যান্ত্রিক এই জীবনে আমাদের শত শত চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হয়। আজ এই পরীক্ষা তো কাল অফিসের আরেক প্রেজেন্টেশন। সবকিছু মিলিয়ে উৎকণ্ঠা কাজ করতে থাকে। যাকে সহজ ভাষায় বলা হয় নার্ভাসনেস।
খানিকটা দুশ্চিন্তাগ্রস্থ থাকা অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু অতিরিক্ত নার্ভাসনেস বা দুশ্চিন্তা আমাদের শরীর আর মনের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। এতে অনেক সময় ব্যক্তির প্যানিক অ্যাটাকও হয়ে থাকে। যা ব্যক্তির স্বাভাবিক কর্মদক্ষতাকে নষ্ট করে দেয়।
যখন দুশ্চিন্তা এসে আমাদের গ্রাস করে, আমাদের চিন্তাভাবনা সেখানেই আটকে যায় এবং আমরা বুঝতে পারি না কিভাবে দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে। এই সময় আপনি হয়ত অনিচ্ছাকৃতভাবে এমন অনেক কিছু করে বসেন যা আপনার দুশ্চিন্তাকে আরো বাড়িয়ে তোলে।
যদি আমি কাজটি করতে না পারি? যদি আমার প্রেজেন্টেশন তাদের পছন্দ না হয়? পরীক্ষাটা যদি ভালো না হয়? বাসাটা না পেলে কি হবে?
এরকম হাজারো দুশ্চিন্তা আমাদের মনের ভেতর ঘুরপাক খায়। দুশ্চিন্তার ফলে আপনি নিজেকে ঠিকভাবে বিচার করতে পারেন না। একারণে আপনি আপনার নেগেটিভ চিন্তাভাবনাকেই সত্য বলে মেনে নেন।
সৌভাগ্যক্রমে, এমন কিছু টিপস এবং পদ্ধতি আছে যা দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত হতে বেশ কার্যকরী। দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি পেতে বিশেষজ্ঞদের শেয়ার করা কিছু স্বাস্থ্যকর উপায় আজ আপনাদের কাছে তুলে ধরব।
নার্ভাসনেস জয় করার সহজ উপায়
১. মেডিটেশন
মানসিক শান্তির জন্য মেডিটেশন কতটা উপকারী তা আমরা সবাই জানি। শুধু চোখ বন্ধ করে নিজের শ্বাস প্রশ্বাসে মনোনিবেশ করলেই মন শান্ত হয়ে যায়। তাই প্রচুর কাজের মধ্যেও একটু সময় বের করে নিয়ে ২মিনিটের জন্য হলেও মনোসংযোগ করুন। এর জন্য প্রয়োজন শুধু একটা শান্ত পরিবেশ ও উন্মুক্ত মন।
এছাড়া দুশ্চিন্তা কমাতে প্রতিদিন সকালে ইয়োগা করতে পারেন। এটি আপনার ভেতরকার মানসিক চাপ অনেকটাই কমিয়ে দেবে। গবেষণায় দেখা গেছে, যারা নিয়মিত ইয়োগা করেন তারা তুলনামূলক কম শারীরিক ও মানসিক সমস্যায় ভোগেন।
ড.হেফনার বলেন, ইয়োগা, ধ্যান ইত্যাদি শরীরে দুশ্চিন্তা সৃষ্টিকারী হরমোনের পরিমাণ কমিয়ে ফেলে। ধ্যানের সময় গভীর শ্বাস প্রশ্বাসের ব্যায়াম শরীরকে শিথিল করে। ধ্যান আত্মবিশ্বাস বাড়াতেও সাহায্য করে এবং মানসিক দুশ্চিন্তা দূর করে দেয়।
একজন সফল এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে যে পার্থক্যগুলো বিদ্যমান -পড়তে ক্লিক করুন
২. বর্তমানকে প্রাধান্য দিন
Freeing yourself from anxiety বই এর লেখক এবং মনোবিজ্ঞানী তমার চান্সকি বলেন, দুঃশ্চিন্তা সাধারণত ভবিষ্যৎ ভিত্তিক মনের অবস্থা। তাই ভবিষ্যতে কি হবে তা নিয়ে চিন্তা না করে, বর্তমানকে প্রাধান্য দিন।
নিজেকে জিজ্ঞাসা করুন-বর্তমান অবস্থা কি? আমি কি ঠিক আছি? কোন কাজটি আমার এখন করা দরকার? যদি তাতেও কাজ না হয়, পরবর্তীতে নিজের সাথে আবার আলোচনায় বসুন।
ভবিষ্যতে কি হতে পারে, কি হবে না তা ভেবে নিজের বর্তমান সময়কে নষ্ট করার কোনো মানে হয় না। তাই বর্তমান সময়ে আপনার যে কাজটি করা প্রয়োজন বা যা আপনি করতে চান তা দ্বিধায় না পড়ে করে ফেলুন।
৩. Nervousness কাটাতে সবসময় পজিটিভ চিন্তা করুন
দুশ্চিন্তাগ্রস্থ ব্যক্তিরা বেশিরভাগ সময় নেগেটিভ চিন্তাভাবনা করেন। দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য আগে ভাবুন, যে আপনার চিন্তাভাবনা গুলো কতটা বাস্তবধর্মী।
যেমন ধরুন, আপনাকে একটি বড় ধরনের প্রেজেন্টেশন তৈরী করতে হবে। আমি পারব না একথা না ভেবে নিজেকে কাজটির জন্য তৈরী করুন। নিজেকে অভয় দিন। মনে মনে ভাবুন, আমি কিছুটা দুশ্চিন্তাগ্রস্থ কিন্তু আমি তৈরী হয়েই এসেছি এবং আমি অবশ্যই পারব।
যেকোনো পরিস্থিতির জন্য আমি প্রস্তুত। আমি ই পারব- এই বাক্যটি কিন্তু আপনার ভীতি অনেকটাই কমিয়ে দিবে।
সবার মধ্যে শ্রেষ্ঠ হতে কে না চায়। কিন্তু এই ধরনের ইচ্ছাও মানসিক ভীতির দিকে এগিয়ে নিতে পারে। হ্যা আপনি ই পারবেন, কিন্তু মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকুন যেন কাঙ্খিত ফল না এলেও মেনে নিতে পারেন। কারণ কোনো পরাজয়ই স্থায়ী নয়।
যে ১১টি লাইফ লেসন আপনার জানা প্রয়োজন – জানতে ক্লিক করুন
৪. পছন্দের কাজগুলো করুন
হয়ত ছোটবেলায় গান শিখতেন বা ছবি আঁকতেন। বড় হওয়ার পর কাজের চাপে বা দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন ঝামেলার কারণে এগুলো আর করা হয়ে ওঠে না। দুশ্চিন্তা কাটাতে আপনার ভালো লাগার কাজগুলো করতে পারেন।
একসময় যা আপনার শখের কাজ ছিল সেগুলো আবার করা শুরু করে দিন। যেমন, ছোট একটা বাগান করে ফেলতে পারেন। সেখানে আপনার পছন্দের ফুল গাছগুলো লাগিয়ে ফেলুন। এতে করে প্রকৃতির সাথে সময় কাটালে আপনার দুশ্চিন্তা অনেকটাই কমে যাবে।
৫. বাস্তববাদী হন
জীবন মানেই সমস্যা থাকবে। এবং অনেক ঘটনাই ঘটতে পারে যা আপনার জীবনে কাম্য নয়। তাছাড়া সব সমস্যার ই কোনো না কোনো সমাধান রয়েছে এবং সময়ের সাথে সবকিছুই ঠিক হয়ে যায়।
ছোট ছোট ঘটনায় আবেগী না হয়ে নিজের আবেগকে নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করুন। এক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রিয় ফুটবল দলের পরাজয়ের সঙ্গে সঙ্গে হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার হারও বেড়ে যায়। তাই তুচ্ছ কারণে উত্তেজিত হবেন না।
বাস্তব পরিস্থিতিগুলো মেনে নিয়ে তার সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলার মনোভাব রাখতে হবে। বাস্তবধর্মী মনোভাব আপনাকে দুশ্চিন্তা থেকে দূরে রাখবে। এতে করে আপনি যেকোনো সমস্যার মুখোমুখি হতে পারবেন।
৬. ভালো খাবার খান এবং পর্যাপ্ত ঘুমান
শরীর ও মন সুস্থ রাখতে ভালো খাবার এবং ঘুমের বিকল্প নেই। ড.সিন্সর বলেন, সুষম খাদ্য গ্রহণের মাধ্যমে শরীর সারাদিন স্থিতিশীল থাকে। ফলে একেক সময় একেক রকম অনুভব হবে না এবং কখনো দ্বিধাদ্বন্দ্বেও ভুগবেন না।
তাই প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় লাল মাংস এবং প্রক্রিয়াজাত খাদ্য কম পরিমাণে এবং শাক সবজি, ফল মাছ ও শস্যদানা বেশি পরিমাণে রাখুন।
আবার কাজের চাপে অনেক সময় পর্যাপ্ত ঘুমানো হয়ে ওঠে না। কিন্তু সুস্থ থাকতে হলে ৬-৮ ঘণ্টা ঘুম আবশ্যক। ঘুম থেকে ভালো stress loser আর কিছু হতে পারে না। এক্ষেত্রে সময়ের চেয়ে কতটা নিশ্চিন্তে ঘুমানো গেল তা বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
৭. ডায়েরি লিখুন
আপনি হয়ত কখনোই ডায়েরি লেখেননি। যে বিষয়টি আপনাকে কষ্ট দিচ্ছে, আপনার মানসিক চাপের কারণ হচ্ছে সেটি একটি ডায়েরীতে লিখে ফেলুন।
পাশাপাশি আপনি কী চান বা কী করলে আপনার ভালো লাগত সেই বিষয়টিও লিখে ফেলুন। ডায়েরী লেখার এই অভ্যাসটি আপনার দুশ্চিন্তা কমাতে সাহায্য করবে।
৮. তালিকা তৈরি করুন
আপনি কি নিয়ে দুশ্চিন্তা করছেন তার একটি তালিকা তৈরি করে ফেলুন। দেখবেন, অল্প কয়েকটি লেখার পর আর কোনো কারণ খুজে পাচ্ছেন না। এরমধ্যে কিছু সমস্যা থাকবে যা কমবেশি সবারই থাকে।
বরং খেয়াল করে দেখবেন যে আপনার থেকেও আপনার আশেপাশের অনেক মানুষ আরো বড় বড় সমস্যায় ভুগছেন। তাই যা কিছু পেয়েছেন, যা রয়েছে তার মূল্য দিন। কৃতজ্ঞ থাকুন।
আর এত দুশিন্তা না করে সমস্যাগুলোর সমাধান খুঁজে বের করুন এবং অন্যদেরও সাহায্য করুন। এতে আপনি মানসিকভাবেও শান্তি পাবেন।
৯. মিষ্টি জাতীয় খাবার থেকে দূরে থাকুন
দুশ্চিন্তায় থাকাকালীন সময়ে আপনার হয়ত খুব মিষ্টি জাতীয় কিছু খেতে ইচ্ছা করবে, কিন্তু সেই সময় আপনি কোনো চকলেট খেলে তাতে আপনার ভালো না হয়ে ক্ষতি ই বেশি হবে।
এক গবেষণায় দেখা যায়, বেশি পরিমাণে মিষ্টি খেলে তা দুশ্চিন্তা আরো বাড়িয়ে তোলে। তাই মিষ্টি কিছু না খেয়ে এক গ্লাস পানি বা প্রোটিন জাতীয় কিছু খান।
এটা আপনার শরীরকে শক্তি যোগাবে দুঃশ্চিন্তা না করতে। এছাড়াও যতটা সম্ভব নিকোটিন, ক্যাফেইন এড়িয়ে চলুন।
১০. মনের কথা শেয়ার করুন
মনে দুশ্চিন্তাকে রেখে দিলে চলবে না। নতুবা এতে হিতে বিপরীত হতে পারে। কোনো বন্ধু বা পরিবারের কারো সাথে আপনি যা নিয়ে দুঃশ্চিন্তা করছেন তা শেয়ার করুন। এতে করে তারা আপনাকে কোনো সমাধান দিতে না পারলেও যথেষ্ট সাহস যোগাবে।
১১. মজার কিছু দেখুন
শেষের এই কৌশলটি সবচেয়ে সহজ। এসময় আপনার পছন্দের কমেডিয়ান এর অনুষ্ঠান বা মজার কোনো টিভি শো দেখুন। এমন মানুষের সঙ্গে সময় কাটান যারা আপনাকে হাসাতে পারে বা আপনার মন ভালো করে দিতে পারে।
একা থাকলেও মজার কোনো কথা বা ঘটনা মনে করার চেষ্টা করুন, এতে করে দুশ্চিন্তায় থাকলেও মন ভালো হয়ে যাবে।
২০০৫ সালে পরিচালিত গবেষণায় জানা গেছে, সবসময় গম্ভীর থাকার বদলে প্রাণ খুলে হাসলে শতকরা ২০ ভাগ বেশি ক্যালরি পোড়ানো যায়।
প্রাণখুলে হাসা দুঃশ্চিন্তাগ্রস্থ মনের জন্য সবচেয়ে ভালো একটি ওষুধ। আরেক গবেষণায় দেখা গেছে, আমাদের মানসিক স্বাস্থ্য এবং ভালো থাকার ক্ষেত্রে হাসির অনেক রকম উপকারিতা আছে।
নার্ভাসনেস দূর করার ক্ষেত্রে ব্যায়ামের থেকেও এটা আপনাকে অনেকটা সাহায্য করে। তাই ঠোটের কোণে সবসময় এক চিলতে হাসি রাখুন কিংবা মন খুলে হাসুন।
১২. নিজেকে সময় দিন
শত ব্যস্ততা থাকলেও নিজের জন্য সময় বের করে নিন। বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিন বা তাদের সাথে কোথাও ঘুরে আসুন। কেউ না গেলে সময় পেলে একাই বেড়িয়ে আসুন।
তাতে কাজের চাপ এবং ভীতি অনেকটাই কমে আসবে। মস্তিষ্ক নতুন উৎসাহে কাজ করা শুরু করবে। এতে আপনার মন ও ভালো হবে এবং আপনার মন দুশ্চিন্তামুক্ত হবে।
দিনশেষে নিজের সাথে বসতে পারেন। প্রতিদিন অন্তত ১০ মিনিট চোখ বন্ধ করে বসে থাকুন, এতে আপনার দুশ্চিন্তা অনেকটা কেটে যাবে।
কোনো বিষয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্থ না হয়ে উপরের টিপসগুলো অনুসরণ করুন। আশা করি এই টিপসগুলো আপনাকে দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি পেতে সাহায্য করবে। নার্ভাসনেস জয় করার কোন টিপসটি আপনার ভালো লেগেছে তা কমেন্টে আমাদের সাথে অবশ্যই শেয়ার করবেন।
নার্ভাসনেস জয় করার আরো উপায় জানতে নিচের ভিডিওটি দেখুন
Leave a Reply