে।
৫. বুকে অস্বস্তির সময় ঘন ঘন শ্বাস-প্রশ্বাস ঘটে। ফলে শ্বাসকষ্টও হতে পারে।
৬. অস্বস্তিকর চাপ কিংবা বুকে ব্যাথার কারণে শরীরে প্রচুর পরিমাণে ঘাম হতে পারে।
তাছাড়া খাবার হজমেও সমস্যা হয়, ঘুমে ব্যাঘাত ঘটে এবং ব্যক্তি ক্লান্তিবোধ করে। আবার হার্ট এটাকে আক্রান্ত হলে, রোগী কখনো কখনো অজ্ঞানও হয়ে যেতে পারে।
মুক্তির উপায় কি
হার্ট এটাকে বুকে প্রচণ্ড ব্যাথা হয়। এই ব্যাথা ২০-৩০ মিনিট স্থায়ী হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই রোগী হাসপাতালে পৌছানোর আগেই মৃত্যুবরণ করে। তাই এটি একটি মেডিকেল ইমার্জেন্সি।
হার্ট এটাক হলে প্রথমে যে জিনিসটা মাথায় রাখতে হবে তা হল আতংকিত না হওয়া। রোগীকে মানসিকভাবে আশ্বস্ত করতে হবে এবং পর্যাপ্ত পরিমাণে আলো বাতাসের ব্যবস্থা করতে হবে।
হার্ট এট্যাক হয়েছে নিশ্চিত হলে রক্ত জমাট বাঁধা বন্ধ করতে এসপিরিন জাতীয় ওষুধ খাওয়াতে হবে। একই সাথে জিহবার নিচে নাইট্রোগ্লিসারিন স্প্রে বা একটি নাইট্রেট ট্যাবলেট দিতে হবে।
প্রয়োজনে বুকে পাম্প করে হৃৎপিণ্ডে রক্ত সঞ্চালন করতে হবে। এবং আক্রান্ত ব্যক্তিকে এক মুহুর্ত দেরি না করে দ্রুত হাসপাতালে নিতে হবে।
কিন্তু রোগী যদি একা থাকে তাহলে অন্য কারো সাহায্য ছাড়া বুকের ওপর পাম্প করে হৃৎপিণ্ডে রক্ত সঞ্চালন করা সম্ভব হয় না। বুকে ব্যাথা শুরু হওয়ার পর অজ্ঞান হয়ে যাবার আগ পর্যন্ত সাধারণত ১০ সেকেন্ড সময় থাকে।
এমন অবস্থায় আক্রান্ত ব্যক্তি জোরে জোরে উচ্চস্বরে কাশি দিলে হৃদপিন্ডে রক্ত চলাচল কিঞ্চিত বেড়ে যায়। এক্ষেত্রে লম্বা সময় নিয়ে দীর্ঘ কাশি দিতে হবে। ফলে ফুসফুসে স্পাটাম বা মিউকাস উৎপন্ন হবে।
লম্বা করে শ্বাস নেবার ফলে ফুস্ফুস পর্যাপ্ত অক্সিজেন পায়। আর কাশির জন্য হৃৎপিণ্ডের সংকোচন-প্রসারণ হবে, এতে আপনার হৃদপিন্ডের ভিতর দিয়ে রক্ত সঞ্চালন প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকবে।
এভাবে কয়েকবার কাশির ফলে উৎপন্ন সংকোচন প্রসারণে হৃদযন্ত্র স্বাভাবিক স্পন্দনে ফিরে আসবে। এরপর অন্য কোনো ব্যক্তির সাহায্যে আপনি হাসপাতালে পৌঁছাতে পারবেন।
প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ উত্তম
এখন প্রশ্ন হল, তাহলে হার্টের সমস্যা এড়াতে আপনাকে কি করতে হবে?
১. প্রচুর টাটকা ফল ও শাকসবজি খেতে হবে। চর্বি ও কোলেস্টেরল যুক্ত খাবার বাদ দিতে হবে।
২. সঠিক ওজন, রক্তে কোস্টেরলের মাত্রা ও রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে নিয়মিত ব্যায়াম করতে হবে। এক্ষেত্রে প্রতিদিন ৩০ মিনিট করে হাঁটতে পারেন।
৩. ধুমপান, মদ্যপান ইত্যাদি থেকে বিরত থাকতে হবে।
৪. কোলেস্টেরল, রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।
৫. মানসিক অবসাদ বা দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত থাকার চেষ্টা করতে হবে। নিয়মিত ব্লাড প্রেসার পরিমাপের মাধ্যমে রক্তচাপ নিয়ন্রণে রাখতে হবে।
সবশেষে, চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী নিয়মিত ওষুধ চালিয়ে যেতে হবে বা প্রয়োজনে বন্ধ করতে হবে।
তাই সুস্থ থাকতে বছরে অন্তত একবার, সম্ভব হলে দুইবার সমগ্র দেহ চেকআপের ব্যবস্থা করুন। এবং বডি মাস ইনডেক্স বা বিএমআই মেনে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী চলার চেষ্টা করুন।
Leave a Reply