জীবনীঃ আড়ালের নায়ক মেসুত ওজিল
বর্তমান বিশ্বের সেরা অ্যাটাকিং মিডফিল্ডারদের একজন তিনি। খেলার মাঠে কখনো তাকে দেখা যায় বাম কিংবা ডান প্রান্তের উইংগার হিসেবে, আবার কখনো সেন্ট্রাল অ্যাটাকিং মিডফিল্ডারের ভূমিকা পালন করতে।
অ্যাটাকিং মিডফিল্ড পজিশন কে তিনি নিয়ে গেছেন এক অনন্য উচ্চতায়। অনেকেই তার তুলনা করেন বিশ্বখ্যাত মিডফিল্ডার জিনেদিন জিদানের সাথে। ভালো খেলার পাশাপাশি ভাল আচরণেরও সংমিশ্রণ ঘটেছে তার চরিত্রে।
হ্যা, একদম ঠিক ধরেছেন। তিনি আর কেউ নন। তিনি হলেন ফুটবল জগতের অন্যতম একজন শৈল্পিক কারিগর, মেসুত ওজিল।
ফুটবল ভালোবাসেন, অথচ মেসুত ওজিলের খেলা দেখে বিমোহিত হননি, এমন ফুটবলপ্রেমী খুঁজে পাওয়া অসম্ভব।
মেসুত ওজিল একজন সুকৌশলী ও সুচিন্তিত অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার। মাঝ মাঠ থেকে আক্রমণভাগে থাকা তার সতীর্থদের তিনি এমনভাবে বল তুলে দেন যে, গোল করতে তাদের কোনো বেগ পেতে হয়না।
তাই ফুটবলপ্রেমীদের কাছে তিনি অ্যাসিস্ট কিং হিসেবেই অধিক পরিচিত। খুবই দ্রুতগামী, ক্রিয়েটিভ এবং টেকনিক্যাল এই প্লেয়ারের বলের উপর রয়েছে অসাধারণ নিয়ন্ত্রণ। রেঞ্জ পাসে নিখুঁত নিশানা, নিখুঁত ক্রসিং ও দুর্দান্ত ভিশন তাকে করে তুলেছে একজন পারফেক্ট প্লে মেকার।
ইতোমধ্যেই তিনি অ্যাসিস্ট সংখ্যায় ছাড়িয়ে গেছেন জিনেদিন জিদান, রোনালদিনহো ও বেকহামের মত মহান খেলোয়াড়দেরকেও।
অসাধারণ ব্যক্তিত্ব ও প্রতিভার অধিকারী মেসুত ওজিলকে নিয়ে আজকে আমরা জানার চেষ্টা করবো।
মেসুত ওজিলের পূর্ব জীবন
১৯৮৮ সালের ১৫ ই অক্টোবর। পশ্চিম জার্মানির একটি ছোট্ট শহর জেলসেনকির্সেনে জন্মগ্রহণ করেন এই ফুটবল তারকা।
তার জন্ম একটি মুসলিম পরিবারে। বাবা মোস্তফা ওজিল ও মা গুলজার ওজিলের চার সন্তানের মধ্যে সবার ছোট তিনি। পুরো নাম মেসুত মোস্তফা ওজিল। তিনি একজন ৩য় প্রজন্মের তুর্কী জার্মান।
মেসুত ওজিল বলেন- “আপনি তখনই ব্যর্থ হবেন, যখন আপনি কাউকে খুশি করার চেষ্টা করবেন”
ছোটবেলা থেকেই ফুটবলের প্রতি ছিল তার প্রবল আগ্রহ। তার থেকে বয়সে বড় ছেলেদের সাথে তিনি ফুটবল খেলার অনুশীলন করতেন। মেসুত ওজিলের ফুটবল ক্যারিয়ার শুরু হয় ১৯৯৫ সালে, মাত্র ৭ বছর বয়সে।
প্রথমদিকে তিনি জেলসেনকির্সেনের বিভিন্ন যুবক্লাবের হয়ে খেলায় অংশ নেন। তার খেলা দেখে ক্লাবের ফ্যানরা তার নাম দেয়, উইজার্ড ওজিল। যার বাংলা অর্থ জাদুকর ওজিল। এরপর তিনি ২০০০-০৫ সাল পর্যন্ত খেলেন রট উইস এসেনের হয়ে।
সিনিয়র ক্যারিয়ার
ওজিল তার সিনিয়র ক্যারিয়র শুরু করেন ২০০৫ সালে, জার্মান ক্লাব শালকা ০৪ এর যুবদলে যোগ দেওয়ার মাধ্যমে। তখন তার বয়স ১৮ বছর।
সেখানে তিনি খেলেন একজন মিডফিল্ডার হিসেবে। কিন্তু ক্লাব কর্তৃপক্ষের সাথে বনিবনা না হওয়ায় ২০০৮ সালে তিনি শালকে ছেড়ে যোগ দেন আরেক জার্মান ক্লাব ওয়েডার ব্রেমেনে।
এই সময় তিনি তার দলকে ২০০৯ ডিএফবি পোকাল জিততে ও উয়েফা কাপের ফাইনালে তুলতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন।
ফুটবলের জাদুকর রোনালদিনহো, শৈল্পিক ছন্দ ছিলো যার পায়ে | পড়তে ক্লিক করুন
২০০৮-০৯ সিজনে বুন্দেসলিগায় ব্রেমেন তেমন ভালো করতে না পারলেও, এই সিজনে তিনি ৩টি গোল করে এবং ১৫টি গোলে এসিস্ট করে তার অসামান্য প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেন।
নরওয়ের বিপক্ষে এক প্রীতি ম্যাচ খেলে, জার্মানির জাতীয় দলে ওজিলের অভিষেক হয় ২০০৯ সালে। তারপর আর ফিরে তাকাতে হয়নি অ্যাসিস্ট কিং ওজিলকে।
২০০৯ সালের উয়েফা ২১ চ্যাম্পিয়নশিপে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে তিনি ম্যান অফ দ্য ম্যাচ নির্বাচিত হন। এরপর ২০১০ ফিফা বিশ্বকাপে তার পারফর্মেন্সের মাধ্যমে তিনি আন্তর্জাতিক ফুটবল মহলের দৃষ্টিতে আসেন। ফলে ফিফা তাকে গোল্ডেন বল অ্যাওয়ার্ডের জন্য মনোনীত করে।
বিশ্বকাপে মেসুত ওজিল
বিশ্বকাপে তার অসাধারণ পারফরম্যান্সে মুগ্ধ হয়ে ইউরোপিয়ান জায়ান্ট রিয়াল মাদ্রিদ ১৫ ইউরোর বিনিময়ে তাকে দলে নিয়ে আসে। রিয়াল মাদ্রিদেও ওজিল তিনটি দুর্দান্ত সিজন পার করেন।
২০১১ সালে ইউরোপিয়ান এবং ডমেস্টিক কম্পিটিশন সব মিলিয়ে ওজিল মোট ২৫ টি গোল এসিস্ট করে এককভাবে ১ম স্থান লাভ করেন। তিনি ২০১২ উয়েফা ইউরোপিয়ান লীগে ৩টি গোলে সহায়তা করেন। যা ছিল টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ।
২০১৩ সালে ইংলিশ ফুটবল দল আর্সেনাল তাদের ক্লাব রেকর্ড ৪২.৫ মিলিয়ন ইউরোর মাধ্যমে ওজিলের সাথে চুক্তিবদ্ধ হন। ফলে তিনি জার্মানির সর্বকালের সবচেয়ে দামী খেলোয়াড়ে পরিণত হন। আর্সেনালের হয়েও দারুন খেলেন ওজিল।
তার খেলার নৈপুণ্য ও তাৎক্ষণিক চতুরতা দীর্ঘ ৯ বছর পর আর্সেনালকে ট্রফি জিততে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এরপর ২০১৪ ফিফা বিশ্বকাপে জার্মানির হয়ে বিশ্বকাপ জেতেন ওজিল। বিশ্বকাপে তিনি দুটি অ্যাসিস্ট ও একটি গোল করেন।
বর্তমানে জার্মান এই ফুটবলার প্রিমিয়ার লীগ ক্লাব আর্সেনাল এবং জার্মানি জাতীয় ফুটবল দলের হয়ে খেলে থাকেন। তার ক্যারিয়ারের ৩৩১ ম্যাচে তিনি গোল দিয়েছেন ৬০টি এবং এসিস্ট করেন ১৮৩টি।
আন্তর্জাতিক লেভেলে তিনি জার্মানি ন্যাশনাল টিমের হয়ে খেলেন ৮৬ টি ম্যাচ এবং গোল করেন ২২টি। এছাড়াও ২০১১ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত মোট ৫ বার জার্মান বর্ষসেরা ফুটবলারের খেতাব অর্জন করেন এই ফুটবল তারকা।
ব্যক্তি হিশেবে মেসুত ওজিল
ব্যক্তি হিসেবে মেসুত ওজিল বেশ সাদাসিধে। তার সহজসুলভ খেলার ধরণ এবং অন্য খেলোয়াড়কে গোলদানে সহায়তা করার ক্ষমতার জন্য তিনি যেমন জনপ্রিয়, তেমনি তার সুন্দর চেহারার পাশাপাশি ভুবনভুলানো হাসি আর উত্তম চরিত্রের জন্য ফুটবলপ্রেমীদের কাছে তিনি প্রিয়পাত্র।
এছাড়াও বিভিন্ন মানবিক কর্মকান্ডে রয়েছে তার অসামান্য অবদান। তাই ২০১০ সালে জার্মান সোসাইটি ওজিলকে শ্রেষ্ঠ মানবিক গুণাবলী সম্পন্ন ব্যক্তিত্বের জন্য বামবি অ্যাওয়ার্ড দেয়।
দরিদ্র পরিবার থেকে উঠে এসেও ওজিল তার পরিশ্রম, অধ্যবসায় এবং ভালো ব্যবহারের মাধ্যমে নিজেকে তুলে ধরেছেন বিশ্বের কাছে।
সর্বকালের সেরা অ্যাসিস্ট মেকার হওয়াও ২৯ বয়সী ওজিলের জন্য এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। ওজিল বলেন, আপনি যদি চান, তবে সকল প্রত্যাশা, চাপ, এমনকি গ্রাভিটিও জয় করতে পারবেন।
Leave a Reply